সোনার বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবী বিশিস্ট বাল বিশেষজ্ঞ গাজিআবাল ওরফে আবালগাজি কে আহবায়ক করে 'সোনার বাংলাদেশ মেধাবী ফোরাম' নামে একটি সংগঠন গঠনের প্রস্তাব করছি!
অদম্য মেধাবীদের কাছে প্রত্যাশা
সৈয়দ আবুল মকসুদ
Published: 2012-08-23
মধ্যশ্রেণী একটি জাতির মেরুদণ্ড। অন্যান্য পেশাজীবী শ্রেণী জাতির হাত-পা প্রভৃতি। যেমন কৃষকসমাজ একটি জাতির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। সমাজের যাবতীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় মধ্যশ্রেণীর দ্বারা। রাষ্ট্র পরিচালনা ও প্রশাসনে তারাই প্রধান। শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তারাই সব। সমাজের যত বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাপার রয়েছে, সেগুলোতে মধ্যশ্রেণীর ভূমিকাই মুখ্য। জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্নকে বাস্তবায়নের কাজটি মধ্যশ্রেণীই করে থাকে। মধ্যবিত্ত হলো সমাজের নেতৃত্বদানকারী শ্রেণী।
অর্থনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় মধ্যবিত্তেরও তিনটি শ্রেণী: নিম্নমধ্যবিত্ত, মাঝারি মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত। অভিজাত-ধনিক শ্রেণী আরেকটি গোত্র। রাষ্ট্রে ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরও বিরাট ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের শিরদাঁড়াটি হলো মধ্যশ্রেণী। কৃষক, শ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমজীবী ও পেশাজীবী শ্রেণী থেকেই কেউ কেউ শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করে চাকরিবাকরি বা ছোটখাটো স্বাধীন ব্যবসা করে মধ্যবিত্তে উন্নীত হয়।
শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসারিত হলে মধ্যশ্রেণীর আকার ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। উনিশ ও কুড়ি শতকের প্রথম দিকে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল আকারে ছোট। তবে মেধায় ও অর্থনৈতিকভাবে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ ছিল খুবই শক্ত ও সৃষ্টিশীল। তারা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বহু দূর। আজ বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ আকারে বিরাট, কিন্তু তাদের মেধা, দক্ষতা ও নৈতিক জোরটা উনিশ শতকের হিন্দু মধ্যবিত্তের মতো নয়।
কোনো সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি যদি সত্, দক্ষ ও শক্ত না হয়, সে সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না। যে সমাজের মধ্যশ্রেণী নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে দুর্বল, সে সমাজ পেছনে পড়ে থাকে। তার অধঃপতন অনিবার্য।
মেধা জিনিসটি টাকার মতো। ওটাকে না খাটালে বাড়ে না। জন্মগত মেধা শুধু থাকলেই হবে না, তাকে অনুশীলনের মাধ্যমে বাড়াতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুশীলনের একটি ক্ষেত্র। প্রতিবছর আমাদের লাখ লাখ ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে ভালো ফলাফল করে বেরিয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকছে। সেখান থেকে তারা উত্তীর্ণ হয়ে ঢুকছে কর্মজীবনে। বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হচ্ছে। তারা আসে বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। কৃষক পরিবার থেকেও, শ্রমিক পরিবার থেকেও। পুরোনো মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে তো বটেই। এভাবে মধ্যশ্রেণীতে নতুন মানুষ যোগ হওয়ায় তার আকার স্ফীত হতে থাকে।
১৮৮১ সাল পর্যন্ত গোটা ভারতবর্ষে—বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারত ও পাকিস্তান—মাত্র তিনটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৮২-তে আরেকটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে—পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়। এখন যে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড রয়েছে, তখন তা ছিল না। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই গ্রহণ করত।
ব্রিটিশ শিক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে ১৮৮৩ পর্যন্ত গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ৫০ বছরের বেশি সময়ে বিএ এবং এমএ পাস মানুষ ছিলেন ২৫ হাজারের কাছাকাছি। ভারতবর্ষে তখন জনসংখ্যা ছিল ২৫ কোটি। (রিপোর্ট অব দি ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটিজ কমিশন, ১৯০২)। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শুধু নয়, স্কুলের মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাও অতি উঁচু মানসম্মত হওয়ায়, ম্যাট্রিক-ইন্টারমিডিয়েট পাস মানুষগুলোও ছিলেন খুবই সুশিক্ষিত, 'দিস ম্যান অয়্যার সার্টেনলি ভেরি এডুকেটেড' এই মানুষদেরই একটি ছোট অংশ স্বাধীনতাসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর অতি অল্পসংখ্যক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এই উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান। আজ এই উপমহাদেশের যা কিছু বড় অর্জন, তা সেই ব্রিটিশ যুগে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাস করা মানুষদেরই অবদান।
বাংলাদেশের মতো একটি মাঝারি আকারের রাষ্ট্রকে ছিমছাম করে গড়ে তুলতে কত শিক্ষিত মধ্যবিত্তের দরকার? খুব বেশি করে যদি ধরি, প্রতিটি জেলায় ২৫ হাজার নিবেদিত, কর্মঠ ও দক্ষ মানুষ যদি সমাজ গঠনে নিয়োজিত থাকেন, তাহলে তো বহু কিছু করা সম্ভব। তার বাইরে উচ্চশিক্ষাবঞ্চিত কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ তো তাঁদের কাজ করেই যাচ্ছেন। তাঁরা উত্পাদনের সঙ্গে যুক্ত।
খুব বেশি কাল আগের কথা নয়। বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করত হাজার দশেক শিক্ষার্থী। এই বছর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৯ লাখ ৬৫ হাজার। পূর্ববর্তী সব বছরের পাস করা মানুষদের বাদ দিয়ে শুধু এবার যারা মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে, তাদের থেকে ১৫ লাখ যদি দেশটি গড়ে তোলার শপথ নিয়ে নিজেদের তৈরি করে, তারাই তো এই ছোট বাংলাদেশকে একটি আধুনিক স্বাবলম্বী রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে।
তিরিশ বছর আগে এসব ছিল না। জেনারেল এরশাদের জামানায় শুরু। টিভি চ্যানেলের আনুকূল্য থাকায় মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত আনন্দে মেতে ওঠে। উচ্ছ্বসিত আনন্দে মেতে ওঠা তারুণ্যের লক্ষণ; আমাদের মতো প্রাণহীন বুড়োদের নয়। কিন্তু শুধু অর্থহীন আনন্দ প্রকাশ জীবনকে কিছু দেয় না। ও রকম আনন্দ যারা করে, তারা দেশকে বিশেষ কিছু দিতে পারে না।
অথচ সত্যিকারের আনন্দ থেকে এখনকার ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত। আমাদের সময় পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকে ফল প্রকাশের সময় পর্যন্ত ছিল অখণ্ড অবসর। ঘুরে বেড়াও, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাও, ফুর্তি করো। এখন শেষ পত্রটির পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরে এসে কোনোরকমে রাতটা পার করা হয়। পরদিন সকালে নাশতা করে মাকে সঙ্গে নিয়ে পূর্ববর্তী বছরের কোনো ভালো ছাত্রের বাড়িতে তার নোটগুলোর ফটোকপি করতে ছুটতে হয়। একই ফটোকপি অগণিত মুখস্থ করে।
শুধু নোট মুখস্থ নয়, কোচিং সেন্টারে নাম লেখানো। ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেলে ভর্তির কোচিং শুধু নয়—সাধারণ ভালো কলেজে ভর্তির জন্যও কোচিং সেন্টারের বিশেষ সুবিধা গ্রহণ অপরিহার্য। কোচিং কর্তার আনুকূল্য না পাওয়া গেলে বহু মেধাবীর জীবন চিরদিনের জন্য বরবাদ হয়ে যেতে পারে। প্রকৃতিদত্ত মেধাকে শিক্ষাবাণিজ্য, ভর্তি-বাণিজ্য ধ্বংস করে দিচ্ছে। ৫০ বছর আগে পাঁচ হাজার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস শিক্ষার্থীর থেকে সমাজ যা পেত, আজ পাঁচ লাখ শিক্ষার্থীর কাছ থেকেও তা পায় না।
মিডিয়া পীড়াপীড়ি করে জানতে চায়—কী হতে চাও। মুখে যা আসে তা-ই বলে। এই হতে চাই, ওই হতে চাই। কেউ বলে না—সবচেয়ে গণ্ড পাড়াগাঁয়ের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করব। অথচ উনিশ শতকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিরাট ডিগ্রি নিয়ে অনেকেই ফিরে গেছেন তাঁর গ্রামে। যে স্কুলে তিনি নিজে পড়েছেন, সেই স্কুলেই শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছেন সামান্য বেতনে। তাঁরা মনে করতেন, ভাগ্যক্রমে আমি উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছি। আমার গ্রামে যারা মেধাবী আছে, স্কুল ফাইনালে ভালো ফলাফল না করলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে না, আমার কর্তব্য তাদের উচ্চশিক্ষার পথ করে দেওয়া।
আজকাল সদ্য-উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কোথাও আমাকেও টানাটানি করে নেয়। চাঁদা তুলে মঞ্চ তৈরি করা হয়। এলাকার সবচেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ জনপ্রতিনিধিকে করা হয় বিশেষ অতিথি। বড় ঘুষখোর আমলাকেও আনা হয় সম্মানিত অতিথি করে। তাঁরা এমন উপদেশ দেন, যা কনফুসিয়াস পর্যন্ত দিতে সাহস করেননি। শেষ পর্যন্ত মেধাবী ছেলেমেয়েদের তাতে কোনো উপকার হয় না।
এই অস্থিরতা ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যেও মেধাবী, বুদ্ধিমান ও নীতিবান ছেলেমেয়ের সংখ্যাও অগণিত। কিন্তু তাদের প্রকৃতিদত্ত মেধাকে কাজে লাগানোর পথটা তাদের জানা নেই। চোখের সামনে আদর্শস্থানীয় কাউকে তারা দেখছে না। সামনে, ডানে, বাঁয়ে এমন কেউ নেই, যিনি সস্নেহে হাত ধরে ওদের সঠিক পথটি দেখিয়ে দেন। বলেন, এই যে অমূল্য মানবজমিন, এখানে আবাদ করলে সোনা ফলানো সম্ভব। এবার যে সাড়ে উনিশ লাখ ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করল, তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে কে বলবেন—মায়েরা, বাবারা, তোমাদের ভেতরে রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। হেলায় তার অপচয় কোরো না। নিজেরা মানুষের মতো মানুষ হও এবং দেশকে সাধ্যমতো কিছু দাও।
ছাত্রছাত্রীদের অনুষ্ঠানে কোথাও কোথাও গিয়ে অনধিকার চর্চা করি। অর্থাত্ উপদেশ দিই। হঠাত্ দু-চারজন দেখি মনোযোগ দিয়ে শোনে। এত দূষিত আবহাওয়ায়ও ওদের মনটা কলুষিত হয়নি। সমাজ নিয়ে ওরা বেশ ভাবে। দেশের কী হবে—জানতে চায়। ওদের বলি, তোমাদেরই সমাজ পরিবর্তনকারীর ভূমিকা পালন করতে হবে। সে শক্তি বিধাতা তোমাদের দিয়েছেন। শুধু কাজে লাগাতে হবে সিদ্ধান্ত নিয়ে।
কেউ কেউ নির্দোষ সরলতায় বলে, ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই। বড় কর্মকর্তা হতে চাই। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করতে চাই। ওদের বলি, শুধু নিজের চাকরি চাকরি করো কেন? চাকরিপ্রার্থী হওয়ার চেয়ে তোমরা চাকরিস্রষ্টা হওয়ার চেষ্টা করো না কেন? নিজেরা সুযোগের অপেক্ষায় না থেকে অন্যকে সুযোগ করে দেওয়া হোক তোমাদের শপথ। তোমাদের প্রাণশক্তি আছে, মেধা আছে, চাই সংকল্প ও স্বপ্ন। দেশের ও সমাজের উপকার হয় এমন আদর্শ আঁকড়ে ধরো। দলগতভাবে কাজ করার অভ্যাস অনুশীলন করো। আত্মকেন্দ্রিক হয়ো না। জীবনে প্রথম বা দ্বিতীয় পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে উত্তীর্ণ হয়েছ, তোমাদের মধ্যে রয়েছে অপরিমেয় সম্ভাবনা। সৃষ্টিশীল হওয়ার চেষ্টা করো। জাতির মধ্যে ইতিবাচক ভাবাবেগ তৈরি করে এমন কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
উচ্চশিক্ষা নিয়ে যারা নতুন জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, তাদের দায়িত্বশীল হতে হবে। দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করার সংকল্প গ্রহণ করতে হবে, যুবনেতৃত্ব ছাড়া সমাজে পরিবর্তন আসবে না। আত্মবিশ্বাস ও ত্যাগ ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন। স্বাধীন ও স্বাবলম্বী অর্থনীতি ছাড়া স্বাধীনতার মূল্য নেই। ডিগ্রি পাস মানেই চাকরি কেন? ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিকল্পনা করতে হবে যুবসমাজকেই।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের একটি দেয়াল দেওয়া প্রথার মধ্যে আটকে রেখেছে। সব এলাকার সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সংহতিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠছে না। শহরের ছেলেমেয়েদের বলি, তোমরা কিছুকাল গ্রামে গিয়ে থাকো। নিজের চোখে দ্যাখো সেখানকার মানুষের সমস্যা ও সম্ভাবনা। সেখানকার মানুষের অভাব ও সমস্যা কীভাবে দূর করা যায়। সমস্যাকে বিপদ মনে না করে কীভাবে কাজে লাগানো যায়। গ্রামীণ জীবনের দুর্বলতাকে কীভাবে শক্তিতে পরিণত করা যায়—তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে।
আমরা একটি ভয়ংকর ভোগবাদী যুগে বাস করছি। বিশ্বব্যবস্থা যুবসমাজকে ভোগবাদে উত্সাহিত করছে। ভোগবাদ অতীতে বড় বড় রাজা-বাদশাকেও শেষ করে দিয়েছে। মধ্যবিত্ত যখন ভোগবাদী হয়ে ওঠে, তখন সে নিজে যে ধ্বংস হয় তা-ই নয়—সমাজটাই শেষ হয়ে যায়। সমাজের শিরদাঁড়া চূর্ণ হয়ে যায়। প্রথম জীবনেই জীবনযাত্রা থেকে অনাবশ্যক বিলাসিতাকে বিদায় দিতে হবে।
সমাজ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, এনজিও-টেনজিও আছে, তাঁদের বলি, গ্রামের কিশোর-কিশোরীরা যাতে অবকাশে শহরে এসে জাতীয় মূলধারার সঙ্গে মিশতে পারে, সে ব্যবস্থা করুন। নাগরিক জীবনের সুযোগ-সুবিধাকে কীভাবে সৃষ্টিশীল কাজে ব্যবহার করা যায়—গ্রামের শিক্ষার্থীদের সে ব্যবস্থা করে দিতে হবে। শুধু মহানগরের একটি বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলেই জীবন অর্থপূর্ণ হবে না।
নতুন ক্লাসে ভর্তি হওয়ার আগের যে সময়টি, সেটির একদম অপচয় করা উচিত নয়। সহপাঠীদের নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করা জরুরি। বুদ্ধিবৃত্তিক ও রুচিশীল বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। তবে কূটতর্ক পরিত্যাজ্য।
যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে চার দশকে জাতি আজ এই পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ অবস্থা বয়স্করা মেনে নিলেও যুবসমাজ মানবে কেন? দেশে পরিবর্তন আনতে নতুন নেতৃত্ব তো যুবসমাজকেই দিতে হবে। সবাই নেতা হবে না। সে যোগ্যতা সবার থাকে না। কিন্তু সকলেই যে জিনিসগুলো অনুশীলন করতে পারে তা হলো সততা, কাজের প্রতি প্রবল অনুরাগ, সৌজন্যবোধ, পরিমিতিবোধ ও ইতিবাচক উদ্যোগ। শুধু কিছু সার্টিফিকেট ও চাকরিতে ঢোকা জীবনের চাওয়া-পাওয়া হতে পারে না।
মাত্র একটি বছরেই প্রায় ২০ লাখ মেধাবী ছেলেমেয়ে পাওয়া কোনো জাতির জন্য পরম সৌভাগ্যের। কিন্তু তাদের মেধার সদ্ব্যবহার না হলে তাদের দিয়ে দেশের কোনো উপকার হবে না। সুতরাং, তাদের মেধা বিকাশের ব্যবস্থা করে দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র যদি তা করতে ব্যর্থ হয়, সে দায় রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণীর—মেধাবী শিক্ষার্থীদের নয়। আমরা আশা করব, মেধাবীরা করবে সেটার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার। রাষ্ট্র পালন করবে তার সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
(সূত্রঃ প্রথম আলো ২৩/০৮/২০১২)
__._,_.___