শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ১৬ ফাল্গুন ১৪২০
কেন এই সাম্প্রদায়িকতা
অধ্যাপক রবীন্দ্রকুমার বক্সী
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। পাকিস্তানের একটি অংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান যা আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শাসকগোষ্ঠীর প্ররোচনায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিহারীদের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র হয়। তবে এদেশের অধিকাংশ মানুষই অসাম্প্রদায়িক। তারপরও স্বার্থান্বেষী মহলের মুষ্টিমেয় লোক কোন কোন স্থানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। পাকিস্তান আমলের পুরো সময়টাই রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সংখ্যালঘুদের রাষ্ট্র তাদের সমঅধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর লুটপাট, অবৈধভাবে সম্পত্তি দখল, নারীনির্যাতন কোনটিই বাদ যায়নি। ১৯৬৪ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের প্রস্তুতিকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের কারণে দাঙ্গা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি।
বাঙালী আবহমান কাল থেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী। মহান একুশের রক্তে যে ফুল ফুটেছিল তার নাম অসাম্প্রদায়িকতা। বাঙালী একুশের চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করেই ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছিল। প্রায় এক কোটি হিন্দু নর-নারী নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়ে নিজের ভিটা-মাটি ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করেছিল। সকল সম্প্রদায়ের মিলিত রক্তস্রোতের মধ্যদিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকায় দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা, আর্তমানবতার সেবায় উৎসর্গীকৃত প্রাণপুরুষ কু-েশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহ, পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপনকারী এ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকের নাম উল্লেখ করার মতো। তবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কবর রচিত হয়।
১৯৭২ সালে বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই চারটি মৌলিক বিষয় সংযোজন করে রচিত হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সংবিধান। সংবিধানে রাষ্ট্রের সকল সম্প্রদায়ের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার পর যারা রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা দখল করেন, তাদের বদান্যতায় স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী শক্তি আবারও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু করে। বিভিন্ন সময়ে সামরিক স্বৈরশাসকরা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে সংবিধানের চার মূলনীতিকে বিসর্জন দিয়ে সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করে দেয়। বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলের মতো পুনরায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে শুরু করে। বিভিন্ন সময় সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হিন্দুরা মূল টার্গেট হলেও এখন বৌদ্ধ ও খ্রীস্টানরাও বাদ নেই। রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার ঘটনা আমাদের ইতিহাসের ট্র্যাজেডি ও কলঙ্কজনক অধ্যায়। দেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘুদের ওপর নেমে আসে চরম নির্যাতন। ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের পরেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সীমাহীন নির্যাতন চালানো হয়। বরিশালের আগৈলঝাড়া, ভোলা, বাগেরহাট, পাবনাসহ বহু জায়গায় হিন্দুদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অর্থ সম্পদ লুটপাট করা হয়। হিন্দু নারীদের ওপর চালানো হয় নির্মম পাশবিক অত্যাচার। পূর্ণিমা শীল, ছবিরাণী বিশ্বাসদের ওপর নির্যাতনের নির্মম কাহিনী দেশের মানুষ ভুলেনি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের কর্মী-সমর্থকরাই অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণিত। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। উপরন্তু তিনি সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিষয়টিই অস্বীকার করেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর দানবীয় অত্যাচারের বিচার করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত আর বিচার প্রক্রিয়া বেশি দূর এগোয়নি। আমরা মনে করি সেই অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া যেত তাহলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগে ও পরে সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এমন ভয়াবহ নির্যাতন চালানোর সাহস পেত না। নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ঘোষণা দানকারী গোষ্ঠী যশোর, দিনাজপুর, বগুড়া, গাইবান্ধা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, সাতক্ষীরাসহ দেশের প্রায় ৩২টি জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য মাঠে থাকার পরও বিএনপি ও জামায়াত শিবিরের সন্ত্রাসী ক্যাডাররা কীভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিঘেœ হামলা করার সুযোগ ও সাহস পেয়েছে তা এখনও রহস্যজনক। হিন্দুদের ভোটকে যে রাজনৈতিক দল নিজেদের ভোটব্যাংক বলে মনে করে সে দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘুদের দুঃসময়ে পাশে দেখা যায়নি। এমনকি কোনও কোনও জায়গায় আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর সুবিধাবাদী নেতা নিজেদের স্বার্থের কারণে জামায়াত- শিবিরকে পরোক্ষভাবে সমর্থন অথবা প্রশাসনের ওপর প্রভাব খাটিয়ে প্রটেকশন দিয়েছেন। এ সকল ঘরের শত্রু বিভীষণদের দল থেকে বের করে দিয়ে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে রক্ষা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জয়ী হওয়ার পর শান্তিকামী মানুষ আশা করেছিল, এদেশে আর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হবে না। সে আশায়ও গুড়েবালি। জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার পর থেকে বিগত এক বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন শুরু হয়। নোয়াখালীর রাজগঞ্জে হিন্দু পল্লীতে আক্রমণ, পাবনার সাঁথিয়ার বনগ্রামে হামলা, বরিশালের কাউয়ারচরে হিন্দুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে আক্রমণ সংখ্যালঘুদের মনে আবারও সাম্প্রদায়িকতার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সাঁথিয়ার বনগ্রামে স্বার্থের জন্য সর্বদলীয় সাম্প্রদায়িক ঐক্য করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর তা-ব চালানো হয়। রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের মধ্যে যতই বিরোধ থাকুক না কেন হিন্দুদের ধন-সম্পত্তি লুটপাট করার ক্ষেত্রে সবাই এক হয়ে যায়। সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারাটা সরকারের উদাসীনতা বা ব্যর্থতা বলেই ধরে নিতে হবে। দেশের কোন স্থানে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন হলেই দু'বৃহৎ রাজনৈতিক দল একে অন্যকে দায়ী করে থাকে। তাই যারা প্রকৃত দোষী তারা পর্দার অন্তরালে চলে যায়। ফলে দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া সম্ভব হয় না। ২০১৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫১ জেলায় মোট ১৪৬ টি মন্দির ও ২৬২টি ঘরবাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। ২১৯টি দোকনে লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব ঘটনায় ৫০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত, ৫ জন নিহত ও ৬০ জন আহত হয় (প্রথম আলো ৩০ নবেম্বর ২০১৩)। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সংবাদ সম্মেলন থেকে জানা যায়, ২৫ নবেম্বর দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের প্রায় ৩২টি জেলায় ৪৮৫টি সংখ্যালঘুর বাড়িঘর, ৫৭৮টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ১৫২টি মন্দির-উপাসনালয় ভাংচুর করা হয়। অনেক হিন্দু মহিলা নির্যাতনের শিকার হয়। যশোরের মনিরামপুরের ঋষিপাড়ার নির্যাতিত দু'মহিলার বক্তব্য থেকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বার বার সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়ে মনোবল ও সহায়সম্বল হারিয়ে প্রাণ রক্ষার জন্য প্রতিবেশী দেশে গিয়ে উদ্বাস্তুর মতো জীবন যাপন করছে। এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ১৯৪৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪ কোটি হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে গেছে। ১৯৪৭ সালে যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। ১৯৭২ সালে সংখ্যালঘুরা মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশে নেমে আসে। ২০১১ সালে তা হ্রাস পেয়ে ৯.৭ শতাংশে এসেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যে তা-ব হয়েছে, তাতে এ সংখ্যা আরও কত শতাংশ নিচে নেমে আসে তা পরবর্তী সমীক্ষায় জানা যাবে। ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ সরকারের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, 'সর্ষের মধ্যে ভূত ঢোকছে।' উপজেলা নির্বাচন চলছে, হবে কয়েক পর্বে। এই নির্বাচনের আগে-পরে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে কিনা সে আতঙ্কের মধ্যেই তারা দিন কাটাচ্ছে। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ তারিখে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা, গুম ও নির্যাতনের অভিযোগ এনে জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু তিনি যদি তার অভিযোগের সঙ্গে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি যুক্ত করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন, তাহলে নির্যাতিতরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেত এবং বিএনপির মধ্যে আস্থার ঠিকানা খোঁজার চেষ্টা করত। তিনি সংবাদ সম্মেলনে শুধু তার দল ও জোটের নেতাকর্মীদের ওপর কথিত নির্যাতনের পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন। বেগম জিয়া অতিসচেতনভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। এর পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথম কারণটি হলো, সাম্প্রদায়িক নির্যাতনে নিরুপায় হয়ে হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করলে আওয়ামী লীগের ভোট কমবে। তাতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় মিত্র জোট রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
দ্বিতীয় কারণটি হলো, সাম্প্রদায়িক সমস্যার গভীরে গেলে, 'কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে' যা কোনমতেই বেগম খালেদা জিয়ার জন্য সুখবর হবে না। কোন দেশেই সংখ্যালঘুরা সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ নয়; তবে ভারতের সংখ্যালঘু ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। ভারতের সংখ্যালঘুরা যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার সাহস রাখে।
ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকরা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে কংগ্রেসকে ভোট দেয়। ভোট দেয়ার কারণে সেখানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয় না। ভারতের হিন্দু মৌলবাদী শক্তির ধর্ম দিয়ে বাড়াবাড়ির কারণেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়, যা অবশ্যই একটি জঘন্য অপরাধ। তবে ভারত রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে একই ছাতার নিচে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। এখানে একপক্ষ আক্রমণ করে এবং অন্যপক্ষ পালাতে থাকে।
সাম্প্রদায়িকতা নিরসনে কোন সরকারই অদ্যাবধি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংঘটিত হওয়ার পর সরকারপ্রধানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সহমর্মিতা প্রকাশ, কিছু ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও অনুদানের চেক প্রদান এবং ঘটনার জন্য একে অন্যকে অভিযুক্ত করার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সীমাবদ্ধ রেখেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন স্পষ্ট করে বলেছেন 'আমরা সাহায্য চাই না, শুধু নিরাপত্তা চাই।' বাংলাদেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ যুগ যুগ ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে মিলেমিশে বসবাস করছে। একে অন্যের উৎসবে-পার্বণে মিলে একাকার হয়ে আনন্দ ভাগ করে নিয়ে থাকে। মুষ্টিমেয় অজ্ঞ, ধর্মান্ধ ও স্বার্থপর রাজনৈতিক ব্যক্তির কারণে কোনক্রমেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে দেয়া যাবে না। সাম্প্রদায়িক সহিংসতাবিরোধী নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সরকারের বিবেচনার জন্য একটি সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশে বলা হয়েছেÑ সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা দরকার; যেখানে পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের ব্যর্থতার জন্য শাস্তির বিধান থাকবে এবং দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। সরকার সুপারিশটি বিচেনা করতে পারে। ভারতের মতো এদেশেও সুপ্রীমকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে 'সংখ্যালঘু কমিশন' গঠন করা যেতে পারে।
সংখ্যালঘুরাও এদেশের নাগরিক। এদেশ তাদেরও জন্মভূমি। এদেশের আলো-বাতাসে তারাও অন্য সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে একত্রে বড় হয়ে উঠেছে। এ পবিত্র মাটির সোঁদাগন্ধ সংখ্যালঘুদেরও উজ্জীবিত করে। কোন অশুভ শক্তির ভয়ে স্বদেশ ভূমি থেকে পলায়ন করে বিদেশের মাটিতে আশ্রয় নেয়ার চেয়ে মৃত্যু অনেক শ্রেয়। নিজের জন্মভূমির পবিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে লড়াই-সংগ্রাম করে বাঁচতে হবে। সবচেয়ে আশার আলো যে, তারুণ্য জেগে উঠেছে। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের তরুণরা আলোর দিশারী হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবার আগে নির্যাতিত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছে গিয়ে সহমর্মিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছে। এ তরুণরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাভূত করে দেশবাসীকে উপহার দিতে সক্ষম হবে এক অসাম্প্রদায়িক আলোকিত বাংলাদেশ। জয় হোক অসাম্প্রদায়িকতার ।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক
বাঙালী আবহমান কাল থেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী। মহান একুশের রক্তে যে ফুল ফুটেছিল তার নাম অসাম্প্রদায়িকতা। বাঙালী একুশের চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করেই ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছিল। প্রায় এক কোটি হিন্দু নর-নারী নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়ে নিজের ভিটা-মাটি ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করেছিল। সকল সম্প্রদায়ের মিলিত রক্তস্রোতের মধ্যদিয়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকায় দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা, আর্তমানবতার সেবায় উৎসর্গীকৃত প্রাণপুরুষ কু-েশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহ, পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপনকারী এ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকের নাম উল্লেখ করার মতো। তবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কবর রচিত হয়।
১৯৭২ সালে বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই চারটি মৌলিক বিষয় সংযোজন করে রচিত হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সংবিধান। সংবিধানে রাষ্ট্রের সকল সম্প্রদায়ের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার পর যারা রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা দখল করেন, তাদের বদান্যতায় স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী শক্তি আবারও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু করে। বিভিন্ন সময়ে সামরিক স্বৈরশাসকরা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে সংবিধানের চার মূলনীতিকে বিসর্জন দিয়ে সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করে দেয়। বাংলাদেশে পাকিস্তান আমলের মতো পুনরায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে শুরু করে। বিভিন্ন সময় সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হিন্দুরা মূল টার্গেট হলেও এখন বৌদ্ধ ও খ্রীস্টানরাও বাদ নেই। রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার ঘটনা আমাদের ইতিহাসের ট্র্যাজেডি ও কলঙ্কজনক অধ্যায়। দেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘুদের ওপর নেমে আসে চরম নির্যাতন। ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের পরেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সীমাহীন নির্যাতন চালানো হয়। বরিশালের আগৈলঝাড়া, ভোলা, বাগেরহাট, পাবনাসহ বহু জায়গায় হিন্দুদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অর্থ সম্পদ লুটপাট করা হয়। হিন্দু নারীদের ওপর চালানো হয় নির্মম পাশবিক অত্যাচার। পূর্ণিমা শীল, ছবিরাণী বিশ্বাসদের ওপর নির্যাতনের নির্মম কাহিনী দেশের মানুষ ভুলেনি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের কর্মী-সমর্থকরাই অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণিত। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। উপরন্তু তিনি সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের বিষয়টিই অস্বীকার করেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর দানবীয় অত্যাচারের বিচার করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত আর বিচার প্রক্রিয়া বেশি দূর এগোয়নি। আমরা মনে করি সেই অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া যেত তাহলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের আগে ও পরে সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর এমন ভয়াবহ নির্যাতন চালানোর সাহস পেত না। নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার ঘোষণা দানকারী গোষ্ঠী যশোর, দিনাজপুর, বগুড়া, গাইবান্ধা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, সাতক্ষীরাসহ দেশের প্রায় ৩২টি জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য মাঠে থাকার পরও বিএনপি ও জামায়াত শিবিরের সন্ত্রাসী ক্যাডাররা কীভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিঘেœ হামলা করার সুযোগ ও সাহস পেয়েছে তা এখনও রহস্যজনক। হিন্দুদের ভোটকে যে রাজনৈতিক দল নিজেদের ভোটব্যাংক বলে মনে করে সে দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘুদের দুঃসময়ে পাশে দেখা যায়নি। এমনকি কোনও কোনও জায়গায় আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর সুবিধাবাদী নেতা নিজেদের স্বার্থের কারণে জামায়াত- শিবিরকে পরোক্ষভাবে সমর্থন অথবা প্রশাসনের ওপর প্রভাব খাটিয়ে প্রটেকশন দিয়েছেন। এ সকল ঘরের শত্রু বিভীষণদের দল থেকে বের করে দিয়ে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে রক্ষা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জয়ী হওয়ার পর শান্তিকামী মানুষ আশা করেছিল, এদেশে আর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হবে না। সে আশায়ও গুড়েবালি। জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার পর থেকে বিগত এক বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন শুরু হয়। নোয়াখালীর রাজগঞ্জে হিন্দু পল্লীতে আক্রমণ, পাবনার সাঁথিয়ার বনগ্রামে হামলা, বরিশালের কাউয়ারচরে হিন্দুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে আক্রমণ সংখ্যালঘুদের মনে আবারও সাম্প্রদায়িকতার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সাঁথিয়ার বনগ্রামে স্বার্থের জন্য সর্বদলীয় সাম্প্রদায়িক ঐক্য করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর তা-ব চালানো হয়। রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের মধ্যে যতই বিরোধ থাকুক না কেন হিন্দুদের ধন-সম্পত্তি লুটপাট করার ক্ষেত্রে সবাই এক হয়ে যায়। সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারাটা সরকারের উদাসীনতা বা ব্যর্থতা বলেই ধরে নিতে হবে। দেশের কোন স্থানে সাম্প্রদায়িক নির্যাতন হলেই দু'বৃহৎ রাজনৈতিক দল একে অন্যকে দায়ী করে থাকে। তাই যারা প্রকৃত দোষী তারা পর্দার অন্তরালে চলে যায়। ফলে দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া সম্ভব হয় না। ২০১৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫১ জেলায় মোট ১৪৬ টি মন্দির ও ২৬২টি ঘরবাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। ২১৯টি দোকনে লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব ঘটনায় ৫০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত, ৫ জন নিহত ও ৬০ জন আহত হয় (প্রথম আলো ৩০ নবেম্বর ২০১৩)। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সংবাদ সম্মেলন থেকে জানা যায়, ২৫ নবেম্বর দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের প্রায় ৩২টি জেলায় ৪৮৫টি সংখ্যালঘুর বাড়িঘর, ৫৭৮টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ১৫২টি মন্দির-উপাসনালয় ভাংচুর করা হয়। অনেক হিন্দু মহিলা নির্যাতনের শিকার হয়। যশোরের মনিরামপুরের ঋষিপাড়ার নির্যাতিত দু'মহিলার বক্তব্য থেকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৫০ সাল থেকে এ পর্যন্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বার বার সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়ে মনোবল ও সহায়সম্বল হারিয়ে প্রাণ রক্ষার জন্য প্রতিবেশী দেশে গিয়ে উদ্বাস্তুর মতো জীবন যাপন করছে। এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ১৯৪৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪ কোটি হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে গেছে। ১৯৪৭ সালে যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার ছিল প্রায় ৩০ শতাংশ। ১৯৭২ সালে সংখ্যালঘুরা মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশে নেমে আসে। ২০১১ সালে তা হ্রাস পেয়ে ৯.৭ শতাংশে এসেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যে তা-ব হয়েছে, তাতে এ সংখ্যা আরও কত শতাংশ নিচে নেমে আসে তা পরবর্তী সমীক্ষায় জানা যাবে। ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ সরকারের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, 'সর্ষের মধ্যে ভূত ঢোকছে।' উপজেলা নির্বাচন চলছে, হবে কয়েক পর্বে। এই নির্বাচনের আগে-পরে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে কিনা সে আতঙ্কের মধ্যেই তারা দিন কাটাচ্ছে। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ তারিখে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা, গুম ও নির্যাতনের অভিযোগ এনে জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু তিনি যদি তার অভিযোগের সঙ্গে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি যুক্ত করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন, তাহলে নির্যাতিতরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেত এবং বিএনপির মধ্যে আস্থার ঠিকানা খোঁজার চেষ্টা করত। তিনি সংবাদ সম্মেলনে শুধু তার দল ও জোটের নেতাকর্মীদের ওপর কথিত নির্যাতনের পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন। বেগম জিয়া অতিসচেতনভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। এর পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথম কারণটি হলো, সাম্প্রদায়িক নির্যাতনে নিরুপায় হয়ে হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করলে আওয়ামী লীগের ভোট কমবে। তাতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় মিত্র জোট রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
দ্বিতীয় কারণটি হলো, সাম্প্রদায়িক সমস্যার গভীরে গেলে, 'কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসতে পারে' যা কোনমতেই বেগম খালেদা জিয়ার জন্য সুখবর হবে না। কোন দেশেই সংখ্যালঘুরা সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ নয়; তবে ভারতের সংখ্যালঘু ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। ভারতের সংখ্যালঘুরা যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার সাহস রাখে।
ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকরা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে কংগ্রেসকে ভোট দেয়। ভোট দেয়ার কারণে সেখানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হয় না। ভারতের হিন্দু মৌলবাদী শক্তির ধর্ম দিয়ে বাড়াবাড়ির কারণেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়, যা অবশ্যই একটি জঘন্য অপরাধ। তবে ভারত রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে একই ছাতার নিচে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। এখানে একপক্ষ আক্রমণ করে এবং অন্যপক্ষ পালাতে থাকে।
সাম্প্রদায়িকতা নিরসনে কোন সরকারই অদ্যাবধি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংঘটিত হওয়ার পর সরকারপ্রধানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সহমর্মিতা প্রকাশ, কিছু ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও অনুদানের চেক প্রদান এবং ঘটনার জন্য একে অন্যকে অভিযুক্ত করার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সীমাবদ্ধ রেখেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন স্পষ্ট করে বলেছেন 'আমরা সাহায্য চাই না, শুধু নিরাপত্তা চাই।' বাংলাদেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ যুগ যুগ ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে মিলেমিশে বসবাস করছে। একে অন্যের উৎসবে-পার্বণে মিলে একাকার হয়ে আনন্দ ভাগ করে নিয়ে থাকে। মুষ্টিমেয় অজ্ঞ, ধর্মান্ধ ও স্বার্থপর রাজনৈতিক ব্যক্তির কারণে কোনক্রমেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে দেয়া যাবে না। সাম্প্রদায়িক সহিংসতাবিরোধী নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সরকারের বিবেচনার জন্য একটি সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশে বলা হয়েছেÑ সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা দরকার; যেখানে পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের ব্যর্থতার জন্য শাস্তির বিধান থাকবে এবং দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। সরকার সুপারিশটি বিচেনা করতে পারে। ভারতের মতো এদেশেও সুপ্রীমকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে 'সংখ্যালঘু কমিশন' গঠন করা যেতে পারে।
সংখ্যালঘুরাও এদেশের নাগরিক। এদেশ তাদেরও জন্মভূমি। এদেশের আলো-বাতাসে তারাও অন্য সম্প্রদায়ের লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে একত্রে বড় হয়ে উঠেছে। এ পবিত্র মাটির সোঁদাগন্ধ সংখ্যালঘুদেরও উজ্জীবিত করে। কোন অশুভ শক্তির ভয়ে স্বদেশ ভূমি থেকে পলায়ন করে বিদেশের মাটিতে আশ্রয় নেয়ার চেয়ে মৃত্যু অনেক শ্রেয়। নিজের জন্মভূমির পবিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে লড়াই-সংগ্রাম করে বাঁচতে হবে। সবচেয়ে আশার আলো যে, তারুণ্য জেগে উঠেছে। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের তরুণরা আলোর দিশারী হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবার আগে নির্যাতিত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছে গিয়ে সহমর্মিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছে। এ তরুণরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাভূত করে দেশবাসীকে উপহার দিতে সক্ষম হবে এক অসাম্প্রদায়িক আলোকিত বাংলাদেশ। জয় হোক অসাম্প্রদায়িকতার ।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক
প্রকাশ : ক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ১৬ ফাল্গুন ১৪২০
নির্বাচনের পর হিন্দুদের ওপর হামলার জন্য জামায়াত-বিএনপি দায়ী
হাইকোর্টের দেয়া আদেশের তথ্য
আরাফাত মুন্না ॥
প্রকাশ : সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ১২ ফাল্গুন ১৪২০
সাম্প্রদায়িকতা-অসাম্প্রদায়িকতা ও রাষ্ট্র http://www.news-bangla.com/index.php?option=com_content&task=view&id=10173&Itemid=40
|
__._,_.___