BANGLADESH বসন্ত অত্যাসন্ন হয়েছে।
Shahadatবাংলা বসন্ত' কি অত্যাসন্ন?
02 August 2013, Friday
তুলিযাঁরা রাজনীতির সামান্য খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা 'আরব বসন্ত' শব্দ দুটির সঙ্গে নিশ্চয় পরিচিত। শব্দ দুটির উদ্ভাবক পশ্চিমা দুনিয়ার গণমাধ্যম। আড়াই বছর আগের কথা। তখন আরব বিশ্বে স্বৈরতন্ত্রের পরিবর্তে গণতন্ত্র প্রবর্তনের দাবিতে জনগণ রাজপথ বা শহরের কেন্দ্রস্থল দখল করে তুমুল গণ-আন্দোলন করছে। বলা বাহুল্য, যারা এই আন্দোলন করছে তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন আর ফ্রান্স। একসময় এই দেশগুলোর সহায়তা আর আশকারায় মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম ও বিকাশ লাভ করেছিল।
কিন্তু একসময় যখন সেসব দেশের মানুষ দেখতে পেল, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কারণে তারা কী ভীষণভাবে শোষিত ও নিপীড়িত হচ্ছে, তখন তারা তাদের শাসকদের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, মিসর প্রভৃতি দেশে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে তারা স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়। কিন্তু বাস্তবে এসব দেশে স্বৈরশাসনের অবসান হলেও বিকল্প কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান না থাকায় সেসব দেশের মানুষ বর্তমানে অনেকটা তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। ইয়েমেন ছাড়া অন্য দেশগুলোতে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের তেমন একটা উৎপাত ছিল না। এসব দেশে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা দল না থাকাতে সেই দেশগুলোতে বর্তমানে ইসলামের নামে জঙ্গিবাদী রাজনীতি গেঁড়ে বসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মনে করা হয়েছিল, মোবারক-উত্তর মিসরে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন হবে, কারণ সেখানে সেই নাসেরের সময় থেকে নিষিদ্ধ থাকলেও মুসলিম ব্রাদারহুড তাদের রাজনীতির ধারা পরিবর্তন করে সুস্থ ধারায় ফিরে এসে মিসরে কিছুটা হলেও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। তারা অন্য নামে (ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকার গঠন করে, কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নতুন ধারার রাজনীতির পরিবর্তে তারা সেই মধ্যযুগীয় রাজনীতিতে ফিরে যেতে আগ্রহী হয় এবং শেষ পর্যন্ত সামরিক বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হয়।
বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, মুরসির নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের জন্য সৌদি বাদশাহ মিসরের সেনাবাহিনীকে প্রচুর অর্থ জোগান দিয়েছিলেন। বিশ্লেষকেরা এখন বলছেন, তথাকথিত আরব বসন্ত অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে এবং যেসব দেশে মনে করা হয়েছিল রাজনৈতিক বসন্ত এসে গেছে, দেখা যাচ্ছে যে সেসব দেশের অবস্থা আগের তুলনায় অনেক খারাপ হয়েছে।
আরব বসন্ত দিয়ে লেখাটা শুরু করার কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশেও বর্তমানে অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারকে হটিয়ে দেশে পুনরায় জামায়াত-বিএনপি জোটকে ক্ষমতায় আনতে পারলে বসন্তের কিছুটা আমেজ পাওয়া যাবে। তাদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে অন্য যেকোনো সরকার শ্রেয়। এখানে জামায়াতের নামটা আগে উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে ঘটনাচক্রে যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারে, তাহলে ক্ষমতায় বিএনপি নয়, আসবে মূলত হেফাজত-সমর্থিত জামায়াত। সংসদে হয়তো বিএনপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে, কিন্তু মূল ক্ষমতা থাকবে জামায়াত আর হেফাজতের হাতে। যাঁরা মনে করেন জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতের একটি মতাদর্শগত পার্থক্য আছে, তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
হেফাজত ঠিকই বোঝে শত্রুর শত্রু আমাদের বন্ধু, সুতরাং আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের নির্বাচনে পরাজিত করতে যা যা করার প্রয়োজন তারা সবটিই করবে। ইতিমধ্যে কোনো রাখঢাখ না করে তারা এই মর্মে ঘোষণাও দিয়েছে।
অন্যদিকে হেফাজতের ভেতরে এখন জেএমবি, হিযবুত তাহ্রীরের মতো জঙ্গিবাদী সংগঠনের সদস্যদের সহজ অনুপ্রবেশ ঘটবে, যেমনটি একাত্তরের পর আলবদর, আলশামসের অনেক সদস্য মওলানা ভাসানীর ন্যাপসহ অনেক অতি বামপন্থী দলে কায়দা করে ঢুকে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতি নিয়ে খালেদা জিয়াসহ খোদ বিএনপির মধ্যেও অনেকে অস্বস্তিতে আছে বলে শুনেছি। তাদের মধ্যে এই ধারণা হয়েছে, সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রকারে যদি আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা যায়, তাহলে জামায়াত দেশে অন্তত তিন মাসের জন্য এক ভয়াবহ তাণ্ডব চালাবে, যার ফলে কয়েক লাখ মানুষ পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদের মধ্যে অনেককে দেশ ত্যাগও করতে হতে পারে।
বিগত ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর বিএনপি আর জামায়াতের ক্যাডাররা দক্ষিণ বঙ্গ, চট্টগ্রাম, পাবনা, যশোর, নোয়াখালী, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, সাধারণ আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকদের ওপর যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, তা অনেককে ১৯৭১ সালের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। এমন তাণ্ডব তারা ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরও ঘটিয়েছিল, তবে ২০০১-এর নির্বাচনের পর সংঘটিত তাণ্ডব আগের তাণ্ডবগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। নির্বাচনের অব্যবহিত পর ক্ষমতায় ছিলেন বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং তারপর খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেছিলেন। তাঁরা সবাই এই তাণ্ডবকে অস্বীকার করেছিলেন।
আগামী নির্বাচনের পর এই দলগুলো সরকার গঠন করলে যে তাণ্ডব সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তা কিন্তু জয় বা পরাজয়কে কেন্দ্র করে নয়, তা হবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত-বিএনপির যে নেতাদের বিচার হচ্ছে, তার পুরো প্রক্রিয়াটাকে বানচাল করার জন্য। শুরু থেকে ট্রাইব্যুনালের বিচার সম্পর্কে বিএনপি তাদের বক্তব্যে কেবল বিচারের তথাকথিত আন্তর্জাতিক মান ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে সীমাবদ্ধ রেখেছে। বলেছে, তারাও একাত্তরের অপরাধীদের বিচার চায়।
তবে তারা পরিষ্কার করেনি তাদের অবস্থান। বলেনি তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরও এই বিচার না করে কেন তারা এই অপরাধের সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত ছিল, তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছে এবং তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছে। এযাবৎ ছয়জন যুদ্ধাপরাধীর সাজা হয়েছে, যার মধ্যে চারজনের মৃত্যুদণ্ড। তা নিয়েও বিএনপি এত দিন মুখ খোলেনি। তবে সম্প্রতি ব্যারিস্টার মওদুদ ও সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক তাঁদের সে অবস্থান থেকে সরে এসে বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে তাঁরা এই পুরো বিষয়টাকে পুনর্বিবেচনা করবেন। বাস্তবে তাঁদের দিয়ে এই কথাগুলো বলানো হয়েছে, আর তাঁদের তা না বলেও উপায় ছিল না। হেফাজতের সমাজবিধ্বংসী ১৩ দফাকে খালেদা জিয়া সমর্থন দিয়েছেন। সুতরাং, ক্ষমতায় গেলে হেফাজত যে তাদের সেই ১৩ দফা বাস্তবায়নে বাধ্য করার চেষ্টা করবে তা বলা বাহুল্য।
অনেকে মনে করেন, ১৮-দলীয় জোট যে বাতিল ঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলন করছে, তা মেনে নিলে বোধ হয় সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তা-ও অনেকটা বোকার স্বর্গে বাস করার শামিল। কারণ, তখন দ্বিগুণ উৎসাহে জামায়াত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অপরাধের কার্যক্রম বন্ধ করে তাদের সব নেতাকে মুক্ত করার আন্দোলনটা আরও সহিংস করবে এবং আরও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হবে। হেফাজতও ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, তারা ঈদের পর সর্বশক্তি দিয়ে তাদের সেই ১৩ দফা আদায়ের লক্ষ্যে মাঠে নামবে। বিএনপির সাদেক হোসেন খোকা লগি-বৈঠার চেয়েও কঠিন পদক্ষেপের হুমকি দিয়ে রেখেছেন। সবাই মিলে যেটি করতে পারে, সেটি হচ্ছে আর একটি ৫ মের শাপলা চত্বর এপিসোড মঞ্চায়নের চেষ্টা করা। হতে পারে এটা হবে কথিত বাংলা বসন্তের সূচনা।
এই রমজান মাসে মধ্যপ্রাচ্যে, সৌদি আরবে, যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাজ্যে জাকাত-ফিতরার নামে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই সময় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষী টিভি চ্যানেল বাংলাদেশে মসজিদ-মাদ্রাসার নামে অর্থ সংগ্রহের জন্য তাদের পুরো ২৪ ঘণ্টাই তহবিল সংগ্রহকারীদের কাছে ভাড়া দিয়ে রেখেছে। ঈদের পর এই অর্থ দেশে আসবে এবং এবার এর বেশির ভাগ ব্যয় হবে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে দেশে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি করার জন্য, অনেকটা এই বাংলা বসন্ত সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে। এই বাংলা বসন্ত যদি সত্যি সত্যি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে তার শেষ পরিণতি কী হতে পারে? এই মুহূর্তে সার্বিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে যা হয়েছে বা হচ্ছে, তার চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার লক্ষণ দেখি না। আবার ধর্মীয় জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাসবাদের উত্থান, আবার বাংলাদেশে গত সাড়ে চার বছরে যা কিছু অর্জন তা জলে ফেলা, বাংলাদেশের আবার একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকার ওপরের দিকে উঠতে থাকা।
এই অবস্থা পরিহার করার জন্য কী করতে পারে বর্তমান সরকার? অবশ্যই প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা। বিএনপিকে বুঝতে হবে তারা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছে, তা বর্তমান সংবিধানের অধীনে সম্ভব নয়। আর তারা বিচারপতি খায়রুল হককেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান চায় না বলে ইতিমধ্যে জানিয়ে রেখেছে। উচ্চ আদালতের রায়েও বিচারপতিদের এই ব্যবস্থা থেকে দূরে রাখার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং, নতুন কিছু করতে হলে তা আলোচনার মাধ্যমে সংসদে গিয়েই করতে হবে। বিএনপি যদি মনে করে, জামায়াত ও হেফাজতকে নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে শান্তিতে থাকবে, তারাও বোকার স্বর্গে বাস করছে। তবে এই লেখাটি যখন লিখছি তখনই খবর পেলাম, আদালত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করেছেন। আপিলেও যদি এই আদেশ বহাল থাকে, তাহলে জামায়াতের নেতাদের অন্য কোনো দলের নামেই নির্বাচন করতে হবে।
আর আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির চেষ্টা থাকতে হবে নির্বাচনে ভালো করা। এসবের কোনো বিকল্প আছে বলে এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে না। সমস্যার সমাধান শান্তিপূর্ণ উপায়ে করতে না পারলে দুই বড় দলের আম আর ছালা উভয়ই হারাতে হতে পারে। বিষয়টি সবাই বিবেচনা করবেন বলে আশা করি।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্লেষক।
কিন্তু একসময় যখন সেসব দেশের মানুষ দেখতে পেল, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কারণে তারা কী ভীষণভাবে শোষিত ও নিপীড়িত হচ্ছে, তখন তারা তাদের শাসকদের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, মিসর প্রভৃতি দেশে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে তারা স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়। কিন্তু বাস্তবে এসব দেশে স্বৈরশাসনের অবসান হলেও বিকল্প কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান না থাকায় সেসব দেশের মানুষ বর্তমানে অনেকটা তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। ইয়েমেন ছাড়া অন্য দেশগুলোতে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের তেমন একটা উৎপাত ছিল না। এসব দেশে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা দল না থাকাতে সেই দেশগুলোতে বর্তমানে ইসলামের নামে জঙ্গিবাদী রাজনীতি গেঁড়ে বসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মনে করা হয়েছিল, মোবারক-উত্তর মিসরে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন হবে, কারণ সেখানে সেই নাসেরের সময় থেকে নিষিদ্ধ থাকলেও মুসলিম ব্রাদারহুড তাদের রাজনীতির ধারা পরিবর্তন করে সুস্থ ধারায় ফিরে এসে মিসরে কিছুটা হলেও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। তারা অন্য নামে (ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকার গঠন করে, কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নতুন ধারার রাজনীতির পরিবর্তে তারা সেই মধ্যযুগীয় রাজনীতিতে ফিরে যেতে আগ্রহী হয় এবং শেষ পর্যন্ত সামরিক বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হয়।
বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, মুরসির নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের জন্য সৌদি বাদশাহ মিসরের সেনাবাহিনীকে প্রচুর অর্থ জোগান দিয়েছিলেন। বিশ্লেষকেরা এখন বলছেন, তথাকথিত আরব বসন্ত অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে এবং যেসব দেশে মনে করা হয়েছিল রাজনৈতিক বসন্ত এসে গেছে, দেখা যাচ্ছে যে সেসব দেশের অবস্থা আগের তুলনায় অনেক খারাপ হয়েছে।
আরব বসন্ত দিয়ে লেখাটা শুরু করার কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশেও বর্তমানে অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারকে হটিয়ে দেশে পুনরায় জামায়াত-বিএনপি জোটকে ক্ষমতায় আনতে পারলে বসন্তের কিছুটা আমেজ পাওয়া যাবে। তাদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে অন্য যেকোনো সরকার শ্রেয়। এখানে জামায়াতের নামটা আগে উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে ঘটনাচক্রে যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারে, তাহলে ক্ষমতায় বিএনপি নয়, আসবে মূলত হেফাজত-সমর্থিত জামায়াত। সংসদে হয়তো বিএনপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে, কিন্তু মূল ক্ষমতা থাকবে জামায়াত আর হেফাজতের হাতে। যাঁরা মনে করেন জামায়াতের সঙ্গে হেফাজতের একটি মতাদর্শগত পার্থক্য আছে, তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
হেফাজত ঠিকই বোঝে শত্রুর শত্রু আমাদের বন্ধু, সুতরাং আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের নির্বাচনে পরাজিত করতে যা যা করার প্রয়োজন তারা সবটিই করবে। ইতিমধ্যে কোনো রাখঢাখ না করে তারা এই মর্মে ঘোষণাও দিয়েছে।
অন্যদিকে হেফাজতের ভেতরে এখন জেএমবি, হিযবুত তাহ্রীরের মতো জঙ্গিবাদী সংগঠনের সদস্যদের সহজ অনুপ্রবেশ ঘটবে, যেমনটি একাত্তরের পর আলবদর, আলশামসের অনেক সদস্য মওলানা ভাসানীর ন্যাপসহ অনেক অতি বামপন্থী দলে কায়দা করে ঢুকে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতি নিয়ে খালেদা জিয়াসহ খোদ বিএনপির মধ্যেও অনেকে অস্বস্তিতে আছে বলে শুনেছি। তাদের মধ্যে এই ধারণা হয়েছে, সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো প্রকারে যদি আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা যায়, তাহলে জামায়াত দেশে অন্তত তিন মাসের জন্য এক ভয়াবহ তাণ্ডব চালাবে, যার ফলে কয়েক লাখ মানুষ পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদের মধ্যে অনেককে দেশ ত্যাগও করতে হতে পারে।
বিগত ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর বিএনপি আর জামায়াতের ক্যাডাররা দক্ষিণ বঙ্গ, চট্টগ্রাম, পাবনা, যশোর, নোয়াখালী, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, সাধারণ আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকদের ওপর যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, তা অনেককে ১৯৭১ সালের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। এমন তাণ্ডব তারা ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরও ঘটিয়েছিল, তবে ২০০১-এর নির্বাচনের পর সংঘটিত তাণ্ডব আগের তাণ্ডবগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। নির্বাচনের অব্যবহিত পর ক্ষমতায় ছিলেন বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং তারপর খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেছিলেন। তাঁরা সবাই এই তাণ্ডবকে অস্বীকার করেছিলেন।
আগামী নির্বাচনের পর এই দলগুলো সরকার গঠন করলে যে তাণ্ডব সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তা কিন্তু জয় বা পরাজয়কে কেন্দ্র করে নয়, তা হবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত-বিএনপির যে নেতাদের বিচার হচ্ছে, তার পুরো প্রক্রিয়াটাকে বানচাল করার জন্য। শুরু থেকে ট্রাইব্যুনালের বিচার সম্পর্কে বিএনপি তাদের বক্তব্যে কেবল বিচারের তথাকথিত আন্তর্জাতিক মান ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে সীমাবদ্ধ রেখেছে। বলেছে, তারাও একাত্তরের অপরাধীদের বিচার চায়।
তবে তারা পরিষ্কার করেনি তাদের অবস্থান। বলেনি তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরও এই বিচার না করে কেন তারা এই অপরাধের সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত ছিল, তাদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছে এবং তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছে। এযাবৎ ছয়জন যুদ্ধাপরাধীর সাজা হয়েছে, যার মধ্যে চারজনের মৃত্যুদণ্ড। তা নিয়েও বিএনপি এত দিন মুখ খোলেনি। তবে সম্প্রতি ব্যারিস্টার মওদুদ ও সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক তাঁদের সে অবস্থান থেকে সরে এসে বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে তাঁরা এই পুরো বিষয়টাকে পুনর্বিবেচনা করবেন। বাস্তবে তাঁদের দিয়ে এই কথাগুলো বলানো হয়েছে, আর তাঁদের তা না বলেও উপায় ছিল না। হেফাজতের সমাজবিধ্বংসী ১৩ দফাকে খালেদা জিয়া সমর্থন দিয়েছেন। সুতরাং, ক্ষমতায় গেলে হেফাজত যে তাদের সেই ১৩ দফা বাস্তবায়নে বাধ্য করার চেষ্টা করবে তা বলা বাহুল্য।
অনেকে মনে করেন, ১৮-দলীয় জোট যে বাতিল ঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলন করছে, তা মেনে নিলে বোধ হয় সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তা-ও অনেকটা বোকার স্বর্গে বাস করার শামিল। কারণ, তখন দ্বিগুণ উৎসাহে জামায়াত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অপরাধের কার্যক্রম বন্ধ করে তাদের সব নেতাকে মুক্ত করার আন্দোলনটা আরও সহিংস করবে এবং আরও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হবে। হেফাজতও ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, তারা ঈদের পর সর্বশক্তি দিয়ে তাদের সেই ১৩ দফা আদায়ের লক্ষ্যে মাঠে নামবে। বিএনপির সাদেক হোসেন খোকা লগি-বৈঠার চেয়েও কঠিন পদক্ষেপের হুমকি দিয়ে রেখেছেন। সবাই মিলে যেটি করতে পারে, সেটি হচ্ছে আর একটি ৫ মের শাপলা চত্বর এপিসোড মঞ্চায়নের চেষ্টা করা। হতে পারে এটা হবে কথিত বাংলা বসন্তের সূচনা।
এই রমজান মাসে মধ্যপ্রাচ্যে, সৌদি আরবে, যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাজ্যে জাকাত-ফিতরার নামে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই সময় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষী টিভি চ্যানেল বাংলাদেশে মসজিদ-মাদ্রাসার নামে অর্থ সংগ্রহের জন্য তাদের পুরো ২৪ ঘণ্টাই তহবিল সংগ্রহকারীদের কাছে ভাড়া দিয়ে রেখেছে। ঈদের পর এই অর্থ দেশে আসবে এবং এবার এর বেশির ভাগ ব্যয় হবে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে দেশে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি করার জন্য, অনেকটা এই বাংলা বসন্ত সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে। এই বাংলা বসন্ত যদি সত্যি সত্যি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে তার শেষ পরিণতি কী হতে পারে? এই মুহূর্তে সার্বিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যে যা হয়েছে বা হচ্ছে, তার চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার লক্ষণ দেখি না। আবার ধর্মীয় জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাসবাদের উত্থান, আবার বাংলাদেশে গত সাড়ে চার বছরে যা কিছু অর্জন তা জলে ফেলা, বাংলাদেশের আবার একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকার ওপরের দিকে উঠতে থাকা।
এই অবস্থা পরিহার করার জন্য কী করতে পারে বর্তমান সরকার? অবশ্যই প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা। বিএনপিকে বুঝতে হবে তারা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছে, তা বর্তমান সংবিধানের অধীনে সম্ভব নয়। আর তারা বিচারপতি খায়রুল হককেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান চায় না বলে ইতিমধ্যে জানিয়ে রেখেছে। উচ্চ আদালতের রায়েও বিচারপতিদের এই ব্যবস্থা থেকে দূরে রাখার কথা বলা হয়েছে। সুতরাং, নতুন কিছু করতে হলে তা আলোচনার মাধ্যমে সংসদে গিয়েই করতে হবে। বিএনপি যদি মনে করে, জামায়াত ও হেফাজতকে নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে শান্তিতে থাকবে, তারাও বোকার স্বর্গে বাস করছে। তবে এই লেখাটি যখন লিখছি তখনই খবর পেলাম, আদালত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করেছেন। আপিলেও যদি এই আদেশ বহাল থাকে, তাহলে জামায়াতের নেতাদের অন্য কোনো দলের নামেই নির্বাচন করতে হবে।
আর আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির চেষ্টা থাকতে হবে নির্বাচনে ভালো করা। এসবের কোনো বিকল্প আছে বলে এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে না। সমস্যার সমাধান শান্তিপূর্ণ উপায়ে করতে না পারলে দুই বড় দলের আম আর ছালা উভয়ই হারাতে হতে পারে। বিষয়টি সবাই বিবেচনা করবেন বলে আশা করি।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্লেষক।
উৎসঃ প্রথম আলো
__._,_.___