ফিরোজ মান্না ॥ দুই সাবেক সেনাসদস্য লে. কর্নেল (অব) এহসান ইউসুফ ও মেজর (অব) একেএম জাকির হোসেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দীতে বলা হয়েছে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের নীলনক্সার পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। দেশে বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় বৈঠক হয়েছে। কে সরকার প্রধান হবেন, কারা সরকারে থাকবেন, সেনাবাহিনীতে কি ধরনের রদবদল হবে সব কিছুই বেরিয়ে এসেছে। বেসামরিক আদালতে জবানবন্দীর পর চাকরিতে থাকা জড়িত সেনা কর্মকর্তাদেরও জবানবন্দী নেয়া হবে। তবে তাদের কোন আদালতে জবানবন্দী নেয়া হবে এটা জানা যায়নি। সেনা সূত্র বলেছে চাকরিরতদের সামরিক আদালতে জবানবন্দী নেয়া হবে। এই সেনাসদস্যরা ঢাকা ক্যান্টমেন্টের লগ এরিয়াতে এখন সংযুক্ত রয়েছেন। সংযুক্ত সেনাসদস্যের সংখ্যা দুই ডজনেরও বেশি হবে বলে সেনা সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এদিকে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ব্যবসায়ী ইশরাক আহমেদ রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে নিতে চেয়েছিলেন। তাঁর সরকার কিভাবে পরিচালিত হবে সেই ছকও করা হয়েছিল। বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা, বেসামরিক বিশিষ্ট ব্যক্তির ও সুশীল সমাজের কিছু লোক নিয়ে তাঁর সরকার গঠন করার ছক লন্ডনে বসে করা হয়েছিল। গ্রেফতার হওয়া লে. কর্নেল (অব) এহসান ইউসুফ ও মেজর (অব) একেএম জাকির হোসেন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে এ কথা বলেছেন। গত ৯ জানুয়ারি এই দুই কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর হাকিম শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান ও কেশব রায় চৌধুরীর আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলেন, ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বেসামরিক আদালতে জবানবন্দী দিতে পারেন। তবে চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের বিচার সেনাআদালতেই হবে। বেসামরিক ব্যক্তিদের বিচার হবে বেসামরিক আদালতে।
আদালতে দেয়া এহসান ইউসুফের জবানবন্দী বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা যায়-ইশরাক আহমেদ এহসানের বড় ভাই লে. কর্নেল মেহবুবুরের বন্ধু। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁরা দুজনই একসঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। ইশরাক ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করেন। জিয়া হত্যাকাণ্ডের অভ্যুত্থানে ১৯৮১ সালে মেহবুব নিহত হন। ইশরাক তখন ডেনমার্কে চলে যান। ১৯৯০ সালের পর আবার ইশরাকের সঙ্গে এহসানের বছরে কয়েক বার কথা হতো। ১৯৯৭ সালে স্টাফ কলেজে পড়ার সময় খবর পান ইশরাক মহাখালী ডিওএইচএস এলাকায় বাসা নিয়েছেন। ২০০৯ সালে এহসান অবসরে যান। আবার ইশরাকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে উঠে। তখন ইশরাক সেনাবাহিনীর ভেতরে কি ঘটছে এমন খবর জানতে চান। এর কিছু দিন আগেই বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটে গেছে। সব ঘটনা শোনার পর ইশরাক বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে এহসানকে নিয়মিত যোগযোগ রাখতে বলেন। এরপর এহসান মেজর (অব) জাকির এবং লে. কর্নেল (অব) শামসের কাছে ইশরাককে নিয়ে যান। ২০১১ সালে ইশরাক তাঁর কাছে জানতে চান, মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে কি না। ২০১১ সালের ফেব্রæয়ারি মাসের দিকে ইশরাক তাঁকে একটি বই দিয়ে সেটি একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে দিতে বলেন। ওই ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে তাঁর আগে থেকে যোগাযোগ ছিল বলে জানান। ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোস্তাক আহম্মেদের সংগঠনের মাধ্যমে সেখানে একটি সেমিনার করা হবে। সেমিনারের মাধ্যমে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীতে যে ক্ষোভ এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যে ঘটনা ঘটতে পারে, সে বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্বকে জানানো হবে। তিনি বলতেন, ভবিষ্যতের জন্য চীন এ অঞ্চলের জন্য একটি ফ্যাক্টর। চীনা নেতাদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ আছে। মেজর জিয়াউল হক তখন প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটে (এমআইএসটি) পড়াশোনা করছিলেন। ইশরাক তাঁকে ধারণা দেন, মেজর জিয়া নেতৃত্ব দিতে পারবেন। তিনি মেজর জাকিরের কথাও বলেন।
জবানবন্দীতে ওই কর্মকর্তা বলেন, বৈঠকে মেজর জাকির বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক অভিযান চালাতে তাঁরা প্রায় রওনা হয়েছিলেন। ইশরাক ধারণা করেছিলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর কোন অভ্যুত্থান হলে সবাই মনে করবে, সেটা এ হত্যাকাণ্ডের কারণেই হয়েছে। তিনি একটি সামরিক পরিকল্পনাও দেখান।
এই পরিকল্পনায় বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে একটি ব্রিগেড ঢাকায় আসবে। তারা ঢাকা সেনানিবাস, বঙ্গভবন ও গণভবন ঘেরাও করবে। প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে নেবে। ৩৪ বেঙ্গল থেকে আসা সেনাসদস্য সদর দফতরে অবস্থান করবে। এরপর রাষ্ট্রপতি সরকার বাতিল করে ওই ব্রিগেডের প্রধানকে নতুন সেনাপ্রধান ঘোষণা করবেন। তখন সামরিক বাহিনীতে ব্যাপক রদবদল করা হবে। ২০১১ সালে প্যারেড না করে শীতকালীন মহড়ার আগেই সবকিছু করতে হবে। ইশরাকের অভ্যুত্থানের এই পরিকল্পনা হয় নিউইয়র্কে একজন ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে।
কার কী দায়িত্ব ॥ এহসান জবানবন্দীতে বলেন, এর দু-এক দিন পর ইশরাকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি আলোচনা প্রসঙ্গে কিছু জেনারেলের নাম উল্লেখ করে বলেন, এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নতুন সরকারে ইশরাকের অবস্থান কী হবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কী হবে? সংবিধানে বিসমিল্লাহ এবং আল্লাহর ওপর আস্থা পুনঃস্থাপন করা, নারী অধিকার নীতি রহিত করা, হিজাব-ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা, শরিয়াহ আইনের প্রবর্তন, জাকাত ফান্ড গঠন, সিনেমা ও টিভিতে অশ্লীলতা বন্ধ করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে শিক্ষামন্ত্রী নিয়োগ দেয়া, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি সর্বোচ্চ কমিটি করা ইত্যাদি নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়।
উল্লেখ্য, ১৯ জানুয়ারি সেনাসদরের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সেনাবাহিনীতে বিশৃক্সখলা সৃষ্টির চেষ্টার বিষয়টি গত ১৩ ডিসেম্বর কর্মকর্তারা জানতে পারেন। এরপর ১৫ ডিসেম্বর রাতে সেনানিবাসের পাশে মাটিকাটা এলাকার বাসভবন থেকে এহসান ইউসুফকে এবং ৩১ ডিসে¤^র ইন্দিরা রোডের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে জাকির হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়।
ওই ঘটনার অনুসন্ধানে ঢাকায় একটি এবং ঢাকার বাইরে পাঁচটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়।
সেনাসদরের সংবাদ সম্মেলনের ১০ দিন আগে এই দুই কর্মকর্তা বেসামরিক আদালতে ¯^ীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিতে চাইলে তাঁদের ঢাকা মহানগর আদালতে নেয়া হয়। সেখানে মহানগর হাকিম আদালত ওই দুই কর্মকর্তার জবানবন্দী ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় রেকর্ড করেছেন।