জহির রায়হানের রহস্যময় অন্তর্ধান
কোহিনূর আক্তার সুচন্দা আজ চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে নিখোঁজ হন তিনি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৭ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন জহির রায়হান। তিনি জানতে পারেন, তার অগ্রজ কথাশিল্পী শহীদুল্লাহ কায়সার ১৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। ভাইকে খুঁজতে বের হন সম্ভাব্য সব জায়গায়। কারণ ওই সময় পাকিস্তানবাহিনী দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। তাদের কেউ আর ফিরে আসেননি। জহির রায়হানকে ঢাকার প্রায় সবখানে ও আশপাশের বিভিন্ন স্থানে খুঁজে ব্যর্থপ্রায়। ইতোমধ্যে দেড় মাস পেরিয়ে গেছে। এর মাঝে জাতীয় প্রেসক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গে অবস্থানরত এদেশের কতিপয় নেতার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তার ধারণকৃত ছবি সম্পর্কে বক্তব্য দেন। ধারণা করা হয়, ওই বক্তব্যই তার নিখোঁজ হওয়ার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। মিরপুরে কারফিউ জারি করে সার্চ পার্টি পাঠানো হয়। ওইদিন তাকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিরপুরে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তার স্ত্রী অভিনেত্রী সুচন্দা বলেন_ 'সকাল বেলা। উনি আমাদের বাসার নিচতলায় বসেছিলেন। হঠাৎ কয়েকজন লোক আসে। তাকে বলা হয়, শহীদুল্লাহ কায়কারসহ নিখোঁজদের অনেককেই মিরপুরে পাওয়া গেছে। তিনি নিচ থেকে দ্রুত দোতলায় ওঠেন। ওই সময় তাকে খুব অস্থির ও বিচলিত দেখাচ্ছিল। লোকগুলো তাকে এও বলেছিল_ মিরপুরে অপারেশন হবে। ভারতীয় আর্মিরা যাবে সেখানে। জহির এক টুকরা রুটি মুখে দিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। নিচে কয়েকজন আর্মি অফিসার ও তার চাচাতো ভাই
শাহরিয়ার কবীর অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ আবার উপরে উঠে টাকা চাইলেন। বললেন টাকা নেই, গাড়ির পেট্রোল কিনতে হবে। আমি টাকা দিলাম। উনি চলে গেলেন। আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে কেবল তার চলে যাওয়া দেখলাম। তখন ঘুণাক্ষরে বুঝতে পারিনি সে যাওয়াই হবে জহিরের শেষ যাত্রা।'
--- On Fri, 2/3/12, Desh Bondhu <desh_bondhu@ymail.com> wrote:
From: Desh Bondhu <desh_bondhu@ymail.com> Subject: [Bangladesh-Zindabad] জহির রায়হানের রহস্যময় অন্তর্ধান To: Date: Friday, February 3, 2012, 5:14 PM
জহির রায়হানের রহস্যময় অন্তর্ধান কোহিনূর আক্তার সুচন্দা আজ চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে নিখোঁজ হন তিনি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৭ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন জহির রায়হান। তিনি জানতে পারেন, তার অগ্রজ কথাশিল্পী শহীদুল্লাহ কায়সার ১৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। ভাইকে খুঁজতে বের হন সম্ভাব্য সব জায়গায়। কারণ ওই সময় পাকিস্তানবাহিনী দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। তাদের কেউ আর ফিরে আসেননি। জহির রায়হানকে ঢাকার প্রায় সবখানে ও আশপাশের বিভিন্ন স্থানে খুঁজে ব্যর্থপ্রায়। ইতোমধ্যে দেড় মাস পেরিয়ে গেছে। এর মাঝে জাতীয় প্রেসক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গে অবস্থানরত এদেশের কতিপয় নেতার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তার ধারণকৃত ছবি সম্পর্কে বক্তব্য দেন। ধারণা করা হয়, ওই বক্তব্যই তার নিখোঁজ হওয়ার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। মিরপুরে কারফিউ জারি করে সার্চ পার্টি পাঠানো হয়। ওইদিন তাকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিরপুরে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তার স্ত্রী অভিনেত্রী সুচন্দা বলেন_ 'সকাল বেলা। উনি আমাদের বাসার নিচতলায় বসেছিলেন। হঠাৎ কয়েকজন লোক আসে। তাকে বলা হয়, শহীদুল্লাহ কায়কারসহ নিখোঁজদের অনেককেই মিরপুরে পাওয়া গেছে। তিনি নিচ থেকে দ্রুত দোতলায় ওঠেন। ওই সময় তাকে খুব অস্থির ও বিচলিত দেখাচ্ছিল। লোকগুলো তাকে এও বলেছিল_ মিরপুরে অপারেশন হবে। ভারতীয় আর্মিরা যাবে সেখানে। জহির এক টুকরা রুটি মুখে দিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। নিচে কয়েকজন আর্মি অফিসার ও তার চাচাতো ভাই শাহরিয়ার কবীর অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ আবার উপরে উঠে টাকা চাইলেন। বললেন টাকা নেই, গাড়ির পেট্রোল কিনতে হবে। আমি টাকা দিলাম। উনি চলে গেলেন। আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে কেবল তার চলে যাওয়া দেখলাম। তখন ঘুণাক্ষরে বুঝতে পারিনি সে যাওয়াই হবে জহিরের শেষ যাত্রা।'
সুচন্দা আরও বলেন_ 'দুপুরে এফডিসি থেকে কে একজন ফোন দিলেন। জহির রায়হানকে চাইলেন। বললেন বোম্বে থেকে শিল্পীরা এসেছেন। আপনাদের এফডিসিতে আসতে হবে। আমি জহিরের কথা বললাম। উনি খুব জোর করছিলেন। শেষ পর্যন্ত আত্দীয়-স্বজনের অনুরোধে এফডিসিতে গেলাম। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখি সবাই নিশ্চুপ বসে আছে। ওদের দেখে আমার মনে অজানা ভীতি কাজ করছিল। জহিরের খবর জানতে চাইলাম। সবাই বলল উনি মিরপুর থানায় আছেন। থানায় ফোন দিলাম। ওপ্রান্ত থেকে কেউ একজন বলল, কিছুক্ষণ পরে ফোন করেন, তিনি এখন নেই। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দিলাম। তখন ফোন রিসিভ করলেন মেজর মঈন। তাকে জহিরের কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি মেজর মতিউরকে ফোন ধরিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, উনি ব্যস্ত, এখন দেওয়া যাবে না। আবার ফোন দিলাম। কে একজন জানালেন, মিরপুরে গোলাগুলি হয়েছে, জহিরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, আমরা ব্যস্ত, আর কিছু বলতে পারব না। নির্বাক হয়ে গেলাম। কাঁদতেও পারছিলাম না। জহিরকে সবাই চেনে। তাকে কেউ কিছু করবে না, হয়তো ব্যস্ত, ঠিকই ফিরে আসবে। ওর জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করি। ও ফেরত আসে না। আমি ভাবি, এই বুঝি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে জহির, এখনই ডাকবে। কিন্তু না, এভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল। আমরা ক্যান্টনমেন্ট গেলাম। মেজর মঈন ও মতিউরের সঙ্গে দেখা করলাম। তারা বললেন, ওইদিন মিরপুরে অপারেশন হয়েছে। কোথায় গেছেন তিনি, কি হয়েছে তার, কিছুই জানেন না তারা। কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলাম, কয়েক দিন পর মিরপুর থানায় গেলাম। ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য পুলিশের সাহায্য চাইলাম। পুলিশ দু'জন অবাঙালিকে ধরে আনল। তাদের বর্ণনামতে সেদিন বিহারীদের সঙ্গে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়েছিল সেখানে। তাতে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। পুলিশ তাদেরসহ আমাকে ঘটনাস্থলে নিয়ে গেল। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল ওইদিন। তাদের ভাষ্যমতে, কিছু কলাগাছের নিচে মাটি খোঁড়া হলো। বেরিয়ে এলো অসংখ্য মৃতদেহ। মৃতদের গায়ে কোনো কাপড় নেই। পচে বীভৎস হয়ে গেছে। কাউকে চেনার উপায় নেই। পুলিশ অন্য একটি কুয়ার কাছে নিয়ে গেল। ওই কুয়া মৃতদেহে ভর্তি ছিল। আমি ভয়ে অাঁতকে উঠলাম। কোথাও জহির রায়হানের সন্ধান পেলাম না। তারপর অনেক সময় পেরিয়ে গেল। নিশ্চিত হলাম জহির রায়হানকে হারিয়ে ফেলেছি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি সান্ত্বনা দিলেন।'
সুচন্দা আরও বলেন_ 'আমার থাকার কোনো জায়গা ছিল না। পরে শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে বনানীতে একটি বাসা পাই। কিন্তু '৭৫-পরবর্তী সরকার বাসাটি নিয়ে নেয়। সন্তানদের নিয়ে আবার রাস্তায় নামতে হয়। জহির রায়হান তো আমার জন্য কিছু রেখে যেতে পারেননি। অনেক কষ্টে দিনযাপন করেছি। কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি।' অনুলিখন : আলাউদ্দীন মাজিদ Desh-Bondhu, 'Desher Kotha Bolay'
|