মুক্তিযুদ্ধ ও নতুন প্রজন্ম
মুক্তিযুদ্ধ কী? মুক্তিযুদ্ধ কেন? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী? এসব সম্পর্কে এখনকার প্রজন্মের অধিকাংশ ছেলেমেয়েরই স্পষ্ট ধারনা নেই। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, এটা জানা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হৃদয়ে ধারন করা দুটোর মাঝে অনেক পার্থক্য। মুক্তিযুদ্ধ শুধু মাত্র একটা ঘটনা নয়, মুক্তিযুদ্ধ এক মহাকাব্যের নাম। সেই মহাকাব্য পাঠ করা এবং তার প্রতিটি শব্দে যে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ রয়েছে তার উত্তাপ অনুভব করার জন্য দরকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঠিক উপস্থাপন। স্বাধীনতার পর গত ৪২ বছরে আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ কে আমাদের সামনে সঠিক রূপে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা ধারন করতে পারিনি আমাদের পূর্ব পুরুষের গৌরব গাথা। যে স্বপ্ন নিয়ে এতগুলো মানুষ জীবন দিয়ে দিলো, আমাদেরকে তা ছুয়ে যেতে পারেনি। নিজের দেশ সম্পর্কে নেতিবাচক কথা শুনে হীনমন্যতায় ভুগেছি। সর্বোপরি বাংলাদেশ নামক দেশটা যে আমার নিজের দেশ, সেই উপলব্ধিটা আমাদের মধ্যে সেভাবে আসেনি।
মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যি কি এদেশে এত ভয়ঙ্কর একটা যুদ্ধ হয়েছিল? যাতে প্রাণ দিয়েছিল ৩০ লক্ষের অধিক লোক। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে এদেশের মানুষ নীরব কেন? তারা কাদছে না কেন? তারা আর্তনাদ করছে না কেন? নাকি তারা শোঁকে পাথর হয়ে গেছে? নাকি তারা মনে করতে চায় না সেই বীভৎস স্মৃতি?
অথবা তারা কি এই মৃত্যু গুলো কে অন্য মৃত্যুর মতোই স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে? যেমন কলেরা বসন্তের মহামারীতে মারা যেত হাজারো মানুষ তারা কি এই মৃত্যুকে সেরকম ভেবেছে? তারা কি ভাবতে পারেনি যে এটা ছিল ঠাণ্ডা মাথায় গণহত্যা? তারা কি ভাবতে পারেনি যে এই গণহত্যা ছিল পুরো জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার একটা প্রয়াস?
হতে পারে তারা ভুলে গেছে, হতে পারে ভাবতে পারেনি, হতে পারে আরও অনেক কিছু। কিন্তু সেসব ভেবে থেমে থাকার দিন আর নেই। আমরা এক সৌভাগ্যবান জাতি। আমরা পেয়েছি সাত রাজার ধন এই স্বাধীনতা। আমাদের স্বাধীনতা আমাদের জীবনের উৎসব। স্বাধীনতা আমাদের হাজার বছরের বাঙালির সমৃদ্ধ সংস্কৃতির মুক্তি। স্বাধীনতা বাঙালি নারীর শেকল ভাঙ্গার গান। স্বাধীনতা বাঙ্গালির গলা ছেড়ে গান গাওয়া, স্বাধীনতা বাঙালি শিল্পীর তুলিতে সাদা ক্যানভাসে মনের রঙ ছড়িয়ে যা খুশি আঁকা, স্বাধীনতা বাঙালি লেখকের দুর্নিবার কলম, কবির বাধভাঙ্গা শব্দস্রোত। স্বাধীনতা মানে মুক্তাকাশে গাংচিলের ডানা মেলা। স্বাধীনতা মানে হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর অবাধ বিচরন। বাঙ্গালির স্বাধীনতা মানে বাঙ্গালির জাতীয়তাবাদ, সাম্যবাদ, মানবতাবাদ, গণতন্ত্র। আমরা পেয়েছি দুর্গম পথ চলার পাথেয়। আমরা এই মহামূল্যবান অর্জনকে হেলায় নষ্ট করতে পারিনা।
কী ছিল মুক্তিযুদ্ধের শপথ? কী ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন? শুধু একটি স্বাধীন ভূখণ্ড নয়, একটি সাম্যবাদী, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক সমাজ। উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা, স্বনির্ভর অর্থনীতি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এই বার্তাগুলো পৌঁছে দিতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এখানেই রয়েছে উন্নত সমাজ গঠনের মূলমন্ত্র। এই চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে। সকল ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্তি দেবে আমাদের এই চেতনা। যেকোনো মূল্যে এই চেতনা সমুন্নত রাখতে হবে। এই চেতনার বিরোধিতাকারী অপশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
ডঃ আহমদ শরীফ তাঁর একটি লেখায় 'বাংলাদেশ কেন উন্নত নয়' এবিষয়ে মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন- বাংলাদেশের মানুষ আসলে স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করার আগেই স্বাধীনতা লাভ করেছে।
বাংলাদেশের মানুষ যে স্বাধীনতা শব্দটির মর্ম বুঝতে পারেনি, তার প্রমাণ আমাদের আশে পাশে তাকালেই পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধকে এখনো অনেকে বলেন গণ্ডগোল বা সংগ্রাম। এদেশের ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকে দেশ সম্পর্কে খারাপ কথা শুনতে শুনতে বড় হয়। মুক্তিযুদ্ধের গৌরব যদি কেউ অনুভব করতে পারে, তার মধ্যে কোন হীনমন্যতা থাকার কথা না। সারাবিশ্বের বুকে বীরের জাতি হিসেবে মাথা উচু করে বাঁচার মত অর্জন আমাদের স্বাধীনতা।
আমাদের দেশের তরুণদের একটা বড় অংশ মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহন করে থাকে। এদেশের শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে কিছু মানুষ এটা মেনে নিতে পারেনা যে মাদ্রাসার ছাত্ররা ও জাতীয় সঙ্গীত গাইবে, মাদ্রাসার মধ্যে শহীদ মিনার হবে এবং সেখানে তারাও অন্যদের মতো ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে। সম্প্রতি শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে বলা হয় যে মাদ্রাসা গুলোতে শহীদ মিনার স্থাপন করতে হবে এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে। স্বাধীনতা বিরোধী জামাত শিবির এটাকে ইসলাম বিরোধী বক্তব্য বলে প্রচার করে এবং বলা বাহুল্য এই অস্র ব্যবহার করে তারা অনেকটাই সফল হয়। কিছু ইসলামী দলের প্রকাশ্য সমর্থনসহ সাধারন ধর্মপ্রাণ মানুষের একাংশের নীরব সমর্থন অর্জন করে। দুঃখজনক হলেও সত্য অনেকেই জাতীয় সঙ্গীত হিন্দু কবির লেখা বলে, সেটা গাইলে গুনাহ হবে মনে করে। শহীদ মিনারে ফুল দেয়াকে তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্র মানুষ ও শিরক মনে করে। যদি এগুলা গুনাহ হয় তাহলে শুধু মাদ্রাসার বেলায় কেন? স্কুলের ছাত্ররা গাইলে বা ফুল দিলে কেন গুনাহ হবে না? জাতীয় সঙ্গীত গাইলে যদি গুনাহ হয় তাহলে বলতে হবে পুরো দেশটাই গুনাহের উপর প্রতিষ্ঠিত। শহীদ মিনারে ফুল দিলে যদি শিরক হয় তাহলে তো বলতে হবে দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকই শিরককারী। এসব প্রচার করে জনসংখ্যার একটা বড় অংশকে দেশপ্রেম বঞ্চিত ধর্মান্ধ কূপমণ্ডূক করে রাখা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকে শিশুদের কাছে পৌঁছে দেবার প্রথম দায়িত্ত হল পরিবারের। আমাদের প্রত্যেকের পরিবারেই এমন দু একজন সদস্য পাওয়া যাবে, যারা প্রত্যক্ষ ভাবে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। অনেকে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন বা অনেকে রয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত। এইসব মানুষের কাছ থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে খুব কমই শুনে থাকি। খুব কম পরিবারই আছে যারা শিশু সন্তান কে তার নিজের দেশ এবং এর গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে বলে থাকেন। এর কারন পরিবারের ওই সদস্যগণ স্বচক্ষে মুক্তিযুদ্ধ দেখলেও, এর প্রকৃত মর্যাদা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
আমাদের বিদ্যালয়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস আমাদের সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ। দেশপ্রেম, মানবপ্রেম এর মত সুন্দর সুন্দর অনুভুতি গুলোর সাথে পরিচিত করাতে আমাদের বিদ্যালয় গুলো খুব কমই ভুমিকা রাখে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়, কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতের সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা অবহিত নয়। জাতীয় সঙ্গীতের গভীর আবেগ তাদেরকে সেভাবে স্পর্শ করেনা। পাঠ্যসূচীতে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম বিষয়ক রচনা পর্যাপ্ত নয়। স্কুল গুলোতে সাংস্কৃতিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনুষ্ঠান এখন কমে গেছে। অনেক জায়গায় স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী জামাত পন্থী কিছু শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তাচ্ছিল্যের সাথে এবং বিকৃত রূপে উপস্থাপন করছে।
বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিবস গুলোতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে কিন্তু এগুলো মূলত শহর কেন্দ্রিক ও ক্ষুদ্র পরিসরে হবার কারনে এসব অনুষ্ঠানের আবেদন সর্বসাধারণের কাছে পৌছতে পারেনা। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়িতে ব্যস্ত। সরকার করে যাচ্ছে ভোট ব্যাংক বাড়ানোর কাজ। ব্যবসায়ীরা পুজি বাড়ানোর খেলায় মত্ত। মিডিয়া প্রচার করে চলেছে বাজার মুখী অনুষ্ঠান। সরকারি কর্মকর্তা গণ ঘুমুচ্ছেন নাকে তেল দিয়ে। বুদ্ধিজীবীরা বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন টাকার কাছে। ছাত্ররা নিজেদেরকে আদর্শ কর্পোরেট চাকর হিসেবে তৈরি করতে ব্যস্ত।
আর সেই সুযোগে 'জাতির পতাকা খামচে ধরছে সেই পুরনো শকুন'। স্বাধীনতা কে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠেছে সেই পুরনো হায়েনার দল।
মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের সাথে বর্তমান প্রজন্মের যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে ঘুচবার নয়। অথচ স্বাধীনতার পূর্ণ সুফল পাবার জন্যে পুরনো প্রজন্মের সাথে নতুন প্রজন্মের এক মেলবন্ধন থাকার কথা ছিল। আশার কথা হল বর্তমান প্রযুক্তির যুগে কোন তথ্যই আর গোপন রাখার উপায় নেই। ইন্টারনেট এর মাধ্যমে আমরা পেয়ে যাচ্ছি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস এবং গুরুত্বপূর্ণ দলিল। যা বহুদিন পর্যন্ত আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। আমরা জানতে পারিনি পূর্ব পুরুষের সঠিক ইতিহাস। আমরা বিভ্রান্ত হয়েছি অপপ্রচারে। কিন্তু সত্য তার নিয়মেই প্রকাশিত হয়েছে। যার ফলে দেশ ব্যাপী গণজাগরণ শুরু হয়েছে। পুরনো পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, বিচার না পাবার হতাশা, পূর্বপুরুষের প্রতি দায় বদ্ধতা সব মিলিয়ে এক গণ বিস্ফোরণ এর সূচনা হয়েছে। এই আমাদের সুযোগ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের দূরত্ব কমিয়ে আনার। আমরা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি অগ্রজদের পানে। আপনারা আমাদের হাত ধরুন, সঠিক পথের নির্দেশনা দিন। পুরনো ভুল আর ব্যর্থতা সংশোধন এর জন্য এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর আসবে না।
- নাদিম আহমেদ
__._,_.___