শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ২৬ মাঘ ১৪২০
মিথ্যাচার এবং গণতন্ত্র এক সঙ্গে চলতে পারে না
মুহম্মদ শফিকুর রহমান
খালেদা জিয়ার সংবাদ সম্মেলন ॥ স্থান ওয়েস্টিন হোটেল, গুলশান ॥ তারিখ-৪ জানুয়ারি ২০১৪ সাল ॥ সংবাদ দিলেন- 'বিগত ২৬ ডিসেম্বর '১৩ থেকে ২৭ জানুয়ারি '১৪ পর্যন্ত এই এক মাসে (বস্তুত ৩৩দিন) দেশে প্রায় তিন শ' রাজনৈতিক নেতাকর্মী খুন ও গুম হয়েছেন।... চাঁদপুর জেলায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের (?) হাতে নিহত হয়েছেন ১৯ দলের মোট ২৩ জন। এরমধ্যে ২১ জনই বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল ও শ্রমিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মী (জনকণ্ঠ, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)।
দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহ পত্রিকার সংবাদ ॥ শিরোনাম- "এক মাসে ২৩ জন নিহত- খালেদা জিয়া ॥ একজন মাত্র নিহতের ঘটনা ঘটেছে-জেলা পুলিশ ॥" (প্রবাহ, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)। সংবাদে বলা হয়েছে, বিএনপি ও ১৯ দল নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া চাঁদপুর জেলায় এক মাসে (২৬ ডিসেম্বর ২০১৩-২৭ জানুয়ারি ২০১৪) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও (তাঁর ভাষায়) আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে ২৩ জন নিহত হবার তথ্য পরিবেশন করেছেন। বস্তুত ঐ সময়ের মধ্যে মাত্র একজন নিহত হয়েছেন- পয়লা জানুয়ারি, ঘোষের হাট এলাকায়। নিহতের নাম ফারুক পাটোয়ারী, সে যুবদল কর্মী। অবরোধের মাঝে যৌথবাহিনীর গুলিতে সে নিহত হয়েছে।
এই হলো ঘটনা। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাতে বেশ কয়েকটি টিভি টক শোতে দেখলাম সুশীল বাবুরা বলেছেন, এবার সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া হাওয়ার ওপর কিছু বলেননি, বরং তথ্যসমৃদ্ধ ঘটনাবলীর বিবরণ দিয়েছেন। এটি একটি ইতিবাচক দিক। খুশি হতে পারতাম যদি তার প্রদত্ত তথ্য সত্য হতো?
মিথ্যা দিয়ে তথ্যের সম্ভার সাজিয়ে কিছু গণমাধ্যম বা পাকি-দালাল সুশীল বাবুদের (প্রফেসর ড. মুনতাসীর মামুন তাদের নাম দিয়েছেন সুশীল বাটপাড়) কোরাস গাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সব গণমাধ্যম যেমন রাজাকার তোষণকারী নয়, তেমনি সব সুশীলও সুশীল বাটপাড় নয়। যার প্রমাণ পদ্মা-মেঘনা পাড়ের ইলিশের শহর চাঁদপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক 'চাঁদপুর প্রবাহ'-এর সংবাদটি। তারা ঐ ২৬ ডিসেম্বর ১৩ থেকে ২৭ জানুয়ারি ১৪ পর্যন্ত ঐ ৩৩ দিনে একজন মাত্র যুবদল কর্মী মারা যাবার খবর দিয়ে বলেছে, অবরোধের মাঝে সংঘর্ষ চলাকালে যৌথবাহিনীর গুলিতে সে মারা গেছে। তার নাম, বাড়িঘর, দলীয় পরিচয় সবই ছেপেছে পত্রিকাটি। প্রশ্ন হলো কখন যৌথবাহিনী গুলি চালিয়েছে? যারা চক্ষুষ্মান তারা দেখেছেন, বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে 'নির্বাচন প্রতিহত' করার ঘোষণা দিয়ে দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি যেভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বিএনপির সন্ত্রাসী ও জামায়াত-শিবিরের রগকাটা-গলাকাটা বাহিনীকে পথে নামানো হয়েছিল, এমনকি তাদের হাতে পেট্রোল বোমা, গান পাউডার তুলে দেয়া হয়েছিল তা দিয়ে সন্ত্রাসীরা যৌথবাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছে, প্রধানত হিন্দু বসতি পাড়া-মহল্লায় হামলা চালিয়েছিল, বোমা মেরে যাত্রীসহ বাস-ট্রেন-ট্রেম্পো-অটোরিকশা-কার জ্বালিয়েছে, যাত্রী ও চালকদের পুড়িয়ে হত্যা করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে, হিন্দুদের ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়েছে, রাস্তা কেটে এবং গাছ কেটে ফেলে চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। ঐ সময় পুলিশের দিক থেকে গুলিও চালানো হয়েছে এটি কেউ অস্বীকার করবে না এবং গুলি চালানোর ব্যাপারটা কেউ সমর্থনও করেন না। কিন্তু একজন পুলিশ সদস্যকে পেটাতে পেটাতে মাটিতে ফেলে লাথির পর লাথি দিতে থাকলে তার সহকর্মীরা কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলবে অতটা আশা করা কি ঠিক? কোন সভ্য সমাজ কি তা সমর্থন করে? এমনকি এও দেখা গেছে, যাত্রীবাহী বাস-টেম্পোতে পেট্রোল বোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তারা হাসাহাসি-উল্লাস করছে কিংবা এমন খবরও শোনা গেছে, পেট্রোল বোমা ছোঁড়ার পর বাস হেলপার দৌড়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিল পারেনি, তাকে ধরে এনে গায়ে পেট্রোল ঢেলে উল্লাস করতে করতে অগ্নিসংযোগ করেছে। ওদের হাতে নিরীহ প্রাণী গরুও রক্ষা পায়নি, চট্টগ্রামে গরুবাহী ট্রাকে আগুন দিয়ে ওরা গরু পুড়িয়ে মেরেছে- এ হিংস্রতার জবাব কি?
বিএনপি-জামায়াত-শিবির এবং বংশবদ সুশীল বাটপাড়রা কথায় কথায় গণতন্ত্রের কথা বলেন অথচ গণতন্ত্রের পথে একদম হাঁটেন না, হাঁটেন চোরা-সন্ত্রাস-জ্বালাও-পোড়াওর পথে, মানুষ হত্যার পথে, নারী ধর্ষণের পথে। বস্তুত যাদের জন্ম মিলিটারি জান্তার নাইট ক্লাবে, তাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা মনে হয় ভিন্ন। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সংজ্ঞার সঙ্গে তাদের গণতন্ত্র মেলে না। তাদের গণতন্ত্র হলো- প্রথমে অগণতান্ত্রিক বা চোরা পথে অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল এবং পরে প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচনে কারচুপি করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন ও সিংহাসনে আরোহণ। এ প্রেসক্রিপশন জিয়া-এরশাদের পরে অচল হয়ে গেলেও খালেদা জিয়া তা আঁকড়ে ধরে আছেন এখনও। তবে পদ্ধতিটা পাল্টেছেন। খালেদার আমলে মিলিটারি নাইট ক্লাবকে নেপথ্যে রেখে ভুয়া ভোটার বানিয়ে সীল মারার প্রবণতা দেখা গেছে। বর্তমান জনসচেতনতার যুগে তাও অচল হয়ে যায় এবং যে কারণে তারা এখন সন্ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও-এর পথ ধরেছে। আমেরিকার গণতন্ত্রের প্রথম যুগে যে সংজ্ঞা প্রেসিডেন্ট জর্জ আব্রাহাম লিংকন দিয়েছিলেন-'Government of the people, for the people, by the people' (একটি জনগোষ্ঠীর সরকার হবে সেই জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এবং সে সরকারও হবে ঐ জনগোষ্ঠীরই দ্বারা নির্বাচিত)। আমাদের বাংলাদেশে তথাকথিত 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী' (এটি আরেকটি বাটপাড়ি। লেজুড়বৃত্তি করে পাকিস্তানের গায়ে বাংলাদেশী সীল) বিশ্বাসীদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা প্রথম দিকে ছিল - 'Government of the military, for the military, by the military' যখন দেখল এই ষড়যন্ত্রের রাজনীতির ধারাও আর চলছে না, অচল হয়ে গেছে, তখন তাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞাও পাল্টে যায়-'Government of the Rajaker, for the Rajaker, by the Rajaker Adminstration' এটিও অচল হয়ে যায়। এখন তাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হলো -'Government of the BNP-Jamaat, for the Jamaat-BNP, by the Rogkata-Golakata Bahini'.
অবশ্য তাদের জন্মটাই মিথ্যাচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাদের মিথ্যাচারের প্রথম নমুনা হলো- জিয়া না কি স্বাধীনতার ঘোষক? হ্যাঁ, ঘোষক অবশ্যই তবে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পাঠ করে ঘোষক হয়েছেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পাঠক। বঙ্গবন্ধুর নাম না নিয়ে যদি বলা হয় জিয়া ঘোষক তবে তা চরম মিথ্যাচার। যেমন জিয়াপত্নী খালেদা জিয়ার প্রথম ও প্রধান মিথ্যাচার হলো তাঁর জন্ম তারিখ... বিভিন্ন সময় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ৫ আগস্ট বা ১৯ আগস্ট। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হবার পর রাজাকার-আল বদর ও সুশীল বাটপাড়রা ১৫ আগস্ট ভুয়া জন্মদিন বানিয়ে কেক কাটার নোংরা রাজনীতি চালু করে। জাতির পিতার শাহাদাত দিবস ১৫ আগস্ট ভুয়া জন্মদিন বানিয়ে খালেদা জিয়া তাঁর বিকৃত রুচিরই পরিচয় দিচ্ছেন। তাছাড়া একজনের একাধিক জন্মদিন খারাপ ইঙ্গিতও বহন করে। তবে এর বিস্তারিত বলা অশোভনীয় তাই বলছি না। কিন্তু এটা যে চরম মিথ্যাচার তা তাঁর দল-জোটঅলারাও অনেকে জানেন এবং বিশ্বাস করেন।
মিথ্যাচার তাদের অস্থি-মজ্জায় মিশে আছে। খালেদা জিয়া গত ৪ জানুয়ারির সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে- এটি মিথ্যাচার।
দ্বিতীয়, নির্বাচনে ৫ শতাংশ ভোট পড়েছে? অথচ নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করলেন ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। যদি নির্বাচন কমিশন মিথ্যাচার করে থাকে তা হলে তো খালেদা জিয়ার উচিত এই নির্বাচন কমিশন বাতিলের আন্দোলন করা। তা না করে তিনি এই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এর অর্থ তার ৫ শতাংশ ভোট পড়ার গল্প মিথ্যাচার। অবশ্য মিথ্যার ডিকশেনারি থেকে মিথ্যাচারই বেরোবে, এতে সন্দেহের কি আছে?
তৃতীয়ত, ভোটের আগেই ১৫৩ আসন আওয়ামী লীগ 'ভাগ-বাটোয়ারা' করে নিয়েছে। এটিও মিথ্যাচার। বাস্তবতা হচ্ছে ঐ ১৫৩ আসনে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী বা একাধিক প্রার্থী ছিল না। যে প্রার্থী শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে ছিলেন এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাও অজ্ঞতা এবং মিথ্যাচার।
চতুর্থ, খালেদা জিয়া বলেছেন ঐ ১৫৩ আসন 'ভাগ-বাটোয়ারার' সময় এক ভাগ তাদেরও দিতে চেয়েছিল, তারা নেননি। এটিও বিশ্বাস করতে হবে? আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। এই আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন ইতিহাসের মহান পুরুষ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁকে এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে (১৯৭৫) দলটির এতটুকু ক্ষতি করা যায়নি এবং যে আওয়ামী লীগের প্রধান ও বঙ্গবন্ধু কন্যা এ সময়ের সবচেয়ে সাহসী ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা, সে দলের দায় পড়েনি কারও তোষামোদ করার! তাছাড়া যারা রাজাকার এবং রাজাকার-আল বদরের পৃষ্ঠপোষক, তাদের সঙ্গে তো পিঠা ভাগ দূরের কথা বিষও ভাগ করা যায় না। খালেদা জিয়া শেখ হাসিনাকে চিনতে ভুল করছেন।
পঞ্চম, বিএনপি নাকি একদলীয় বাকশালী স্বৈরশাসনের ধ্বংসস্তূপ থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র এনেছে। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পুনর্জন্ম দিয়েছে। এখানে প্রথম মিথ্যাচার হলো বাকশাল বা বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ স্বৈরশাসন ছিল না এবং ধ্বংসস্তূপ হওয়ার কথাটাও সত্য নয়। সত্য হলো বাকশাল জনগণের নির্বাচিত পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গঠিত হয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করে এগিয়ে যাওয়ার এবং খালেদা জিয়ার প্রয়াত স্বামী জিয়াউর রহমানও এই বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। সদস্য হওয়ার জন্য তাঁকে তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমদের অফিস কক্ষে বহুদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের পুনর্জন্মের প্রশ্ন ওঠে না। তখন অবস্থা ছিল বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের হত্যা করা হয়েছে, যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনিকে হত্যা করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের যে সব নেতা বেঁচেছিলেন তাদেরও খুঁজে খুঁজে জেলে পাঠানো হয়েছে। এ অবস্থায় হয়ত বছর খানেক লাগত ঘুরে দাঁড়াতে, তারপরই আওয়ামী লীগ আবারও দাঁড়িয়ে যেত, তার প্রমাণ এখনকার আওয়ামী লীগ। কোন মিলিটারি ক্যুদেঁতার কাছে ধর্ণা দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার প্রশ্নই ওঠে না। বরং জিয়াউর রহমানই আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাছে ধর্ণা দিয়েছিলেন, এই প্রস্তাব নিয়ে যে, তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেবেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হবেন, পার্লামেন্ট, মন্ত্রিসভা আওয়ামী লীগের হাতে থাকবে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তা ঘৃণাভরে প্রত্যাহার করে বলেছিলেন, প্রথমত বঙ্গবন্ধুর খুনী, দ্বিতীয়ত মিলিটারি, এদের সঙ্গে মিলে রাজনীতি করার তো প্রশ্নই ওঠে না।
ষষ্ঠ, খালেদা জিয়া বলেছেন, সংবাদ মাধ্যমে যারা কাজ করছেন তাঁদের পক্ষেও না-কি সত্য তুলে ধরা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পথ সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। তাঁর কথা সত্যি হলে বাংলাদেশে শত শত দৈনিক সংবাদপত্র বা দুই ডজনেরও অধিক টিভি চ্যানেল চলেছে কেমন করে। বিশেষ করে টিভি চ্যানেলের আলোচনা বা টকশোক অথবা অন্তত ২টি বড় পত্রিকা যেভাবে সত্য-মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য দিয়ে সরকারের সমালোচনা করছে, এমনকি শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করছে, অশোভন-অভদ্র আচরণ করছে, কই সরকার তো কোন বাধা দিচ্ছে না। তারপরও যদি কেউ বলে, 'সত্য তুলে ধরা কঠিন হয়ে পড়েছে, সে শুধু মিথ্যাবাদীই নয়, চরম অগণতান্ত্রিকও। হ্যাঁ, যদি কেউ বলে- চাঁদে এক রাজাকারের মাথা দেখা গেছে বা পবিত্র কাবা শরীফে গিলাপ পরিবর্তনের ছবি ছেপে যদি বলে রাজাকার সাঈদীর জন্য মানববন্ধন করছে, সে তো কেবল মিথ্যুকই নয়, মুসলমান কিনা সে প্রশ্নও সামনে আসে। কিংবা যদি কেউ বলে যৌথবাহিনীতে ভারতীয় সৈন্য, তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কি? অবশ্য ঘৃণ্য রাজাকারের ঔরষে জন্ম যার তার আবার দেশ, তার আবার ধর্ম?
সপ্তম, খালেদা জিয়া বলেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী সব রাজনৈতিক শক্তি ও দলকে নিশ্চিহ্ন করে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার অপকৌশল গ্রহণ করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী অথচ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে, তারা প্রায় সবাই বর্তমান সংসদ ও সরকারে আছে। নেই কেবল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন পাকিপন্থী বিএনপি এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না সেই সব দল। তাদের তো বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকারই থাকা উচিত নয়। সে আন্দোলনও এখন শুরু হয়েছে, একদিন তাও হবে। অবশ্য সিপিবি জাতীয় নামসর্বস্ব স্বাধীনতার পক্ষের কিছু দলও সরকার বিরোধিতা করছে। কখনও কখনও এদের ভূমিকা রাজাকারদের পক্ষে চলে যাচ্ছে। যেমন বাংলাদেশবিরোধী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি চরম মুসলিমবিরোধী উগ্রবাদী দাঙ্গাবাজ নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসার পাত্রী হয়েছেন এখন। তঁকে মোদী বলছেন, 'আপনি রাজ্য সামলান, আমি দেশ চালাব' (প্রথম আলো, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)।
এমনি করে খালেদা জিয়ার মিথ্যাচারের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। দিতে হলে ভলিউমের পর ভলিউম রচনা করতে হবে। যে জন্য বিএনপি নেতার নাম হয়েছে 'মিথ্যার ডিকশনারি ঠ-১।'
খালেদা জিয়া বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি নির্বাচন 'বর্জন' 'প্রতিরোধ' এবং 'প্রতিহত' করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিদেশে পলাতক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত পুত্র তারেকও লন্ডন থেকে এই আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারেক আবার দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি 'আহ্বান' শব্দের পরিবর্তে 'নির্দেশনা' শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। তারপর দেশব্যাপী সন্ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ, গৃহহারা, অগ্নিসংযোগের মতো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েও দেড় শ'র মতো ভোট কেন্দ্র জ্বালিয়েও ভোটার জনগণকে আটকানো যায়নি, তারা ভোট দিয়েছে। কেন দিয়েছে? কারণ খালেদা জিয়া স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে নিয়েছেন, তাদের বিচারের কাঠগড়া থেকে ছাড়িয়ে নিতে দেশব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। যে কারণে তার জনপ্রিয়তা তলানীতে নেমে গেছে।
দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত (৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ডি-আই (ডেমোক্রেটিক ইন্টারন্যাশনাল)-এর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী ৫ জানুয়ারি সর্বদলীয় নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট পড়ত শতকরা ৪২ দশমিক ৭ ভাগ, বিএনপির পক্ষে ৩৫ দশমিক ১ ভাগ এবং এখন নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ৪১ দশমিক ৫ ভাগ, বিএনপির পক্ষে ৩৭ দশমিক ৬ ভাগ ভোট পড়বে। গত ১১ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত দেশের ৩৯টি জেলার ভোটারদের মধ্যে জরিপ করে ডি-আই এই তথ্য প্রকাশ করেছে। এর অর্থ বাংলাদেশের জনগণ যেমন সন্ত্রাস, রগকাটা-গলাকাটা, হরতাল অবরোধের নামে নাশকতা সৃষ্টি, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিপক্ষে, তেমনি স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী অপশক্তির চলমান বিচার ত্বরান্বিত হোক তা চায়। জনগণ চায় ফ্যাসিস্ট জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হোক, মিথ্যাচার বন্ধ হোক, কেন না মিথ্যাচার ফ্যাসিজম এবং গণতন্ত্র এক সঙ্গে চলতে পারে না।
ঢাকা- ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহ পত্রিকার সংবাদ ॥ শিরোনাম- "এক মাসে ২৩ জন নিহত- খালেদা জিয়া ॥ একজন মাত্র নিহতের ঘটনা ঘটেছে-জেলা পুলিশ ॥" (প্রবাহ, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)। সংবাদে বলা হয়েছে, বিএনপি ও ১৯ দল নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া চাঁদপুর জেলায় এক মাসে (২৬ ডিসেম্বর ২০১৩-২৭ জানুয়ারি ২০১৪) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও (তাঁর ভাষায়) আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে ২৩ জন নিহত হবার তথ্য পরিবেশন করেছেন। বস্তুত ঐ সময়ের মধ্যে মাত্র একজন নিহত হয়েছেন- পয়লা জানুয়ারি, ঘোষের হাট এলাকায়। নিহতের নাম ফারুক পাটোয়ারী, সে যুবদল কর্মী। অবরোধের মাঝে যৌথবাহিনীর গুলিতে সে নিহত হয়েছে।
এই হলো ঘটনা। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাতে বেশ কয়েকটি টিভি টক শোতে দেখলাম সুশীল বাবুরা বলেছেন, এবার সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া হাওয়ার ওপর কিছু বলেননি, বরং তথ্যসমৃদ্ধ ঘটনাবলীর বিবরণ দিয়েছেন। এটি একটি ইতিবাচক দিক। খুশি হতে পারতাম যদি তার প্রদত্ত তথ্য সত্য হতো?
মিথ্যা দিয়ে তথ্যের সম্ভার সাজিয়ে কিছু গণমাধ্যম বা পাকি-দালাল সুশীল বাবুদের (প্রফেসর ড. মুনতাসীর মামুন তাদের নাম দিয়েছেন সুশীল বাটপাড়) কোরাস গাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সব গণমাধ্যম যেমন রাজাকার তোষণকারী নয়, তেমনি সব সুশীলও সুশীল বাটপাড় নয়। যার প্রমাণ পদ্মা-মেঘনা পাড়ের ইলিশের শহর চাঁদপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক 'চাঁদপুর প্রবাহ'-এর সংবাদটি। তারা ঐ ২৬ ডিসেম্বর ১৩ থেকে ২৭ জানুয়ারি ১৪ পর্যন্ত ঐ ৩৩ দিনে একজন মাত্র যুবদল কর্মী মারা যাবার খবর দিয়ে বলেছে, অবরোধের মাঝে সংঘর্ষ চলাকালে যৌথবাহিনীর গুলিতে সে মারা গেছে। তার নাম, বাড়িঘর, দলীয় পরিচয় সবই ছেপেছে পত্রিকাটি। প্রশ্ন হলো কখন যৌথবাহিনী গুলি চালিয়েছে? যারা চক্ষুষ্মান তারা দেখেছেন, বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে 'নির্বাচন প্রতিহত' করার ঘোষণা দিয়ে দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি যেভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বিএনপির সন্ত্রাসী ও জামায়াত-শিবিরের রগকাটা-গলাকাটা বাহিনীকে পথে নামানো হয়েছিল, এমনকি তাদের হাতে পেট্রোল বোমা, গান পাউডার তুলে দেয়া হয়েছিল তা দিয়ে সন্ত্রাসীরা যৌথবাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছে, প্রধানত হিন্দু বসতি পাড়া-মহল্লায় হামলা চালিয়েছিল, বোমা মেরে যাত্রীসহ বাস-ট্রেন-ট্রেম্পো-অটোরিকশা-কার জ্বালিয়েছে, যাত্রী ও চালকদের পুড়িয়ে হত্যা করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে, হিন্দুদের ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়েছে, রাস্তা কেটে এবং গাছ কেটে ফেলে চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। ঐ সময় পুলিশের দিক থেকে গুলিও চালানো হয়েছে এটি কেউ অস্বীকার করবে না এবং গুলি চালানোর ব্যাপারটা কেউ সমর্থনও করেন না। কিন্তু একজন পুলিশ সদস্যকে পেটাতে পেটাতে মাটিতে ফেলে লাথির পর লাথি দিতে থাকলে তার সহকর্মীরা কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলবে অতটা আশা করা কি ঠিক? কোন সভ্য সমাজ কি তা সমর্থন করে? এমনকি এও দেখা গেছে, যাত্রীবাহী বাস-টেম্পোতে পেট্রোল বোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তারা হাসাহাসি-উল্লাস করছে কিংবা এমন খবরও শোনা গেছে, পেট্রোল বোমা ছোঁড়ার পর বাস হেলপার দৌড়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিল পারেনি, তাকে ধরে এনে গায়ে পেট্রোল ঢেলে উল্লাস করতে করতে অগ্নিসংযোগ করেছে। ওদের হাতে নিরীহ প্রাণী গরুও রক্ষা পায়নি, চট্টগ্রামে গরুবাহী ট্রাকে আগুন দিয়ে ওরা গরু পুড়িয়ে মেরেছে- এ হিংস্রতার জবাব কি?
বিএনপি-জামায়াত-শিবির এবং বংশবদ সুশীল বাটপাড়রা কথায় কথায় গণতন্ত্রের কথা বলেন অথচ গণতন্ত্রের পথে একদম হাঁটেন না, হাঁটেন চোরা-সন্ত্রাস-জ্বালাও-পোড়াওর পথে, মানুষ হত্যার পথে, নারী ধর্ষণের পথে। বস্তুত যাদের জন্ম মিলিটারি জান্তার নাইট ক্লাবে, তাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা মনে হয় ভিন্ন। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সংজ্ঞার সঙ্গে তাদের গণতন্ত্র মেলে না। তাদের গণতন্ত্র হলো- প্রথমে অগণতান্ত্রিক বা চোরা পথে অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল এবং পরে প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্বাচনে কারচুপি করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন ও সিংহাসনে আরোহণ। এ প্রেসক্রিপশন জিয়া-এরশাদের পরে অচল হয়ে গেলেও খালেদা জিয়া তা আঁকড়ে ধরে আছেন এখনও। তবে পদ্ধতিটা পাল্টেছেন। খালেদার আমলে মিলিটারি নাইট ক্লাবকে নেপথ্যে রেখে ভুয়া ভোটার বানিয়ে সীল মারার প্রবণতা দেখা গেছে। বর্তমান জনসচেতনতার যুগে তাও অচল হয়ে যায় এবং যে কারণে তারা এখন সন্ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও-এর পথ ধরেছে। আমেরিকার গণতন্ত্রের প্রথম যুগে যে সংজ্ঞা প্রেসিডেন্ট জর্জ আব্রাহাম লিংকন দিয়েছিলেন-'Government of the people, for the people, by the people' (একটি জনগোষ্ঠীর সরকার হবে সেই জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এবং সে সরকারও হবে ঐ জনগোষ্ঠীরই দ্বারা নির্বাচিত)। আমাদের বাংলাদেশে তথাকথিত 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী' (এটি আরেকটি বাটপাড়ি। লেজুড়বৃত্তি করে পাকিস্তানের গায়ে বাংলাদেশী সীল) বিশ্বাসীদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা প্রথম দিকে ছিল - 'Government of the military, for the military, by the military' যখন দেখল এই ষড়যন্ত্রের রাজনীতির ধারাও আর চলছে না, অচল হয়ে গেছে, তখন তাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞাও পাল্টে যায়-'Government of the Rajaker, for the Rajaker, by the Rajaker Adminstration' এটিও অচল হয়ে যায়। এখন তাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হলো -'Government of the BNP-Jamaat, for the Jamaat-BNP, by the Rogkata-Golakata Bahini'.
অবশ্য তাদের জন্মটাই মিথ্যাচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাদের মিথ্যাচারের প্রথম নমুনা হলো- জিয়া না কি স্বাধীনতার ঘোষক? হ্যাঁ, ঘোষক অবশ্যই তবে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা পাঠ করে ঘোষক হয়েছেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পাঠক। বঙ্গবন্ধুর নাম না নিয়ে যদি বলা হয় জিয়া ঘোষক তবে তা চরম মিথ্যাচার। যেমন জিয়াপত্নী খালেদা জিয়ার প্রথম ও প্রধান মিথ্যাচার হলো তাঁর জন্ম তারিখ... বিভিন্ন সময় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ৫ আগস্ট বা ১৯ আগস্ট। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হবার পর রাজাকার-আল বদর ও সুশীল বাটপাড়রা ১৫ আগস্ট ভুয়া জন্মদিন বানিয়ে কেক কাটার নোংরা রাজনীতি চালু করে। জাতির পিতার শাহাদাত দিবস ১৫ আগস্ট ভুয়া জন্মদিন বানিয়ে খালেদা জিয়া তাঁর বিকৃত রুচিরই পরিচয় দিচ্ছেন। তাছাড়া একজনের একাধিক জন্মদিন খারাপ ইঙ্গিতও বহন করে। তবে এর বিস্তারিত বলা অশোভনীয় তাই বলছি না। কিন্তু এটা যে চরম মিথ্যাচার তা তাঁর দল-জোটঅলারাও অনেকে জানেন এবং বিশ্বাস করেন।
মিথ্যাচার তাদের অস্থি-মজ্জায় মিশে আছে। খালেদা জিয়া গত ৪ জানুয়ারির সংবাদ সম্মেলনে বললেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে- এটি মিথ্যাচার।
দ্বিতীয়, নির্বাচনে ৫ শতাংশ ভোট পড়েছে? অথচ নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করলেন ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। যদি নির্বাচন কমিশন মিথ্যাচার করে থাকে তা হলে তো খালেদা জিয়ার উচিত এই নির্বাচন কমিশন বাতিলের আন্দোলন করা। তা না করে তিনি এই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এর অর্থ তার ৫ শতাংশ ভোট পড়ার গল্প মিথ্যাচার। অবশ্য মিথ্যার ডিকশেনারি থেকে মিথ্যাচারই বেরোবে, এতে সন্দেহের কি আছে?
তৃতীয়ত, ভোটের আগেই ১৫৩ আসন আওয়ামী লীগ 'ভাগ-বাটোয়ারা' করে নিয়েছে। এটিও মিথ্যাচার। বাস্তবতা হচ্ছে ঐ ১৫৩ আসনে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী বা একাধিক প্রার্থী ছিল না। যে প্রার্থী শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে ছিলেন এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাও অজ্ঞতা এবং মিথ্যাচার।
চতুর্থ, খালেদা জিয়া বলেছেন ঐ ১৫৩ আসন 'ভাগ-বাটোয়ারার' সময় এক ভাগ তাদেরও দিতে চেয়েছিল, তারা নেননি। এটিও বিশ্বাস করতে হবে? আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। এই আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন ইতিহাসের মহান পুরুষ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁকে এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে (১৯৭৫) দলটির এতটুকু ক্ষতি করা যায়নি এবং যে আওয়ামী লীগের প্রধান ও বঙ্গবন্ধু কন্যা এ সময়ের সবচেয়ে সাহসী ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা, সে দলের দায় পড়েনি কারও তোষামোদ করার! তাছাড়া যারা রাজাকার এবং রাজাকার-আল বদরের পৃষ্ঠপোষক, তাদের সঙ্গে তো পিঠা ভাগ দূরের কথা বিষও ভাগ করা যায় না। খালেদা জিয়া শেখ হাসিনাকে চিনতে ভুল করছেন।
পঞ্চম, বিএনপি নাকি একদলীয় বাকশালী স্বৈরশাসনের ধ্বংসস্তূপ থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র এনেছে। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পুনর্জন্ম দিয়েছে। এখানে প্রথম মিথ্যাচার হলো বাকশাল বা বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ স্বৈরশাসন ছিল না এবং ধ্বংসস্তূপ হওয়ার কথাটাও সত্য নয়। সত্য হলো বাকশাল জনগণের নির্বাচিত পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গঠিত হয়েছিল। এর লক্ষ্য ছিল জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করে এগিয়ে যাওয়ার এবং খালেদা জিয়ার প্রয়াত স্বামী জিয়াউর রহমানও এই বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। সদস্য হওয়ার জন্য তাঁকে তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমদের অফিস কক্ষে বহুদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের পুনর্জন্মের প্রশ্ন ওঠে না। তখন অবস্থা ছিল বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের হত্যা করা হয়েছে, যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনিকে হত্যা করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের যে সব নেতা বেঁচেছিলেন তাদেরও খুঁজে খুঁজে জেলে পাঠানো হয়েছে। এ অবস্থায় হয়ত বছর খানেক লাগত ঘুরে দাঁড়াতে, তারপরই আওয়ামী লীগ আবারও দাঁড়িয়ে যেত, তার প্রমাণ এখনকার আওয়ামী লীগ। কোন মিলিটারি ক্যুদেঁতার কাছে ধর্ণা দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার প্রশ্নই ওঠে না। বরং জিয়াউর রহমানই আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাছে ধর্ণা দিয়েছিলেন, এই প্রস্তাব নিয়ে যে, তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেবেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হবেন, পার্লামেন্ট, মন্ত্রিসভা আওয়ামী লীগের হাতে থাকবে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তা ঘৃণাভরে প্রত্যাহার করে বলেছিলেন, প্রথমত বঙ্গবন্ধুর খুনী, দ্বিতীয়ত মিলিটারি, এদের সঙ্গে মিলে রাজনীতি করার তো প্রশ্নই ওঠে না।
ষষ্ঠ, খালেদা জিয়া বলেছেন, সংবাদ মাধ্যমে যারা কাজ করছেন তাঁদের পক্ষেও না-কি সত্য তুলে ধরা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পথ সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। তাঁর কথা সত্যি হলে বাংলাদেশে শত শত দৈনিক সংবাদপত্র বা দুই ডজনেরও অধিক টিভি চ্যানেল চলেছে কেমন করে। বিশেষ করে টিভি চ্যানেলের আলোচনা বা টকশোক অথবা অন্তত ২টি বড় পত্রিকা যেভাবে সত্য-মিথ্যা-বানোয়াট তথ্য দিয়ে সরকারের সমালোচনা করছে, এমনকি শেখ হাসিনাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করছে, অশোভন-অভদ্র আচরণ করছে, কই সরকার তো কোন বাধা দিচ্ছে না। তারপরও যদি কেউ বলে, 'সত্য তুলে ধরা কঠিন হয়ে পড়েছে, সে শুধু মিথ্যাবাদীই নয়, চরম অগণতান্ত্রিকও। হ্যাঁ, যদি কেউ বলে- চাঁদে এক রাজাকারের মাথা দেখা গেছে বা পবিত্র কাবা শরীফে গিলাপ পরিবর্তনের ছবি ছেপে যদি বলে রাজাকার সাঈদীর জন্য মানববন্ধন করছে, সে তো কেবল মিথ্যুকই নয়, মুসলমান কিনা সে প্রশ্নও সামনে আসে। কিংবা যদি কেউ বলে যৌথবাহিনীতে ভারতীয় সৈন্য, তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কি? অবশ্য ঘৃণ্য রাজাকারের ঔরষে জন্ম যার তার আবার দেশ, তার আবার ধর্ম?
সপ্তম, খালেদা জিয়া বলেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী সব রাজনৈতিক শক্তি ও দলকে নিশ্চিহ্ন করে সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার অপকৌশল গ্রহণ করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী অথচ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে, তারা প্রায় সবাই বর্তমান সংসদ ও সরকারে আছে। নেই কেবল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন পাকিপন্থী বিএনপি এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না সেই সব দল। তাদের তো বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকারই থাকা উচিত নয়। সে আন্দোলনও এখন শুরু হয়েছে, একদিন তাও হবে। অবশ্য সিপিবি জাতীয় নামসর্বস্ব স্বাধীনতার পক্ষের কিছু দলও সরকার বিরোধিতা করছে। কখনও কখনও এদের ভূমিকা রাজাকারদের পক্ষে চলে যাচ্ছে। যেমন বাংলাদেশবিরোধী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি চরম মুসলিমবিরোধী উগ্রবাদী দাঙ্গাবাজ নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসার পাত্রী হয়েছেন এখন। তঁকে মোদী বলছেন, 'আপনি রাজ্য সামলান, আমি দেশ চালাব' (প্রথম আলো, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪)।
এমনি করে খালেদা জিয়ার মিথ্যাচারের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। দিতে হলে ভলিউমের পর ভলিউম রচনা করতে হবে। যে জন্য বিএনপি নেতার নাম হয়েছে 'মিথ্যার ডিকশনারি ঠ-১।'
খালেদা জিয়া বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি নির্বাচন 'বর্জন' 'প্রতিরোধ' এবং 'প্রতিহত' করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিদেশে পলাতক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত পুত্র তারেকও লন্ডন থেকে এই আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারেক আবার দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি 'আহ্বান' শব্দের পরিবর্তে 'নির্দেশনা' শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। তারপর দেশব্যাপী সন্ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ, গৃহহারা, অগ্নিসংযোগের মতো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েও দেড় শ'র মতো ভোট কেন্দ্র জ্বালিয়েও ভোটার জনগণকে আটকানো যায়নি, তারা ভোট দিয়েছে। কেন দিয়েছে? কারণ খালেদা জিয়া স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে নিয়েছেন, তাদের বিচারের কাঠগড়া থেকে ছাড়িয়ে নিতে দেশব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। যে কারণে তার জনপ্রিয়তা তলানীতে নেমে গেছে।
দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত (৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ডি-আই (ডেমোক্রেটিক ইন্টারন্যাশনাল)-এর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী ৫ জানুয়ারি সর্বদলীয় নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট পড়ত শতকরা ৪২ দশমিক ৭ ভাগ, বিএনপির পক্ষে ৩৫ দশমিক ১ ভাগ এবং এখন নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ৪১ দশমিক ৫ ভাগ, বিএনপির পক্ষে ৩৭ দশমিক ৬ ভাগ ভোট পড়বে। গত ১১ থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত দেশের ৩৯টি জেলার ভোটারদের মধ্যে জরিপ করে ডি-আই এই তথ্য প্রকাশ করেছে। এর অর্থ বাংলাদেশের জনগণ যেমন সন্ত্রাস, রগকাটা-গলাকাটা, হরতাল অবরোধের নামে নাশকতা সৃষ্টি, সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিপক্ষে, তেমনি স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী অপশক্তির চলমান বিচার ত্বরান্বিত হোক তা চায়। জনগণ চায় ফ্যাসিস্ট জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হোক, মিথ্যাচার বন্ধ হোক, কেন না মিথ্যাচার ফ্যাসিজম এবং গণতন্ত্র এক সঙ্গে চলতে পারে না।
ঢাকা- ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
প্রকাশ : জনকণ্ঠ, শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ২৬ মাঘ ১৪২০
Also Read:
মিথ্যাচারে 'নোবেল প্রাইজ' থাকলে ওরাই পেতো!:
__._,_.___