শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০১৪, ২৮ পৌষ ১৪২০
নির্বাচন, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সুশীলদের বিশাল ক্রোধ এবং তারপর -(তৃতীয় কিস্তি)
মুনতাসীর মামুন
পুলিশ বাহিনীকে গত তিন মাস সবাই রাস্তায় দেখেছে বিএনপি-জামায়াতের বোমাবাজদের প্রতিহত করতে। অকাতরে প্রাণও দিয়েছে তারা। আহতও হয়েছে অগণিত। সঙ্গে ছিলেন বিজেপির সদস্যরাও। কিন্তু তার মধ্যেও এতগুলো নির্বাচনী কেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া হলো কী ভাবে? যশোহরের মালোপাড়ার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তাঁরা সাহায্যের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ফোন করেছেন। কেউ সাড়া দেয়নি। ঐসব এলাকার ওসি, এসপি বা যে সেনা/র্যাব ইউনিট ছিল তাদের অধিকর্তাদের বক্তব্য কী? এক্ষেত্রে তাদের দায় আছে কি নেই? বিষয়গুলো ভেবে দেখা দরকার। তদন্তের কথা বলে বিষয়গুলো ধামাচাপা দিলে আবারও তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। নির্বাচন নিয়ে যে সহিংসতা চলছিল এবং নির্বানোত্তর যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে এ কথা কারও অজানা ছিল না। তবুও কর্তৃপক্ষ কেন ঐসব এলাকায় যথাযথ ব্যবস্থা নেননি?
নির্বাচন হলেই হিন্দুদের হুমকি দেয়া হবে তাদের ওপর বিএনপি-জামায়াত ঝাঁপিয়ে পড়বে এ তো জানা কথা। সব সময় ঘটেছে। নাকি নির্বাচন কমিশনাররা দেশের রাজনীতির কথা তেমন জানেন না? এক হতে পারে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানতে চায়নি। নির্বাচন কমিশন ভোটারদের রক্ষায় অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছে- এ বক্তব্য রাখলে কি খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে?
অন্যদিকে, একটি বিষয় সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা হলো আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা। এ মন্তব্য নেতৃবৃন্দকে ক্রোধান্বিত করবে কারণ তারা হ্যাঁ শুনতে অভ্যস্ত। সব রাজনৈতিক দলের নেতারা হ্যাঁ শুনতে অভ্যস্ত। গত তিন মাস কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় এত অত্যাচার হয়েছে যে বলার নয়। এলাকার এমপিরা দলীয় নেতারা সেখানে যাননি, স্থানীয় কর্মীদের পাশে দাঁড়াননি। ঢাকার বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে বক্তৃতা দেয়া যদি দলের নেতারা মনে করেন প্রতিরোধ তা হলে অবশ্য বলার কিছু নেই। মার খেয়েছেন স্থানীয় কর্মীরা। এটি অন্যায় এবং লজ্জার। অনেক কেন্দ্র থেকে ভোটাররা ফিরে গেছেন সিরিয়াল নম্বরের অভাবে। প্রায় ক্ষেত্রে প্রার্থী বা দলের কেউ ছিলেন না সাহায্য করার জন্য। ১৪ দলের সমর্থকরা সবচেয়ে দুঃখিত এবং হতাশ হয়েছেন সাতক্ষীরা, ফেনী এবং আরও কয়েকটি এলাকার ঘটনায়। সরকার সেসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করেনি। ১৪ দলের দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা সেসব অঞ্চলে যাননি। সাংবাদিক বাসুদেব ধর উত্তরাঞ্চলের এক জেলার কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, সেখানে যখন হিন্দুদের কথা ওপর একদফা আক্রমণ হলো তখন তিনি আওয়ামী লীগের সে এলাকার সিনিয়র নেতা যিনি এখন কেন্দ্রেও নেতা তাকে বলেছিলেন, আর কেউ না যাক আপনি গেলেন না কেন? তার উত্তর ছিল কেন্দ্র থেকে কোন নির্দেশ আসেনি। এটি অবশ্যই শেখ হাসিনা বা সৈয়দ আশরাফের জন্য শ্লাঘার বিষয় কিন্তু দলের জন্য স্বাস্থ্যহানিকর। যাক, এই হলো আমরা যাকে বলি ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থা। ভবিষ্যতে যখন ১৮ দল আরও মরিয়া হয়ে নামবে তখন আর যাই হোক দলের এরকম অবস্থা থাকলে প্রতিরোধ করা মুশকিল হবে। ক্ষমতাগুণে স্ফীত হওয়ার সময় এখন নয়। হলে, খালেদা জিয়ার মতো ক্ষমতা ছাড়তে হবে। ক্ষমতা এমন একটি নিবস্তুক বস্তু, যা চিরস্থায়ী নয়। বাংলার ইতিহাসের সূত্রও তাই বলে।
নির্বাচন বিরোধীরা আশা করছিলেন ৫ ভাগ সর্বোচ্চ ১০ ভাগ ভোট পড়বে। নির্বাচনের পর টকারদের অনেকে মন্তব্য করেছেন ৫ ভাগ কী ভাবে ৪০ ভাগ হয়? নিশ্চয় কারচুপি হয়েছে। এই প্রথম দেখা গেছে মিডিয়া সরকারের রীতি ভেঙ্গে ভোটকেন্দ্রে যখন তখন প্রবেশ করে ভোট কিভাবে দেয়া হচ্ছে তাও দেখিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কতটা কারচুপি সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্য সুশীলরা দিতে চাইবেন না। তাদের অনেকের এখন বক্তব্য, মিডিয়া কারচুপি করছে। যে মিডিয়া এতদিন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে কিনা, যুদ্ধাপরাধীদের কেন বিচার হবেÑ এসব বিষয় প্রমাণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন 'একদলীয়' 'প্রহসন' হচ্ছে বলে প্রচার করছে, সে মিডিয়া নির্বাচনের দিন নির্বাচনের পক্ষে বলবেÑ এ মন্তব্য কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্বের মতো। তবে এ ধরনের বক্তব্যে তাদের তীব্র হতাশাটা স্পষ্ট হয়েছে। এখন যতই একতরফা নির্বাচন বলা হোক না কেন, সবাইকে বোঝানো কষ্টকর হবে যে, 'একদলীয়', 'একতরফা' নির্বাচন হয়েছে। কারণ, ঐ ধরনের নির্বাচনে এত ভোট পড়ে না। কিন্তু নির্বাচন একেবারে নিখুঁত হয়েছে এটি বলাও বাড়াবাড়ি হবে। ঐতিহ্য মতো, আগের সব নির্বাচনের ধারায় কোথাও কোথাও জালভোট পড়েছে, ব্যালটে সিলও মারা হয়েছে কিন্তু সে ভার যদি মোট ভোটের ১ ভাগও হয় তারপরও ভোটের হার ৪০ ভাগের ওপরে থাকে।
আসলে এ নির্বাচনে জয় হয়েছে যতটা না আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীদের তার চেয়ে বেশি হয়েছে ভোটারদের যারা আদর্শগত কারণে (ব্যতিক্রম থাকতেই পারে) ভোট দিতে গেছেন। তারা নিজেদের রক্ষা করার জন্য লড়াই করেছেন। দল যদি এদের এবং এ বিষয়টিকে মূল্যায়ন না করে তাহলে এসব ভোটারদের আর কোন দায়িত্ব থাকবে না এসব দলকে মূল্যায়ন করার। মূল্যায়ন ব্যাপারটা একতরফা হতে পারে না।
এই নির্বাচনের আরেকটি ইতিবাচক দিক এরশাদ নামক ব্যক্তিটির রাজনীতিতে মূল্যহীন হয়ে যাওয়া। জাতীয় পার্টির এখন থেকে ক্রমাবনতি হবে এবং এক সময় এর একটি বড় অংশ বিএনপিতে এবং ক্ষুদ্র অংশ আওয়ামী লীগ বিলীন হয়ে যাবে বা ন্যাপ, গণতান্ত্রিক পার্টি, সাম্যবাদী দলের মতো কয়েক দলের পার্টিতে পরিণত হবে। জেনারেল এরশাদ ও বাংলাদেশের কম ক্ষতি করেননি। তাঁকে এতদিন মেনে নেয়ার একটিই কারণ, জামায়াত বিরোধিতা ও যুদ্ধাপরাধ বিচার সমর্থন।
জামায়াত-বিএনপি ও সুশীলদের প্রকৃতি
বাংলাদেশের সবচেয়ে চালু পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলোয় একটি সংবাদের শিরোনামÑ "শুধু 'একতরফা' নয়, 'প্রাণঘাতী' নির্বাচন।" তারা বোঝাতে চেয়েছে উর্ধকমার শব্দ দুটি তাদের নয়। কিন্তু তারা শব্দ দুটি বেছে নিয়েছে কারণ তারা এমনটিই মনে করে। প্রতিবেদনের প্রথম প্যারাটি এরকমÑ "একতরফা' তকমার পাশাপাশি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইতিহাসের পাতায় 'প্রাণঘাতী' নির্বাচন হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে থাকবে। পরিসংখ্যান বলছে, নির্বাচনের আগে এত বিপুলসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা বাংলাদেশের আর কোন নির্বাচনের আগে ঘটেনি।" [৫.১.২০১৪]
এরপর মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনের শেষ করেছেÑ 'এ পর্যন্ত নাগরিকদের জানমাল রক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র খুব সফলতার পরিচয় দিতে পেরেছে বলে আমাদের প্রতীয়মান হয়নি।" [ঐ]
মূল বিষয়টি কী দাঁড়াল তাহলে? নির্যাসটি হলোÑ প্রাণঘাতী নির্বাচন হচ্ছে এবং এতে যারা আহত হচ্ছেন বা প্রাণ দিচ্ছেন রাষ্ট্র অর্থাৎ সরকার তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আচ্ছা, এই হত্যাগুলো কারা করেছে? প্রতিবেদনে তার কোন উল্লেখ নেই। সুশীলরাও অনবরত তফসিল ঘোষণার পর এ ধরনের কথাই বলে এসেছেন। মিডিয়াও কখনও উল্লেখ করেনি কারা এসব করছে। হ্যাঁ বলেছে, দুর্র্র্র্র্বৃত্তরা এসব করছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের নির্দেশে মিডিয়া 'মুক্তিযোদ্ধা' শব্দটি ব্যবহার করত না, লিখত 'দুষ্কৃতকারী।' কোন কোন সংবাদপত্র ও টিভি আরেকটু নির্দিষ্ট করে বলেছে, নির্বাচনবিরোধীরা। অধুনা মিডিয়ার দৌলতে অধিক পরিচিত 'সুজন'ও একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। এর প্রধান জনাব মজুমদার সুশাসন চান দেখে সুজনের মতো এনজিও করেছেন। তো সুশাসনের প্রতিবন্ধক শুধু আওয়ামী লীগ? বিএনপি-জামায়াত নয়? তারা আবার একটি আলোচনা সভা করেছিলেন। সেখানেও ভায়োলেন্সের সমালোচনা করা হয়েছে এবং তা যে গণতন্ত্রবিরোধী তাও বলা হয়েছে। কিন্তু এই বিরোধের মূল কারণ যে, যুদ্ধাপরাধ বিচার সে বিষয়ে একটি কথাও কেউ উল্লেখ করেননি। এমনকি কারা এর জন্য দায়ী তাও আলোচনায় আসেনি স্পষ্টভাবে। এ কারণেই এরা বাটপার। সুশীল বাটপার।
নির্বাচন ঘোষণার পর প্রায় ১৫০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। টার্গেট করে পুলিশ, বিজেবি ও আনসারদের আক্রমণ করা হয়েছে। তাদের অনেককে পিটিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, তরুণ, মধ্যবয়সীদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এরা সব সাধারণ মানুষ, দরিদ্র। সাধারণ মানুষকে নিয়ে রাজনীতি, অথচ তাদেরই পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কুপিয়ে মারা হয়েছে, গুলি করে মারা হয়েছে, পিটিয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু কারা করেছে উল্লিখিত সুশীলরা জানেন না। কারণ, তারা বিরোধীদের সমর্থক দেখে প্রকাশ্যে তাদের নাম বলেননি। আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছিÑ এগুলো করেছে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা। এবং এর নির্দেশ দিয়েছেন এ দুটি দলের নেতারা। সাদেক হোসেন খোকা ওরফে ধোঁকা [নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর ভাষায়] প্রকাশ্যে হত্যা করার কথা বলেছেন, অন্যরা গোপনেÑ এই যা তফাৎ।
জামায়াত-শিবির-বিএনপির এবং ১৬ দলের [একত্রে ১৮ দল] কর্মীরা শিক্ষামন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী ৫৩১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়েছে। পাকিস্তানের পর থেকে এ পর্যন্ত ৬৭ বছরে কোন নির্বাচনে এমনটি ঘটেনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা আছে। তবে, মাদ্রাসার সংখ্যা কম। মাত্র কিছুদিন আগে শিক্ষাবর্ষ শুরুতে অন্য ছাত্ররা নতুন বই পেয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে কয়েকটি মাত্র ঘটনা আছে গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেয়ার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পোড়ানো অনেকটা সেই ধাঁচের। চীনের শি হুয়াংডি কনফুসিয়াস এবং আরও অনেকের বই পুড়িয়েছিলেন। হালাকু খান বাগদাদের গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দিয়েছেন। রোমক এক সম্রাট আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি ধ্বংস করেন। জার্মানির নাজিরা ব্যাপক হারে বই পুড়িয়েছিল। এখানে বিদ্যালয় কারা পোড়াল? সুশীলরা জানেন না। জানলে নিশ্চয় বিবৃতি দিতেন। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রার্থীদের তথ্য ডাউনলোড করা যাচ্ছে নাÑ সেটির নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। নির্বাচন একতরফা হচ্ছে সেটি নিয়ে হরেক রকম বক্তব্য, প্রতিবাদ করা হয়েছে, কিন্তু ৫৩১টি বিদ্যালয় পুড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে এদের কোন বক্তব্য, নিন্দা দেখিনি। বলেননি তারা যে, বিএনপি-জামায়াত চায় এ দেশে অন্ধকার যুগ ফিরে আসুক। জ্ঞান চর্চা বড় নয়, বড় হচ্ছে মাসল চর্চা।
(চলবে)
নির্বাচন হলেই হিন্দুদের হুমকি দেয়া হবে তাদের ওপর বিএনপি-জামায়াত ঝাঁপিয়ে পড়বে এ তো জানা কথা। সব সময় ঘটেছে। নাকি নির্বাচন কমিশনাররা দেশের রাজনীতির কথা তেমন জানেন না? এক হতে পারে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানতে চায়নি। নির্বাচন কমিশন ভোটারদের রক্ষায় অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছে- এ বক্তব্য রাখলে কি খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে?
অন্যদিকে, একটি বিষয় সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা হলো আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা। এ মন্তব্য নেতৃবৃন্দকে ক্রোধান্বিত করবে কারণ তারা হ্যাঁ শুনতে অভ্যস্ত। সব রাজনৈতিক দলের নেতারা হ্যাঁ শুনতে অভ্যস্ত। গত তিন মাস কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় এত অত্যাচার হয়েছে যে বলার নয়। এলাকার এমপিরা দলীয় নেতারা সেখানে যাননি, স্থানীয় কর্মীদের পাশে দাঁড়াননি। ঢাকার বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে বক্তৃতা দেয়া যদি দলের নেতারা মনে করেন প্রতিরোধ তা হলে অবশ্য বলার কিছু নেই। মার খেয়েছেন স্থানীয় কর্মীরা। এটি অন্যায় এবং লজ্জার। অনেক কেন্দ্র থেকে ভোটাররা ফিরে গেছেন সিরিয়াল নম্বরের অভাবে। প্রায় ক্ষেত্রে প্রার্থী বা দলের কেউ ছিলেন না সাহায্য করার জন্য। ১৪ দলের সমর্থকরা সবচেয়ে দুঃখিত এবং হতাশ হয়েছেন সাতক্ষীরা, ফেনী এবং আরও কয়েকটি এলাকার ঘটনায়। সরকার সেসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করেনি। ১৪ দলের দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা সেসব অঞ্চলে যাননি। সাংবাদিক বাসুদেব ধর উত্তরাঞ্চলের এক জেলার কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, সেখানে যখন হিন্দুদের কথা ওপর একদফা আক্রমণ হলো তখন তিনি আওয়ামী লীগের সে এলাকার সিনিয়র নেতা যিনি এখন কেন্দ্রেও নেতা তাকে বলেছিলেন, আর কেউ না যাক আপনি গেলেন না কেন? তার উত্তর ছিল কেন্দ্র থেকে কোন নির্দেশ আসেনি। এটি অবশ্যই শেখ হাসিনা বা সৈয়দ আশরাফের জন্য শ্লাঘার বিষয় কিন্তু দলের জন্য স্বাস্থ্যহানিকর। যাক, এই হলো আমরা যাকে বলি ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থা। ভবিষ্যতে যখন ১৮ দল আরও মরিয়া হয়ে নামবে তখন আর যাই হোক দলের এরকম অবস্থা থাকলে প্রতিরোধ করা মুশকিল হবে। ক্ষমতাগুণে স্ফীত হওয়ার সময় এখন নয়। হলে, খালেদা জিয়ার মতো ক্ষমতা ছাড়তে হবে। ক্ষমতা এমন একটি নিবস্তুক বস্তু, যা চিরস্থায়ী নয়। বাংলার ইতিহাসের সূত্রও তাই বলে।
নির্বাচন বিরোধীরা আশা করছিলেন ৫ ভাগ সর্বোচ্চ ১০ ভাগ ভোট পড়বে। নির্বাচনের পর টকারদের অনেকে মন্তব্য করেছেন ৫ ভাগ কী ভাবে ৪০ ভাগ হয়? নিশ্চয় কারচুপি হয়েছে। এই প্রথম দেখা গেছে মিডিয়া সরকারের রীতি ভেঙ্গে ভোটকেন্দ্রে যখন তখন প্রবেশ করে ভোট কিভাবে দেয়া হচ্ছে তাও দেখিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে কতটা কারচুপি সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্য সুশীলরা দিতে চাইবেন না। তাদের অনেকের এখন বক্তব্য, মিডিয়া কারচুপি করছে। যে মিডিয়া এতদিন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে কিনা, যুদ্ধাপরাধীদের কেন বিচার হবেÑ এসব বিষয় প্রমাণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন 'একদলীয়' 'প্রহসন' হচ্ছে বলে প্রচার করছে, সে মিডিয়া নির্বাচনের দিন নির্বাচনের পক্ষে বলবেÑ এ মন্তব্য কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্বের মতো। তবে এ ধরনের বক্তব্যে তাদের তীব্র হতাশাটা স্পষ্ট হয়েছে। এখন যতই একতরফা নির্বাচন বলা হোক না কেন, সবাইকে বোঝানো কষ্টকর হবে যে, 'একদলীয়', 'একতরফা' নির্বাচন হয়েছে। কারণ, ঐ ধরনের নির্বাচনে এত ভোট পড়ে না। কিন্তু নির্বাচন একেবারে নিখুঁত হয়েছে এটি বলাও বাড়াবাড়ি হবে। ঐতিহ্য মতো, আগের সব নির্বাচনের ধারায় কোথাও কোথাও জালভোট পড়েছে, ব্যালটে সিলও মারা হয়েছে কিন্তু সে ভার যদি মোট ভোটের ১ ভাগও হয় তারপরও ভোটের হার ৪০ ভাগের ওপরে থাকে।
আসলে এ নির্বাচনে জয় হয়েছে যতটা না আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীদের তার চেয়ে বেশি হয়েছে ভোটারদের যারা আদর্শগত কারণে (ব্যতিক্রম থাকতেই পারে) ভোট দিতে গেছেন। তারা নিজেদের রক্ষা করার জন্য লড়াই করেছেন। দল যদি এদের এবং এ বিষয়টিকে মূল্যায়ন না করে তাহলে এসব ভোটারদের আর কোন দায়িত্ব থাকবে না এসব দলকে মূল্যায়ন করার। মূল্যায়ন ব্যাপারটা একতরফা হতে পারে না।
এই নির্বাচনের আরেকটি ইতিবাচক দিক এরশাদ নামক ব্যক্তিটির রাজনীতিতে মূল্যহীন হয়ে যাওয়া। জাতীয় পার্টির এখন থেকে ক্রমাবনতি হবে এবং এক সময় এর একটি বড় অংশ বিএনপিতে এবং ক্ষুদ্র অংশ আওয়ামী লীগ বিলীন হয়ে যাবে বা ন্যাপ, গণতান্ত্রিক পার্টি, সাম্যবাদী দলের মতো কয়েক দলের পার্টিতে পরিণত হবে। জেনারেল এরশাদ ও বাংলাদেশের কম ক্ষতি করেননি। তাঁকে এতদিন মেনে নেয়ার একটিই কারণ, জামায়াত বিরোধিতা ও যুদ্ধাপরাধ বিচার সমর্থন।
জামায়াত-বিএনপি ও সুশীলদের প্রকৃতি
বাংলাদেশের সবচেয়ে চালু পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলোয় একটি সংবাদের শিরোনামÑ "শুধু 'একতরফা' নয়, 'প্রাণঘাতী' নির্বাচন।" তারা বোঝাতে চেয়েছে উর্ধকমার শব্দ দুটি তাদের নয়। কিন্তু তারা শব্দ দুটি বেছে নিয়েছে কারণ তারা এমনটিই মনে করে। প্রতিবেদনের প্রথম প্যারাটি এরকমÑ "একতরফা' তকমার পাশাপাশি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইতিহাসের পাতায় 'প্রাণঘাতী' নির্বাচন হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে থাকবে। পরিসংখ্যান বলছে, নির্বাচনের আগে এত বিপুলসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা বাংলাদেশের আর কোন নির্বাচনের আগে ঘটেনি।" [৫.১.২০১৪]
এরপর মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনের শেষ করেছেÑ 'এ পর্যন্ত নাগরিকদের জানমাল রক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র খুব সফলতার পরিচয় দিতে পেরেছে বলে আমাদের প্রতীয়মান হয়নি।" [ঐ]
মূল বিষয়টি কী দাঁড়াল তাহলে? নির্যাসটি হলোÑ প্রাণঘাতী নির্বাচন হচ্ছে এবং এতে যারা আহত হচ্ছেন বা প্রাণ দিচ্ছেন রাষ্ট্র অর্থাৎ সরকার তাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আচ্ছা, এই হত্যাগুলো কারা করেছে? প্রতিবেদনে তার কোন উল্লেখ নেই। সুশীলরাও অনবরত তফসিল ঘোষণার পর এ ধরনের কথাই বলে এসেছেন। মিডিয়াও কখনও উল্লেখ করেনি কারা এসব করছে। হ্যাঁ বলেছে, দুর্র্র্র্র্বৃত্তরা এসব করছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের নির্দেশে মিডিয়া 'মুক্তিযোদ্ধা' শব্দটি ব্যবহার করত না, লিখত 'দুষ্কৃতকারী।' কোন কোন সংবাদপত্র ও টিভি আরেকটু নির্দিষ্ট করে বলেছে, নির্বাচনবিরোধীরা। অধুনা মিডিয়ার দৌলতে অধিক পরিচিত 'সুজন'ও একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। এর প্রধান জনাব মজুমদার সুশাসন চান দেখে সুজনের মতো এনজিও করেছেন। তো সুশাসনের প্রতিবন্ধক শুধু আওয়ামী লীগ? বিএনপি-জামায়াত নয়? তারা আবার একটি আলোচনা সভা করেছিলেন। সেখানেও ভায়োলেন্সের সমালোচনা করা হয়েছে এবং তা যে গণতন্ত্রবিরোধী তাও বলা হয়েছে। কিন্তু এই বিরোধের মূল কারণ যে, যুদ্ধাপরাধ বিচার সে বিষয়ে একটি কথাও কেউ উল্লেখ করেননি। এমনকি কারা এর জন্য দায়ী তাও আলোচনায় আসেনি স্পষ্টভাবে। এ কারণেই এরা বাটপার। সুশীল বাটপার।
নির্বাচন ঘোষণার পর প্রায় ১৫০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। টার্গেট করে পুলিশ, বিজেবি ও আনসারদের আক্রমণ করা হয়েছে। তাদের অনেককে পিটিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, তরুণ, মধ্যবয়সীদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এরা সব সাধারণ মানুষ, দরিদ্র। সাধারণ মানুষকে নিয়ে রাজনীতি, অথচ তাদেরই পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কুপিয়ে মারা হয়েছে, গুলি করে মারা হয়েছে, পিটিয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু কারা করেছে উল্লিখিত সুশীলরা জানেন না। কারণ, তারা বিরোধীদের সমর্থক দেখে প্রকাশ্যে তাদের নাম বলেননি। আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছিÑ এগুলো করেছে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা। এবং এর নির্দেশ দিয়েছেন এ দুটি দলের নেতারা। সাদেক হোসেন খোকা ওরফে ধোঁকা [নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর ভাষায়] প্রকাশ্যে হত্যা করার কথা বলেছেন, অন্যরা গোপনেÑ এই যা তফাৎ।
জামায়াত-শিবির-বিএনপির এবং ১৬ দলের [একত্রে ১৮ দল] কর্মীরা শিক্ষামন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী ৫৩১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়েছে। পাকিস্তানের পর থেকে এ পর্যন্ত ৬৭ বছরে কোন নির্বাচনে এমনটি ঘটেনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা আছে। তবে, মাদ্রাসার সংখ্যা কম। মাত্র কিছুদিন আগে শিক্ষাবর্ষ শুরুতে অন্য ছাত্ররা নতুন বই পেয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে কয়েকটি মাত্র ঘটনা আছে গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেয়ার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পোড়ানো অনেকটা সেই ধাঁচের। চীনের শি হুয়াংডি কনফুসিয়াস এবং আরও অনেকের বই পুড়িয়েছিলেন। হালাকু খান বাগদাদের গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দিয়েছেন। রোমক এক সম্রাট আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি ধ্বংস করেন। জার্মানির নাজিরা ব্যাপক হারে বই পুড়িয়েছিল। এখানে বিদ্যালয় কারা পোড়াল? সুশীলরা জানেন না। জানলে নিশ্চয় বিবৃতি দিতেন। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রার্থীদের তথ্য ডাউনলোড করা যাচ্ছে নাÑ সেটির নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। নির্বাচন একতরফা হচ্ছে সেটি নিয়ে হরেক রকম বক্তব্য, প্রতিবাদ করা হয়েছে, কিন্তু ৫৩১টি বিদ্যালয় পুড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে এদের কোন বক্তব্য, নিন্দা দেখিনি। বলেননি তারা যে, বিএনপি-জামায়াত চায় এ দেশে অন্ধকার যুগ ফিরে আসুক। জ্ঞান চর্চা বড় নয়, বড় হচ্ছে মাসল চর্চা।
(চলবে)
প্রকাশ: শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০১৪, ২৮ পৌষ ১৪২০
Related:
বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারী ২০১৪, ২৬ পৌষ ১৪২০
নির্বাচন, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সুশীলদের বিশাল ক্রোধ এবং তারপর - (প্রথম কিস্তি)
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারী ২০১৪, ২৬ পৌষ ১৪২০
শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০১৪, ২৭ পৌষ ১৪২০
নির্বাচন, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সুশীলদের বিশাল ক্রোধ এবং তারপর - (দ্বিতীয় কিস্তি)
প্রকাশ:শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০১৪, ২৭ পৌষ ১৪২০
__._,_.___