বাংলাদেশের জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন। তবে সরকার যে পথে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যাচ্ছে, সে পথের প্রতি জনগণের সমর্থন নেই। সরকারের কাছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রথম পছন্দ হলো রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্লান্টের মাধ্যমে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করা। কিন্তু এটা করতে গিয়ে সরকার জনগণের ওপর স্বাভাবিকের চেয়ে ছয় গুণ বেশি মূল্য চাপিয়ে দিয়েছে। গ্যাস ও অন্য বিকল্প থেকে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ পড়ে প্রতি ইউনিট ২ থেকে আড়াই টাকা, সেখানে সরকার রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মালিকদের দিচ্ছে প্রতি ইউনিটের বিপরীতে ১৪ টাকা। সরকার ব্যক্তি খাতে স্থাপিত এসব ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি দিচ্ছে, আবার নির্দিষ্ট মূল্যে বিদ্যুৎ কেনার গ্যারান্টিও দিয়েছে। ব্যক্তি খাতে স্থাপিত এসব ভাড়াভিত্তিক ছোট বিদ্যুৎ প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ কেনার অন্য বৈশিষ্ট্য হলো, বিদ্যুৎ প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ কেনা না হলেও তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ নামের একটা মূল্য দিতে হবে। অন্য কথায়, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্টের মালিকদের সুবিধা হলো, তারা গ্যারান্টিড মূল্যে বিদ্যুৎ বেচলেও লাভ, আবার সরকার কোনো কারণে তাদের থেকে বিদ্যুৎ না কিনলে আরো লাভ। বেশির ভাগ রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মালিক পুরনো প্লান্ট বিদেশ থেকে এনে প্লান্ট ক্রয় ও স্থাপনের যে ব্যয় দেখিয়েছে, তা নতুন প্লান্ট ক্রয় ও ব্যয়ের সমতুল্য। অন্য কথায়, তারা পুরনো প্রকল্প স্থাপন করে সরকারের ওপর চার্জ করছে নতুন প্রকল্পের মূল্য। ফল হয়েছে, তাদের থেকে বিদ্যুৎ নিতে হবে ইউনিটপ্রতি ১২ থেকে ১৪ টাকায়। এসব ভাড়াভিত্তিক প্লান্ট থেকে সরকার যদি ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎও কেনে, তাহলে কত হাজার টাকা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে, সেটা সব লোকই মোটামুটি হিসাব করে নিতে পারে। শেষ পর্যন্ত এই বিদ্যুৎ উচ্চমূল্যে কিনতে সরকার জনগণকে বাধ্য করছে। বিদ্যুতের জন্য বিকল্প কোনো বাজার নেই। এখানে বিদ্যুতের উৎপাদক সরকার, আবার বিক্রেতাও সরকার। যে এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ ব্যক্তি খাতে উৎপাদিত হচ্ছে, সেই বিদ্যুতের বাধ্যতামূলক ক্রেতাও সরকার। বিপণনের পূর্ণ দায়িত্ব সরকারের। উৎপাদনের জন্য ব্যক্তি খাতকে অত্যন্ত অস্বচ্ছভাবে অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এখন বিদ্যুৎ ব্যবসা হচ্ছে বড় ব্যবসা। এমন গ্যারান্টিড মুনাফা অন্য ব্যবসায় নেই।
যে ব্যক্তি বা কথিত কম্পানি একটি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্টের মালিক হলো, সে তো অনেক ভাগ্যবান। তার ভাগ্য এসেছে কোনো দক্ষতা বা ক্যারিয়ার সক্ষমতার কারণে নয়; স্রেফ সে সরকারের গুডবুকে আছে বলেই এই গ্যারান্টিড ব্যবসাটা পেয়েছে। এমন একচেটিয়া ও ঝুঁকিবিহীন ব্যবসা বিশ্বের অন্যত্র আছে বলে আমাদের জানা নেই। এমনকি বাংলাদেশের অন্য ব্যবসায়ও এত লাভ আর এত শূন্য ঝুঁকির কোনো সুযোগ নেই। বিদ্যুৎ খাত হলো বাংলাদেশে অতি অল্প সময়ে অর্থকড়ি বানানোর একটা উর্বর ক্ষেত্র। তবে সে জন্য ব্যবসায়ীকে অবশ্যই সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে। অনেক ব্যবসায়ীই জানে তাদের কিভাবে সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে। এ খাতে ব্যবসা বিতরণের ক্ষেত্রে কোনো রকম পূর্ব অভিজ্ঞতা বা অন্য কোনো শক্ত শর্ত পালনের আবশ্যকতা হয়নি। সরকার খুশি, ব্যবসা এসে গেছে। যদি সম্ভব হতো তাহলে বাংলাদেশের অন্য শিল্প মালিকরা, এমনকি গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরাও এ ব্যবসায় নেমে পড়ত। কিন্তু সবার জন্য জায়গা করে দেওয়া যে অসম্ভব! তবে বর্তমান সরকার কথা দিয়েছিল যে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ব্যাপারটা সাময়িক। সে সময় জনগণকে এ ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে দু-তিন বছরের মধ্যে বৃহৎ আকারের গ্যাসভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেলের বিদ্যুৎ প্লান্ট উৎপাদনে আসবে। তখন রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের অতিমূল্যের প্লান্টগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনা বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কম্বাইন্ড সাইকেলের গ্যাসভিত্তিক বৃহৎ বিদ্যুৎ প্রকল্প আজও অনেক দূরের ব্যাপার হয়ে থাকল। উদাহরণ তো সিলেটের বিবিয়ানার ৪৫০ মেগাওয়াটের প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ প্রকল্প। একটি ব্যক্তি খাতের কম্পানিকে ওই প্রকল্প স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হলো, যে কম্পানি আজতক প্রকল্পের জন্য অর্থই জোগাড় করতে পারেনি। এখন নাকি আপাতত ওই প্রকল্প পরিত্যক্ত। তাহলে বাংলাদেশের জনগণকে কি অনিশ্চিত এক ভবিষ্যৎ পর্যন্ত একচেটিয়া মুনাফার ভাড়ার বিদ্যুৎ প্লান্ট থেকে বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে থাকতে হবে? সরকার বড় গলায় বলছে, লোডশেডিং কমেছে। হ্যাঁ, কমেছে তো বটে, তবে কত মূল্যে? এ পথে নেওয়ার জন্য এবং এ পথে স্থিতি রাখার জন্য তো অবশ্যই সরকারের ইচ্ছা ও নীতিই দায়ী।
কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র বিশ্ব থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। যেসব দেশে আগে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা দিয়ে উৎপাদন করা হতো, সেসব দেশে এখন সেই হার নেমে এসেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশে। কিন্তু বাংলাদেশ যেন উল্টো পথে হাঁটছে। বাংলাদেশ অন্য সব বিকল্প উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে অবহেলা করে আমদানিনির্ভর কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার অসুবিধা হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে দূষণ, যে দূষণের কারণে জনগণের স্বাস্থ্যহানি হবে, গাছ ও প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্য কথায়, কয়লার অন্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে ক্ষতিটা কিছু কম হলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ক্ষতি অনেক বেশি হবে। ভারতের যে রাষ্ট্রায়ত্ত কম্পানির মাধ্যমে ও তাদের মালিকানায় খুলনার রামপালে ১০০০ মেগাওয়াটের বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, সেটার ক্ষতি বাংলাদেশকেই পূর্ণাঙ্গভাবে বহন করতে হবে। ক্ষতি হবে সুন্দরবনের, ক্ষতি হবে এ দেশের জীববৈচিত্র্যের, স্বাস্থ্যহানি হবে এ দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর। বলা হচ্ছে, আরো দূরে এনে বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করলে অর্থনৈতিকভাবে এগোবে না, কিন্তু সরকার কি নিরপেক্ষ কোনো বিশেষজ্ঞদল দিয়ে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষতির দিকটা মূল্যায়ন করেছে? সরকারের অধীনে থাকা পরিবেশ দপ্তর তো ছাড়পত্র দিতেই পারে। কিন্তু দেশের জনগণ সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক এই সর্বনাশা বিদ্যুৎ প্রকল্প চায় না। ভারতে একটি কম্পানি কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে জনগণের ক্ষোভের মুখে প্রকল্প বাস্তবায়ন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী পাবে? কয়লা রপ্তানিতেও ভারত লাভ করবে। যন্ত্রপাতি সরবরাহেও ভারত লাভ করবে। আবার মুনাফার ভাগাভাগিতেও ভারত লাভ করবে। হ্যাঁ, বাংলাদেশ ১০০০ থেকে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাবে বটে, তবে ওই বিদ্যুতের জন্য এ দেশের মানুষকে কত হারাতে হবে? যাঁরা রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করার জন্য আন্দোলন করছেন, তাঁরা অবশ্যই দেশপ্রেমিক। তাঁদের সঙ্গে এ দেশের জনগণের একাত্মতা আছে। আমরা আশা করি, দেশের ক্ষতির কথাটা চিন্তা করে সরকার রামপাল প্রকল্প থেকে সরে আসবে।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(কাল্র কন্ঠ, ০২/