যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই দিতে হবে'
শাহবাগে চেতনার জাগরণ দেশকে নিয়ে যাবে আগামীর পথে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে প্রজন্ম চত্বরে অবস্থানকারী জনতা শনিবার রাতে করেছে মশাল মিছিল কাজল হাজরা
দৃপ্ত শপথে উজ্জীবিত জাগ্রত জনতার সমাবেশ আরও উত্তাল হয়ে উঠেছে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে। যতই দিন গড়াচ্ছে ততই বাড়ছে জনস্রোত, তীব্র হয়ে উঠছে যুদ্ধাপরাধী আর তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে ঘৃণার আগুন। সেই আগুনের শিখায় শনিবার রাতে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে জ্বলে উঠল হাজার মোমবাতি, অসংখ্য মশাল। মোমবাতি হাতে নিয়ে জনতার দীর্ঘ মিছিল। গণজাগরণের আলোয় উদ্ভাসিত ঢাকার আকাশ। এ আলো নিভবে না। কোটি প্রাণের প্রতিটি স্পন্দনে যে আলোর শিখা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, সে আলো চিরন্তন প্রেরণার মশাল হয়ে জ্বলবে হাজার বছর। সহস্র জনতার কণ্ঠেও চেতনার আলোয় উদ্দীপ্ত স্লোগান_ 'তোমার আমার ঠিকানা, শাহবাগের মোহনা', 'ফাঁসির রায় না নিয়ে ঘরে ফিরে যাব না', 'আর কোনো দাবি নাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই', 'যেখানেই রাজাকার, সেখানেই প্রতিরোধ'।
শুক্রবার জনতার মহাসমুদ্রে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি আর জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার যে শপথের ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছিল, সেই শপথ রক্ষায় আরও বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শাহবাগের মোহনায় মিলে যাওয়া নানা বয়সের, শ্রেণী-পেশার মানুষ। আন্দোলনকারীরা রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি ঘৃণাসূচক পোস্টার, প্ল্যাকার্ডের পাশাপাশি নিয়ে এসেছে কার্টুন। যুদ্ধাপরাধী, রাজাকারদের মুখপত্র সংগ্রাম, নয়া দিগন্ত, আমার দেশে প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলন ঘিরে মিথ্যা খবর পরিবেশন করায় এসব পত্রিকার কপিও পোড়ানো হয় গতকাল।
দলে দলে মানুষ এসে এক হয়েছেন শাহবাগের মোহনায়। শুধু ঢাকা নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসছেন প্রজন্ম চত্বরের বিক্ষোভে শামিল হতে। সংহতি প্রকাশ করতে আসছেন বিশিষ্টজনরা। দুপুরে এসেছিলেন লেখক-শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল্লাহ খান। আসেন ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। গণজাগরণ মঞ্চে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন ছায়ানটের শিল্পীরা।
বিকেলে এসেছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। তারা বক্তব্য দেননি, শুধু সংহতি প্রকাশ করেছেন।
শনিবার সকাল ৮টা থেকেই আবারও সরগরম হয়ে ওঠে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে জনতার ভিড়। শনিবার সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিল ঢাকার বিভিন্ন স্কুলের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের দল বেঁধে আসা। ক্লাস রেখে শিক্ষকদের অনুমতি নিয়ে এসেছে রাজধানী উচ্চবিদ্যালয়, গাজীপুর বিআরআরআই স্কুল, উদয়ন স্কুল, তেজগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তাদের কণ্ঠে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে স্লোগান, অনেকের হাতে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে প্ল্যাকার্ড। দুপুর ১২টার দিকে প্রজন্ম চত্বরের চারপাশ ভরে যায় মানুষে মানুষে। গণজাগরণ মঞ্চে স্লোগান আর গণসঙ্গীত চলে অবিরাম। এর মধ্যেই খবর আসে চট্টগ্রামে জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতাল প্রতিহত করেছে জাগ্রত জনতা। মুহূর্তেই আনন্দে-উল্লাসে মেতে ওঠে হাজারো মানুষ। গণজাগরণ মঞ্চ থেকে স্লোগান ওঠে, 'যেখানেই জামায়াত-শিবির সেখানেই প্রতিরোধ'। একটু পরে আরও একটি ঘোষণায় সচকিত হয়ে ওঠে সবাই। শিবিরের কিছু ঘাপটি মারা কর্মী প্রজন্ম চত্বরের আশপাশে মিথ্যা তথ্য সংবলিত লিফলেট বিতরণ করছে। ঘোষণা দেওয়া হয়, এ ধরনের কাউকে পেলেই নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে সোপর্দ করার। এর কিছুক্ষণ পরে শাহবাগে আসেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, এ আন্দোলন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে চলছে এবং এটি একটি ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ সমাবেশ। এ কারণে পুলিশ সার্বিকভাবে নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছে। শিবিরকর্মীদের নিভৃত বিচরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরো শাহবাগ এলাকায় নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন করা হয়েছে শতাধিক সাদা পোশাকের পুলিশ। শিবিরকর্মীদের যে ধরনের তৎপরতার কথা বলা হচ্ছে, তার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভরদুপুরে সূর্যের খরতাপ উপেক্ষা করে চলে স্লোগান আর গণসঙ্গীত। সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের সমস্ত মানুষ আজ তরুণ সমাজের দিকে তাকিয়ে আছে সমস্ত অন্ধকার দূর করে আলোর পথে নতুন বিজয় দেখার জন্য। তরুণ প্রজন্ম দেশপ্রেম আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি যে আনুগত্য দেখিয়েছে, তার জন্য তাদের অভিবাদন। অধ্যাপক রফিকুল্লাহ খান বলেন, আমরা চাই বাংলার মাটিতে কোনো রাজাকার থাকবে না। কোনো যুদ্ধাপরাধী থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের স্লোগান 'জয় বাংলা' ছাড়া আর কোনো স্লোগান থাকবে না।
বিকেলে জনসমাগম আরও বেড়ে দিনের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় জনস্রোত ছড়িয়ে পড়ে প্রজন্ম চত্বর ছাড়িয়ে রূপসী বাংলা (শেরাটন) মোড়, অন্যদিকে টিএসসি পর্যন্ত। যেন গতকালও ছিল মহাসমাবেশ। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা একের পর এক মিছিল নিয়ে আসেন। এ সময় জনতার হাতে ছিল মোমবাতি, অসংখ্য মানুষের হাতে প্ল্যাকার্ড। সন্ধ্যা ৭টা থেকে একের পর এক বের হয় মিছিল। মোমবাতি আর মশাল মিছিলে পুরো এলাকায় সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে ওঠে স্লোগান আর স্লোগানে।
ফাঁসির রায় ছাড়া আন্দোলন চলবে : দুপুরের দিকে গণজাগরণ মঞ্চের ঘোষণায় বলা হয়, আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সরকার আপিলের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ জন্য আইন সংশোধনও করা হতে পারে। এ বিষয়টি তিনি আন্দোলনকারীদের বিবেচনার জন্য বলেছেন। এখন কারও বক্তব্যে, আশ্বাসে আশ্বস্ত হওয়ার সুযোগ নেই। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় ছাড়া এখানে অবস্থান নেওয়া কেউই ঘরে ফিরে যাবে না। মুহূর্তেই তুমুল স্লোগান ওঠে, 'ফাঁসির রায় না নিয়ে ঘরে ফিরে যাব না'। আন্দোলনে অংশ নেওয়া নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ ব্যক্তিগত অনুভূতি জানিয়ে বলেন, অনেক আশ্বাস হয়েছে অতীতে, আর নয়, এবার বাস্তবায়ন ছাড়া ঘরে ফেরা নয়। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করা মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, 'আগে অনেকবার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, পরে তা আঁতাতে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় কোনো আশ্বাসে আর ভুলছি না।' ব্যাংকার আনিসুল ইসলাম বলেছেন, কাজের ফাঁকে যখনই সময় পাচ্ছি, শাহবাগে চলে আসছি। শাহবাগের স্লোগান প্রতি মুহূর্তে টানছে।
আন্দোলনে নানা আয়োজন :শাহবাগ চত্বরের চার পাশে যত বিলবোর্ড ছিল তার প্রায় সবগুলোই এখন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবির বিলবোর্ড। লাল রঙের ব্যানারে কালো অক্ষর, 'যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই'। কয়েকজন তরুণ নিয়ে আসেন একটি কফিন। কফিনে লেখা আছে_ 'রাজাকারের কফিন-পার্সেল ফর পাকিস্তান'। পরে জানা গেল এই তরুণরা বিএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী। তারা বলেন, কফিন প্রস্তুত। রাজাকারের ফাঁসির রায় হলে লাশ আসা মাত্র পাঠিয়ে দেওয়া হবে পাকিস্তানে। আরেক দল তরুণ নিয়ে এসেছে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বীভৎস কার্টুন। তার গলায় লেখা_ 'গোলাম আযম মামু, কল্লা ছিইল্যা লবণ লাগামু'। বের করা হয়েছে শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে একটি কবিতা সংকলন। তরুণ কবিরা তাৎক্ষণিকভাবে লিখেছেন এসব কবিতা। কয়েকজন তরুণ হাতে হাত রেখে গড়েছেন প্রাচীর। সামনে লেখা, এ প্রাচীর ভেঙে রাজাকারের ফাঁসির রায় উপেক্ষা করার সুযোগ কারও নেই।
রাজাকারদের পত্রিকার বিরুদ্ধে ক্ষোভ :গত কয়েকদিন ধরে জামায়াত-শিবিরের মুখপত্র সংগ্রাম, নয়া দিগন্ত ও আমার দেশ পত্রিকায় প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণকে বিষোদ্গার করে সম্পূর্ণ মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে। এ কারণে শনিবার দফায় দফায় পোড়ানো হয় সংগ্রাম, নয়া দিগন্ত আর আমার দেশ পত্রিকার কপি। স্লোগান দেওয়া হয়, 'আ-তে আমার দেশ, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার', 'স-তে সংগ্রাম তুই রাজাকার, তুই রাজাকার, 'দ-তে দিগন্ত তুই রাজাকার, তুই রাজাকার'।
জাতীয় দলের ক্রিকেটার শাহরিয়ার নাফীস শনিবার রাতে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। সঙ্গে তার স্ত্রী ইশিতাও ছিলেন। তিনি সংহতি প্রকাশ করে বলেন, তরুণদের এই আন্দোলনে এসে খুব ভালো লাগছে। সবারই উচিত, এই আন্দোলনে যোগ দেওয়া। শাহরিয়ার নাফীস চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আসেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রখ্যাত শিল্পী আবদুল জব্বার। তিনি গণজাগরণ মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলেন। রাতে আরও সংহতি জানাতে আসেন অভিনয়শিল্পী রাইসুল ইসলাম আসাদ, সাজু খাদেম ও শামস সুমন। রাতে চারটি পয়েন্টে মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র দেখানো হয়।
এদিকে রাতে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের দিন ট্রাইব্যুনালের আশপাশে অবস্থান নেওয়া হবে। রাত ১২টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শাহবাগে হাজার হাজার জনতা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে স্লোগান দিচ্ছিলেন। রাতে ফকির আলমগীরের লেখা নতুন একটি গণসঙ্গীত পরিবেশন করা হয়।
__._,_.___