প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর, ২০১৩ ০১:৫২:৪৫ | অঅ-অ+ |
মনির হোসেন। ১৩ বছর বয়সী শিশু। ঢাকার অদূরে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বড়কাঞ্চনপুরে তাদের বাড়ি। সেখানেই স্থানীয় একটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ত সে। ২০ নভেম্বর শুরু হওয়া প্রাথমিক স্কুল সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আগে শিশুটি বাবার কাছে বায়না ধরেছিল, 'বাবা ঢাকা দেখতে যাব।' গাড়িচালক বাবা বায়নাও মিটিয়ে ছিলেন ছেলের। তবে ইটপাথরে গড়া রঙিন ঢাকা দেখে শিশুটি আর বাড়ি ফিরে যেতে পারেনি। হরতালের আগুনে পুড়ে গতকাল বাড়িতে গেছে শিশুটির নিথর দেহ। ঢাকা দেখতে আসার সময় সারা পথেই বাবা রমজান আলীর কাছে অনেক বায়না ধরেছিল মনির। গতকাল বাড়ি ফেরার সময়ও পুরো পথ বাবার পাশেই ছিল মনির। তবে এবার মনিরের কোনো বায়না ছিল না। মনির আর কোনোদিন বাবার কাছে কোনো বায়না ধরবে না। কারণ, হরতাল মনিরের সব বায়না কেড়ে নিয়েছে। গত সোমবার গাজীপুর চৌরাস্তার পাশে হরতালকারীদের দেওয়া আগুনে বাবার গাড়ির ভেতর দগ্ধ হয়েছিল ঘুমন্ত মনির। শরীরের ৯৫ ভাগ পোড়া নিয়ে যন্ত্রণাকাতর মনির টানা তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যায়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক পার্থশঙ্কর প্রামাণিক জানান, মনিরের শরীরের ৯৫ ভাগই পুড়ে গিয়েছিল। এ অবস্থা থেকে পোড়া রোগী ফিরে আসে না। তবু ছেলেটিকে আইসিইউতে নিয়ে নিবিড় পরিচর্যায় রাখা হয়েছিল। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে গতকাল ভোর পৌনে ৫টার দিকে মনির মারা যায় বলে জানান ওই চিকিৎসক।মনিরের বাবা গাড়িচালক রমজান আলী জানান, রোববার মনির সারাদিন তার সঙ্গে ঢাকায় গাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। সোমবার ভোর রাতে মালবোঝাই কাভার্ড ভ্যান নিয়ে তিনি গাজীপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। পাশে বসা মনির। ওই দিন সকালে হরতাল শুরু হয়ে যাওয়ায় তিনি গাড়িটি চৌরাস্তার পাশে পার্ক করে রাখেন। গাড়িতেই ছেলে ঘুমিয়ে যাওয়ায় তাকে রেখেই তিনি খাবার কিনতে যান। একটু পরে ফিরে দেখেন তার গাড়ি জ্বলছে, ছেলে অঙ্গার হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। সেদিনের নৃশংস ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে আবারও কেঁদে ফেলেন এই বাবা।
সন্তানহারা রমজান বিলাপ করে বলছিলেন, ছেলেটা খাবার খেয়েও যেতে পারল না।রমজান আলী বলেন, 'পুড়ে যাওয়ার পর যন্ত্রণায় ছেলেটা বলছিল, আর ঢাকা আসবে না। বারবার বাড়ি যেতে চাইছিল পোলাডা। আমি ওর ঢাকা দ্যাখার বায়না মেটালেও বাড়ি যাওয়ার বায়না তো মেটাইতে পারলাম না।' পরক্ষণেই তিনি বলছিলেন, 'ঢাকা আসার সময় মনির আমার পাশে বসে কত কথা কইল। ঢাকা থেকে বাড়ি গিয়া ভালো করে পড়ালেখা করবে। ওরে কইছিলাম, ভালো করে পড়ালেখা করলে ওরে আবার ঢাকায় নিয়ে বড় ডাক্তার দেখাইমু।' আবার বিলাপ এ বাবার, 'আর কখনোই মনির ঢাকা আইবো না, ওরে ডাক্তার দেখাতে অইবো না। আমিই তো ছেলেডারে ঢাকায় আইনা মারলাম। আমি ওর লাশ নিয়া বাড়ি যাইয়া মনুর কাছে (মনিরের মা) জবাব দিমু কী? আমিই তো আমার ছেলেডারে পোড়াইয়া মারলাম, আমারে আপনারা গ্রেফতার করেন স্যার।'মনিরের একজন স্বজন জানান, মনিরের গলাফোলা রোগ ছিল। এজন্য তাকে ঢাকা ঘুরিয়ে সময় পেলে ডাক্তারও দেখানোর কথা ছিল। বছরখানেক আগে কালিয়াকৈরে বাড়ির সামনের রাস্তায় গাড়িচাপায় মারা গিয়েছিল মনিরের একমাত্র বোন মুক্তা। এবার ছেলে হারিয়ে পুরো পরিবারটাই শেষ হয়ে গেল।
কালিয়াকৈর প্রতিনিধি জানান, দুপুরের পর মনিরের লাশ বাড়িতে নিলে সেখানে শত শত মানুষ ভিড় করেন। মনিরের মা মিনুয়ারা বেগম ছেলের নিথর দেহ দেখে বারবার মূর্ছা যান। জ্ঞান ফিরে আসার পর এই মা বিলাপ করে বলতে থাকেন, 'পুরা শরীরডাই পুইড়া দিছে আমার ছেলেডার। আমার হাত ধরার চেষ্টা করে কি যেন কইতে চেষ্টা করছিল আমার মনির।' এ কথা বলে আবার মূর্ছা যান মা মিনিয়ারা। পরক্ষণেই ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে বলেন, 'যারা আমার পোলারে আগুন দিয়া মারছে, ওগো আল্লাহ বিচার করবে।'
এদিকে জয়দেবপুর থানা পুলিশ জানায়, শিশু মনিরের শরীরে আগুন দিয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ওইদিনই থানায় মামলা হয়েছে। এ মামলাটি এখন হত্যা মামলায় রূপান্তর হবে। ওই মামলায় গাজীপুর জেলা জামায়াতের আমির আবুল হাসেম খান ও সাধারণ সম্পাদক এস এম সানাউল্লাহসহ বিএনপি ও জামায়াতের ৫৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ২৫-৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম জানান, মামলায় ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
http://www.samakal.net/2013/11/08/18700
__._,_.___