Banner Advertiser

Monday, September 9, 2013

[mukto-mona] আমাদের জাতীয় চেতনায় রবীন্দ্রনাথ



 
 

আমাদের জাতীয় চেতনায় রবীন্দ্রনাথ

আত্মপক্ষ

রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩, ০৪:৪৮ অপরাহ্ন


এবনে গোলাম সামাদ

রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা ছিল বহুমুখী। কিন্তু তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন কবি হিসেবে। আর তাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনো আলোচনায়, বিশেষ করে সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনায় প্রশ্ন ওঠে কবিতার স্বরূপ নিয়ে। বিলাতের কবি S T Coleridge (১৭৭২-১৮৩৪) কবিতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছেনÑ The best words in their best order. অর্থাৎ কবিতা হলো সুন্দর শব্দগুলোর সুচারু বিন্যাস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিদ্ধ কবি Robert Frost (১৯৭৪-১৯৬৩) বলেছেনÑ A performance in words. অর্থাৎ কবিতা হলো শব্দ সাজানোর কৃতিত্ব। সেই সাথে অবশ্য তিনি আরো বলেছেনÑ Saying one thing and meaning another. অর্থাৎ কবিতা হলো রূপকল্প (Imagery) নির্ভর। কবিরা এক কথা বলে আরেক কথা বোঝান। এর মাধ্যমে ফুটে ওঠে ভাব প্রকাশের তীব্রতা। রূপকল্প ছাড়া ভালো কবিতা হতে চায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতা বাংলা থেকে নিজেই ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। কিন্তু তার অনুবাদকে বিশেষভাবে পরিমার্জনা প্রদান করেন আইরিশ কবি W B Yeats (১৮৬৫-১৯৩৯)। ইয়েটস নিজেও ছিলেন খুবই বড় মাপের কবি। ইয়েটস তার নিজের লেখা কবিতার জন্য ১৯২৩ সালে নোবেল প্রাইজ পান। অনেকে মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদে ইয়েটসের পরিমার্জনা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের পক্ষে পাওয়া সম্ভব হতো না নোবেল প্রাইজ। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদে (Song Offerings) ইয়েটসের হাত ছিল বলে তা হতে পেরেছিল বিশ্বসভায় আদৃত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিহ্নিত হতে পেরেছিলেন একজন বড় কবি হিসেবে। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলি আর বাংলা গীতাঞ্জলি এক নয়। ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে আছে রবীন্দ্রনাথের লেখা অন্য কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া একাধিক কবিতা। রবীন্দ্রনাথের Song Offerings বিলেতে প্রকাশিত হয় ১৯১২ সালে। রবীন্দ্রনাথকে নোবেল প্রাইজ দেয়া হয় ১৯১৩ সালে। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ করেন Paul Andre Gide (১৮৬৯-১৯৫১)। তিনি ছিলেন সে সময়ের ফ্রান্সের একজন শ্রেষ্ঠ অনুবাদক। পরে তিনি সাহিত্যিক হিসেবেও প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি তার নিজের লেখার জন্য ১৯৪৭ সালে নোবেল প্রাইজ পান। আঁদ্রে জিদের ফরাসি অনুবাদ ইউরোপে রবীন্দ্রনাথকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে বিপুলভাবে সাহায্য করেছিল। কারণ ফরাসি ভাষার ছিল সারা ইউরোপে বিপুল প্রভাব। ফরাসি ভাষার সাহিত্য সম্পদ ছিল এবং এখনো হয়ে আছে খুবই খ্যাত। ফরাসি ভাষা আর ইংরেজি ভাষার মধ্যে ব্যাকরণের দিক থেকে একটা বড় পার্থক্য হলো, ফরাসি ভাষায় স্ত্রীলিঙ্গ ও পুংলিঙ্গের ব্যবহার। স্ত্রীলিঙ্গ ও পুংলিঙ্গের জটিলতা কতকটা হিন্দি ভাষারই মতো। হিন্দি ভাষায় 'দাড়ি' শব্দটি হলো স্ত্রীলিঙ্গ। তাই বলতে হয় 'লম্বি দাড়ি'। যদিও দাড়ি স্ত্রীলোকের হয় না। ফরাসি ভাষায় Police হলো স্ত্রীলিঙ্গ। ছেলেপুলিশ হলেও তাই বলতে হয় La police। আন্দ্রে জিদ বলেছেন, ইংরেজি থেকে ফরাসি ভাষায় গীতাঞ্জলির অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি পড়েছিলেন বেশ কিছুটা অসুবিধায়। কারণ কবি পুরুষ না নারী, সেটা ঠিক করা হয়ে উঠেছিল তার পক্ষে কষ্টকর। কারণ বিধাতার প্রতি কবির আকুতিতে পুরুষের ভাব ফুটে ওঠেনি। ফুটে উঠেছে যেন কোনো নারীর আকুতি। আমরা জানি, বাউলেরা অনেক সময় মেয়েদের সাজে নিজেকে সাজায়। আর বিধাতার কাছে আত্মনিবেদন করে, সে যেন একজন নারী; এভাবেই। রবীন্দ্র কাব্যেও আছে বাউল প্রভাব।
 
রবীন্দ্র কাব্য নিয়ে আমরা আলোচনা বিশদ করতে চাই না। আমরা যা আলোচনা করতে চাই, তা হলো রবীন্দ্রনাথকে অনেকে এখন তুলে ধরার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে। এর মূলে ঐতিহাসিক সত্য নেই। ক'দিন আগে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের লেখা একটি বই আমার হাতে পড়ল। বইটির নাম 'একজন ভারতীয় বাঙালির আত্মসমালোচনা'। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৫ সালে। আমার পড়তে দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু বইটি পড়ে আমার মনে হতে পেরেছে বিশেষ প্রতিক্রিয়া। আর এ কারণেই আমি করতে চাচ্ছি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কিছু আলোচনা। বর্তমান আলোচনা রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে হবে না; হবে দেশে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে এক ধরনের বিশেষ রাজনীতি করার চেষ্টা হচ্ছে তার প্রতিপক্ষে কিছু বলার। হাবিবুর রহমান সাহেবের মতে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন আদর্শ আত্মসমালোচক। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির সমালোচনা করেছেন। এই সমালোচনার দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি তার বইতে রবীন্দ্রনাথের চৈতালি কাব্যগ্রন্থ থেকে 'বঙ্গমাতা' নামক কবিতাটি উদ্ধৃত করেছেন। আমরাও আমাদের আলোচনার সুবিধার জন্য ওই কবিতাটিকে উদ্ধৃত করছি। পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমিÑ তব গৃহক্রোড়ে। চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে। দেশদেশান্তরÑ মাঝে যার যেথা স্থান খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান। পদে পদে ছোট ছোট নিষেধের ডোরে বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালো ছেলে করে। প্রাণ দিয়ে, দুঃখ সয়ে, আপনার হাতে সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দÑ সাথে। শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে। দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া করে। সাত কোটি সন্তানের, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করেÑ মানুষ কর নি ॥ কিন্তু কবিতাটি পড়ে খটকা লাগে, রবীন্দ্রনাথ এখানে বাঙালি বলতে ঠিক কাদের বুঝিয়েছেন। কারণ হিন্দুধর্মে সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ। কিন্তু মুসলমান ধর্মে তা নয়। বাংলাভাষী মুসলমানেরা জাহাজে চাকরি নিয়েছে এবং করেছে সমুদ্রযাত্রা। এ ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমান বাংলাভাষীর মানসিকতা এক ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেন এক করে ফেলতে চেয়েছেন উভয়ের মানসিকতাকে। কুরআন শরিফে বলা হয়েছেÑ সমুদ্রে মাছ ধরে খেতে। বাংলাদেশে সমুদ্র তীরবর্তী মুসলমানেরা জীবন বিপন্ন করেও সমুদ্রে মাছ ধরেছে। তাই তাদের সম্পর্কে রবীন্দ্র-বচন গ্রহণীয় নয়। রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে ধরা পড়েছে তার বিখ্যাত 'শিবাজি-উৎসব' কবিতায়। তিনি এই কবিতায় বলেছেনÑ শিবাজি এই উপমহাদেশ চেয়েছিলেন হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে, যা আসলে হতো ধর্মরাষ্ট্র। কিন্তু তার এই কথার সাথে বাংলাভাষী মুসলমান চিন্তক ব্যক্তিরা একমত হতে পারেননি। তারা রবীন্দ্রনাথকে করেছেন তার এই ধারণার জন্য বিশেষ সমালোচনা। মারাঠা সৈন্যরা বাংলাদেশে এসে করেছিল ভয়াবহ লুটপাট, যা এখনো খ্যাত হয়ে আছে বর্গির হাঙ্গামা হিসেবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে মনে হয় বর্গিরা (মারাঠা ঘোড়সওয়ার সৈন্যরা) ছিল খুবই আদর্শনিষ্ঠ; যার পশ্চাতে কোনো ঐতিহাসিক সত্য নেই। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ তার যৌবনের প্রারম্ভে একজন মারাঠি কিশোরীকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা কোনো কারণে সম্ভব হয়নি। এই সময় রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহারাষ্ট্রে (বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে) উচ্চ সরকারি কর্মে নিযুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ থাকতেন তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার কাছে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম আইসিএস ক্যাডারভুক্ত সরকারি কর্মচারী। তার আগে এই সৌভাগ্য আর কোনো ভারতীয়ের হয়নি। রবীন্দ্রনাথও এক সময় স্বপ্ন দেখেছিলেন তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মতোই উচ্চ সরকারি কর্মচারী হওয়ার। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে মারাঠি-প্রীতি ছিল সহজাত। বর্গির হাঙ্গামার কথা তিনি ভেবে দেখার অবকাশ পাননি। তাই তিনি তার 'শিবাজি-উৎসব' কবিতায় বলতে পেরেছেনÑ সেদিন শুনিনি কথাÑ আজ মোরা তোমার আদেশ শির পাতি লব। কণ্ঠে কণ্ঠে বক্ষে বক্ষে ভারতে মিলিবে সর্বদেশ ধ্যানমন্ত্রে তব। ধ্বজা ধরি উড়াইব বৈরাগীর উত্তরীবসনÑ দারিদ্র্যের বল। 'একধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে' এ মহাবচন করিব সম্বল। মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙালি, এক কণ্ঠে বলো 'জয়তু শিবাজি'। মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙালি এক সঙ্গে চলো মহোৎসবে সাজি। আজি এক সভাতলে ভারতের পশ্চিম-পুরব দক্ষিণে ও বামে একত্রে করুক ভোগÑ একসাথে একটি গৌরব এ পুণ্য নামে। মারাঠিরা এখনো হয়ে আছে ভয়ঙ্কর মুসলিমবিদ্বেষী। তাই ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর আমরা দেখতে পেলাম মহারাষ্ট্র থেকে শিবসেনাদের এসে বাবরি মসজিদ ভাঙার কাজে অংশ নিতে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার পিতামহ ও পিতার মতো ব্রাহ্মসমাজভুক্ত। রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে। ব্রাহ্মরা মনে করতেন, ঈশ্বর এক এবং তিনি নিরাকার এবং মূর্তিপূজা করা ধর্মসিদ্ধ নয়। এ বিষয়ে ব্রাহ্মরা হিন্দুসমাজ থেকে পৃথক হয়ে গড়েন নিজেদের সমাজ। কিন্তু রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। এক ভাগকে বলা হতে থাকে আদি ব্রাহ্মসমাজ। আরেক ভাগকে বলা হতে থাকে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ এবং তৃতীয় ভাগকে বলা হতে থাকে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ। আদি ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা করেন কেশবচন্দ্র সেন। আর সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। আদি ব্রাহ্মসমাজ আসলে হয়ে উঠেছিল প্রায় হিন্দুদেরই মতো। আদি ব্রাহ্মসমাজ হিন্দু সমাজের মতো বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় বিশ্বাস করত। কিন্তু ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ছিল অনেক উদার। এই সমাজভুক্তরা বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে সমর্থন জানাতেন না। এই সমাজের একজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন গিরিশচন্দ্র সেন। গিরিশচন্দ্র কুরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করেন ফারসি অনুবাদ থেকে। আর মুসলমানদের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন ভাই গিরিশচন্দ্র হিসেবে। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ জাতিভেদ প্রথা মানত না। তারা ছিলেন বহুবিবাহ এবং বাল্যবিবাহের বিরোধী এবং নারী শিক্ষার পক্ষপাতী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৪ সাল থেকে বহু দিন আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন এবং রচনা করেন অনেক ব্রহ্মসঙ্গীত; যা গান হিসেবে এখনো খ্যাত হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বীরভূম জেলার বোলপুরে ২০ বিঘা জমি ক্রয় করেন। এই জমির ওপরে তিনি একটি একতলা বাড়ি নির্মাণ করেন এবং তার নাম দেন শান্তিনিকেতন। রবীন্দ্রনাথ এখানে স্থাপন করেন 'ব্রহ্মচর্যাশ্রম' নামে একটি আবাসিক বিদ্যালয় (১৯০১)। এই বিদ্যালয়ে নিম্নবর্ণের কোনো হিন্দু অথবা মুসলমান ছাত্রের পড়ার কোনো অধিকার ছিল না। পরে রবীন্দ্রনাথ এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন, যার নাম দেন বিশ্বভারতী। বিশ্বভারতী গড়ার জন্য একপর্যায়ে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। রবীন্দ্রনাথ চাঁদা চান বিভিন্ন দেশীয় রাজন্যবর্গের কাছে। কিন্তু তারা বিশেষ কোনো সাড়া দেননি। কেবল হায়দরাবাদের নিজাম প্রদান করেন চাঁদা হিসেবে এক লাখ টাকা। এক লাখ টাকা সেদিন ছিল অনেক টাকা। আজকের এক লাখ টাকার সাথে তার তুলনা হয় না। এই চাঁদা পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীতে হাতেগোনা কিছু মুসলমান ছাত্রের পড়ার ব্যবস্থা করেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান হলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। রবীন্দ্রনাথের জমিদারি ছিল নওগাঁর পতিসরে। কিন্তু তিনি পতিসরের কৃষক প্রজাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের কোনো উদ্যোগ নেননি। রবীন্দ্রনাথের সেরেস্তায় মুসলমান কৃষক প্রজারা খাজনা দিতে এলে তাদের বসতে বলা হতো না। তাদের থাকতে হতো দাঁড়িয়ে। পতিসরে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ির ঠিক পেছনে ছিল একটা বিরাট দিঘি। দিঘিটা এখনো আছে। এই দিঘিতে ছিল না কোনো মুসলমান কৃষক প্রজার স্নান করবার অধিকার। পতিসরে রবীন্দ্রনাথের জমিদারির সেরেস্তায় যারা কাজ করত তারা ছিল ভয়ঙ্কর অসাধু। তারা কেবল খাজনা আদায় করেই খুশি হতো না। আদায় করত বাড়তি টাকা বা আবওয়াব। এ ছাড়া মাঝে মাঝে তারা আদায় করত নজরানা। রবীন্দ্রনাথ দূর আর্জেন্টিনায় যাওয়ার আগে প্রজাদের কাছ থেকে নিয়েছিলেন নজরানা। তিনি আর্জেন্টিনায় গিয়েছিলেন কেবল দেশ দেখতেই নয়, গিয়েছিলেন ভিক্টর ওকাম্পো নামে এক মহিলাকে দেখতে, যার সাথে তার প্রথম পরিচয় ঘটে কলকাতা শহরে। এ ছিল জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের পরিচয়। তবে তিনি পতিসরে বসে লিখেছিলেন 'হতভাগ্যের গান' নামক কবিতা, যার প্রথম কয়েক ছত্র হচ্ছে এ রকমÑ কিসের তরে অশ্রু ঝরে, কিসের লাগি দীর্ঘশ্বাস! হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস। রিক্ত যারা সর্বহারা সর্বজয়ী বিশ্বে তারা, গর্বময়ী ভাগ্যদেবীর নয়কো তারা ক্রীতদাস। হাস্যমুখে অদৃষ্টেরে করব মোরা পরিহাস ॥ কবিতাটি পড়ে মনে হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সর্বহারাদেরই পক্ষে। কিন্তু তার জমিদারিতে গিয়ে খোঁজ নিলে হতে পারত যথেষ্ট ভিন্ন ধারণা। আমি ব্যক্তিগতভাবে পতিসরে অনেকবার গিয়েছি। পতিসরে এখনো আছে একটি উচ্চবিদ্যালয়। এটা রবীন্দ্রনাথ স্থাপন করেননি। এটা স্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যিনি পতিসরে বহু দিন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অনেকে বলেন, তার রচিত ও সুরারোপিত গানের মাধ্যমেই বেঁচে থাকবেন বাংলাভাষাভাষী মানুষের মনে। আমরা যখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলন করি, তখন কোনো মিছিলেই গাওয়া হয়নি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত কোনো গান। ভাষা আন্দোলনে আমরা বলিনি বাংলা ভাষা হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাতৃভাষা; তাই তাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পাশে দিতে হবে স্থান। আমাদের বাংলা ভাষা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকেছেন অনুপস্থিত। সাবেক পাকিস্তান সরকার ১৯৬৭ সালের ২২ জুন রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। কেন সাবেক পাকিস্তান সরকার এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্যোগী হয়, আমরা তা এখনো জানি না। বলা হয়, রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমে চলেছে একটা বিশেষ ষড়যন্ত্র। কিন্তু কী সেই ষড়যন্ত্র, তা ব্যাখ্যা করা থেকে তদানীন্তন সরকার থাকে বিরত। এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ তোলেন এই সম্প্রচার বন্ধের বিপক্ষে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরÑআমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি গানটিকে। কিন্তু ১৯৭১ সালে এই গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষে অনেকেই ছিলেন না। এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত করার পক্ষে ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তার মস্কোপন্থী সাথীরা। শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে ফিরে এসে অসুস্থ কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। তাকে প্রদান করেন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। শেখ মুজিব নজরুল ইসলামকে ঘোষণা করেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমার সোনার বাংলা গানের পাশে কবি নজরুলের লিখিত ও সুরারোপিত- চল্ চল্, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণী তল গানটিকে দেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর রণসঙ্গীতের মর্যাদা। এখন মহলবিশেষের পক্ষ থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা চলেছে, শেখ মুজিব ছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাভক্ত। কিন্তু শেখ মুজিব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাদ দিয়ে চেয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলামকেই বাংলাদেশের জাতীয় কবি করতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলভাষাভাষী মুসলমানদের মনমানসিকতা গঠন করেননি। মুসলমানদের মনমানসিকতা গঠনে যে সাহিত্যিক বিশেষভাবে প্রভাব ফেলেছেন, তিনি হলেন মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৮-১৯১২)। তিনি খুব উন্নত মানের বাংলা লিখেছেন। কারবালার করুণ কাহিনী অবলম্বনে রচিত মীর মশাররফ হোসেনের 'বিষাদ-সিন্ধু' (৩ খণ্ড, ১৮৮৪-১৮৯০) বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এ ছাড়াও তিনি আরো উপন্যাস, প্রবন্ধ ও কিছু কবিতা লিখেছেন। তার লেখা 'জমিদার দর্পণ' উল্লেখযোগ্য নাটক। কিন্তু তাকে নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন কাঙাল হরিনাথের প্রভাবে। কাঙাল হরিনাথ ছিলেন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর লোক (শিলাইদহ, কুমারখালী উপজেলাতেই অবস্থিত)। কাঙাল হরিনাথ কুমারখালী থেকে 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' নামে একটি সাময়িক পত্র প্রকাশ করতেন। সাময়িক পত্রিকাটি প্রথমে ছিল মাসিক, পরে হয় পাক্ষিত ও আরো পরে হয় সাপ্তাহিক। পত্রিকাটি ১৯ বছর পর্যন্ত চলেছিল। গ্রাম ও গ্রামবাসীর দুরবস্থার কথা প্রচার করাই ছিল এর বিশেষ লক্ষ্য। 'গ্রামবার্তা' কাগজ আমাদের কৃষককে জমিদারের নির্যাতনের হাত থেকে রা পেতে সাহায্য করেছে। আর বাংলাদেশ হলো মূলত কৃষকেরই দেশ। কাঙাল হরিনাথ রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথের প্রজাপীড়ন সম্পর্কে তার পত্রিকায় লেখেন। দেবেন্দ্রনাথ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গুণ্ডা নিযুক্ত করেন কাঙাল হরিনাথকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু তিনি সফল হননি। কারণ কুমারখালীর মুসলমানেরা নেয় হরিনাথের পক্ষ। মীর মশাররফ হোসেনও ছিলেন এদের পক্ষে। কাঙাল হরিনাথকে হত্যার চক্রান্ত ঠাকুর পরিবারের ইতিহাসকে কলঙ্ক প্রদান করেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনো এই নিয়ে আত্মসমালোচনা করেননি। বাংলার মুসলমান কবিদের ওপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। প্রভাব পড়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের। কবি কায়কোবাদ (১৮৫৪-১৯৫১) মধুসূদনের 'মেঘনাদবধ' মহাকাব্যের আদর্শে রচনা করেন তার 'মহাশ্মশান' (১৯০৪) নামক মহাকাব্য। এর বিষয়বস্তু হলো পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ ও মারাঠা শক্তির পতনের কাহিনী। (কায়কোবাদ কবির ছদ্মনাম। আসল নাম মুহাম্মদ কাজেম)। মহাশ্মশান কাব্যের সাহিত্যমূল্য যাই হোক, বাংলাভাষী মুসলমান সমাজে পড়তে পেরেছে এর বিপুল প্রভাব। অর্থাৎ মুসলমান সাহিত্যিকদের কাব্য সাধনা হতে চায়নি রবীন্দ্র-বাক্য সাধনার অনুগামী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে তাই করা যায় না বাংলাভাষী মুসলমানদের সাহিত্যচর্চার ইতিহাস বিশ্লেষণ, যেটা এখন অনেকেই করতে চাচ্ছেন। (আজকের লেখার বাকি অংশ আগামীকাল সমাপ্য) প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট


    __._,_.___


    ****************************************************
    Mukto Mona plans for a Grand Darwin Day Celebration: 
    Call For Articles:

    http://mukto-mona.com/wordpress/?p=68

    http://mukto-mona.com/banga_blog/?p=585

    ****************************************************

    VISIT MUKTO-MONA WEB-SITE : http://www.mukto-mona.com/

    ****************************************************

    "I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it".
                   -Beatrice Hall [pseudonym: S.G. Tallentyre], 190




    Your email settings: Individual Email|Traditional
    Change settings via the Web (Yahoo! ID required)
    Change settings via email: Switch delivery to Daily Digest | Switch to Fully Featured
    Visit Your Group | Yahoo! Groups Terms of Use | Unsubscribe

    __,_._,___