আনিস রায়হান শুক্রবার বেলা বারোটা। গিয়েছিলাম পল্টন এলাকায়। জামায়াত-শিবির ও অন্য ধর্মভিত্তিক দলগুলো জুমার নামাজের পর মাঠে নামবে, বিক্ষোভ দেখাবে, এটা জেনেই বের হয়েছিলাম স্বচক্ষে পরিস্থিতি দেখতে। পল্টনে তখন কয়েক হাজার লোক সমবেত হয়েছে। আরও মানুষ আসছে। বায়তুল মোকাররম থেকে একটু দূরে পুলিশ ও সাংবাদিকদের অবস্থান করতে দেখা যায় তখন। এরপর পল্টন ঘুরে শাহবাগে চলে আসি। শাহবাগে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়মুখী সড়কে সামিয়ানার নিচে গণজাগরণ মঞ্চে কিছু তরুণ সেøাগান দিচ্ছিল। সংখ্যায় তারা ৫০ এর বেশি ছিল না। সেখানে তখন চলছিল গণস্বাক্ষর অভিযান। আগের দিন, বৃহস্পতিবার রাতেই আনুষ্ঠানিক টানা ১৭ দিনের অবস্থান কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করে নতুন কর্মসূচি দেয় গণজাগরণ মঞ্চের নেতারা। তাই স্বাভাবিকভাবেই সেদিন উপস্থিতি ছিল কম। বেলা বেড়ে তখন ১টা ১৫। হঠাৎ দেখা গেল শাহবাগ থানা থেকে পুলিশের কয়েকটি গাড়ি এলিফ্যান্ট রোডের দিকে ছুটছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাঁটাবনে সংঘর্ষের আশঙ্কায় পুলিশ সেদিক যাচ্ছে। কাঁটাবন মসজিদ মিশন এলাকায় জামায়াত-শিবির কর্মীরা জড়ো হচ্ছে। এ খবর শুনে মঞ্চ থেকে ২০ জনের মতো একটি ছোট্ট দল এগিয়ে যায় পুলিশের গাড়ির পিছু পিছু। এগিয়ে চলি তাদের সঙ্গে। পুলিশ কাঁটাবন গিয়েই প্রথম মসজিদ গেটের বিপরীত প্রান্তে অবস্থান নেয়। কাঁটাবন মোড়ের যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। চার পাশে পুলিশ সদস্যরা ছড়িয়ে থাকে। নামাজ শেষ হওয়া মাত্রই শোনা যায় হ্যান্ডমাইকে করে মিছিলে অংশ নিতে মুসল্লিদের ডাকা হচ্ছে। মুসল্লিদের উত্তেজিত করার জন্য পুলিশকে লক্ষ্য করে সেøাগান দেয়া হচ্ছে। প্রথমেই বেরিয়ে যায় সাধারণ কিছু মুসল্লি। তাদের হাতে লিফলেট দেখা যায়। হেফাজতে বিসমিল্লাহ কমিটির প্রচারকৃত এ লিফলেট ছিল শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্যে ভরপুর। মুসল্লিদের বেরিয়ে যেতে দেখলে তখন হ্যান্ডমাইকধারীরা কৌশল পাল্টায়। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ভাষণ দিতে শুরু করে এবং পুলিশের দিকে জুতা ও ঢিল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। সাধারণ মুসল্লিরা তখন মসজিদ কম্পাউন্ডে আটকা পড়ে যায়। একপর্যায়ে পুলিশের রমনা অঞ্চলের এসি শিবলী নোমান, শাহবাগ থানার ওসি সিরাজুল ইসলামসহ দুইজন এসআই এবং কয়েকজন পুলিশ সদস্য মসজিদ কম্পাউন্ডের দিকে এগিয়ে যায় আলাপ করে তাদের শান্ত করার জন্য। কিন্তু জামায়াত-শিবির কর্মীরা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল সহিংসতা ঘটানোর জন্য। মসজিদ কম্পাউন্ডের দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই তারা এসি ও ওসির ওপর হামলা চালায়। সরাসরি ওসি সিরাজুল ইসলামের মাথায় লাঠি দিয়ে বাড়ি দেয় তারা। এসি শিবলী নোমানও বেধড়ক পিটুনির শিকার হন। এ সময় সরাসরি পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবির কর্মীদের হাতাহাতির মতো অবস্থা হয়। পুলিশ মিশন কম্পাউন্ডে টিয়ারশেল ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। হুড়োহুড়ির মধ্য দিয়ে কাঁটাবন ঢালের দিকে কিছুটা হটে পুলিশ ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের লক্ষ্য করে ঢিল মারতে শুরু করে জামায়াত-শিবির কর্মীরা। এসময় তারা বেশ কয়েকটি ককটেল ফাটায়। একপর্যায়ে আরও পুলিশ ও জল কামানের গাড়ি এসে সেখানে এসে পৌঁছালে জামায়াত-শিবির কর্মীরা কাঁটাবন ঢালের গলির দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এ সময় শিবিরের তিনজন আটক হয়। এদিকে কাঁটাবন মসজিদ মিশন থেকে তখনই দেখা যায় একটি অ্যাম্বুলেন্স বের হওয়ার চেষ্টা করছে। পুলিশ এবং জাগরণ মঞ্চের কর্মীরা অ্যাম্বুলেন্সটি আটকাতে গেলে অ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলে পুলিশকে লক্ষ্য করে লাঠি চালাতে শুরু করেন দুজন। এতে দুজন এসআই আহত হন। একপর্যায়ে অ্যাম্বুলেন্সসহ ভেতরে থাকা দুইজন আটক হয়। অ্যাম্বুলেন্সটি আটকানোর পর দেখা যায় এর গায়ে জেহাদি পোস্টার লাগানো হয়েছে। পোস্টারে লেখা আছে, শাহজালালের তলোয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। প্রয়োজনে হাসতে হাসতে শাহাদাতের নাযরানা পেশ করব। পোস্টারের মধ্যে আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মূর্তি নির্মাণের গর্হিত পদক্ষেপ রুখতে জান কোরবান করার আহ্বান জানানো হয়। অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে আরও অনেক ব্যাগভর্তি লিফলেট, পুস্তিকা পাওয়া যায়। দুটি ব্যাগ পাওয়া যায়, যা পুলিশ বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ছাড়া খুলতে অস্বীকৃতি জানায়। ঘটনার এই পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে কাঁটাবনে জড়ো হতে শুরু করে। একপর্যায়ে উত্তেজিত ছাত্ররা ওই অ্যাম্বুলেন্সটির কাঁচ ভাংচুর করে। এ সময় পুলিশ তাদের বাধা দেয় এবং গাড়িটি রেকারের সাহায্যে থানার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। কাঁটাবনে জড়ো হওয়া ছাত্ররা তখন কাঁটাবন মিশনের দোকানগুলো ভাংচুর করতে চাইলে কয়েকটি হলের ছাত্রলীগ নেতারা তাদের বাধা দেন। তারা ভাংচুরের দায়দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানান। এতে স্থানীয় কয়েকজন মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে বলে ওঠে, এই মসজিদের পাশের দোকানগুলোতে শিবিরের সিলেবাস, বই ও অন্যান্য কাগজপত্র বিক্রি হয়। এখানে প্রায়ই সাঈদীর ওয়াজের সিডি বাজাতে শোনা যায়। এই দোকানগুলোকে কেন্দ্র করে কাঁটাবন ঢালে বেশ কয়েকটি মেসের মাধ্যমে শিবির একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। ওইসব শিবিরকর্মী এই দোকানগুলোতেই সব সময় আড্ডা দেন। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতারা এসব কথায় কান না দিয়ে মিছিল করে শাহবাগের দিকে ফেরত যান। মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে শাহবাগ থানায় পৌঁছে দেখি, অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর থেকে আটক একজন নিজের পরিচয় দিচ্ছেন তিনি নাকি মৌলভীবাজারের কোনো এক পীরের ছেলে। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি মাওলানা নূরে আলম হামিদী। হেফাজতে বিসমিল্লাহ কমিটির লন্ডন শাখার সভাপতি। অথচ তার কাছে প্রাপ্ত লিফলেটে দেখা যায়, মাওলানা নূরে আলম হামিদীর পরিচয় লেখা আছে মৌলভীবাজারের সভাপতি হিসেবে। পুলিশ তাকে এবং আটককৃত অন্যদের শাহবাগ থানার একটি সেলে ঢুকিয়ে বাকিদের থানা প্রাঙ্গণ থেকে বের করে দেয়। এই ঘটনা যখন ঘটছিল তখন বায়তুল মোকাররম এলাকায় চলছিল তুমুল সংঘর্ষ। পুলিশ ও সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে চালানো হচ্ছিল গুলি। সারা দেশে ভাংচুর হচ্ছিল গণজাগরণ মঞ্চ। এ থেকে বোঝা যায়, জামায়াত-শিবির পরিকল্পনামাফিক জেএমবির মতো করে সারা দেশে হামলা চালানোর নজির তৈরি করতে চেয়েছে ওই দিন। তাদের এই তৎপরতা নির্দেশ করে নীলনকশা নিয়েই মাঠে নেমেছে তারা। http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=7862 |