18 Sep, 2013
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নৌকা ডুববে না, নৌকা ডোবে না। নুহ নবীর সময় নৌকায় মানুষ চড়ে রক্ষা পেয়েছিল। ঝড়-ঝাপ্টায় এই নৌকা জেগে থাকবে। বাংলার মানুষকেও রাজাকার, খুনি থেকে নৌকা বাঁচিয়েছে। নৌকাই বাঁচাবে।
'বিএনপির হৃদয়ে পেয়ারে পাকিস্তান' মন্তব্য করে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না। তাই এসএসসিতেও তিনি কেবল উর্দুতে পাস করেছিলেন। তিনি আসলে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন চান না। তিনি আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন চান।
'খালেদা জিয়া ছিলেন দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন। হাওয়া ভবন খুলে তিনি এতিমের টাকা চুরি করেছেন' অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রীর উদ্দেশে বলেন, 'আপনি যদি এতিমের টাকা চুরি করে না-ই খাবেন, তাহলে পালিয়ে বেড়ান কেন? মামলার শুনানির দিন হলেই পালান কেন? সাহস থাকলে আর চুরি না করে থাকলে আদালতের মুখোমুখি হন।'
'বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার পেছনে বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাত আছে' বলে অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচন হবেই হবে দাবি করে বলেন, বিএনপির সাধ্য নেই নির্বাচন বানচাল করার। ষড়যন্ত্র করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। বাংলার মাঠিতে এ বিচারের রায় কার্যকর হবেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সিলেটের গোলাপগঞ্জে ১২টি উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও উদ্বোধন শেষে স্থানীয় এমসি একাডেমি মাঠে এক জনসভায় এসব কথা বলেন।
এতে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, খালেদা জিয়া বলছেন, ভিন্নভাবে দেশ চালাবেন। তারা ক্ষমতায় গেলে হাওয়া ভবনের বদলে নতুন ভবন খুলে নতুনভাবে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করবে।
আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেন, বিএনপি বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করেছিল। আমরা সেই কলঙ্ক থেকে দেশকে মুক্ত করেছি। বিএনপি নেত্রী বলেছেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে শান্তি দেবেন। তিনি কেমন শান্তি দেবেন তা আমরা জানি, তার শান্তি হলো বোমা হামলার শান্তি, মানুষ হত্যার শান্তি।
তিনি বলেন, আমি গোপালগঞ্জের মেয়ে এসেছি গোলাপগঞ্জে। লাখো গোলাপে ভরে গেছে এই মাঠ। গত নির্বাচনে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় আরও বলেন, যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাংলার মাটিতেই হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন এবং অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশকে একটি সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে আমরা আবারও আপনাদের ভোট চাই।
শেখ হাসিনা বলেন, আগের মেয়াদে আমরা বিদ্যুত্ ও গ্যাসের উত্পাদন বাড়িয়েছিলাম। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে বোমা হামলা ও জঙ্গি হামলার দেশে পরিণত করেছিল। আমাকেও হত্যা করতে চেয়েছিল; কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমি বেঁচে গেছি।
তিনি বিএনপির সভানেত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, উনি নাকি সংখ্যালঘুবান্ধব। কিন্তু উনার আমলে সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীন ছিল। তিনি বলে বেড়াচ্ছেন নির্বাচন নাকি করতে দেবেন না। আওয়ামী লীগ অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে জানে। করেও দেখাবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি সরকার সন্ত্রাস, ক্ষুধা আর দুর্নীতি ছাড়া কিছুই দিতে পারে না। সিলেট বিএনপি নেত্রীর বেয়াইর বাড়ি। তারেক জিয়ার শ্বশুরবাড়ি। তাই খাম্বা চুরি করে তারা সিলেটের রাস্তার পাশে ফেলে রেখেছে কিন্তু বিদ্যুত্ দিতে পারেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে বিদ্যুত্ দিয়েছে। আমরা প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছি।
তিনি বলেন, এখন মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট। মোবাইল ফোনে থ্রিজি চালু করেছি। কৃষকের জন্য মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ করে দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা বলেছিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ করব, আমরা তা করেছি। ৪০ লাখ শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাচ্ছে। আমরা কাজ করতে চাই, উন্নয়ন করতে চাই। তাই আজ অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেছি। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আমরা দীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বলেছিলাম, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব। আমরা তা করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে রায়ও হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিএনপি ইসলামের কথা বলে, বায়তুল মোকাররম মসজিদে আগুন দেয়। কোরআন-জায়নামাজ পোড়ায়। যারা মসজিদে আগুন দেয়, যারা কোরআন শরীফ পোড়ায়, তারা কোন ইসলামে বিশ্বাস করে? তারা কীভাবে ইসলামের হেফাজত করবে?
'বিএনপি বলেছিল শেখ হাসিনা পালাবার পথ পাবে না।' শেখ হাসিনা কখনো পালানোর চিন্তা করে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও পালাইনি। খালেদা জিয়া বলে বেড়াচ্ছেন, উনি নাকি ভোট চান না। তাহলে উনি কী চান? সন্ত্রাস চান? জঙ্গিবাদ চান? কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এসব চায় না। বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন চায়। আর আওয়ামী লীগ এলেই এদেশে উন্নয়ন হয়। আজ তারা নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কথা বলছে। অথচ আমাদের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সব দলের সঙ্গে আলোচনা করেই এই নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। এই আলোচনায় খালেদা জিয়াও অংশ নিয়েছিলেন।
খালেদা জিয়া আসলে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন চান না। তিনি আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন চান— অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে একটি নির্বাচন নিয়েও কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। আওয়ামী লীগের দ্বারাই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। কারণ আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। জনগণের ভোটাধিকারে বিশ্বাস করে।
তিনি বলেন, নূহ নবীর নৌকায় উঠে মানুষ বেঁচেছিল। আওয়ামী লীগের নৌকায় উঠেও বাংলার মানুষের উন্নতি হয়েছে। নৌকা কখনো ডুববে না। ডুবলে আবার জেগে উঠবে। নৌকা মার্কা বাংলাদেশের জনগণের মার্কা।
বাংলাদেশের মানুষকে যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, জঙ্গি, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজদের কবল থেকে নৌকাই তীরে নিয়ে যাবে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী সমবেত জনতার উদ্দেশে আরও বলেন, আপনারা ভোট দিয়ে যদি আমাদের আবার জয়যুক্ত করেন, তবে এই এলাকার সব দাবি-দাওয়া পূরণ করার অঙ্গীকার করছি। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলব। বিএনপি নেত্রীর সাধ্য নেই নির্বাচন বানচাল করার। আমরা তা হতে দেব না। আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদের বিজয়ী করবেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী নৌকা মার্কায় ভোট দিতে সভাস্থলের সবাইকে হাত তুলে ওয়াদা করান।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এ সরকারের আমলে দেশে কোথাও বোমা হামলা হয়নি। জঙ্গি হামলা হয়নি। দেশে শান্তি বিরাজ করছে। মানুষের আয় বেড়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে যে উন্নয়ন এই সরকারের আমলে হয়েছে, তা গত একশ' বছরেও হয়নি।
দফতরবিহীনমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, শেখ হাসিনা ভোটের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন। জনগণের অধিকারে বিশ্বাস করেন। সংবিধানে বিশ্বাস করেন। তাই তিনি মানুষের ভোটের অধিকার ও সংবিধান সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে ১ হাজার ৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৬৮টি উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজারের ঘরে ঘরে গ্যাস সংযোগ দেয়ার দাবি পূরণ করা হবে।
সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, উপদেষ্টা সৈয়দ আবু নছর, শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুজ জহির চৌধুরী সুফিয়ান, মহানগর সভাপতি বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, জেলা সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী এমপি, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ, হাফিজ আহমদ মজুমদার এমপি, হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু জহির এমপি, মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী এমপি, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুব্রত পুরকায়স্থ, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান, বিয়ানীবাজার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান খান, গোলাপগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জাকারিয়া আহমদ পাপলু, গোলাপগঞ্জ আওয়ামী লীগ নেতা এমএ ছালিক, গোলাপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বেগম শীলা।
সভার শুরুতে কোরআন তেলাওয়াত করেন সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ চৌধুরী। শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে গোলাপগঞ্জ এমসি একাডেমি মাঠ লোকেলোকারণ্য হয়ে ওঠে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতকাল বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটে হেলিকপ্টারযোগে গোলাপগঞ্জে এসে পৌঁছান। তিনি সভামঞ্চে যান ৩টা ৫৮ মিনিটে। গোলাপগঞ্জ পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফিতা কেটে একসঙ্গে ১২টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে এসে পৌঁছলে মুহুর্মুহু করতালিতে জনতা তাকে স্বাগত জানায়। এ সময় তিনি হাত নেড়ে কানায় কানায় পূর্ণ মাঠের জনতার প্রতি উষ্ণ অভিনন্দন জানান।
এর আগে সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট এসে পৌঁছে জালালাবাদ সেনানিবাসে ১৭ পদাতিক ডিভিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে বিমান বাহিনীর একটি ফ্লাইটে তিনি সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান সিলেটের আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানানোর সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, সংসদ সদস্য জেবুন্নেছা হক, শফিকুর রহমান চৌধুরী, মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েছ, সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ প্রমুখ।
প্রধানমন্ত্রী সাতটি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও পাঁচটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ব্যয় হবে প্রায় চারশ' কোটি টাকা।
সভায় সভাপতিত্ব করেন গোলাপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবাল আহমদ চৌধুরী। সভা পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ।
উৎসঃ আমার দেশ