বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- দুই দলই, এমনকি ডান-বামের আরো কিছু দলের নেতারা দাবি করে থাকেন, 'দেশটিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে। এখন আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় না।' কথাটা যে সঠিক নয়, তা অনেকে জেনেও স্বীকার করতে চান না। এ কথা সত্য, বাংলাদেশে এখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় না। দাঙ্গা হতে হলে দুই সম্প্রদায়কেই সমান শক্তিশালী হতে হয়। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আগের সেবাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- দুই দলই, এমনকি ডান-বামের আরো কিছু দলের নেতারা দাবি করে থাকেন, 'দেশটিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে। এখন আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় না।' কথাটা যে সঠিক নয়, তা অনেকে জেনেও স্বীকার করতে চান না। এ কথা সত্য, বাংলাদেশে এখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় না। দাঙ্গা হতে হলে দুই সম্প্রদায়কেই সমান শক্তিশালী হতে হয়। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আগের সেই সংখ্যাশক্তি নেই, রাজনৈতিক অবস্থানও নেই। সর্বোপরি ক্রমাগত নির্যাতিত হতে হতে তাদের মনোবলও আর চাঙ্গা নেই।
ফলে তারা একতরফাভাবে নির্যাতিত হয়। পাল্টা দাঙ্গা করতে পারে না। তাই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নেই; কিন্তু সংখ্যালঘু নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। এই নির্যাতনের পেছনে শুধু অর্থনৈতিক কারণ নয়, রাজনৈতিক কারণও বিদ্যমান। অর্থনৈতিক কারণ হলো, সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগে বাধ্য করে তাদের ভূসম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করা। রাজনৈতিক কারণটি হলো, সংখ্যালঘুদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা গেলে তাদের সংখ্যা কমে যায়। বিএনপি ও জামায়াতের মতো সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দলগুলোর ধারণা, তাতে একদিকে আওয়ামী লীগের ভোট কমে, অন্যদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুবিহীন বাংলাদেশে নিরঙ্কুশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করা গেলে দেশটিকে এক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র বা তালেবান রাষ্ট্র বানানোর পথও সুগম হয়।
এই উদ্দেশ্যে দেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-ক্ষুদ্রজাতি প্রমুখ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ধারাবাহিক নির্যাতন তো চলেই, সাধারণ নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনের সময় তা আরো বেড়ে যায় এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এই নির্যাতন সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগে তো বাধ্য করেই, তার সঙ্গে চলে তাদের নারী নির্যাতন, মন্দির, বিহার, দেবমূর্তি ধ্বংস করা ইত্যাদি।
এই সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখেছি ২০০১ সালের নির্বাচনের সময়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে বিএনপি ও জামায়াত যেসব জেলায় শক্তিশালী, যেমন- বগুড়া, যশোর, সাতক্ষীরা, রামু, কক্মবাজার, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় সংখ্যালঘুরা নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়েছে। তাদের ঘরবাড়ি, মন্দির পোড়ানো হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে গোটা হিন্দু গ্রাম জনশূন্য হয়ে গেছে।
এই অমানবিক নির্যাতনের মুখে আগে সংখ্যালঘুরা প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম রাজ্য প্রভৃতিতে গিয়ে আশ্রয় নিত। বর্তমানেও আশ্রয় নিতে ছোটে। কিন্তু এই আশ্রয় নেওয়া তাদের জন্য দুরূহ হয়ে উঠেছে। কারণ ভারত সরকার তাদের দেশে সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করার নামে সীমান্তে বিএসএফের পাহারা, কাঁটাতারের বেড়া এত শক্ত করেছে যে তা পেরিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদেরও ভারতে আশ্রয় গ্রহণ ক্রমশ দুরূহ হয়ে উঠছে। সম্প্রতি এমন খবরও পাওয়া গেছে, বেশ কিছু সংখ্যালঘু পরিবার দেশ ছাড়তে গেলে ভারতের বর্ডার পুলিশ তাদের বাংলাদেশে পুশব্যাক করেছে।
বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা কি তাহলে ভারত কর্তৃকও পরিত্যক্ত? এ সম্পর্কে কলকাতার এক বুদ্ধিজীবী বন্ধুর মুখে একটি থিওরি শুনেছি। তিনি বলেছেন, 'ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) যত দিন বর্ণহিন্দু সম্প্রদায় ও উচ্চবর্ণের শিক্ষিত সংখ্যালঘুরা ছিলেন, তত দিন তাঁদের স্বার্থ ও নিরাপত্তার জন্য বর্ণহিন্দুদের দ্বারা প্রভাবিত ভারত সরকারের মাথাব্যথা ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির অবনতি হলে তখন তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণেরও হুমকি দিত। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ সংখ্যালঘু নির্যাতনের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীকে দিল্লি ছুটে গিয়ে নেহরু সরকারকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে নেহরু-লিয়াকত চুক্তি করতে হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য ভারত সরকারের এই মাথাব্যথা আর নেই।'
কলকাতার বন্ধুর মতে, এর প্রধান কারণ বাংলাদেশ থেকে অনেক আগেই উচ্চবর্ণের ও প্রতিষ্ঠিত পেশাজীবী অধিকাংশ সংখ্যালঘু পরিবার চলে গেছে, এখন যারা আছে, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই উচ্চবর্ণের নয় এবং সমাজের নিচুতলার মানুষ। তাদের জন্য ভারতের সরকার ও মিডিয়ার মাথাব্যথা কম। এ জন্যই ২০০১ সালে বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে-পরে যখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্মম নির্যাতন (পূর্ণিমা শীলকে গণধর্ষণসহ) হয় এবং তারা দলে দলে দেশত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করে, তখন রাজ্যের ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পর্যন্ত সে কথা অস্বীকার করে বলেছিলেন, 'না, না, বাংলাদেশ থেকে কোনো শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে আসছে না।'
পরে ধরা পড়ল, ২০০১ সালে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে গমনকারী সংখ্যালঘু উদ্বাস্তুর সংখ্যা ছিল ১০ হাজারের ওপর। এই সংখ্যা প্রকাশ পেতেই সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণের মুখে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তিনি বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে গমনকারী শরণার্থীদের কথা গোপন করেছিলেন। এর অজুহাত তিনি দেখিয়েছিলেন এই বলে, 'বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার সংখ্যালঘু পশ্চিমবঙ্গে আসছে, এ কথা প্রকাশ পেলে পশ্চিমবঙ্গে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিত এবং সম্প্রদায়িক শান্তি বিপন্ন হতো। তাঁর এই অজুহাত বাংলাদেশে ও ভারতে অনেকেই মেনে নেননি।
বাংলাদেশের নির্যাতিত হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ও ক্ষুদ্রজাতি সম্প্রদায়গুলোর একটা বড় ভরসার স্থল ছিল অসাম্প্রদায়িক বাম গণতান্ত্রিক শিবির এবং তাদের সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ। সেই ১৯৫০ সালের ভয়াবহ সংখ্যালঘু নির্যাতনের সময় থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান আমলে যত দাঙ্গা বাধানো হয়েছে, তার প্রতিরোধে আওয়ামী লীগসহ বাম রাজনৈতিক দল, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীর দল ঐক্যবদ্ধ দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেছে। বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা দলবদ্ধ হয়ে রাজপথে মিছিল করেছেন। কেউ কেউ দুষ্কৃতি প্রতিরোধ করতে গিয়ে আত্মদান করেছেন।
এই পরিস্থিতি একুশ শতকের বাংলাদেশে নেই, সংখ্যালঘুদের স্বার্থ, অধিকার ও নিরাপত্তায় অতন্দ্র প্রহরী বাম গণতান্ত্রিক শিবিরটির এখন ভগ্নদশা। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিরোধ শিথিল। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নামের একটি মোর্চা গঠিত হয়েছিল, সেটি এখন দুর্বল ও বিভক্ত। বাংলাদেশের বর্তমান সুধীসমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই এখন দেশে সাম্প্রদায়িক দানবের দাপট ও সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে মাথা ঘামান না।
চলতি সালের নির্বাচনের সময়ও যখন দেখা গেল সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ-শিশু নির্মমভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, তাদের ঘরবাড়ি পোড়ানো হচ্ছে, তখন এই সুধীসমাজ একেবারেই নিষ্ক্রিয়। তারা মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের 'বাঘ বাঘ' চিৎকারের মতো 'গণতন্ত্র গেল গেল' বলে চিৎকারে পাড়া মাতাচ্ছেন।
দেশের এই দুঃসময়ে একটি অসাম্প্রদায়িক ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দায়িত্বই ছিল বেশি। বারবার সংখ্যালঘুদের হত্যা-নির্যাতনের শিকার করা হবে এবং সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পুনর্নির্মাণ করে কিছু ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া হবে- এটা কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের একমাত্র নীতি হতে পারে না। সংখ্যালঘুদের ওপর যাতে কোনো ধরনের হামলাই না হয় এবং তাদের সমান নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত থাকে, তার নিশ্চিত ব্যবস্থা করাই হবে একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালন করতে না পারলে কেবল মুখে সেক্যুলারিজমের বুলি আউড়ে কোনো লাভ হবে না।
বিএনপি ও জামায়াত সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালায় প্রধানত রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু এই নির্যাতনে পরোক্ষভাবে মদদ দিয়ে অথবা নির্যাতনকারীদের প্রটেকশন দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয় এমন একটি প্রভাবশালী শ্রেণী আওয়ামী লীগের মধ্যেও গড়ে উঠেছে। সরকার যে পুলিশ-র্যাব মাঠে নামিয়েও জামায়াতি সন্ত্রাস বন্ধ করতে পারছিল না, তার একটা বড় কারণ কোনো কোনো জেলায় এই সন্ত্রাসীরা আওয়ামী লীগের এক শ্রেণীর নেতার প্রটেকশন লাভ করেছে। পুলিশ সন্ত্রাসীদের ধরেছে আর এক শ্রেণীর আওয়ামী লীগ নেতা (এবং এমপিও) তাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য পুলিশের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন।
এই শ্রেণীর আওয়ামী নেতারা জামায়াতের সঙ্গে তাঁদের ছোটবড় লাভজনক ব্যবসায় পার্টনার হয়ে চুটিয়ে টাকা কামাচ্ছেন এবং জামায়াতিদের সন্ত্রাসের গডফাদার হয়ে বসে আছেন। জামায়াতিরা তাঁদের অর্থ দেয়। বিনা পয়সায় তাঁদের ব্যবসার পার্টনার করে নিয়ে নিজেদের জন্য প্রটেকশন তৈরি করে। এক শ্রেণীর আওয়ামী নেতার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ বগুড়া, যশোর, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, কক্মবাজার প্রভৃতি জায়গা থেকে আমার কাছেও এসেছে। একটি জেলার এসপি আমাকে টেলিফোনে দুঃখ করে বলেছেন, 'আমরা প্রাণ বাজি রেখে জামায়াতি সন্ত্রাসী ধরি আর আওয়ামী লীগের এক নেতার নির্দেশে তাদের ছেড়ে দিতে হয়।'
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার বিনীত নিবেদন, তিনি জামায়াতি জঙ্গি ও সন্ত্রাসী দমনের জন্য দেশব্যাপী যে চিরুনি অভিযান (Combing operation) চালাতে চান, সেটি আগে তাঁর দলের মধ্যে চালান। যেসব আওয়ামী নেতা ও এমপির জামায়াত-সংশ্লিষ্টতা, জামায়াতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত পার্টনারশিপ আছে, তাদের খুঁজে বের করুন এবং ব্যবস্থা নিন। বিএনপি ও জামায়াতের সংখ্যালঘু নির্যাতন দ্বারা আওয়ামী লীগের ভেতরের যে গোষ্ঠীটি অর্থনৈতিক লাভের শরিক হয়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন।
প্রধানমন্ত্রীকে একটি কথা মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগকে এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা ও জামায়াতি সংস্রব থেকে মুক্ত করতে না পারলে কেবল বিএনপিকে জামায়াতি সংস্রবমুক্ত করে কোনো লাভ হবে না। জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেও কোনো সুবিধা করা যাবে না। কারণ শর্ষের মধ্যেই যদি ভূত আশ্রয় গ্রহণ করে, তাহলে সেই শর্ষে দিয়ে ভূত তাড়ানো যায় না। আমি আগেই বলেছি, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নেই, কিন্তু রয়েছে তার চেয়েও ভয়াবহ সংখ্যালঘু নির্যাতন। এই নির্যাতন স্থায়ীভাবে বন্ধ করার জন্য হাসিনা সরকারকে তাদের দলের ভেতরে-বাইরে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লন্ডন, সোমবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৪
__._,_.___