রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০১২, ২ পৌষ ১৪১৯
যুদ্ধাপরাধের বিচার ॥ এক ক্রান্তিলগ্নে জাতি
মোজাম্মেল খান
কোন জাতির জীবনে সঙ্কটময় অবস্থা আসে বহুবার, কিন্তু ক্রান্তিলগ্ন আসে না বার বার; হয়তবা কয়েক যুগ পর পর বা শতাব্দীতে ্একবার । বাঙালী জাতির জীবনে এমন এক ক্রান্তিলগ্ন এসেছিল ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ, এবং পরবর্তী নয় মাস ছিল সেদিনের সাড়ে সাতকোটি বাঙালীর জাতি হিসেবে অস্তিত্ব রক্ষার মরণপণ লড়াই। সে লড়াইয়ে আমাদের ইস্পাতকঠিন একতা এবং ঐক্যবদ্ধ প্রত্যয়ের জয় হয়েছিল, যদিও বিনিময়ে মানব ইতিহাসের এক জঘন্য গণহত্যার নির্মমতা নেমে এসেছিল আমাদের ওপর; আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল তিরিশ লাখ সন্তানকে। এ বিয়োগান্ত ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলোÑআমাদের এ মরণপণ সংগ্রামে আমাদের জাতিরই কিছু বিশ্বাসঘাতক কুসন্তান শুধু দখলদার এবং গণহত্যাকারী বাহিনীকে সহায়তা আর সাহায্যই করেনি, বহুক্ষেত্রে তাদের নিজেদের জাতির মানুষের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে এবং ঠা-া মাথায় অগণিত নিরপরাধ, নিষ্পাপ এবং নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে। এরমধ্যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিখুঁত পরিকল্পনায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা তারা ঘটিয়েছে '৭১এর ১৪ ডিসেম্বর তারিখে, আমাদের ঈপ্সিত বিজয়ের মাত্র দু'দিন আগে। জাতিকে মেধাশূন্য করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় সে রাতে বিভিন্ন পেশার জাতির কয়েক শ' শ্রেষ্ঠ সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যে সমস্ত কৃতি সন্তান জাতিকে সবদিক দিয়ে এগিয়ে নেয়ায় নেতৃত্ব দিতে পারতেন।
আমাদের এ চরম কষ্টার্জিত বিজয়ের অব্যবহিত পরেই সেদিনের সরকার বাংলাদেশ দালাল অ্াইন আদেশ (১৯৭২) জারি করে, যে সমস্ত বাংলাদেশের নাগরিক পাকিস্তানী সশস্ত্রবাহিনীকে গণহত্যায় প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য এবং সহযোগিতা করেছিল তাদের বিচার করার উদ্দেশ্যে। যে সমস্ত ঘৃণিত দালাল নিরাপদ কোন দেশে পলায়নে ব্যর্থ হয়েছিল, তাদের প্রায় সবাইকে আটক করে সেসময়ের সংসদে পাস করা ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে বিচারের আওতায় আনা হয়। বিচার চলাকালীন ১৯৭৩-এর ৩০ নবেম্বর সরকার এক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে, যার আওতায় যারা ধর্ষণ, খুন, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দ-িত বা অভিযুক্ত হয়েছে তাদের ছাড়া অন্য সবাইকে মুক্তি দেয়া হয়। এ সাধারণ ক্ষমার পরিধি যদিও অতি পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, তবুও এটাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে এবং সুপরিকল্পিতভাবে বিচার বিরোধীরা প্রচার করে চলেছে এই বলে, "বঙ্গবন্ধু সব দালালের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন।"
এর পর সংঘটিত হলো '৭৫-এর চরম বিয়োগান্ত ঘটনা। পরের দু'দশক ছিল বিকৃতি, প্রবঞ্চনা আর প্রতারণার ইতিহাস। এ বিকৃতির নেতৃত্বে ছিলেন আর কেউ নন, তিনি হলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মূল্যবোধকে ভূলণ্ঠিত করে দ্বিজাতিতত্ত্বের সমাধির ওপর প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের ইতিহাসের চাকাকে তিনি সম্পূর্ণ উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিলেন। জিয়াউর রহমানই সব দালালকে সমাজ এবং রাজনীতিতে পুনর্বাসন করলেন। দালাল শিরোমণি গোলাম আযমকে তিনি স্বসম্মানে দেশে ফিরিয়ে আনলেন। ১৯৭২-এর দালাল আইন আদেশকে তিনি বাতিল করলেন '৭৫ সালে, যার ফলে সব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী নিষ্কলুষ হয়ে গেলেন এবং জামায়াতে ইসলামী নামের যে কুখ্যাত দলটি '৭১-এ তাদের অপকর্মের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সেটাকে তিনি আবার নিবন্ধন করার অনুমতি দিলেন। এ ঘৃণিত কাজটি করার পর থেকেই আজ অবধি এ দলটির নিবন্ধন এবং আইনগত কার্যকরণ একটা বিতর্কিত বিষয় হিসেবেই সমগ্র জাতির কাছে পরিগণিত হয়েছে।
বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে এক বিরাট নৈতিক এবং আইনগত ভিত্তির ওপর অবস্থান করছে যেহেতু এটা ছিল তাদের বিগত সাধারণ নির্বাচনে জনগণের কাছে উপস্থাপিত নির্বাচন, প্রতিশ্রুতির এক অতীব জননন্দিত অঙ্গ। ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল আইনকে আরো যুগোপযোগী করতে এবং রোম সংবিধির স্বাক্ষরদাতা হিসেবে পূর্বশর্ত পূরণের অংশ হিসেবে ২০০৯ সালের ৬ জুলাই বাংলাদেশ মন্ত্রিপরিষদ এ আইনের কিছু সংশোধনীর অনুমোদন দিয়েছে যার আওতায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার পরিচালনা সম্ভব হয়। বর্তমান সময় পর্যন্ত ৮ জন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয় শেষ পর্যায়ে, কিংবা মাঝপথে রয়েছে। এদের সবাই সমস্ত জাতির কাছে '৭১ সালে তাদের কুখ্যাত অবস্থান এবং নৃশংস কর্মের জন্য অত্যন্ত পরিচিত।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে জামায়াতের জঙ্গী সমর্থকরা দেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় তাদের 'গণতান্ত্রিক অধিকার' প্রয়োগ করে চলেছে। গত ১৪ নবেম্বরের ডেইলি স্টারে 'শহরে শিবিরের সন্ত্রাসী আঘাত' শিরোনামে রাজধানীর একটিমাত্র রাস্তায় তাদের অপারেশনের বিবরণ ছিল এ রকম: "তারা একজন পুলিশের রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে তাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারধর করে, আরো কয়েক ডজন পুলিশকে আহত করে, এক যুবলীগ কর্মীর গলা কেটে ফেলার চেষ্টা করে, আইনমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবের গাড়ি আক্রমণ করে, পুলিশের কয়েকটা মোটরসাইকেল জ¦ালিয়ে দেয়, তিনটা সংবাদপত্রের গাড়িসহ কয়েক ডজন সরকারী ও বেসরকারী গাড়ি ভাংচুর করে এবং সাধারণ মানুষকে বেধড়ক মারধর করে।" এ সমস্ত 'গণতান্ত্রিক অধিকার' তারা প্রয়োগ করে চলেছে তাদের যে সব নেতৃবৃন্দকে '৭১ সালে 'শুধুমাত্র তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার' প্রয়োগের অপরাধে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে, তাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে!
এ সময় তারা এক নূতন মিত্রের সন্ধান পেয়েছে; আর সেটা হলো বর্তমান আমাদের গ্রহের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রটি যার ঢাকাস্থ কূটনীতিকরা বাংলাদেশ সরকারকে উপদেশ দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী দলটির সঙ্গে সমঝোতায় আসতে। ১৫ নবেম্বর ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এক বিবৃতিতে দেশব্যাপী ইদানীং ঘটে যাওয়া সংঘর্ষের ব্যাপারে তাদের উদ্বিগ্নতার কথা জানিয়ে সংলাপের মাধ্যমে এ মতপার্থক্য অবসানের আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতির ভাষায়, "শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের অঙ্গ; সে অধিকারকে শক্তি দিয়ে দমন ন্যায়সঙ্গত নয়। আমরা বিশ্বাস করি সংলাপই হলো মতপার্থক্য দূরীকরণের শ্রেষ্ঠ উপায়।" জামায়াত তাদের এ মিত্রের সমর্থনের তাৎক্ষণিক প্রতিদান দিয়েছে তাদের কর্মীদের মার্কিন দূতাবাসের পোড়ানো গাড়িটির ক্ষতিপূরণ প্রদানের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ সরকারের এবং নাগরিকদের গাড়ি পোড়ানো অবশ্য জামায়াত এবং মার্কিন দূতাবাসের দৃষ্টিতে 'শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ।'
মার্কিন দূতাবাসের উপরোক্ত বিবৃতির আলোকে এটা ধরে নেয়া যায় যে, জামায়াতের ইদানীংকার প্রতিবাদ, যার কিয়দংশরূপ উপরে বর্ণিত হলো, তাদের দৃষ্টিতে 'মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার।' এবং মার্কিন দূতাবাস এ মত পোষণ করে যে, মানবতাবিরোধী অপরাধে যাদের বিচার চলছে তাদের মুক্তির দাবিটি 'সমঝোতার' বিষয়। মার্কিন দূতাবাস প্রায়শই ভুলে যায় বা ভোলার ভান করে যে, বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং যে আইনে এ বিচার চলছে সেটা বাংলাদেশ সংসদে পাস হওয়া একটি আন্তর্জাতিক মানের আইন, গুয়ানতানামোতে যে আইনে বিচার চলছে সেটার মতো কোন জংলী আইন নয়। ইউরোপিয়ান সম্প্রদায়সহ প্রায় উল্লেখযোগ্য সব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এ আইনে বড় ধরনের কোন ব্যত্যয় খুঁজে পায়নি। উপরন্তু এ বিচার চলছে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে উন্মুত্ত আদালতে, যেখানে অভিযুক্তরা তাদের ইচ্ছামতো আইনজীবী নিয়োগ করতে পেরেছে। এর বিপরীতে, উল্টোটি ঘটে চলেছে গুয়ানতানামোতেÑ যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অসংখ্য বন্দীর বিচার চালিয়ে যাচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করার অপরাধে। সে বিচার কিভাবে চলছে তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ এখানে উপস্থাপন করলে বোধ করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না । ১৭ বছর বয়স্ক কানাডিয়ান নাগরিক ওমর খাদরকে বিচার করা হয়েছে আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রে এক আমেরিকান সৈনিককে গ্রেনেড ছুড়ে হত্যা করার অভিযোগে। সে যুদ্ধে ওমর খাদরের পিতাও নিহত হন, যিনি ওমরকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে গিয়েছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা মানবতাবিরোধী অপরাধ কিনা সেটা অন্য ব্যাপার। কানাডিয়ান নাগরিক ওমর খাদরকে কোন কানাডিয়ান আইনজীবী নিয়োগ করতে দেয়া হয়নি। তার ওপর যেভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছেÑ যার বিস্তারিত হৃৎকাঁপানো বিবরণ ও দৃশ্য কানাডার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেটা শুনলে বা দেখলে যে কারুরই রক্ত হিম হওয়ার অবস্থা হবে। এইত গতবছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমন একটা আইনে সই করলেন, যে আইনের বলে আল কায়েদার সমর্থক সন্দেহে যে কোন ব্যক্তিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিনাবিচারে আটক রাখা যাবে। এটা মার্কিন জনগণের কাছে কতটুকু সম্মানজনক বা গ্রহণযোগ্য হবে যদি তৃতীয় কোন রাষ্ট্র মার্কিন সরকারকে আল কায়েদার সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে তাদের মতপার্থক্য দূর করার উপদেশ বর্ষণ করে?
তাদের নূতন বন্ধুর সমর্থনে, এটা আশা করা যাচ্ছে যে, জামায়াতের কর্মীবাহিনী আগামী দিনগুলোতে আরো পরাক্রমশালীভাবে তাদের 'গণতান্ত্রিক অধিকার' প্রয়োগের প্রচেষ্টা চালাবে। একদা যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর '৭১ সালে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত জাতিকে ব্লাকমেল করার অশুভ প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছিল; এখন ৪২ বছর পর মার্কিন কূটনীতিক প্রচেষ্টা আমাদের জনগণের ওপর পরিচালিত মানতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার করার দৃঢ় প্রত্যয়কে দুর্বল করার আর এক অশুভ প্রয়াসে লিপ্ত। জাতি আজ আর এক ক্রান্তিলগ্নে উপনীত, যে লগ্নের পরিধি আগামী এক বছর, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অবধি। যদি সে সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন না হয়, কিংবা বিচারের রায় কার্যকর না হয়, এবং পরবর্তী নির্বাচনে যদি ক্ষমতার পালাবদল ঘটে তবে সমস্ত বিচার প্রক্রিয়াটাকেই চিরতরে উল্টে দেয়া হবে: ঠিক যেমনভাবে '৭৫ সালের বিয়োগান্ত ঘটনার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মূল্যবোধকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী কি সেটা উপলব্ধি করছেন?
লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
আমাদের এ চরম কষ্টার্জিত বিজয়ের অব্যবহিত পরেই সেদিনের সরকার বাংলাদেশ দালাল অ্াইন আদেশ (১৯৭২) জারি করে, যে সমস্ত বাংলাদেশের নাগরিক পাকিস্তানী সশস্ত্রবাহিনীকে গণহত্যায় প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য এবং সহযোগিতা করেছিল তাদের বিচার করার উদ্দেশ্যে। যে সমস্ত ঘৃণিত দালাল নিরাপদ কোন দেশে পলায়নে ব্যর্থ হয়েছিল, তাদের প্রায় সবাইকে আটক করে সেসময়ের সংসদে পাস করা ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে বিচারের আওতায় আনা হয়। বিচার চলাকালীন ১৯৭৩-এর ৩০ নবেম্বর সরকার এক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে, যার আওতায় যারা ধর্ষণ, খুন, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দ-িত বা অভিযুক্ত হয়েছে তাদের ছাড়া অন্য সবাইকে মুক্তি দেয়া হয়। এ সাধারণ ক্ষমার পরিধি যদিও অতি পরিষ্কারভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, তবুও এটাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে এবং সুপরিকল্পিতভাবে বিচার বিরোধীরা প্রচার করে চলেছে এই বলে, "বঙ্গবন্ধু সব দালালের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন।"
এর পর সংঘটিত হলো '৭৫-এর চরম বিয়োগান্ত ঘটনা। পরের দু'দশক ছিল বিকৃতি, প্রবঞ্চনা আর প্রতারণার ইতিহাস। এ বিকৃতির নেতৃত্বে ছিলেন আর কেউ নন, তিনি হলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মূল্যবোধকে ভূলণ্ঠিত করে দ্বিজাতিতত্ত্বের সমাধির ওপর প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের ইতিহাসের চাকাকে তিনি সম্পূর্ণ উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিলেন। জিয়াউর রহমানই সব দালালকে সমাজ এবং রাজনীতিতে পুনর্বাসন করলেন। দালাল শিরোমণি গোলাম আযমকে তিনি স্বসম্মানে দেশে ফিরিয়ে আনলেন। ১৯৭২-এর দালাল আইন আদেশকে তিনি বাতিল করলেন '৭৫ সালে, যার ফলে সব অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী নিষ্কলুষ হয়ে গেলেন এবং জামায়াতে ইসলামী নামের যে কুখ্যাত দলটি '৭১-এ তাদের অপকর্মের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সেটাকে তিনি আবার নিবন্ধন করার অনুমতি দিলেন। এ ঘৃণিত কাজটি করার পর থেকেই আজ অবধি এ দলটির নিবন্ধন এবং আইনগত কার্যকরণ একটা বিতর্কিত বিষয় হিসেবেই সমগ্র জাতির কাছে পরিগণিত হয়েছে।
বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে এক বিরাট নৈতিক এবং আইনগত ভিত্তির ওপর অবস্থান করছে যেহেতু এটা ছিল তাদের বিগত সাধারণ নির্বাচনে জনগণের কাছে উপস্থাপিত নির্বাচন, প্রতিশ্রুতির এক অতীব জননন্দিত অঙ্গ। ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল আইনকে আরো যুগোপযোগী করতে এবং রোম সংবিধির স্বাক্ষরদাতা হিসেবে পূর্বশর্ত পূরণের অংশ হিসেবে ২০০৯ সালের ৬ জুলাই বাংলাদেশ মন্ত্রিপরিষদ এ আইনের কিছু সংশোধনীর অনুমোদন দিয়েছে যার আওতায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার পরিচালনা সম্ভব হয়। বর্তমান সময় পর্যন্ত ৮ জন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয় শেষ পর্যায়ে, কিংবা মাঝপথে রয়েছে। এদের সবাই সমস্ত জাতির কাছে '৭১ সালে তাদের কুখ্যাত অবস্থান এবং নৃশংস কর্মের জন্য অত্যন্ত পরিচিত।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে জামায়াতের জঙ্গী সমর্থকরা দেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় তাদের 'গণতান্ত্রিক অধিকার' প্রয়োগ করে চলেছে। গত ১৪ নবেম্বরের ডেইলি স্টারে 'শহরে শিবিরের সন্ত্রাসী আঘাত' শিরোনামে রাজধানীর একটিমাত্র রাস্তায় তাদের অপারেশনের বিবরণ ছিল এ রকম: "তারা একজন পুলিশের রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে তাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারধর করে, আরো কয়েক ডজন পুলিশকে আহত করে, এক যুবলীগ কর্মীর গলা কেটে ফেলার চেষ্টা করে, আইনমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবের গাড়ি আক্রমণ করে, পুলিশের কয়েকটা মোটরসাইকেল জ¦ালিয়ে দেয়, তিনটা সংবাদপত্রের গাড়িসহ কয়েক ডজন সরকারী ও বেসরকারী গাড়ি ভাংচুর করে এবং সাধারণ মানুষকে বেধড়ক মারধর করে।" এ সমস্ত 'গণতান্ত্রিক অধিকার' তারা প্রয়োগ করে চলেছে তাদের যে সব নেতৃবৃন্দকে '৭১ সালে 'শুধুমাত্র তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার' প্রয়োগের অপরাধে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে, তাদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে!
এ সময় তারা এক নূতন মিত্রের সন্ধান পেয়েছে; আর সেটা হলো বর্তমান আমাদের গ্রহের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রটি যার ঢাকাস্থ কূটনীতিকরা বাংলাদেশ সরকারকে উপদেশ দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী দলটির সঙ্গে সমঝোতায় আসতে। ১৫ নবেম্বর ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এক বিবৃতিতে দেশব্যাপী ইদানীং ঘটে যাওয়া সংঘর্ষের ব্যাপারে তাদের উদ্বিগ্নতার কথা জানিয়ে সংলাপের মাধ্যমে এ মতপার্থক্য অবসানের আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতির ভাষায়, "শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের অঙ্গ; সে অধিকারকে শক্তি দিয়ে দমন ন্যায়সঙ্গত নয়। আমরা বিশ্বাস করি সংলাপই হলো মতপার্থক্য দূরীকরণের শ্রেষ্ঠ উপায়।" জামায়াত তাদের এ মিত্রের সমর্থনের তাৎক্ষণিক প্রতিদান দিয়েছে তাদের কর্মীদের মার্কিন দূতাবাসের পোড়ানো গাড়িটির ক্ষতিপূরণ প্রদানের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ সরকারের এবং নাগরিকদের গাড়ি পোড়ানো অবশ্য জামায়াত এবং মার্কিন দূতাবাসের দৃষ্টিতে 'শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ।'
মার্কিন দূতাবাসের উপরোক্ত বিবৃতির আলোকে এটা ধরে নেয়া যায় যে, জামায়াতের ইদানীংকার প্রতিবাদ, যার কিয়দংশরূপ উপরে বর্ণিত হলো, তাদের দৃষ্টিতে 'মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার।' এবং মার্কিন দূতাবাস এ মত পোষণ করে যে, মানবতাবিরোধী অপরাধে যাদের বিচার চলছে তাদের মুক্তির দাবিটি 'সমঝোতার' বিষয়। মার্কিন দূতাবাস প্রায়শই ভুলে যায় বা ভোলার ভান করে যে, বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং যে আইনে এ বিচার চলছে সেটা বাংলাদেশ সংসদে পাস হওয়া একটি আন্তর্জাতিক মানের আইন, গুয়ানতানামোতে যে আইনে বিচার চলছে সেটার মতো কোন জংলী আইন নয়। ইউরোপিয়ান সম্প্রদায়সহ প্রায় উল্লেখযোগ্য সব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এ আইনে বড় ধরনের কোন ব্যত্যয় খুঁজে পায়নি। উপরন্তু এ বিচার চলছে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে উন্মুত্ত আদালতে, যেখানে অভিযুক্তরা তাদের ইচ্ছামতো আইনজীবী নিয়োগ করতে পেরেছে। এর বিপরীতে, উল্টোটি ঘটে চলেছে গুয়ানতানামোতেÑ যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অসংখ্য বন্দীর বিচার চালিয়ে যাচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করার অপরাধে। সে বিচার কিভাবে চলছে তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ এখানে উপস্থাপন করলে বোধ করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না । ১৭ বছর বয়স্ক কানাডিয়ান নাগরিক ওমর খাদরকে বিচার করা হয়েছে আফগানিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রে এক আমেরিকান সৈনিককে গ্রেনেড ছুড়ে হত্যা করার অভিযোগে। সে যুদ্ধে ওমর খাদরের পিতাও নিহত হন, যিনি ওমরকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে গিয়েছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা মানবতাবিরোধী অপরাধ কিনা সেটা অন্য ব্যাপার। কানাডিয়ান নাগরিক ওমর খাদরকে কোন কানাডিয়ান আইনজীবী নিয়োগ করতে দেয়া হয়নি। তার ওপর যেভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছেÑ যার বিস্তারিত হৃৎকাঁপানো বিবরণ ও দৃশ্য কানাডার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেটা শুনলে বা দেখলে যে কারুরই রক্ত হিম হওয়ার অবস্থা হবে। এইত গতবছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমন একটা আইনে সই করলেন, যে আইনের বলে আল কায়েদার সমর্থক সন্দেহে যে কোন ব্যক্তিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিনাবিচারে আটক রাখা যাবে। এটা মার্কিন জনগণের কাছে কতটুকু সম্মানজনক বা গ্রহণযোগ্য হবে যদি তৃতীয় কোন রাষ্ট্র মার্কিন সরকারকে আল কায়েদার সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে তাদের মতপার্থক্য দূর করার উপদেশ বর্ষণ করে?
তাদের নূতন বন্ধুর সমর্থনে, এটা আশা করা যাচ্ছে যে, জামায়াতের কর্মীবাহিনী আগামী দিনগুলোতে আরো পরাক্রমশালীভাবে তাদের 'গণতান্ত্রিক অধিকার' প্রয়োগের প্রচেষ্টা চালাবে। একদা যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর '৭১ সালে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত জাতিকে ব্লাকমেল করার অশুভ প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছিল; এখন ৪২ বছর পর মার্কিন কূটনীতিক প্রচেষ্টা আমাদের জনগণের ওপর পরিচালিত মানতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার করার দৃঢ় প্রত্যয়কে দুর্বল করার আর এক অশুভ প্রয়াসে লিপ্ত। জাতি আজ আর এক ক্রান্তিলগ্নে উপনীত, যে লগ্নের পরিধি আগামী এক বছর, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অবধি। যদি সে সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন না হয়, কিংবা বিচারের রায় কার্যকর না হয়, এবং পরবর্তী নির্বাচনে যদি ক্ষমতার পালাবদল ঘটে তবে সমস্ত বিচার প্রক্রিয়াটাকেই চিরতরে উল্টে দেয়া হবে: ঠিক যেমনভাবে '৭৫ সালের বিয়োগান্ত ঘটনার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মূল্যবোধকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী কি সেটা উপলব্ধি করছেন?
লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
Also Read:
রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০১২, ২ পৌষ ১৪১৯
এটাই হোক একাত্তরের ঘাতকদের উল্লাস নৃত্যের শেষ বছর
আবদুল মান্নান
রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০১২, ২ পৌষ ১৪১৯
সোমবার, ১০ ডিসেম্বর ২০১২, ২৬ অগ্রহায়ন ১৪১৯
জামায়াত মানেই কি ফেরেববাজি আর ভণ্ডামি?
আবদুল মান্নান
লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক। ডিসেম্বর ৮, ২০১২
সোমবার, ১০ ডিসেম্বর ২০১২, ২৬ অগ্রহায়ন ১৪১৯
Related:
একাত্তরে মুজাহিদ পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করতেন'
নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ০৬-১২-২০১২
শুক্রবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২, ৩০ ভাদ্র ১৪১৯
আলবদর প্রধান ছিলেন নিজামী, উপপ্রধান মুজাহিদ ॥ জেরায় শাহরিয়ার কবির
শুক্রবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১২, ৩০ ভাদ্র ১৪১৯
httphttp://www.nybangla.com/Muktijoddho/Muzahid/Ali%20Ahsan%20Mohammed%20Mujahid_JB.pdf://www.nybangla.com/Muktijoddho/Muzahid/Muzahid.htm
দার্শনিক ও কৌশলগত পরিকল্পনার নেতৃত্বে ছিলেন গোলাম আযম যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ সুলতানা কামালের জবানবন্দী...
বুধবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১২, ২৮ ভাদ্র ১৪১৯
মাস্টারমাইন্ড ছিলেন গোলাম আযম
নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ১১-০৯-২০১২
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-09-11/news/288426
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পক্ষের প্রতীক ছিলেন গোলাম আযম
যুদ্ধাপরাধী বিচার
সুলতানা কামালের জবানবন্দী
সুলতানা কামালের জবানবন্দী
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=15&dd=2012-09-11&ni=108832
Related:
আলবদর ১৯৭১ - ১৬ (শেষাংশ)
মঙ্গলবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১২, ২৭ ভাদ্র ১৪১৯
আলবদর ১৯৭১ - ১৫
সোমবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১২, ২৬ ভাদ্র ১৪১৯
আলবদর ১৯৭১ -১৪
আলবদর ১৯৭১ -১৩ : আলবদর ১৯৭১ ॥ বুদ্ধিজীবী হত্যা ... ..
শনিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১২, ২৪ ভাদ্র ১৪১৯
বুদ্ধিজীবী হত্যা; ২৫ মার্চ থেকে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
http://www.somewhereinblog.net/blog/onujibblog/28882040আলবদর ১৯৭১ -১২
শুক্রবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১২, ২৩ ভাদ্র ১৪১৯
আলবদর ১৯৭১ - ১১
বুধবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১২, ২১ ভাদ্র ১৪১৯
আলবদর ১৯৭১ - ১০
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2012-09-02&ni=107855
মঙ্গলবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১২, ২০ ভাদ্র ১৪১৯
আলবদর ১৯৭১ - ৯
সোমবার, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১২, ১৯ ভাদ্র ১৪১৯
আলবদর ১৯৭১ - ৮
রবিবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০১২, ১৮ ভাদ্র ১৪১৯
আলবদর ১৯৭১ - ৭
শনিবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০১২, ১৭ ভাদ্র ১৪১৯
আলবদর ১৯৭১ - ৬
শুক্রবার, ৩১ আগষ্ট ২০১২, ১৬ ভাদ্র ১৪১৯
আলবদর ১৯৭১ - ৫
বৃহস্পতিবার, ৩০ আগষ্ট ২০১২, ১৫ ভাদ্র ১৪১৯
আলবদর ১৯৭১ - ৪
বুধবার, ২৯ আগষ্ট ২০১২, ১৪ ভাদ্র ১৪১৯
আলবদর ১৯৭১ - ৩
মঙ্গলবার, ২৮ আগষ্ট ২০১২, ১৩ ভাদ্র ১৪১৯
আলবদর ১৯৭১ - ২
সোমবার, ২৭ আগষ্ট ২০১২, ১২ ভাদ্র ১৪১৯
আলবদর ১৯৭১ - ১
রবিবার, ২৬ আগষ্ট ২০১২, ১১ ভাদ্র ১৪১৯
৭১-এর যুদ্ধাপরাধ ও জামায়াতে ইসলামী
২৮ শে জানুয়ারি, ২০১১ সকাল ৯:৪৬
৭১ জামায়াতে ইসলামীর বর্বরতার আরেকটি নৃশংস উদ্যোগ হচ্ছে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর কায়দায় আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন, বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা প্রণয়ন এবং জামায়াতের ঘাতকদের দ্বারা সুপরিকল্পিতভাবে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যা
|