হাসিনার জাতিসংঘে ভাষণ বাংলাদেশের সুনামে কলঙ্ক
সি রা জু র র হ মা ন |
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ নিয়ে পশ্চিমে প্রচুর রসিকতা হয়। বলা হয় দন্ত-নখরবিহীন এই সংস্থাটি অর্থহীন বক্তৃতার তুবড়ি ওড়ানোর স্থান মাত্র। নিজ দেশে যেসব নেতার কোনো জনসমর্থন নেই, যাদের কথা কেউ শোনে না, তারা জাতিসংঘে এসে বড় বড় অসার কথা বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অবশ্যই ওয়াশিংটন থেকে শ' দুয়েক মাইল উড়ে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে হাজির হতে হয়। শত হলেও তিনি স্বাগতিক দেশের প্রেসিডেন্ট। বহু দেশেরই রাষ্ট্র কিংবা সরকারপ্রধান আজকাল সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এসে সময় ও অর্থের অপব্যয় করতে চান না। সাধারণত সেসব দেশের পররাষ্ট্র কিংবা অন্য কোনো মন্ত্রী সাধারণ পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করেন।
বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন বসে না। জিয়াফতের কথা শুনলে এক ধরনের হ্যাংলা মানুষ দশ গ্রাম দূরে থেকেও হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীরও হয়েছে সে অবস্থা। ছলছুঁতো কিছু একটা পেলেই হলো। প্রবাসী পরিবারের কারও, এবং নিজের জন্মদিন উদযাপনের জন্য বিদেশে যাবেনই তিনি। দেশের মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য খামোখা একটা সরকারি সফরের বাহানা সৃষ্টি করেন। গোটা উড়োজাহাজ বোঝাই চেলা-চামুণ্ডা ও স্তাবক নিয়ে উড়ে চলে যান তিনি। স্তাবকরা অন্তত সামনে প্রশংসা করেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর শুনতে ভালো লাগে। তিনি মনে করেন এসব লোককে ফ্রি শপিং ট্রিপ দিলে তার রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত হবে। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী? বোধ হয় ঢাকায় তার বিছানায় ছারপোকা আছে, রাতে ঘুম হয় না। ঘুমানোর জন্য হলেও তাকে বিদেশে যেতে হয়। কিন্তু তাদের বিদেশ সফরের বোঝা বহন করতে গিয়ে বাংলাদেশ বিমান সর্বস্বহারা হয়ে গেল, আর দেশের মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর।
বহু বছর পর এবার ব্যতিক্রম ঘটেছে। এবারের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন এসেছে বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে। বলা-কওয়া হচ্ছিল, সিরিয়ার তিন বছর স্থায়ী ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের অবসান, বিশেষ করে সে যুদ্ধে রাায়নিক অস্ত্র ব্যবহার বন্ধ করার জন্য রাশিয়ার সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টায় অগ্রগতি হবে সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষে। যখন শোনা গেল ইরানের নবনির্বাচিত নরমপন্থী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও সাধারণ পরিষদে যাবেন তখন আগ্রহ বহু গুণে বেড়ে গেল।
এ দুটি বিষয় বিশ্ব শান্তির জন্য সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সিরিয়ার যুদ্ধে প্রায় সোয়া লাখ মানুষ নিহত হয়েছে এ যাবত। পঞ্চাশ লাখ বাস্তুহারা হয়েছে, ২০ লাখেরও বেশি সিরীয় সীমান্ত পেরিয়ে তুরস্ক, লেবানন, জর্দান আর ইরাকি কুর্দিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। এদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নারী ও শিশু। অত্যন্ত অমানুষিক অবস্থায় তারা শরণার্থী জীবনযাপন করছে। শান্তিপূর্ণ কিংবা সামরিক পন্থায় এই গৃহযুদ্ধের অবসানের পথ দেখা যাচ্ছিল না রাশিয়ার সঙ্গে সিরিয়ার মৈত্রীর কারণে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ রুশ সমর্থনের অপসুযোগ নিচ্ছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে। তার সর্বশেষ ঔদ্ধত্যের কারণে রুশ সরকার ইদানীং এ আভাস দিচ্ছিল যে সিরিয়ার নিন্দা নয়, বরং তার রাসায়নিক অস্ত্রগুলো বিনষ্ট করার ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদে একটা প্রস্তাব পাস করতে সে রাজি হতে পারে।
ইরানের সঙ্গে ওয়াশিংটনের বিরোধ আরও পুরনো, আরও সাংঘাতিক। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইসলামী বিপ্লবের সময় ইরানি ছাত্র-কর্মীরা মার্কিন দূতাবাস বন্ধ করে দেয়, কূটনীতিকদের ৪৪৪ দিন ধরে বন্দি রাখে এবং মার্কিন অভিযোগ অনুযায়ী তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। তখন থেকে দু'দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। বিগত কয়েক বছরে ইরান তার পারমাণবিক গবেষণায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছে। ইউরেনিয়াম জ্বালানি পরিশোধনের জন্য কয়েকটি সুরক্ষিত গবেষণাগারও নির্মাণ করেছে সে। ইরাইলিরা অনবরত ওয়াশিংটনকে উস্কানি দিয়ে চলেছে যে তেহরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। তাকে বোমা তৈরির সুযোগ দিলে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি বিপন্ন হবে।
শুধু তাই নয়। তেলআবিব কয়েক বছর ধরেই মার্কিন প্রশাসনের পাঁজরে যেন বেয়নেটের খোঁচা দিয়ে চলেছে। সে বলছে, মার্কিন সরকার যদি তেহরানকে এসব পারমাণবিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত না করে তাহলে সে (ইসরাইল) নিজেই ইরানের গবেষণাগারগুলো আক্রমণ করে উড়িয়ে দেবে। তেমন অবস্থায় ইরান অবশ্যই প্রতিশোধ নেবে এবং প্রায় অনিবার্যভাবেই মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে যুদ্ধের দাবানল জ্বলে উঠবে। ওয়াশিংটন কিংবা অন্য কোনো পশ্চিমা শক্তি বর্তমানে সে ধরনের যুদ্ধের কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। ইরাক এবং আফগানিস্তানে তাদের হাত পুড়েছে।
শাড়ির বাহার দেখার মুড কারও ছিল না
অন্যদিকে ওয়াশিংটনের উদ্যোগে পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের বিরুদ্ধে যে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে, প্রতিটি ইরানি তাতে ক্ষতিগ্রস্ত। হাসান রুহানি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই ওয়াশিংটনের সঙ্গে সুসম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অবরোধ প্রত্যাহার এবং পারমাণবিক বিষয়াবলি সম্বন্ধে সংলাপ শুরুর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সাধারণভাবেই পশ্চিমে এবং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টির কারণ এই যে, প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ খামেনির ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন ব্যক্তি। মনে করা হচ্ছে যে রুহানি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছলে খামেনি সেটা বাতিল করে দেবেন না।
গত কয়েকদিনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে ইরান-মার্কিন সম্পর্কের ব্যাপারে। রুহানি জাতিসংঘে এবং মার্কিন মিডিয়ায় আপসমুখী কথাবার্তা বলেছেন। দু'দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ফলপ্রসূ কথাবার্তা বলেছেন জাতিসংঘে। প্রেসিডেন্ট ওবামা আর প্রেসিডেন্ট রুহানি দীর্ঘ ১৫ মিনিট ধরে আলাপ করেছেন টেলিফোনে এবং স্থির হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র আর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অবিলম্বে জেনেভায় সবিস্তার আলোচনায় বসবেন। ওদিকে বহু দরকষাকষির পর রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিরিয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস করতে সম্মতি দিয়েছেন। এ প্রস্তাবে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র বিনষ্ট করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জাতিসংঘকে, তবে এ যাবত এ অস্ত্র কারা ব্যবহার করেছে সে কথা বলা হবে না।
এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যেখানে চলছে সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা শোনা কিংবা তার শাড়ির বাহার দেখার মুডে কূটনীতিক কিংবা সাংবাদিকরা ছিলেন না। গত বছর চারেক ধরে লক্ষ্য করছি, শেখ হাসিনার সাজসজ্জা ও শাড়ির বাহার বেড়েই চলেছে। সবাই জানে তার স্বামী প্রয়াত হয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর বয়সও কিছু কমছে না। সে যা হোক, এ যাত্রায় মার্কিন প্রশাসনের কোনো পদস্থ কর্মকর্তা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত্ করেননি। মনে করা হচ্ছে, নির্বাচন পদ্ধতির ব্যাপারে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের অনুরোধ করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি শেখ হাসিনাকে যে চিঠি লিখেছিলেন সে চিঠির জবাব না দেয়ায় ওয়াশিংটন ইচ্ছা করেই শেখ হাসিনার প্রতি শৈত্য দেখিয়েছে।
বাংলাদেশের সরকারি ও সরকার সমর্থক মিডিয়া খবর দিয়েছে কে বা কারা দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকার দরুন শেখ হাসিনাকে দক্ষিণ-দক্ষিণ পুরস্কার দিয়েছে। কিন্তু এ সম্বন্ধে অন্য কারও মনোযোগ কিংবা প্রতিক্রিয়ার খবর কোথাও দেখিনি। কেন জানি মনে পড়ছে, দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকার দরুন অতীতেও কেউ শেখ হাসিনাকে পুরস্কৃত করেছিল বলে বাংলাদেশের সরকারি মিডিয়ায় খবর দেখেছিলাম। সেটা বিচিত্রও নয়। ডিগ্রি কিংবা পুরস্কার ক্রয় করার ব্যাপারে (শুধু নোবেল পুরস্কার ছাড়া) বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষে বাংলাদেশের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছিল ম্যাসিসহ নিউইয়র্কের অভিজাত ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোতে। প্রধানমন্ত্রীর ১৩৩ জন সফরসঙ্গীর 'গোগ্রাসে' কেনাকাটায় নিশ্চয়ই বহু খদ্দেরের চোখ কপালে উঠেছে। তারপর হঠাত্ করেই একটা চমক সৃষ্টি হলো নিউইয়র্কে। সড়কের পাশে মালিকবিহীন চারটি বাক্স পড়ে থাকতে দেখে সাধারণ মানুষ ও নিরাপত্তা বাহিনীতে আতঙ্ক দেখা দিল। নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাস এখনও দগদগে ক্ষতের মতো এ মহানগরীর মানুষের মনে তাজা, সুতরাং সে চাঞ্চল্য অস্বাভাবিকও ছিল না। পরে অবশ্য জানা গেল বাক্সগুলোতে বোমা ছিল না, ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের মুদ্রিত পুস্তিকা।
ঘরের নোংরা কাপড় সদর রাস্তায় টাঙানো
হলফ করে বলতে পারি, ভারত এবং তার দু'একটি উপগ্রহ দেশ ছাড়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আর কোনো দেশের প্রতিনিধি মনে মনে শেখ হাসিনার বক্তৃতায় খুশি হতে পারেননি। সে বক্তৃতা সম্বন্ধে তাদের ধারণা নিশ্চয়ই এই হয়েছে যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ঘরের নোংরা কাপড় রাস্তায় এনে মেলে দিয়েছেন। বিশ্ব সভায় দাঁড়িয়ে তিনি ২০০১-০৬ মেয়াদের বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে কুত্সা প্রচার করেছেন, যদিও সেখানে বিএনপির তরফ থেকে জবাব দেবার কোনো সুযোগ ছিল না। তিনি অভিযোগ করেন যে সে সরকারের আমলে স্বাধীনতা-বিরোধীদের একটি সন্ত্রাসী চক্র গড়ে তোলা হয়; এ চক্র বার বার তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনা বেকায়দায় পড়লেই তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেন। তিনি হয়তো আশা করেন যে তাতে তার প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হবে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন না যে প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষ বিরক্ত হয়, আরও বেশি করে তাকে করুণা করে।
শেখ হাসিনা কয়েকজন জামায়াত ও দু'জন বিএনপি নেতার বিচারের ব্যাপারে বিশ্ব সমাজের সমর্থন কামনা করেছেন। সাধারণ পরিষদকে তিনি বলেছেন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা অপরিহার্য ছিল।
শেখ হাসিনা বিশ্ব সামজকে স্টুপিড ভাবেন কিনা জানি না, কিন্তু সাধারণ পরিষদে সে ধারণাই তিনি দিয়েছেন। বাংলাদেশে নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ নেই, কট্টর আওয়ামী লীগপন্থীদের দিয়ে আদালত বোঝাই করে দেয়া হয়েছে এবং আপাত দৃষ্টিতেই সেসব বিচারক সরকারের ইচ্ছাপূরণের রায় দেন। এ করুণ অবস্থার কথা বিশ্বের কোন দেশ না জানে? যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য সরকার যে আইন পাস করেছে, যেভাবে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে এবং যেভাবে বিদেশি আইনজীবী ও পর্যবেক্ষকদের সে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশাধিকার দেয়া হয়নি, বিশ্ব সমাজ বার বার তার প্রকাশ্য সমালোচনা করেছে।
বিশ্ব সমাজ আরও লক্ষ্য না করে পারেনি যে, প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের হাসিনার পিতাই অব্যাহতি দিয়ে গেছেন ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে মুক্তি দিয়ে, আর যুদ্ধাপরাধীদের যারা কালো কোট পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন কিংবা মন্ত্রী হয়েছেন তাদের কাউকে অভিযুক্তের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সরকারের ভাড়া করা শাহবাগের কতিপয় দুর্বৃত্তের দাবি পূরণের জন্য পশ্চাদগামীভাবে (রেট্রোস্পেকটিভ) কাউকে ফাঁসি দানের জন্য আইন পাসের নজিরও সম্ভবত বিশ্বের কোনো দেশেই নেই।
বাংলাদেশে মানবাধিকার বলতে যে কিছু নেই, সে দেশে যে শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়, মানুষ গুম হয়ে যায়, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও মিছিল করার অধিকার যে রহিত করা হয়েছে, কথায় কথায় যে শাসক দলের ক্যাডারদের সহায়তায় পুলিশ রাজনৈতিক প্রতিভূদের ওপর চড়াও হয়, গুলি চালায় ইত্যাদি সব দেশের সরকার ও মানুষ জানে। বাংলাদেশের পুলিশ যে সম্পূর্ণরূপে দলীয়কৃত এবং সেখানে যে আইন ও শৃঙ্খলা পরিচালিত হয় সরকারের রাজনৈতিক সুবিধা-অসুবিধার বিবেচনায়, সে খবরও বিশ্ব সমাজ রাখে। এই প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনের অনুরোধ শুনে কোনো কোনো প্রতিনিধি নিশ্চয়ই ভেবেছেন : এ মহিলার কি চোখের চামড়াও নেই?
শহীদানের স্মৃতির অপমান
প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারকে জনপ্রিয় করার জন্য এক লাখ ডলার ফি'তে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার যদি প্রকৃতই ন্যায়নিষ্ঠ হতো তাহলে লবিস্ট নিয়োগ কি প্রয়োজনীয় ছিল? তাছাড়া এই লবিস্ট কোম্পানি কি সেই কোম্পানি, শেখ হাসিনা শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের প্রত্যার্পণের আশায় আগেও যাদের লবিস্ট নিয়োগ করেছিলেন?
হাসিনা ও তার সরকার দেশ-বিদেশের মানুষকে বোঝাতে চাইছেন যে তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন বলেই তাদের আবারও ক্ষমতা ফিরে পাওয়া উচিত। এই বিচারকে নানা মোড়কে ও আবরণে সাজিয়ে বিশ্ব সমাজে পেশ করা হচ্ছে। সজীব ওয়াজেদ জয় এ বিচারকে বলছেন দ্বিতীয় বিপ্লব। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রথম বিপ্লব, কিন্তু সে বিপ্লবে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা শরিক ছিলেন না। জয় নিশ্চয়ই আশা করছেন আবার বিপ্লব হলে তিনি ওয়াশিংটন থেকে উড়ে এসে বিপ্লবী হবেন। সে বিপ্লবে আমার বেশ কয়েকজন প্রিয় ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন। মুখোশপরা কিছু লোক এসে তাদের চোখ বেঁধে নিয়ে চলে গেছে, আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তাদের।
অবিকল সে রকমের অজস্র ঘটনা ঘটেছে বর্তমান সরকারের পৌনে পাঁচ বছরে। আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। ক্রসফায়ার আর বন্দুকযুদ্ধের দুর্নাম দিয়ে সরকারের প্রায় আড়াইশ' বিরোধী ও সমালোচককে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ ও র্যাবের পোশাক পরা লোকেরা প্রায় দু'শ সরকার বিরোধীকে ধরে নিয়ে গেছে এবং একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মতোই তাদের কারও কারও হত-পা বাঁধা লাশ পাওয়া গেলেও অন্যদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম আর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী কোথায় এখন? সরকার যদি তাদের সশরীরে হাজির করতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে যে একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মতো তাদেরও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গুম ও হত্যা করা হয়েছে। এসব গুম ও হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদেরও অবিলম্বে বিচারে চড়াতে হবে। অন্যথায় শেখ হাসিনা কিছুতেই বিশ্ববাসীকে বিশ্বাস করাতে পারবেন না যে প্রকৃতই ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং আইন-শৃঙ্খলাই তার কাম্য।
কী অধিকারে এই বিচারের প্রহসন?
একাত্তরের বুদ্ধিজীবী শহীদরা কেন প্রাণ দিয়েছিলেন? তারা এই দেশ আর এই দেশের মানুষকে ভালো বেসেছিলেন, এই দেশ সুখী আর সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াবে—এসব আশাতেই তারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। তাদের নামে বর্তমানে যা করা হচ্ছে, প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসার বিষে দেশকে যেভাবে বিভক্ত আর বিষাক্ত করা হচ্ছে, তাতে শহীদদের আত্মা নিশ্চয়ই ক্ষুব্ধ, ব্যথিত এবং অপমানিত বোধ করছে। প্রকৃত প্রস্তাবে বিচার কিংবা মানবাধিকারের জন্য নয়, বর্তমান সরকার বিচারের নামে এসব তাণ্ডব করছে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে, নিজেদের গদি আঁকড়ে থাকার লক্ষ্যে। তারা শহীদানের স্মৃতিকে অপমান করছে।
এই সরকার বিচারের নামে বাংলাদেশের মানুষকে কীভাবে বিভ্রান্ত-প্রতারিত করতে চায়, দিরাইতে নির্লজ্জ দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উক্তি থেকেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি বলেছেন, 'যারা ত্রিশ লাখ মানুষ হত্যা করেছে, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে, হাজার হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে, তাদের ক্ষমার কোনো সুযোগ নেই।' প্রথম কথা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ মারা যায়নি। সেটা মিথ্যা কথা। শেখ মুজিবুর রহমান অনবধানতাবশত তিন লাখের বদলে তিন মিলিয়ন বলে ফেলেছিলেন মাত্র।
দ্বিতীয়ত, ৪২ বছর পর হাসিনার সরকার যাদের বিচারে চড়িয়েছে, একাত্তরের সব যুদ্ধাপরাধের জন্য সম্পূর্ণরূপে তারাই কি দায়ী? তারাই যদি সবকিছু করল তাহলে পাকিস্তানিরা ৯৩ হাজার সৈন্যকে কি ঘোড়ার ঘাস কাটতে পাঠিয়েছিল? সেই ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের, বিশেষ করে সবচাইতে জঘন্য যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত ১৫০ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে কেন বিচারে চড়ানো হয়নি? কে তাদের মুক্তি দিয়েছিল? তাদের যখন বিচার করা হয়নি, মুক্তি দেয়া হয়েছে; তখন সরকারের রাজনৈতিক বিরোধী মুষ্টিমেয় সংখ্যক রাজনৈতিক নেতার বিচারের অভিনয় করার কি অধিকার আছে এই সরকারের?
(লন্ডন, ০১.১০.১৩)
serajurrahman34@gmail.com
বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন বসে না। জিয়াফতের কথা শুনলে এক ধরনের হ্যাংলা মানুষ দশ গ্রাম দূরে থেকেও হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীরও হয়েছে সে অবস্থা। ছলছুঁতো কিছু একটা পেলেই হলো। প্রবাসী পরিবারের কারও, এবং নিজের জন্মদিন উদযাপনের জন্য বিদেশে যাবেনই তিনি। দেশের মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য খামোখা একটা সরকারি সফরের বাহানা সৃষ্টি করেন। গোটা উড়োজাহাজ বোঝাই চেলা-চামুণ্ডা ও স্তাবক নিয়ে উড়ে চলে যান তিনি। স্তাবকরা অন্তত সামনে প্রশংসা করেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর শুনতে ভালো লাগে। তিনি মনে করেন এসব লোককে ফ্রি শপিং ট্রিপ দিলে তার রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত হবে। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী? বোধ হয় ঢাকায় তার বিছানায় ছারপোকা আছে, রাতে ঘুম হয় না। ঘুমানোর জন্য হলেও তাকে বিদেশে যেতে হয়। কিন্তু তাদের বিদেশ সফরের বোঝা বহন করতে গিয়ে বাংলাদেশ বিমান সর্বস্বহারা হয়ে গেল, আর দেশের মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর।
বহু বছর পর এবার ব্যতিক্রম ঘটেছে। এবারের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন এসেছে বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে। বলা-কওয়া হচ্ছিল, সিরিয়ার তিন বছর স্থায়ী ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের অবসান, বিশেষ করে সে যুদ্ধে রাায়নিক অস্ত্র ব্যবহার বন্ধ করার জন্য রাশিয়ার সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টায় অগ্রগতি হবে সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষে। যখন শোনা গেল ইরানের নবনির্বাচিত নরমপন্থী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও সাধারণ পরিষদে যাবেন তখন আগ্রহ বহু গুণে বেড়ে গেল।
এ দুটি বিষয় বিশ্ব শান্তির জন্য সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সিরিয়ার যুদ্ধে প্রায় সোয়া লাখ মানুষ নিহত হয়েছে এ যাবত। পঞ্চাশ লাখ বাস্তুহারা হয়েছে, ২০ লাখেরও বেশি সিরীয় সীমান্ত পেরিয়ে তুরস্ক, লেবানন, জর্দান আর ইরাকি কুর্দিস্তানে আশ্রয় নিয়েছে। এদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নারী ও শিশু। অত্যন্ত অমানুষিক অবস্থায় তারা শরণার্থী জীবনযাপন করছে। শান্তিপূর্ণ কিংবা সামরিক পন্থায় এই গৃহযুদ্ধের অবসানের পথ দেখা যাচ্ছিল না রাশিয়ার সঙ্গে সিরিয়ার মৈত্রীর কারণে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ রুশ সমর্থনের অপসুযোগ নিচ্ছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে। তার সর্বশেষ ঔদ্ধত্যের কারণে রুশ সরকার ইদানীং এ আভাস দিচ্ছিল যে সিরিয়ার নিন্দা নয়, বরং তার রাসায়নিক অস্ত্রগুলো বিনষ্ট করার ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদে একটা প্রস্তাব পাস করতে সে রাজি হতে পারে।
ইরানের সঙ্গে ওয়াশিংটনের বিরোধ আরও পুরনো, আরও সাংঘাতিক। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইসলামী বিপ্লবের সময় ইরানি ছাত্র-কর্মীরা মার্কিন দূতাবাস বন্ধ করে দেয়, কূটনীতিকদের ৪৪৪ দিন ধরে বন্দি রাখে এবং মার্কিন অভিযোগ অনুযায়ী তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়। তখন থেকে দু'দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। বিগত কয়েক বছরে ইরান তার পারমাণবিক গবেষণায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছে। ইউরেনিয়াম জ্বালানি পরিশোধনের জন্য কয়েকটি সুরক্ষিত গবেষণাগারও নির্মাণ করেছে সে। ইরাইলিরা অনবরত ওয়াশিংটনকে উস্কানি দিয়ে চলেছে যে তেহরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। তাকে বোমা তৈরির সুযোগ দিলে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি বিপন্ন হবে।
শুধু তাই নয়। তেলআবিব কয়েক বছর ধরেই মার্কিন প্রশাসনের পাঁজরে যেন বেয়নেটের খোঁচা দিয়ে চলেছে। সে বলছে, মার্কিন সরকার যদি তেহরানকে এসব পারমাণবিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত না করে তাহলে সে (ইসরাইল) নিজেই ইরানের গবেষণাগারগুলো আক্রমণ করে উড়িয়ে দেবে। তেমন অবস্থায় ইরান অবশ্যই প্রতিশোধ নেবে এবং প্রায় অনিবার্যভাবেই মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে যুদ্ধের দাবানল জ্বলে উঠবে। ওয়াশিংটন কিংবা অন্য কোনো পশ্চিমা শক্তি বর্তমানে সে ধরনের যুদ্ধের কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। ইরাক এবং আফগানিস্তানে তাদের হাত পুড়েছে।
শাড়ির বাহার দেখার মুড কারও ছিল না
অন্যদিকে ওয়াশিংটনের উদ্যোগে পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের বিরুদ্ধে যে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে, প্রতিটি ইরানি তাতে ক্ষতিগ্রস্ত। হাসান রুহানি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই ওয়াশিংটনের সঙ্গে সুসম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অবরোধ প্রত্যাহার এবং পারমাণবিক বিষয়াবলি সম্বন্ধে সংলাপ শুরুর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সাধারণভাবেই পশ্চিমে এবং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টির কারণ এই যে, প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ খামেনির ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন ব্যক্তি। মনে করা হচ্ছে যে রুহানি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছলে খামেনি সেটা বাতিল করে দেবেন না।
গত কয়েকদিনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে ইরান-মার্কিন সম্পর্কের ব্যাপারে। রুহানি জাতিসংঘে এবং মার্কিন মিডিয়ায় আপসমুখী কথাবার্তা বলেছেন। দু'দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ফলপ্রসূ কথাবার্তা বলেছেন জাতিসংঘে। প্রেসিডেন্ট ওবামা আর প্রেসিডেন্ট রুহানি দীর্ঘ ১৫ মিনিট ধরে আলাপ করেছেন টেলিফোনে এবং স্থির হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র আর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অবিলম্বে জেনেভায় সবিস্তার আলোচনায় বসবেন। ওদিকে বহু দরকষাকষির পর রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিরিয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস করতে সম্মতি দিয়েছেন। এ প্রস্তাবে সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র বিনষ্ট করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জাতিসংঘকে, তবে এ যাবত এ অস্ত্র কারা ব্যবহার করেছে সে কথা বলা হবে না।
এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যেখানে চলছে সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা শোনা কিংবা তার শাড়ির বাহার দেখার মুডে কূটনীতিক কিংবা সাংবাদিকরা ছিলেন না। গত বছর চারেক ধরে লক্ষ্য করছি, শেখ হাসিনার সাজসজ্জা ও শাড়ির বাহার বেড়েই চলেছে। সবাই জানে তার স্বামী প্রয়াত হয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর বয়সও কিছু কমছে না। সে যা হোক, এ যাত্রায় মার্কিন প্রশাসনের কোনো পদস্থ কর্মকর্তা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত্ করেননি। মনে করা হচ্ছে, নির্বাচন পদ্ধতির ব্যাপারে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের অনুরোধ করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি শেখ হাসিনাকে যে চিঠি লিখেছিলেন সে চিঠির জবাব না দেয়ায় ওয়াশিংটন ইচ্ছা করেই শেখ হাসিনার প্রতি শৈত্য দেখিয়েছে।
বাংলাদেশের সরকারি ও সরকার সমর্থক মিডিয়া খবর দিয়েছে কে বা কারা দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকার দরুন শেখ হাসিনাকে দক্ষিণ-দক্ষিণ পুরস্কার দিয়েছে। কিন্তু এ সম্বন্ধে অন্য কারও মনোযোগ কিংবা প্রতিক্রিয়ার খবর কোথাও দেখিনি। কেন জানি মনে পড়ছে, দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকার দরুন অতীতেও কেউ শেখ হাসিনাকে পুরস্কৃত করেছিল বলে বাংলাদেশের সরকারি মিডিয়ায় খবর দেখেছিলাম। সেটা বিচিত্রও নয়। ডিগ্রি কিংবা পুরস্কার ক্রয় করার ব্যাপারে (শুধু নোবেল পুরস্কার ছাড়া) বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর প্রচুর অভিজ্ঞতা আছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন উপলক্ষে বাংলাদেশের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছিল ম্যাসিসহ নিউইয়র্কের অভিজাত ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোতে। প্রধানমন্ত্রীর ১৩৩ জন সফরসঙ্গীর 'গোগ্রাসে' কেনাকাটায় নিশ্চয়ই বহু খদ্দেরের চোখ কপালে উঠেছে। তারপর হঠাত্ করেই একটা চমক সৃষ্টি হলো নিউইয়র্কে। সড়কের পাশে মালিকবিহীন চারটি বাক্স পড়ে থাকতে দেখে সাধারণ মানুষ ও নিরাপত্তা বাহিনীতে আতঙ্ক দেখা দিল। নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাস এখনও দগদগে ক্ষতের মতো এ মহানগরীর মানুষের মনে তাজা, সুতরাং সে চাঞ্চল্য অস্বাভাবিকও ছিল না। পরে অবশ্য জানা গেল বাক্সগুলোতে বোমা ছিল না, ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের মুদ্রিত পুস্তিকা।
ঘরের নোংরা কাপড় সদর রাস্তায় টাঙানো
হলফ করে বলতে পারি, ভারত এবং তার দু'একটি উপগ্রহ দেশ ছাড়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আর কোনো দেশের প্রতিনিধি মনে মনে শেখ হাসিনার বক্তৃতায় খুশি হতে পারেননি। সে বক্তৃতা সম্বন্ধে তাদের ধারণা নিশ্চয়ই এই হয়েছে যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ঘরের নোংরা কাপড় রাস্তায় এনে মেলে দিয়েছেন। বিশ্ব সভায় দাঁড়িয়ে তিনি ২০০১-০৬ মেয়াদের বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে কুত্সা প্রচার করেছেন, যদিও সেখানে বিএনপির তরফ থেকে জবাব দেবার কোনো সুযোগ ছিল না। তিনি অভিযোগ করেন যে সে সরকারের আমলে স্বাধীনতা-বিরোধীদের একটি সন্ত্রাসী চক্র গড়ে তোলা হয়; এ চক্র বার বার তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। শেখ হাসিনা বেকায়দায় পড়লেই তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেন। তিনি হয়তো আশা করেন যে তাতে তার প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হবে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন না যে প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষ বিরক্ত হয়, আরও বেশি করে তাকে করুণা করে।
শেখ হাসিনা কয়েকজন জামায়াত ও দু'জন বিএনপি নেতার বিচারের ব্যাপারে বিশ্ব সমাজের সমর্থন কামনা করেছেন। সাধারণ পরিষদকে তিনি বলেছেন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা অপরিহার্য ছিল।
শেখ হাসিনা বিশ্ব সামজকে স্টুপিড ভাবেন কিনা জানি না, কিন্তু সাধারণ পরিষদে সে ধারণাই তিনি দিয়েছেন। বাংলাদেশে নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ নেই, কট্টর আওয়ামী লীগপন্থীদের দিয়ে আদালত বোঝাই করে দেয়া হয়েছে এবং আপাত দৃষ্টিতেই সেসব বিচারক সরকারের ইচ্ছাপূরণের রায় দেন। এ করুণ অবস্থার কথা বিশ্বের কোন দেশ না জানে? যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য সরকার যে আইন পাস করেছে, যেভাবে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে এবং যেভাবে বিদেশি আইনজীবী ও পর্যবেক্ষকদের সে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশাধিকার দেয়া হয়নি, বিশ্ব সমাজ বার বার তার প্রকাশ্য সমালোচনা করেছে।
বিশ্ব সমাজ আরও লক্ষ্য না করে পারেনি যে, প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের হাসিনার পিতাই অব্যাহতি দিয়ে গেছেন ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে মুক্তি দিয়ে, আর যুদ্ধাপরাধীদের যারা কালো কোট পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন কিংবা মন্ত্রী হয়েছেন তাদের কাউকে অভিযুক্তের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সরকারের ভাড়া করা শাহবাগের কতিপয় দুর্বৃত্তের দাবি পূরণের জন্য পশ্চাদগামীভাবে (রেট্রোস্পেকটিভ) কাউকে ফাঁসি দানের জন্য আইন পাসের নজিরও সম্ভবত বিশ্বের কোনো দেশেই নেই।
বাংলাদেশে মানবাধিকার বলতে যে কিছু নেই, সে দেশে যে শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়, মানুষ গুম হয়ে যায়, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও মিছিল করার অধিকার যে রহিত করা হয়েছে, কথায় কথায় যে শাসক দলের ক্যাডারদের সহায়তায় পুলিশ রাজনৈতিক প্রতিভূদের ওপর চড়াও হয়, গুলি চালায় ইত্যাদি সব দেশের সরকার ও মানুষ জানে। বাংলাদেশের পুলিশ যে সম্পূর্ণরূপে দলীয়কৃত এবং সেখানে যে আইন ও শৃঙ্খলা পরিচালিত হয় সরকারের রাজনৈতিক সুবিধা-অসুবিধার বিবেচনায়, সে খবরও বিশ্ব সমাজ রাখে। এই প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনের অনুরোধ শুনে কোনো কোনো প্রতিনিধি নিশ্চয়ই ভেবেছেন : এ মহিলার কি চোখের চামড়াও নেই?
শহীদানের স্মৃতির অপমান
প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারকে জনপ্রিয় করার জন্য এক লাখ ডলার ফি'তে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার যদি প্রকৃতই ন্যায়নিষ্ঠ হতো তাহলে লবিস্ট নিয়োগ কি প্রয়োজনীয় ছিল? তাছাড়া এই লবিস্ট কোম্পানি কি সেই কোম্পানি, শেখ হাসিনা শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের প্রত্যার্পণের আশায় আগেও যাদের লবিস্ট নিয়োগ করেছিলেন?
হাসিনা ও তার সরকার দেশ-বিদেশের মানুষকে বোঝাতে চাইছেন যে তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন বলেই তাদের আবারও ক্ষমতা ফিরে পাওয়া উচিত। এই বিচারকে নানা মোড়কে ও আবরণে সাজিয়ে বিশ্ব সমাজে পেশ করা হচ্ছে। সজীব ওয়াজেদ জয় এ বিচারকে বলছেন দ্বিতীয় বিপ্লব। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রথম বিপ্লব, কিন্তু সে বিপ্লবে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা শরিক ছিলেন না। জয় নিশ্চয়ই আশা করছেন আবার বিপ্লব হলে তিনি ওয়াশিংটন থেকে উড়ে এসে বিপ্লবী হবেন। সে বিপ্লবে আমার বেশ কয়েকজন প্রিয় ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন। মুখোশপরা কিছু লোক এসে তাদের চোখ বেঁধে নিয়ে চলে গেছে, আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তাদের।
অবিকল সে রকমের অজস্র ঘটনা ঘটেছে বর্তমান সরকারের পৌনে পাঁচ বছরে। আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা শত শত মানুষকে হত্যা করেছে। ক্রসফায়ার আর বন্দুকযুদ্ধের দুর্নাম দিয়ে সরকারের প্রায় আড়াইশ' বিরোধী ও সমালোচককে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ ও র্যাবের পোশাক পরা লোকেরা প্রায় দু'শ সরকার বিরোধীকে ধরে নিয়ে গেছে এবং একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মতোই তাদের কারও কারও হত-পা বাঁধা লাশ পাওয়া গেলেও অন্যদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম আর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী কোথায় এখন? সরকার যদি তাদের সশরীরে হাজির করতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে যে একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মতো তাদেরও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গুম ও হত্যা করা হয়েছে। এসব গুম ও হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদেরও অবিলম্বে বিচারে চড়াতে হবে। অন্যথায় শেখ হাসিনা কিছুতেই বিশ্ববাসীকে বিশ্বাস করাতে পারবেন না যে প্রকৃতই ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং আইন-শৃঙ্খলাই তার কাম্য।
কী অধিকারে এই বিচারের প্রহসন?
একাত্তরের বুদ্ধিজীবী শহীদরা কেন প্রাণ দিয়েছিলেন? তারা এই দেশ আর এই দেশের মানুষকে ভালো বেসেছিলেন, এই দেশ সুখী আর সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াবে—এসব আশাতেই তারা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। তাদের নামে বর্তমানে যা করা হচ্ছে, প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসার বিষে দেশকে যেভাবে বিভক্ত আর বিষাক্ত করা হচ্ছে, তাতে শহীদদের আত্মা নিশ্চয়ই ক্ষুব্ধ, ব্যথিত এবং অপমানিত বোধ করছে। প্রকৃত প্রস্তাবে বিচার কিংবা মানবাধিকারের জন্য নয়, বর্তমান সরকার বিচারের নামে এসব তাণ্ডব করছে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে, নিজেদের গদি আঁকড়ে থাকার লক্ষ্যে। তারা শহীদানের স্মৃতিকে অপমান করছে।
এই সরকার বিচারের নামে বাংলাদেশের মানুষকে কীভাবে বিভ্রান্ত-প্রতারিত করতে চায়, দিরাইতে নির্লজ্জ দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উক্তি থেকেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি বলেছেন, 'যারা ত্রিশ লাখ মানুষ হত্যা করেছে, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে, হাজার হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে, তাদের ক্ষমার কোনো সুযোগ নেই।' প্রথম কথা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ মারা যায়নি। সেটা মিথ্যা কথা। শেখ মুজিবুর রহমান অনবধানতাবশত তিন লাখের বদলে তিন মিলিয়ন বলে ফেলেছিলেন মাত্র।
দ্বিতীয়ত, ৪২ বছর পর হাসিনার সরকার যাদের বিচারে চড়িয়েছে, একাত্তরের সব যুদ্ধাপরাধের জন্য সম্পূর্ণরূপে তারাই কি দায়ী? তারাই যদি সবকিছু করল তাহলে পাকিস্তানিরা ৯৩ হাজার সৈন্যকে কি ঘোড়ার ঘাস কাটতে পাঠিয়েছিল? সেই ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের, বিশেষ করে সবচাইতে জঘন্য যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত ১৫০ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে কেন বিচারে চড়ানো হয়নি? কে তাদের মুক্তি দিয়েছিল? তাদের যখন বিচার করা হয়নি, মুক্তি দেয়া হয়েছে; তখন সরকারের রাজনৈতিক বিরোধী মুষ্টিমেয় সংখ্যক রাজনৈতিক নেতার বিচারের অভিনয় করার কি অধিকার আছে এই সরকারের?
(লন্ডন, ০১.১০.১৩)
serajurrahman34@gmail.com
__._,_.___