সরকার যে অসুস্থ তা সাধারণ গীতা সরকার বুঝলেও হাসিনা সরকার বোঝেন না
মোহাম্মদ আবদুল গফুর : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ গীতা সরকারকে সহানুভূতি জানাতে এবং তাকে বোঝাতে যে, তার ভোগান্তি বিরোধী দলের অপকর্মের ফল। এবং বিরোধী দল যারা করে তারা আসলেই খারাপ লোক। কিন্তু অগ্নিদগ্ধ গীতা সরকার তাকে কী বলেছিলেন? বলেছিলেন, আমরা অসুস্থ সরকার চাই না। বিরোধী দলের হাতে অগ্নিদগ্ধ হয়েও হুঁশ হারাননি, রাজনৈতিক সচেতনতা হারাননি সাধারণ মেয়ে গীতা। তাই তিনি বিরোধী দল নয়, সরকারের বিরুদ্ধেই অনাস্থা ঘোষণা করে বলেছেন, আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।
গীতা সরকার প্রমাণ করেছেন সরকার দেশের সাধারণ মানুষকে যত বোকা ঠাওরিয়েছেন তারা বোকা নন। তারা বোঝেন, কেন, কিভাবে দেশে বর্তমান সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। আর তাই দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইলে নিয়মিত ব্যবধানে দেশে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে হবে। শুধু যেনতেন প্রকারে নিয়মিত ব্যবধানে নির্বাচন দেয়ার দ্বারা দেশে কখনও গণতন্ত্র আসতে পারে না। যেকোনো ধরনের একটা নির্বাচনী মহড়া দিয়ে বিশেষ ব্যক্তি ও বিশেষ দলের ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত করার যে রাজনীতি তার নাম অসুস্থ রাজনীতি। আর এ রকম রাজনীতির মাধ্যমে যে সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে চায় সে সরকারের নাম অসুস্থ সরকার। হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ গীতা সেরকম সরকারকেই অসুস্থ সরকার নামে অভিহিত করে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের বিরুদ্ধে একজন সাধারণ মানুষ গীতা সরকারের এই অনাস্থাকে কতটা মূল্য দেবেন, তা তিনিই ভালো জানেন। তবে মনে হয় তার সরকারের বিরুদ্ধে অগ্নিদগ্ধ গীতার এই অনাস্থা জ্ঞাপনকে তিনি কোনো মূল্যই দিচ্ছেন না। কারণ তিনি এত সবের পরও তার একতরফা নির্বাচনের জিদ বাস্তবায়নের পথেই এগিয়ে চলেছেন। দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বর্জিত নির্বাচনী মহড়ার দ্বারা তিনি কী লাভ করবেন তা তিনিই ভালো জানেন। ইতোমধ্যে তার এই জিদের একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে বহির্বিশ্বেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা করেছে কেবল সকল দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই তাদের সমর্থন লাভ করবে। অথচ সব দল তো দূরের কথা প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না।
সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে সে নির্বাচন যে বহির্বিশ্বে সমর্থন লাভ করবে না তা জেনেশুনেও প্রধানমন্ত্রী এই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চালিয়ে নিতে কেন গোঁ ধরেছেন? তিনি কি তবে ধরেই নিয়েছেন সকল দলের কাছে গ্রহণযোগ্য অবাধ নির্বাচন হলে তার দলের পরাজয় নিশ্চিত? এই ভয়েই কি তিনি যে কোনো মূল্যে প্রধান বিরোধী দলসহ অধিকাংশ দলের বর্জিত নির্বাচন অনুষ্ঠানে গোঁ ধরেছেন? তা যদি সত্য হয় তবে বলতেই হবে তিনি প্রকৃতপক্ষে তাদের বাকশালী শাসনের ঐতিহ্য ভুলতে পারছেন না।
কিন্তু দেশ তো আমাদের ইতিহাসের লজ্জাকর বাকশালী ঐতিহ্য ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে চায়। কারণ, বাকশালী ঐতিহ্য আর গণতন্ত্র কখনও একসাথে চলতে পারে না। তাছাড়া দেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন। যে দেশ একবার নয়, একাধিকবার দলীয় সরকারের পরিবর্তে নিন্দনীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে তার পক্ষে পুনরায় পচা অতীতের মতো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের লজ্জাকর স্থানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়, শোভনও নয়। এতে শুধু দেশব্যাপী অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও হানাহানিই বেড়ে যাবে, যার নমুনা সারাদেশে ইতোমধ্যেই প্রকট হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে বিরোধী দলের আরোপিত হরতাল, অবরোধ প্রভৃতি কর্মসূচির কারণে দেশের অর্থনীতি চরম স্থবিরতার মুখে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তারপরও হরতাল, অবরোধ প্রভৃতি কর্মসূচিতে জনগণের সম্পৃক্ততা ক্রমেই বাড়ছে, তার কারণ কি? তার জন্য দায়ী কে? এসব প্রশ্নের উত্তর একটাই, যা অগ্নিদগ্ধ গীতা সরকারের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে- অসুস্থ সরকার। যতদিন এ অসুস্থ সরকার জনগণের কাঁধে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চেপে থাকবে, ততদিন দেশে অসুস্থ রাজনীতিই চলবে। বরং বলা চলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অসুস্থতার ক্রমাবনতিই ঘটতে থাকবে।
তাই যারা দেশের প্রকৃত কল্যাণকামী, তাদের প্রত্যাশা দেশের শান্তিপূর্ণ অগ্রগতির লক্ষ্যে যে কোনো মূল্যে আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ অসুস্থতা যত দ্রুত সম্ভব, নিরাময়ের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কীভাবে হবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অসুস্থতার নিরাময়? কোনো ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থে নয়, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অসুস্থতা নিরাময়ের পথ খুঁজে বের করতে হবে। সংঘাত নয়, সমঝোতার পথেই খুঁজে পেতে হবে রাজনৈতিক অসুস্থতার নিরাময় ব্যবস্থা।
আমরা দেখে খুশি হয়েছি যে, দেশের এই রাজনৈতিক ক্ষেত্রের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বিরোধী দলীয় নেত্রী খেই হারিয়ে না ফেলে সময় শেষ না হয়ে যেতেই সঙ্কট নিরসনে সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সরকারপ্রধানের হাবভাব দেখে মনে হয় তিনি সমঝোতার নয়, সংঘাতের পথেই অগ্রসর হতে জিদ বজায় রেখে অগ্রসর হচ্ছেন। সমঝোতা না হওয়ার ফলে দেশে সংঘাত ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ইতোমধ্যেই বহু লোক হতাহত হয়েছে। সরকার সমঝোতার বদলে সংঘাতের পথ বেছে নিয়ে একদিকে পুলিশি হামলা, অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার চালিয়ে যাচ্ছেন।
সরকারের কর্মকা- দেখে মনে হয়, এভাবে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হামলা-মামলার শিকার করে একতরফা নির্বাচনী মহড়া দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার পথে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। কিন্তু এ পথ যে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ নয়, অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, সংঘাত বাড়িয়ে তোলার পথ, সরকারপ্রধান যেন তা গায়েই মাখছেন না। অথচ তিনি ইচ্ছা করলে যে কোনো সময় শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে ফিরে আসতে পারেন। সবাই জানেন সে পথ হচ্ছে- নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা।
পাঠকদের মনে থাকার কথা অতীতে আমাদের ইতিহাসের এক পর্যায়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দাবি ও আন্দোলনের ভিত্তিতেই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন তদানিন্তন সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়। সে ব্যবস্থা প্রবর্তনের পেছনে শেখ হাসিনার এ গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি নিজেও গৌরব বোধ করতে পারেন। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের সে ব্যবস্থা দেশে বেশ কিছুদিন কার্যকর ছিল এবং তার ফলে পর্যায়ক্রমে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমাসীন হয়। এমন একটি সুন্দর ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য শেখ হাসিনা যথেষ্ট গৌরব বোধও করতে পারেন।
কিন্তু এত সুন্দর ব্যবস্থার বদলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জিদ ধরে শুধু তিনি নিজেকেই বিতর্কিত করে তোলেননি, দেশবাসীকে নিক্ষেপ করেছেন চরম অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে। নিকট অতীতে তিনি এক সময় বলতেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় বাংলাদেশেও সেভাবেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ যেহেতু অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয় এ দেশেও তাই হবে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে তবে তিনি অতীতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন কেন? অতীতে যা অতিপ্রয়োজনীয় বিবেচিত হয়েছিল তা বর্তমানে হঠাৎ করে কেন অবশ্য বর্জনীয় হয়ে উঠলো, এ প্রশ্নের উত্তর কি দেবেন তিনি?
তবে কি সুবিধাবাদিতাই তার রাজনৈতিক জীবনের প্রধান মূলমন্ত্র? অতীতে নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে তার ক্ষমতাসীন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আর বর্তমানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হলে তার ক্ষমতায় যাওয়ার আশা সুদূর পরাহত হয়ে ওঠায়ই কি তিনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ঘোর বিরোধী হয়ে উঠেছেন? সুবিধাবাদিতাই যদি তার রাজনৈতিক জীবনের মূলমন্ত্র হয় তাহলে গণতন্ত্রের নামই বা মুখে নেয়া কেন। আর নির্বাচনের মহড়া দেয়ারই বা প্রয়োজন কি? বাকশালী ব্যবস্থার অনুকরণে বলে দিলেই তো হয় তার নিজের ক্ষমতায় টিকে থাকা যে ব্যবস্থায় নিশ্চিত হবে সেই ব্যবস্থাধীনেই দেশ চলতে হবে।
দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যে বর্তমানে তার কল্যাণে অসুস্থ হয়ে উঠেছে তা দেশের সাধারণ মানুষও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। অসুস্থ রাজনীতির কবলে পড়ে দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। বংলাদেশে মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। এই বন্ধুহীনতার সুযোগে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ডুবন্ত মানুষের মত তৃণ ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগে বর্তমান সরকারকে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টিকফা চুক্তির মতো সর্বনাশা চুক্তিও স্বাক্ষর করিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে শুধু বাংলাদেশর জাতীয় স্বার্থেই নয়, জাতীয় সার্বভৌমত্বও চরমভাবে বিপন্ন হয়ে উঠছে। দেশের এ বিপর্যস্ত অবস্থার জন্য মূলত দায়ী বর্তমান সরকারের জিদ। এই গণতন্ত্রবিরোধী জিদের খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের ষোল কোটি মানুষকে, দেশের বিপন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য খাতকে, দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত তৈরি পোশাক শিল্পকে।
চলমান পরিস্থিতি দেশকে কোন্ দিকে নিয়ে চলছে বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোঝেন না, তা নয়। কিন্তু মূল সমস্যা যেহেতু তার জিদ, সেহেতু তিনি সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। নিজের ও দলের ক্ষুদ্র স্বার্থে তার অতীতের নিজের ফর্মুলা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন ব্যবস্থার বিরোধিতা করে দেশে গণতন্ত্রকে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিক্ষেপ করার খেলায় মেতে উঠেছেন। এটা যে দেশের জন্য কল্যাণকর পথ নয়, দেশের জন্য শুভ ইঙ্গিতবহ ব্যাপার নয়, তা বিলক্ষণ বুঝেও না বোঝার ভান করছেন এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন করার জন্য বিরোধী দলকে একতরফা দুষে চলেছেন। এতে করে তিনি যে তার অতীতের অবস্থানের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন তাও যেন তিনি বুঝে উঠছেন না। এটা যে অসুস্থ রাজনীতির লক্ষণ এবং এই রাজনীতির জন্য যে সরকার দায়ী সে সরকার যে একটি অসুস্থ সরকার এটা অতি সাধারণ মেয়ে গীতা সরকার বুঝলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন বুঝতে চান না, সে রহস্যের উত্তর দেবে কে?
গীতা সরকার প্রমাণ করেছেন সরকার দেশের সাধারণ মানুষকে যত বোকা ঠাওরিয়েছেন তারা বোকা নন। তারা বোঝেন, কেন, কিভাবে দেশে বর্তমান সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। আর তাই দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইলে নিয়মিত ব্যবধানে দেশে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে হবে। শুধু যেনতেন প্রকারে নিয়মিত ব্যবধানে নির্বাচন দেয়ার দ্বারা দেশে কখনও গণতন্ত্র আসতে পারে না। যেকোনো ধরনের একটা নির্বাচনী মহড়া দিয়ে বিশেষ ব্যক্তি ও বিশেষ দলের ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত করার যে রাজনীতি তার নাম অসুস্থ রাজনীতি। আর এ রকম রাজনীতির মাধ্যমে যে সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে চায় সে সরকারের নাম অসুস্থ সরকার। হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ গীতা সেরকম সরকারকেই অসুস্থ সরকার নামে অভিহিত করে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের বিরুদ্ধে একজন সাধারণ মানুষ গীতা সরকারের এই অনাস্থাকে কতটা মূল্য দেবেন, তা তিনিই ভালো জানেন। তবে মনে হয় তার সরকারের বিরুদ্ধে অগ্নিদগ্ধ গীতার এই অনাস্থা জ্ঞাপনকে তিনি কোনো মূল্যই দিচ্ছেন না। কারণ তিনি এত সবের পরও তার একতরফা নির্বাচনের জিদ বাস্তবায়নের পথেই এগিয়ে চলেছেন। দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বর্জিত নির্বাচনী মহড়ার দ্বারা তিনি কী লাভ করবেন তা তিনিই ভালো জানেন। ইতোমধ্যে তার এই জিদের একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে বহির্বিশ্বেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা করেছে কেবল সকল দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই তাদের সমর্থন লাভ করবে। অথচ সব দল তো দূরের কথা প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না।
সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে সে নির্বাচন যে বহির্বিশ্বে সমর্থন লাভ করবে না তা জেনেশুনেও প্রধানমন্ত্রী এই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চালিয়ে নিতে কেন গোঁ ধরেছেন? তিনি কি তবে ধরেই নিয়েছেন সকল দলের কাছে গ্রহণযোগ্য অবাধ নির্বাচন হলে তার দলের পরাজয় নিশ্চিত? এই ভয়েই কি তিনি যে কোনো মূল্যে প্রধান বিরোধী দলসহ অধিকাংশ দলের বর্জিত নির্বাচন অনুষ্ঠানে গোঁ ধরেছেন? তা যদি সত্য হয় তবে বলতেই হবে তিনি প্রকৃতপক্ষে তাদের বাকশালী শাসনের ঐতিহ্য ভুলতে পারছেন না।
কিন্তু দেশ তো আমাদের ইতিহাসের লজ্জাকর বাকশালী ঐতিহ্য ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে চায়। কারণ, বাকশালী ঐতিহ্য আর গণতন্ত্র কখনও একসাথে চলতে পারে না। তাছাড়া দেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন। যে দেশ একবার নয়, একাধিকবার দলীয় সরকারের পরিবর্তে নিন্দনীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে তার পক্ষে পুনরায় পচা অতীতের মতো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের লজ্জাকর স্থানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়, শোভনও নয়। এতে শুধু দেশব্যাপী অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও হানাহানিই বেড়ে যাবে, যার নমুনা সারাদেশে ইতোমধ্যেই প্রকট হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে বিরোধী দলের আরোপিত হরতাল, অবরোধ প্রভৃতি কর্মসূচির কারণে দেশের অর্থনীতি চরম স্থবিরতার মুখে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তারপরও হরতাল, অবরোধ প্রভৃতি কর্মসূচিতে জনগণের সম্পৃক্ততা ক্রমেই বাড়ছে, তার কারণ কি? তার জন্য দায়ী কে? এসব প্রশ্নের উত্তর একটাই, যা অগ্নিদগ্ধ গীতা সরকারের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে- অসুস্থ সরকার। যতদিন এ অসুস্থ সরকার জনগণের কাঁধে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চেপে থাকবে, ততদিন দেশে অসুস্থ রাজনীতিই চলবে। বরং বলা চলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অসুস্থতার ক্রমাবনতিই ঘটতে থাকবে।
তাই যারা দেশের প্রকৃত কল্যাণকামী, তাদের প্রত্যাশা দেশের শান্তিপূর্ণ অগ্রগতির লক্ষ্যে যে কোনো মূল্যে আমাদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ অসুস্থতা যত দ্রুত সম্ভব, নিরাময়ের ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কীভাবে হবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অসুস্থতার নিরাময়? কোনো ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থে নয়, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অসুস্থতা নিরাময়ের পথ খুঁজে বের করতে হবে। সংঘাত নয়, সমঝোতার পথেই খুঁজে পেতে হবে রাজনৈতিক অসুস্থতার নিরাময় ব্যবস্থা।
আমরা দেখে খুশি হয়েছি যে, দেশের এই রাজনৈতিক ক্ষেত্রের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বিরোধী দলীয় নেত্রী খেই হারিয়ে না ফেলে সময় শেষ না হয়ে যেতেই সঙ্কট নিরসনে সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সরকারপ্রধানের হাবভাব দেখে মনে হয় তিনি সমঝোতার নয়, সংঘাতের পথেই অগ্রসর হতে জিদ বজায় রেখে অগ্রসর হচ্ছেন। সমঝোতা না হওয়ার ফলে দেশে সংঘাত ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ইতোমধ্যেই বহু লোক হতাহত হয়েছে। সরকার সমঝোতার বদলে সংঘাতের পথ বেছে নিয়ে একদিকে পুলিশি হামলা, অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার চালিয়ে যাচ্ছেন।
সরকারের কর্মকা- দেখে মনে হয়, এভাবে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হামলা-মামলার শিকার করে একতরফা নির্বাচনী মহড়া দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার পথে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। কিন্তু এ পথ যে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ নয়, অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, সংঘাত বাড়িয়ে তোলার পথ, সরকারপ্রধান যেন তা গায়েই মাখছেন না। অথচ তিনি ইচ্ছা করলে যে কোনো সময় শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে ফিরে আসতে পারেন। সবাই জানেন সে পথ হচ্ছে- নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা।
পাঠকদের মনে থাকার কথা অতীতে আমাদের ইতিহাসের এক পর্যায়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দাবি ও আন্দোলনের ভিত্তিতেই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন তদানিন্তন সরকার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়। সে ব্যবস্থা প্রবর্তনের পেছনে শেখ হাসিনার এ গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি নিজেও গৌরব বোধ করতে পারেন। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের সে ব্যবস্থা দেশে বেশ কিছুদিন কার্যকর ছিল এবং তার ফলে পর্যায়ক্রমে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমাসীন হয়। এমন একটি সুন্দর ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য শেখ হাসিনা যথেষ্ট গৌরব বোধও করতে পারেন।
কিন্তু এত সুন্দর ব্যবস্থার বদলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জিদ ধরে শুধু তিনি নিজেকেই বিতর্কিত করে তোলেননি, দেশবাসীকে নিক্ষেপ করেছেন চরম অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে। নিকট অতীতে তিনি এক সময় বলতেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয় বাংলাদেশেও সেভাবেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ যেহেতু অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয় এ দেশেও তাই হবে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে তবে তিনি অতীতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন কেন? অতীতে যা অতিপ্রয়োজনীয় বিবেচিত হয়েছিল তা বর্তমানে হঠাৎ করে কেন অবশ্য বর্জনীয় হয়ে উঠলো, এ প্রশ্নের উত্তর কি দেবেন তিনি?
তবে কি সুবিধাবাদিতাই তার রাজনৈতিক জীবনের প্রধান মূলমন্ত্র? অতীতে নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে তার ক্ষমতাসীন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আর বর্তমানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হলে তার ক্ষমতায় যাওয়ার আশা সুদূর পরাহত হয়ে ওঠায়ই কি তিনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ঘোর বিরোধী হয়ে উঠেছেন? সুবিধাবাদিতাই যদি তার রাজনৈতিক জীবনের মূলমন্ত্র হয় তাহলে গণতন্ত্রের নামই বা মুখে নেয়া কেন। আর নির্বাচনের মহড়া দেয়ারই বা প্রয়োজন কি? বাকশালী ব্যবস্থার অনুকরণে বলে দিলেই তো হয় তার নিজের ক্ষমতায় টিকে থাকা যে ব্যবস্থায় নিশ্চিত হবে সেই ব্যবস্থাধীনেই দেশ চলতে হবে।
দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যে বর্তমানে তার কল্যাণে অসুস্থ হয়ে উঠেছে তা দেশের সাধারণ মানুষও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। অসুস্থ রাজনীতির কবলে পড়ে দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। বংলাদেশে মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হওয়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার নাভি পিল্লাই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। এই বন্ধুহীনতার সুযোগে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ডুবন্ত মানুষের মত তৃণ ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগে বর্তমান সরকারকে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টিকফা চুক্তির মতো সর্বনাশা চুক্তিও স্বাক্ষর করিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে শুধু বাংলাদেশর জাতীয় স্বার্থেই নয়, জাতীয় সার্বভৌমত্বও চরমভাবে বিপন্ন হয়ে উঠছে। দেশের এ বিপর্যস্ত অবস্থার জন্য মূলত দায়ী বর্তমান সরকারের জিদ। এই গণতন্ত্রবিরোধী জিদের খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের ষোল কোটি মানুষকে, দেশের বিপন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য খাতকে, দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী খাত তৈরি পোশাক শিল্পকে।
চলমান পরিস্থিতি দেশকে কোন্ দিকে নিয়ে চলছে বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোঝেন না, তা নয়। কিন্তু মূল সমস্যা যেহেতু তার জিদ, সেহেতু তিনি সবকিছু বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। নিজের ও দলের ক্ষুদ্র স্বার্থে তার অতীতের নিজের ফর্মুলা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন ব্যবস্থার বিরোধিতা করে দেশে গণতন্ত্রকে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিক্ষেপ করার খেলায় মেতে উঠেছেন। এটা যে দেশের জন্য কল্যাণকর পথ নয়, দেশের জন্য শুভ ইঙ্গিতবহ ব্যাপার নয়, তা বিলক্ষণ বুঝেও না বোঝার ভান করছেন এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থার দাবিতে আন্দোলন করার জন্য বিরোধী দলকে একতরফা দুষে চলেছেন। এতে করে তিনি যে তার অতীতের অবস্থানের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন তাও যেন তিনি বুঝে উঠছেন না। এটা যে অসুস্থ রাজনীতির লক্ষণ এবং এই রাজনীতির জন্য যে সরকার দায়ী সে সরকার যে একটি অসুস্থ সরকার এটা অতি সাধারণ মেয়ে গীতা সরকার বুঝলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন বুঝতে চান না, সে রহস্যের উত্তর দেবে কে?
__._,_.___