দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের holocaust- এর পর সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে। ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় collaborators জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী দল সরকারী হিসেবে তিন মিলিয়ন নিরস্ত্র, নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে প্রায় কোয়ার্টার মিলিয়ন নারীকে। এ সময় এক কোটি মানুষ নিজেদের বাড়িঘর, সহায়সম্পদ ও মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে আশ্রয়গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। দেশের ভেতর displaced হয়েছিল আরও তিন কোটি মানুষ।
'৭১-এ এসব হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের জন্য যারা দায়ী আত্মপৰ সমর্থনে তাদের বক্তব্য হচ্ছে পাকিস্তানের অখ-তা ও ইসলাম রৰার জন্য তারা এসব করেছে। বাঙালী মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের তারা '৭১-এ আখ্যায়িত করত 'দুষ্কৃতকারী', 'ভারতের চর' ও 'ইসলামের শত্রু' হিসেবে। তারা দলীয় কর্মীদের ইসলাম ও পাকিস্তান রৰার জন্য গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে উদ্বুদ্ধ করত। একইভাবে তারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকেও প্ররোচিত এবং কখনও বাধ্য করেছে অধিকতর হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞে।
১৯৭১-এ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের অভু্যদয়ের পরপরই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ১৯৭৫-এ স্বাধীন বাঙালী জাতির জনক ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে এ বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেন। এরপর '৭১-এর শীর্ষস্থানীয় ঘাতক ও দালালদের সমন্বয়ে তিনি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যার বর্তমান নাম বিএনপি। এর তেত্রিশ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে নির্বাচনী প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী ২০১০-এর ২৬ মার্চ 'আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনাল' গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম শুরু করেছে।
স্বাধীনতা লাভের প্রায় ৪০ বছর পর '৭১-এর গণহত্যাকারী, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের প্রধান দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের প্রধান মিত্র বিএনপি মেনে নিতে পারেনি। জামায়াত জানে এ বিচার যদি যথাযথভাবে সম্পন্ন হয় বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব থাকবে না। তারা এ বিচার বাধাগ্রস্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য দেশে-বিদেশে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। যে আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ১৯৭৩-এ প্রণীত সেই আইনের বিরম্নদ্ধে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে এবং ৪০ বছর পর এ বিচারের যৌক্তিকতার বিরুদ্ধে কথা বলে সমগ্র বিচার প্রক্রিয়াকে তারা নস্যাত করতে চাইছে।
'৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার না করার জন্য কোন কোন দেশ বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে, বিশেষভাবে সেই সব দেশ যারা তখন এ গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে নীরব ছিল কিংবা প্রত্যৰ ও পরোৰভাবে সমর্থন করেছে। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ স্বাধীনতার পর থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার। এ বিচার এড়িয়ে যাওয়ার কোন পথ বর্তমান সরকারের সামনে খোলা নেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখন বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ নাগরিকের দাবি। এমনকি বিএনপিরও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে চান। দলনিরপেৰ নাগরিক সমাজের ধারাবাহিক আন্দোলনের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।
॥ দুই ॥
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম যে মিছিল রাজধানী ঢাকায় দেখা গিয়েছিল সেটি ছিল '৭১-এর গণহত্যাকারী ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে। ১৯৭২-এর ১৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্যরা সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে পস্ন্যাকার্ডসহ মিছিল করে বঙ্গভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মারকপত্র দিয়ে '৭১-এর গণহত্যার বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন। এ মিছিলের অধিকাংশ ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর ঘাতক বাহিনী আলবদরের হাতে নিহত বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের স্ত্রী, ভাইবোন ও স্বজনরা। এ মিছিল কোন রাজনৈতিক দল আয়োজন করেনি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ১৯৭২-এর ২৪ জানুয়ারি প্রণয়ন করেছিল The Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order, ১৯৭২, যা দালাল আইন (Collaborators act) নামে বেশি পরিচিত। দালাল আইন অনুযায়ী '৭১-এর গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার হচ্ছিল প্রচলিত সাক্ষ আইনে, যার দ্বারা এসব অপরাধের যথাযথ বিচার সম্ভব ছিল না। বিচারের সীমাবদ্ধতা লক্ষ করে সরকার ১৯৭৩-এর জুলাইয়ে প্রণয়ন করেছিল International Crimes (Tribunals) Act.) অপঃ. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান ও জাপানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য নু্যরেমবার্গ, টোকিও ও ম্যানিলায় স্থাপিত ট্রাইবু্যনালে যে বিশেষ নীতি ও আইন প্রণীত হয়েছিল তারই মডেলে '৭১-এর গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য International Crimes (Tribunals) Act) অপঃ ১৯৭৩ প্রণয়ন করা হয়েছিল।
১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পূর্ব পর্যন্ত সারাদেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, গৃহে অগি্নসংযোগ প্রভৃতি অপরাধের দায়ে প্রায় ১১ হাজার ব্যক্তির বিচার চলছিল, যাদের ভেতর ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ-ও দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক সরকারের প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম বন্ধ করে দেন এবং সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি প্রদান করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য উন্মুখ মুক্তিযুদ্ধের ভিকটিম ৩০ লাখ নিহতের পরিবারের দুর্ভাগ্যজনক সমাপ্তি এভাবেই ঘটেছিল।
১৯৭২-এর ৪ নবেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে সদ্যোজাত রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেৰতা। ধর্মনিরপেক্ষতার গ্যারান্টি ক্লজ হিসেবে এ সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কারণ '৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধসহ যাবতীয় নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছিল ইসলাম ও পাকিস্তানের অখ-তা রৰার দোহাই দিয়ে। জামায়াতে ইসলামীর প্রধান গোলাম আযম তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন_ পাকিসত্মান হচ্ছে আলস্নাহর ঘর। আলস্নাহর ঘরের হেফাজত করার জন্য ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রুদের বিরুদ্ধে জেহাদ করতে হবে। জামায়াতে ইসলামী ও সমচরিত্রের ধর্মভিত্তিক দলগুলো '৭১-এর গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধকে ইসলামের নামে বৈধতা দিতে চেয়েছে। জিয়াউর রহমান সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে মৌলবাদী যুদ্ধাপরাধীদের ধর্মের নামে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
দল গঠনের সুযোগ পাওয়ার পর বাংলাদেশে রাতারাতি ব্যাঙের ছাতার মতো কয়েক ডজন ইসলামপন্থী দলের অভ্যুত্থান ঘটে। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ৰমতায় গিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট সারাদেশে শতাধিক জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনের জন্ম দেয়। যাদের গ্রেনেড-বোমা হামলা ও হত্যার লৰ্য ছিল ধর্মনিরপেৰ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলসমূহের নেতাকর্মী, মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী এবং সংখ্যালঘু ধর্মীয় সমপ্রদায়। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ইবহ করবৎহধহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে অব্যাহতিকে দায়ী করেছেন আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আল কায়েদা, তালেবান ও সমচরিত্রের জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের অভু্যত্থানের জন্য। রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সময় মৌলবাদের সঙ্গে আপোস করেছে, কখনও অপেৰা করেছে, কিন্তু সচেতন নাগরিক সমাজ সব সময় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল।
॥ তিন ॥
'৭১-এর ঘাতক, দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এক অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন ১৯৯২-এর ১৯ জানুয়ারি, গঠন করেছিলেন 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।' গত ২০ বছর বহু ঝড়ঝঞ্ঝা ও ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে এ আন্দোলন এখন বিজয়ের দ্বারপ্রানত্মে উপনীত হয়েছে। ভিকটিমদের পরিবারের দীর্ঘ প্রতীক্ষা এবং নাগরিকদের অব্যাহত আন্দোলনের পর বিশেষ ট্রাইবু্যনালে '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম শুরম্ন হয়েছে।
'৯২-এর ১৯ জানুয়ারি নির্মূল কমিটি গঠনের তিন সপ্তাহ আগে মুক্তিযুদ্ধের আত্মস্বীকৃত প্রতিপক্ষ, গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সংবিধান লঙ্ঘন করে শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করেছিল। তখন এর তীব্র প্রতিবাদ করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ। মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ মিছিল বের করে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা গোলাম আযমের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে। '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিরম্নদ্ধে এ জনবিক্ষোভের ফলশ্রুতি_ 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমর্ূল কমিটি।'
দেশের ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিকের সমন্বয়ে গঠিত নির্মূল কমিটির ঘোষণায় বলা হয়েছিল_ 'আমরা নিম্ন স্বাক্ষরকারীবৃন্দ এই মর্মে ঘোষণা করছি, বেআইনীভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিসত্মানী নাগরিক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে যদি অবিলম্বে দেশ থেকে বহিষ্কার করা না হয় তা হলে আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ২১তম বার্ষিকীর দিন সোহরাওয়াদর্ী উদ্যানে বিশিষ্ট নাগরিক ও আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত প্রকাশ্য গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার হবে। যেহেতু গোলাম আযম অপরাধ করেছে এ দেশের সমগ্র জনগণের কাছে সেহেতু গণআদালতই হবে এ ঘৃণিত ব্যক্তির বিচারের উপযুক্ত স্থান।'
গোলাম আযমের বিচারের দাবি আরও স্পষ্ট করে ১০ ফেব্রুয়ারি '৯২ তারিখে প্রকাশিত নিমর্ূল কমিটির প্রথম ইশতেহারে বলা হয়_ 'গোলাম আযমের বিচার হওয়া দরকার_ (১) একাত্তরের নৃশংস গণহত্যাযজ্ঞের প্ররোচনাদানের জন্য (২) ঘাতক বাহিনীসমূহকে হত্যা, নারী নির্যাতন ও লুণ্ঠনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য (৩) স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখে দেশের যে শ্রেষ্ঠ সনত্মানরা যুদ্ধ করছিল তাদের 'জারজ সনত্মান' 'দুষ্কৃতকারী' আখ্যা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরম্নদ্ধে জনমত গঠনের প্রচেষ্টার জন্য (৪) বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার জন্য (৫) বাংলাদেশে বসে স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখার জন্য ...।'
নিমর্ূল কমিটির ঘোষণা ও ইশতেহার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল। দেশের সকল জনপদের সর্বস্তরের মানুষ নির্মূল কমিটির ঘোষণার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন। শুধু দেশের ভেতরে নয়, বাঙালী অধু্যষিত বিভিন্ন দেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গঠিত হয়েছে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।' যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াত-শিবিরচক্রের মৌলবাদী সামপ্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিতে লক্ষ লক্ষ গণস্বাক্ষর সংগৃহীত হয়েছে। জাহানারা ইমামের জনসভায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়েছে। '৯২-এর ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়াদর্ী উদ্যানে গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার প্রত্যক্ষ করার জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ ছুটে এসেছিলেন। খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার দূরপালস্নার বাস, ট্রেন, লঞ্চ বন্ধ করে রাসত্মায় বেরিকেড দিয়ে, ১৪৪ ধারা জারি করেও গণআদালত অভিমুখী প্রবল জনস্রোত রম্নদ্ধ করতে পারেনি। তবে ক্রোধ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য সরকার জাহানারা ইমামসহ গণআদালতের ২৪ উদ্যোক্তার বিরম্নদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেছিল।
গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের ধারণা নেয়া হয়েছিল ভিয়েতনামে আমেরিকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত 'ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার ক্রাইমস ট্রাইবু্যনাল অন ভিয়েতনাম' থেকে। এটি ছিল যুদ্ধাপরাধের বিরম্নদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিবেকবান মানুষের প্রতিবাদের অভিব্যক্তি। এ ট্রাইবু্যনালের কোন আইনী বৈধতা বা দ- কার্যকর করার ৰমতা ছিল না। ১৯৬৬ সালের ১৩ নবেম্বর লন্ডনে এ ট্রাইব্যুনালের প্রথম মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। ট্রাইবু্যনালের অনারারি প্রেসিডেন্ট ছিলেন ব্রিটিশ লেখক ও দার্শনিক লর্ড বাটর্্রান্ড রাসেল, নির্বাহী সভাপতি ছিলেন ফরাসী লেখক জাঁ পল সার্ত্র এবং অধিবেশনসমূহের সভাপতি ছিলেন রম্নশ আইনজ্ঞ ও ঐতিহাসিক ভস্নাদিমির দেদিজের। ট্রাইবু্যনালের সদস্য ছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৩ আইনজ্ঞ, লেখক, অধ্যাপক, বৈজ্ঞানিক, সাংবাদিক, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ। একইভাবে বিভিন্ন দেশের ৩১ বিশিষ্ট নাগরিক এ ট্রাইবু্যনালে সাৰ্য প্রদান করেছিলেন। বাট্রান্ড রাসেল ও জাঁ পল সার্ত্রের এ ট্রাইবু্যনাল বিভিন্ন দেশের নাগরিক সমাজকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছে।
(বাকি অংশ আগামীকাল)