গাড়ি চলে না, চলে না ...
শিরোনামে যদিও গাড়ি চলে না লিখেছি, কিন্তু লেখা দরকার গাড়িকে চলতে দেয়া হচ্ছে না। গাড়িটা গণতন্ত্রের। উদ্দেশ্যমূলক যানজট সৃষ্টি করে গাড়ির স্বাভাবিক চলায় বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। যারা বাধা সৃষ্টি করছে তারা পারলে বোমা মেরে গাড়িটা উড়িয়েও দিতে চায়। গণতন্ত্রের ব্যানারে ঢাকা গাড়িটা তাদের দুই চোখের বিষ।
গাড়িটার প্রতিটি কম্পার্টমেন্ট অনেক অর্জনের সুফল। শিক্ষা, কৃষি, খাদ্য, তথ্য, সংস্কৃতি, যোগাযোগ, পররাষ্ট্র, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, খেলাধুলাসহ গত সোয়া তিন বছরের অনেক সাফল্যের দলিল রয়েছে এই গাড়ির কম্পার্টমেন্টগুলোতে। তাছাড়া রয়েছে জাতির কাক্সিক্ষত বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার প্রক্রিয়া, বিগত আমলে সৃষ্ট জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী রাজনীতির বিষদাঁত ভেঙ্গে দেয়ার মতো বিরাট সাফল্য। অনেকেরই ধারণা ছিল যে, এই কঠিন কাজগুলো করার সাহস বোধ হয় কারও নেই। অসাম্প্রদায়িকতা, সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা ও প্রাপ্য সম্মান, অন্যান্য জাতিসত্তার স্বাভাবিক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধান ইত্যাদি নিশ্চিত করার একটা সুদৃশ্য চিত্রও রয়েছে গণতন্ত্রের ব্যানার লেখা গাড়ির কম্পার্টমেন্টে। আধুনিক ও উপযোগী নারীনীতি প্রণয়নের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং শিশুদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে গৃহীত কার্যক্রমের সাফল্য এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনাও রয়েছে একটি কম্পার্টমেন্টে। সব মিলিয়ে বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয় যে, গণতন্ত্রের সুদৃশ্য গাড়িটার সর্বাঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের ছায়া। গাড়ির প্রধান চালক যিনি। তিনি এবং তাঁর দল যে কোন মূল্যে গাড়িটিকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। বিগত অনেক বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র শরীর থেকে খাবলাখাবলিভাবে মাংস তুলে নেয়ার চেষ্টা হয়েছে। গাড়ির প্রধান চালকের লক্ষ্য ক্ষত সারিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সুস্থ, সবল, সুন্দর অবয়ব পুনর্নির্মাণ করা। সে কারণেই তিনি গত সোয়া তিন বছরের সোনালি ফসল একটু একটু করে ভারছেন প্রতিটি কম্পার্টমেন্টে। তবে পদে পদে তাঁকে বাধা দেয়া হচ্ছে। বাধা দিচ্ছে তারা, যারা সারাদেশ ও মানুষের কল্যাণ চায় না। মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলেই যাদের গাত্রদাহ হয়। মুক্তিযুদ্ধের ছায়াঢাকা পথে চলছে যে গণতন্ত্রের গাড়ি, সেই গাড়ির পথরোধ করতে তারা তাই ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠেছে। গাড়ির যাত্রাপথে সৃষ্টি করা হচ্ছে নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা। যাত্রার শুরুতেই ঘটানো হলো পিলখানার বিডিআর ক্যাম্পে পৈশাচিক ও বর্বর হত্যাযজ্ঞ। বিশ্ব ইতিহাসে এমন নৃশংসতার নজির আছে কিনা কে জানে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর ভেতর মিথ্যা ও বানোয়াট অপপ্রচার চালিয়ে উস্কানি দিয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালানো ছিল যাত্রাপথের আরেক বাধা। শেয়ারবাজার, বিদ্যুত, গ্যাস, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাবোটেজের মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি করেও বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে গণতন্ত্র-গাড়ির যাত্রা।
স্বার্থান্বেষী সুশীল সমাজও বক্তৃতা-বিবৃতি-আলোচনা-টকশো-কলাম ইত্যাদির মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য ও তত্ত্বকথা বলে সৃষ্টি করছে প্রতিবন্ধকতা। দেশ ও বিদেশের গণমাধ্যমে যা বলা এবং দেখানো হয় তাতেও রয়েছে মিথ্যাচারের গরম লাভা। এবং এসবের পেছনে ঢালা হচ্ছে বিপুল অর্থসম্পদ। দেশের ভেতর কিছুটা রাখঢাক থাকলেও বিদেশের গণমাধ্যমগুলোতে চলছে ঢালাও মিথ্যাচার এবং তা যে পরিকল্পিতভাবে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। দৈনিক জনকণ্ঠের ২৭ এপ্রিল সংখ্যার প্রথম পাতায় এ বিষয়ে একটি খবর গুরুত্বসহকারে ছাপাও হয়েছে। বিদেশী অখ্যাত কিছু ওয়েব পত্রিকা ও পোর্টালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে ছাপা হয়েছে মিথ্যা ও বানোয়াট কিছু তথ্য এবং এসব ঢাকার কিছু পত্রিকা পুনমুর্দ্রণ করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তথ্যসূত্রের কোন বিশ্বাসযোগ্যতা নেই এবং যাদের নাম নিয়ে রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে তারাও নাকি ভুয়া। বাস্তবে নাকি অস্তিত্বই নেই। এর আগে কুখ্যাত গোলাম আযম এবং নিজামীর পুত্রদ্বয়ের বিদেশী টেলিভিশনে প্রদত্ত বক্তব্যে মিথ্যাচার ও বিভ্রান্তিকর তথ্য সম্পর্কে লেখা হয়েছে। লেখা হয়েছে আলজাজিরার নিকোলাস হকসহ আরও ক'জন বিদেশী সাংবাদিকের রহস্যজনক আগমন ও আচরণ নিয়ে। সবকিছু মিলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, যুক্তিযুদ্ধের লাইনে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের ফসলবাহী যে গাড়িটিকে ভবিষ্যতের সুবর্ণবন্দরে নিয়ে যেতে চান, সেই গাড়িটিকে যে কোন উপায়ে লাইনচ্যুত করাটাই বিরুদ্ধচারীদের প্রধান লক্ষ্য।
আর সেজন্য তারা আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। যে কোন অপচেষ্টায় তারা মুক্তিযুদ্ধের লাইনকে উপড়ে ফেলে সোয়া তিন বছরের সকল অর্জন এবং ভবিষ্যতের সুপরিকল্পনাবাহী গাড়িকে ধ্বংস করতে চায়। প্রয়োজনে তারা ধ্বংসাত্মক কাজ চালাতেও যে দ্বিধা করবে না তার আলামত ইতোমধ্যে প্রদর্শন করেছে। ডিসেম্বরের আঠারো তারিখে কাকডাকা সকালে পুলিশ ও সাধারণ মানুষের ওপর তারা পরিকল্পিত সশস্ত্র আক্রমণ এরই ইঙ্গিত দেয়। সেদিন বাস পুড়িয়ে নিরীহ মানুষ হত্যার ঘটনাও ঘটেছে রাজধানীর ঢাকার বাইরের এক শহরে। এরপর একে একে ঘটেছে একাধিক ঘটনা যা দেশ ও মানুষের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। রোডমার্চ এবং ঢাকা চলো কর্মসূচীর নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চালানো হয়েছে সহিংসতা। জনমনে ভীতি সঞ্চার করে সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে তারা যে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের রক্ষা করার বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে এটা এখন পাগলেও বোঝে।
সম্প্রতি ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন এক রাফ এবং টাফ গেম যেখানে একের পর এক ফাউলের ছড়াছড়ি। যেনতেন নয়। রীতিমতো রেডকার্ড খাওয়ার উপযোগী ফাউল। আদালতের আশ্বাস এবং বেঁধে দেয়া দিনকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে গত সপ্তাহে পরপর তিনদিনের হরতালে সাধারণ মানুষ যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে। স্বাভাবিক জনজীবন হয়েছে বিপর্যস্ত। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের অর্থনীতি। এইচএসসি পরীক্ষাসহ বিঘিœত হয়েছে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম। পুড়িয়ে মারা হয়েছে অসহায় ঘুমন্ত বাসচালককে। পিকেটারদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে দুর্ঘটনায় জীবন দিয়েছে নিরীহ গাড়িচালক। গুলিতেও মারা গেছেন ক'জন সাধারণ আদমসন্তান। বক্ষমান লেখাটি লিখবার সময় শুনছি রবি ও সোমবার হরতাল সহ আরও কঠোর আন্দোলনের হুমকি। সাধারণ মানুষকে বিপদগ্রস্ত করে সেই কঠোর আন্দোলনের চেহারাটা যে কি ধরনের হবে তা ভাবলে নানা রকম আশঙ্কা জাগে বৈকি!
গণতন্ত্রের ব্যানার আঁটা গাড়িটার একটি কম্পার্টমেন্টে রয়েছে আন্তর্জাতিক মামলায় সমুদ্রসীমানা জয়ের অবিস্মরণীয় সাফল্যগাথা। একাত্তরের পর এত বড় অর্জন নিয়ে বিরোধীদের কোনরকম উচ্চবাচ্য নেই। বরং তাদের বক্তব্য-বিবৃতি-কথাবার্তায় বালখিল্যের সুর। এটা দুঃখজনক। এই কম্পার্টমেন্টে আরও রয়েছে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় দেশের প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ ও উদ্যোগ, উন্নয়নশীল বিশ্বের পরিবেশ রক্ষায় তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে বিবেচনা করার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবনা ইত্যাদির মতো কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় যা বাংলাদেশকে বসাবে বিশ্বসভায় সম্মানজনক আসনে।
সুতরাং দেশ ও জাতির জন্য এতসব ইতিবাচক শুভবার্তাকে অবজ্ঞা করে যারা কেবল উল্টো পায়ে হাঁটতে চায় তারা বাংলাদেশ ও মানুষের কল্যাণ চায় না। শুধু শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের বিরোধিতা করাই যদি বিরোধীদের একমাত্র রাজনীতি হয়, তবে সেটা তাদের নিজেদের জন্য চরম অমঙ্গল বয়ে আনবে। মুক্তিযুদ্ধের পথকে ধ্বংস করে চলমান গাড়িকে বাধাগ্রস্ত করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
লেখাটা শেষ করতে গিয়ে ভাবছি শিরোনাম পাল্টে দেব কি না! গাড়ি চলেনার পরিবর্তে বরং লেখা হোক শত বাধা উপেক্ষা করে গণতন্ত্রের গাড়ি চলছে, চলবে এবং চলবেই।
লেখক : কলামিস্ট ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব