মন্দ বন্ধ করলে ভালো প্রশংসিত হয়
ওয়াহিদ নবি
সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, মানুষের জীবন সব সময় যুক্তি-তর্ক মেনে চলে না। যদি চলত, তবে সক্রেটিসকে বিষপান করতে হতো না, আর যিশুকেও ক্রুশবিদ্ধ হতে হতো না। আসলে ভালো আর মন্দ দুটি আশ্চর্য জিনিস। একই জিনিস কারো কাছে ভালো আবার কারো কাছে খারাপ। আবার একই জিনিস একই মানুষের কাছে কখনো ভালো আবার কখনো মন্দ। আসলে মানুষের মনের কিছু বিশেষত্ব আছে, যাকে দুর্বলতা বলে বর্ণনা করা যায়। কোনো একটি দেশের মানুষের কথা আলোচনা করার সময় আমরা এই বিশেষত্বকে সেই দেশের মানুষের দুর্বলতা বলে আখ্যায়িত করি; কিন্তু হতে পারে এই দুর্বলতা সব দেশের মানুষের দুর্বলতা। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। একজন ভালো কাজ করলে অনেক সময় তা উপেক্ষিত হয় বা ভালোভাবে প্রশংসিত হয় না। কিন্তু কেউ ভুল করলে অনেকেই (বলব না সবাই) সোচ্চার হয়ে ওঠেন। আমরা বলি, এটি আমাদের দোষ কিন্তু আসলে অন্য দেশের মানুষের মধ্যেও এই বিশেষত্ব রয়েছে।
একটা নির্বাচন হয়ে গেল বাংলাদেশে। একটা সরকার শপথ গ্রহণ করে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। ১৮ দল এই নির্বাচন মেনে নেয়নি। অনেক বিজ্ঞজনও এই নির্বাচন মেনে নেননি। অনেকে বলেছেন, নির্বাচন বৈধ হয়নি। দেশের আইন অনুযায়ী নির্বাচন হয়েছে, কাজেই নির্বাচনটি অবৈধ হয়েছে তাও বলা যায় না। বিরোধী দল বলছে, খুব কম লোক ভোট দিয়েছে। এসব তর্ক চলতেই থাকবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এর পর কী হতে যাচ্ছে? বিরোধী দল আবার নির্বাচন চায়। সরকারি দলের কেউ কেউ বলেছেন, পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। দুই দলের মধ্যে আলোচনার কথা বলেছেন অনেকেই। আমরা ধরে নিচ্ছি, তাঁরা নির্বাচন নিয়ে আলোচনার কথা বলছেন। সরকার আর বিরোধী দলের মধ্যে আদর্শগত ও পদ্ধতিগত বিরাট মতপার্থক্য রয়েছে। এগুলো নিয়ে কাজ চলার মতো কোনো মতৈক্য না হলে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হবে কি না- এসব নিয়ে কেউ কিছু বলছেন না।
দুই পক্ষের তাৎক্ষণিক মতানৈক্যের কারণ হচ্ছে নির্বাচন পদ্ধতি। সরকার পক্ষ বলছে, দলীয় সরকারের অধীনে, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনটি হবে। বিরোধী পক্ষ বলছে, নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো আপস হয়নি। সত্যি বলতে কী, বিরোধী দলের মনোভাব দেখে মনে হয়েছে, সরকার যদি তাদের কথা মতো, তাদের পছন্দ মতো পদ্ধতিতে নির্বাচন না দেয়, তবে বিরোধী দল তা যেভাবে হোক আদায় করে নেবে। তাদের কাজেও তাদের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। জ্বালাও-পোড়াও চালিয়েছে তারা অনেক দিন ধরে। কিন্তু নির্বাচন হয়ে গেছে, যদিও তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার বিরাম নেই। তা না হয় থাক, তবে জনগণের আচার-আচরণ দেখে মনে হচ্ছে যে তাঁরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। একটা সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। যেদিন নির্বাচন হয় হোক।
নির্বাচন যখন হয় হবে। যে পদ্ধতিতে হয় হবে। কিন্তু যে সরকার দেশ চালাচ্ছে, তারা কী করে, সেটা আমরা দেখতে চাই। গত পাঁচ বছর এই দলটিই দেশ চালিয়েছে। অনেক ভালো কাজ করেছে তারা, আবার ভুলও করেছে। এই ভুলগুলোর কিছু কিছু দলীয় লোকদের সুযোগসন্ধানী কাজের জন্য আবার কিছু কিছু অনুপযুক্ততার জন্য।
সরকারের সাফল্যের সম্পূর্ণ তালিকা পেশ করা সম্ভব নয়, তবে কিছু কিছু উল্লেখ করা উচিত। খাদ্য সমস্যার সমাধান, পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। বনানী ফ্লাইওভারকে আমি একটা বড় সাফল্য বলে মনে করি। কারণ ঢাকা শহরের ও দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ উন্নত হয়েছে এই ফ্লাইওভারের জন্য। সবচেয়ে বড় কথা, বিমানবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ উন্নত হয়েছে। এই ফ্লাইওভারের কথা আমার কিছু আত্মীয়-বন্ধুর কাছে উল্লেখ করায় তারা বলেছে, 'এ আর এমন কী? এই মনোভাবই আমাদের সমস্যা। টক শোর অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি এমন মনোভাব প্রকাশ করেন। বিরোধী দল বলে না তাদের সরকার কী করেছে- বিজ্ঞজনরাও কিছুই বলেন না এ সম্পর্কে। বিরোধী দল ক্ষমতায় গেলে কী করবে, সে কথাও তারা বলে না। তাহলে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা তুলনা করব কার সঙ্গে। এটি আমাদের আরেকটি সমস্যা। তুলনা করার দরকার কী। শুধু সমালোচনা করে যাও। ভাবটা এই যে অতীত নিয়ে ভাবনার দরকার কী? ভবিষ্যতের কথা ভাবা যাবে যখন সেটা আসবে। আমাদের এই মনোভাব নিয়ে অভিমান করার কিছু নেই। আমরা এমনটাই, এমনি কথা আমরা শুরুতেই বলেছি।
সরকার সমালোচিত হয়েছে কী সব কারণে, তার কিছু উল্লেখ করা যাক। ছাত্রলীগের কার্যকলাপ। ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনের অধঃপতন দেখে সবাই হতাশ হয়েছে। চাঁদাবাজি আর টেন্ডারবাজি বন্ধ করার জন্য সরকারকে সব কিছু করতে হবে। শেয়ারবাজারে ধস। শোনা গেছে, বড় বড় দলের বড় ব্যক্তিরা এতে জড়িত ছিল। এটা কোনো সান্ত্বনার কথা নয়। শুধু এ ব্যাপারেই নয়, সব ব্যাপারেই সরকারকে এই মনোভাব নিতে হবে, অপরাধী অপরাধীই, তা যে দলেরই হোক। সরকার সঠিক ব্যবস্থা তো নেবেই; কিন্তু জনগণ যেন জানতে পারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। 'শেয়ারবাজার ধসের জন্য দায়ী ব্যক্তিরা খুব ক্ষমতাশীল'- অর্থমন্ত্রীর এই উক্তি মানুষকে হতাশ করেছে। আর আমাদের অভিভাবকদের আর বিজ্ঞজনদের উচিত হবে জনসাধারণকে বলা যে শেয়ারের ব্যবসা স্বদেশেই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা। হলমার্ক কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী ব্যক্তি কারা, এ কথা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। তবে এসবের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। রানা প্লাজার মালিকরা কোন দলের সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, রানা প্লাজা নিরাপদ কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব যাদের ছিল তারা কি নিজ দায়িত্ব পালন করেছিল? সব কারখানার নিরাপত্তা পরীক্ষা করার দায়িত্ব এখন সরকারের, তা মালিক যে পক্ষেরই হোক। তবে সরকার সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে পদ্মা সেতুর জন্য। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, সব বিষয় যেন কুয়াশাচ্ছন্ন। আর এমনটা হলে সরকারকে লোকে দোষ দেবেই। এখন দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি ও অন্যান্য কারণে কয়েকজন মন্ত্রী বাদ পড়েছেন। ভবিষ্যতে কিছুদিন পর পর মন্ত্রিসভার পরিবর্তন ঘটলে ভালো হবে সবার জন্য।
সরকারের ভালো কাজগুলো তেমন প্রশংসিত হয়নি, এ নিয়ে অভিমান করে লাভ নেই। মানুষ মন্দ কাজ দেখতে চায় না, এটাই অভিজ্ঞতা। কাজেই মন্দ কাজ কমানোর দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। আসলে ভালো কাজের সুফলগুলো মন্দ কাজগুলো নষ্ট করে দেয়, এটা ঠিক। বিভিন্ন ধরনের মানুষ থাকে সরকারে। দলীয় ব্যক্তি থাকে, আমলারা থাকেন বিভিন্ন ধরনের। জনগণের কাজে নিযুক্ত থাকেন, যাঁদের আমলা বলে বর্ণনা করা হয় না। যেমন শিক্ষকরা। কিন্তু সবার কাজের জন্য ব্যক্তি হচ্ছেন রাজনৈতিক ব্যক্তি। দলকে তাই সুসংগঠিত করা আশু প্রয়োজন। সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক জায়গায় বসানো তাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রশিক্ষণকে আরো গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। এমনি আরো অনেক বিষয় রয়েছে। আসলে মন্দের তালিকা কমাতেই হবে, তাতে যদি সাফল্যের তালিকা ছোট করতে হয় করতে হবে। শুনতে হয়তো অদ্ভুত লাগছে কথাটা, তবে আমাদের অবশ্যই বাস্তবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে।
লেখক : রয়াল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের ফেলো
http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2014/02/01/47421
Also by Dr. Waheed Nabi:
Secularism in search of truth
http://archive.thedailystar.net/beta2/news/secularism-in-search-of-truth/
__._,_.___