সংসদ রিপোর্টার ॥ সংঘাত-সংঘর্ষের সর্বনাশা রাজনীতি বাদ দিয়ে বিরোধী দলকে সংসদে আসার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা বলেছেন, অনির্বাচিত সরকারের এক মিনিটের জন্যও দেশ শাসন করার সুযোগ শেষ হয়ে গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে কোন উন্নত প্রস্তাব থাকলে সংসদে এসে দিন। প্রস্তাবটি সংবিধানসম্মত ও গণতান্ত্রিক হলে আমরা অবশ্যই গ্রহণ করব। সংসদে না এসে, রাজপথে কোন আল্টিমেটাম বা হুমকি ধামকি দিয়ে কোন লাভ হবে না।
মহাসমাবেশের নামে বিএনপি-জামায়াত জোটের ব্যয়কৃত বিপুল পরিমাণ অর্থের উৎস তদন্ত করে খুঁজে বের করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তাঁরা বলেন, এক শ' কোটি টাকা ব্যয় করেও বিএনপি-জামায়াত জোটের মহাসমাবেশ সুপার ফ্লপ করেছে। এই বিপুল পরিমাণ টাকার উৎস যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এই অর্থের যোগান দিয়েছে। এই মহাসমাবেশের নামে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে লাশ ফেলার ষড়যন্ত্র করেছিল, কিন্তু প্রশাসনের সতর্ক অবস্থানে তা পারেনি। খালেদা জিয়া সংসদে এসেছেন মাত্র ছয় দিন অথচ গত ৩৯ মাসে সংসদ থেকে বেতনভাতা নিয়েছেন সাড়ে ৫১ লাখ টাকা। আর মাত্র ৯ কার্যদিবস পর খালেদা জিয়াকে বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধা রক্ষায় সংসদে আসতেই হবে। গণতন্ত্রকে সুরক্ষায় নয়, সদস্যপদ রক্ষায় এখন বিরোধীদলীয় নেত্রীকে না ডাকলেও সংসদে আসবেন।
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ও রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবং আতিউর রহমান আতিক। এদিকে সংসদের শুরুতেই সংসদে অনুপস্থিতির কারণে বিরোধী দলের দেয়া ৭৬টি মুলতবি প্রস্তাব নাকচ করে দেন স্পীকার। আলোচনা শেষে সংসদ অধিবেশন আজ বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের 'চলো চলো ঢাকা চলো' কর্মসূচী চূড়ান্তভাবে ফ্লপ করেছে। জনগণ ঘৃণাভরে তাঁকে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে। মহান স্বাধীনতার মাসে মহাসমাবেশের নামে এ কর্মসূচী এক মহাতামাশায় পরিণত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট মহাসমাবেশে ৫০ লাখ লোকের জমায়েতের কথা বললেও বাস্তবে এক লাখ লোকও হয়নি। তাদের অভিসন্ধি ছিল বিপুলসংখ্যক লোককে জমায়েত করে দেশকে এক অরাজক অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা। কিন্তু জনগণ তাদের দুরভিসন্ধি নস্যাত করে দিয়েছে।
স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে মঙ্গলবার সংসদে আরও আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ও রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আতিউর রহমান আতিক,
সাজেদা চৌধুরী বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচনা করে আরও বলেন, খালেদা জিয়া পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের কাছ থেকে ৯১ সালের নির্বাচনে ৫ কোটি রুপী নিয়েছেন। পাকিস্তানের আদালতেই এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জাতি জানতে চায় তিনি (খালেদা) আইএসআইয়ের কাছ থেকে আরও কত টাকা নিয়েছেন? খালেদা জিয়া আইএসআইয়ের টাকার বিনিময়ে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার মিশনে নেমেছেন। তিনি বলেন, যে নেত্রী মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে টাকা নেন, তাঁর হাতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিরাপদ থাকতে পারে না।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। যতদিন পর্যন্ত একজন রাজাকার থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলবে। আমরা যদি সব রাজাকারদের শেষ করে যেতে না পারি তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়ের ওপর এই দায়িত্ব বর্তাবে। তারা আমাদের অসমাপ্ত কাজ রাজাকারমুক্ত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আর শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলবেই। রাজাকারদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাব না।
প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিরোধী দলের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী আমাদের ৯০ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছেন। কথায় কথায় তিনি পতনের ভয় দেখান, মনে হয় আমরা কারোর দয়ায় সরকারে এসেছি। ৯০ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছেন কীসের জন্য? ৯০ দিনের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভ-ুল করতে হবে, ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ফেরত দিতে হবে নাকি দুর্নীতিবাজ দুই পুত্রের বিচার বন্ধ করে মুক্তি দিতে হবে? যদি আল্টিমেটাম এই হয় যে সাম্প্রদায়িক-উগ্রবাদিতা, জঙ্গীবাদ, পঁচাত্তরউত্তর সংবিধান ফিরিয়ে আনা, তবে খালেদা জিয়ার সেই চ্যালেঞ্জ আমরা গ্রহণ করলাম। তরুণ প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এর জবাব দেব। তিনি বলেন, যতই হুমকি ধামকি দেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। ঘাতকদের বিচার পেতেই হবে। কোন আল্টিমেটাম দিয়ে লাভ হবে না।
তিনি বলেন, একবিন্দু রক্তপাত না ঘটিয়ে প্রশাসন যেভাবে বিএনপি-জামায়াত জোটের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত নস্যাত করে দিয়েছে তা অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারে। কারণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সারাদেশে তা-ব চালাতে চেয়েছিল। কিন্তু তা পারেনি। যদি এই কর্মসূচিকে ঘিরে ৫০টি লাশ পড়ত, তখন গণমাধ্যম সরকারকে তুলোধুনো করত। ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত বাদ দিয়ে সংসদে এসে আলোচনা করার জন্য খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী কোন অনির্বাচিত সরকার এক মিনিটের জন্য দেশ শাসন করতে পারবে না। তাই সংসদে আসুন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে আপনার কোন ভাল ফর্মুলা থাকলে দিন, খোলা বিতর্ক হবে। ভাল আইডিয়া থাকলে আমরা গ্রহণ করব। তবে অবশ্যই প্রস্তাবটি সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক হতে হবে। আমরা সবার অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। সংঘাত নয়, সমঝোতা চাই। সংঘাত-সাংঘর্ষিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। কারণ সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
শেখ ফজলুল করিম সেলিম তাঁর বক্তব্যে নয়াপল্টনের মহাসমাবেশে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার বক্তব্যে মতলববাজি আর ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নেই। খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগকে আন্দোলনের ভয় দেখায়। আওয়ামী লীগ আন্দোলনে ভয় পায় না। তাই আওয়ামী লীগকে চোখ রাঙিয়ে লাভ হবে না। বিরোধী দলের মহাসমাবেশে খরচের বিষয়টি তদন্তের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, মিটিংয়ে কম করে হলেও এক শ' কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এত টাকা আসে কোত্থেকে? এই টাকা আইএসআইয়ের থেকে আনা হয়েছে কী না তদন্ত করে দেখা হোক।
সুশীল সমাজের সমালোচনা করে তিনি বলেন, কিছু মতলববাজি বুদ্ধিজীবী আছেন, তাঁদের অবস্থান হলো সব সময়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিছু না কিছু বলতে হবে। তিনি বলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ সদস্যপদ চলে যেতে আর মাত্র ৯ দিন বাকি রয়েছে। এই নয় দিনের মধ্যে উনি (খালেদা) অবশ্যই সংসদে আসবেন। কাউকে ডাকতে হবে না, উনি (খালেদা) টাকার লোভ সামলাতে পারবেন না, সংসদে আসবেনই।