সাংবাদিক এবিএম মূসা সম্ভবত আমাদের সর্বোচ্চ বয়সী সাংবাদিক। তাঁর অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ সরস বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা ও লেখা জাতির জন্য প্রায়ই পথনির্দেশক হয়ে থাকে বলে অনেকে মনে করেন। তাঁর মতামত পক্ষে-বিপক্ষে যতই যাক না কেন, শ্রোতারা তা পুরোটাই শোনে। কোথাও তেমন প্রতিবাদ হয় না। প্রতিবাদ না হওয়াটার মানে এই নয় যে, মূসা ভাই যা বলেছেন তা সত্য এবং কেবলই সত্য। কিন্তু এ প্রতিবাদ না হবার একটা ক্ষতিকারক দিক আছে। কলামিস্ট এবং আলোচক এবিএম মূসা নিজেই ভেবে বসতে পারেন তিনি যা বলেছেন সেটা সত্য এবং একমাত্র সত্য। এমনও তো হতে পারে যে, ধীমান সাংবাদিকরা এ বয়সে মুরব্বির মনে কষ্ট দিতে চান না। তাঁর সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে না গেলে এ লেখকও মুরব্বির মুখের ওপর কথা না বলার প্রাচ্য-ঐতিহ্য অনুসরণ করতেন। তিনি যেন এ ভুলটা না করেন, তা সবিনয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই এ লেখা।
চ্যানেল আইতে সাংবাদিক মতিয়ুর রহমানের সঙ্গে পুলিশের গুলিতে নাগরিকের মৃত্যুর সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হতে না হতেই মূসা ভাই বলে বসলেন, এ সরকার রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান, আইনশৃক্সখলা রক্ষা, দুর্নীতি দমন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে ব্যর্থ একটি সরকার। এখন গুলি করে মানুষ মারায় এ সরকার সম্বন্ধে কোন কথা বলতেই তাঁর ইচ্ছা করে না। তাই বলে অনুষ্ঠানের বাকি সময়টা যে চুপ করেছিলেন, তা নয়।
এ সরকারকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলা মির্জা ফখরুল, জয়নাল ফারুকদেরই শোভা পায়। আওয়ামী লীগ যদি আল্লাহ আছে বলে, বিএনপি-জামায়াত আল্লাহ নেই বলবে, এমনটাই জনগণ বিশ্বাস করে। এখন তাদের সঙ্গে দেশের সর্বজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কণ্ঠ মেলালে জনগণ বিষম খাবে বৈকি। যে যে বিষয় নিয়ে জনগণ সরকারের ওপর অগ্নিশর্মা হয়, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবার তারা ঐগুলোতেই মহাখুশি। সাংবাদিক মূসা বলুন, অতীতের কোন সরকার হাসিনা সরকারের মতো শি¶া, কৃষি ও খাদ্যের মতো জরুরী বিষয়ে এত সাফল্য অর্জন করেছে? শহরে বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ করে সেচের জন্য যেদিন বিদ্যুত সরবরাহ করা হলো, সেদিনই মোসাহেবী পেতে অভ্যস্ত শহুরে গণমাধ্যম নেতাদের জানা উচিত ছিল, বঙ্গবন্ধুর শনাক্ত করা 'সাফকাপুইড়্যাদের' গলাবাজি শোনার সময় এ সরকারের নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থনের নিশ্চিত ভ‚মিতে পা রয়েছে এ সরকারের। তা নয়ত চল্লিশ বছর ধরে যা সম্ভব হয়নি একাত্তরের সে ঘৃণিত ঘাতকদের বিচার এখন কিভাবে সম্ভব হচ্ছে?
দুর্নীতি দমন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, ফটকাবাজির শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নিয়ে জনগণ বেশি দুশ্চিন্তায় ভোগে না। কারণ তারা জানে ক্রসফায়ার নামক বিনাবিচারে মানুষ মারার ফন্দি করেও এ দেশে অপরাধ দমন করা যায় না। যে দেশ দুর্নীতিতে পরপর তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়, হাসিনার এক সরকার আমলেই তার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র হবে, এমন হাস্যাস্পদ কথা জনগণ বিশ্বাস করে না। দুর্ভাগ্যবশত দুূর্নীতিতে জনগণেরই সায় রয়েছে- তাদের যুক্তি- আগের সরকারের নেতাকর্মীরা ভোগ করতে পারলে এরা কেন পারবে না? বস্তুত ধনবাদী শাসনব্যবস্থার বুনিয়াদই হচ্ছে চুরি- জোচ্চুরি, সংবিধানে 'সমাজতন্ত্র' থাকলেও আওয়ামী লীগ ঐ পথে হাঁটেনি। তার ওপর আরও কথা, টাকা-পয়সা খরচ করে যারা নির্বাচন করে, তাদের প্রথম লক্ষ্যই তো খরচটা উঠিয়ে পরবর্তী নির্বাচনের খরচ সংগ্রহ করা। আমাদের নির্বাচন প্রথাই তো দুর্নীতির ধারক ও বাহক। মাছ যেমন জলে বাস করে, বাংলাদেশের মানুষ তেমন দুর্নীতিতে বাস করে। শেয়ারবাজারের ওঠানামা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি দুর্নীতির একই সুরে বাঁধা দুটি গান। আসল কথা, বাংলাদেশের জনগণ দুর্নীতিবাজদের সমর্থন দেয় বলেই তো বাংলাদেশ আজও দুর্নীতিতে সমীহ জাগানো দেশ। তাই বগলের গন্ধের জন্য আওয়ামী লীগকে একা দোষ দিয়ে মূসা সাহেব ¯^াধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধীদের প্রচারাভিযানকেই জোরদার করার অপচেষ্টা করেছেন!
সাংবাদিক এবিএম মূসা কর্তৃক রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগের ব্যর্থতাকে দায়ী করাটা ছিল আমার জন্য সর্বাদিক বিস্ময়ের কারণ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা একজন নেতা, একটি বা দুটি রাজনৈতিক দলের জমিদারি ব্যবস্থাপনা নয়। এটি বিপুল সময় ধরে একটি জনগোষ্ঠীর অবিরাম সংগ্রামের ফসল। তবে এটা ঠিক, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই পার্লামেন্টকে সার্থক করতে পারত, বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়ন অনেকদূর এগিয়ে যেত। কিন্তু চারদলীয় জোটের পার্লামেন্ট বর্জনের কারণে তা অন্তত এবার আর হলো না। এ ব্যর্থতার জন্য আওয়ামী লীগকে দোষ দেয়ায় একটা জিনিস স্পষ্ট যে বরেণ্য, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বাংলাদেশের রাজনীতির সমুদ্রতলের জীবন্ত আগ্নেয়গিরিটির কথা বেমালুম ভুলে গেছেন। বিএনপির জন্ম, জামায়াতের পুনর্বাসন যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে কবর দেয়ার জন্যই হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের অগ্রিম বার্তায় তা ধরা দিলেও সাংবাদিক মূসা তা আমলে নিলেন না। না কি কবি আল মাহমুদের মতো তিনিও সমাজ ও ইতিহাস দেখার চশমা বদল করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে কেবল হত্যা নয়, সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, জেলখানায় বন্দী নিরস্ত্র দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতাদের হত্যা করা হয়েছে কেবলমাত্র আজকের এ ধর্মধাপ্পাবাজ পাকিস্তানী জারজদের প্রতিষ্ঠার জন্য। হত্যার মধ্য দিয়ে চালু রাজনৈতিক দলে জিঘাংসা থাকে, গণতন্ত্র থাকতে পারে না। জামায়াতে ইসলামীর কাছে পার্লামেন্ট ও গণতন্ত্র শরিয়তবিরোধী কিন্তু তারপরেও ওরা নির্বাচন করে। কারণ গণতন্ত্রের কাঁটা দিয়ে গণতন্ত্র ধ্বংসই তাদের উদ্দেশ্য। বিএনপি যদি গণতন্ত্র চাইত তাহলে তো পার্লামেন্টেই যোগ দিত। এখন তারা পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছে তারা গণভ্যুত্থান করে এ সরকার উৎখাত করবে। অর্থাৎ রক্তপাতই তাদের ল¶্য। জামায়াতে ইসলামীর জন্য আওয়ামী লীগের ধ্বংস ব্যতীত বিকল্প নেই। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি মানে তাদের বিলুপ্তি। তাই ইসলামী বিপ্লবের নামে তারা খুনোখুনি করবেই।
এবিএম মূসা কর্তৃক ঘোষিত ব্যর্থ আওয়ামী সরকার বাংলাদেশের গণমাধ্যমসমূহকে অবারিত ¯^াধীনতা দিয়ে রেখেছে। দায়িত্ববোধের লাগাম না থাকলে, ¯^াধীনতা উচ্ছৃক্সখল ¯ে^চ্ছাচারিতা হয়ে যায়। জনগণের সার্বভৌমত্ব, ইতিহাস-ঐতিহ্য, তার সংবিধান, তার আশা-আকাক্সক্ষা যেন সমুন্নত থাকে সেদিকে মিডিয়াসমূহের সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী