বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ৩০ মাঘ ১৪২০
মরিয়ার্টির পাঠানো গোপন বার্তায় সুপারিশ ॥ যুক্তরাষ্ট্রে তারেক নিষিদ্ধ
০ উইকিলিকসের তথ্য ফাঁস
০ তারেক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা ও বৈদেশিক সহায়তা বিনষ্টের কারণ
০ অবৈধভাবে লাখ লাখ মার্কিন ডলারের মালিক হয়েছেন
০ শুধু দেশীয় নয়, বিদেশী কোম্পানির সঙ্গেও দুর্নীতি করেছেন
০ সিমেন্সের কাছ থেকে ২ শতাংশ ও চীনের বিদ্যুত কোম্পানির কাছ থেকে সাড়ে সাত লাখ ডলার ঘুষ নিয়েছেন
০ ওই বার্তায় তাকে কুখ্যাত বলে অভিহিত করা হয়
০ তারেক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা ও বৈদেশিক সহায়তা বিনষ্টের কারণ
০ অবৈধভাবে লাখ লাখ মার্কিন ডলারের মালিক হয়েছেন
০ শুধু দেশীয় নয়, বিদেশী কোম্পানির সঙ্গেও দুর্নীতি করেছেন
০ সিমেন্সের কাছ থেকে ২ শতাংশ ও চীনের বিদ্যুত কোম্পানির কাছ থেকে সাড়ে সাত লাখ ডলার ঘুষ নিয়েছেন
০ ওই বার্তায় তাকে কুখ্যাত বলে অভিহিত করা হয়
স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজনৈতিকভাবে সংঘটিত গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছিল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। ২০০৮ সালের ৩ নবেম্বর ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়েছিল এই গোপন বার্তা। আলোচিত ওয়েবসাইট উইকিলিকস এই বার্তাটি ফাঁস করেছে। একই সঙ্গে তারেক রহমানকে 'কুখ্যাত' অভিহিত করে দুর্নীতিপ্রবণ সরকার এবং বাংলাদেশের সহিংস রাজনীতির এক দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই বার্তায়।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো ওই গোপন বার্তায় বলা হয়, রাজনৈতিকভাবে সংঘটিত গুরুতর দুর্নীতির জন্য তারেক দায়ী বলে দূতাবাস মনে করে। তার দুর্নীতির কারণে মার্কিন ঘোষণাপত্রের ৪ নম্বর ধারায় বর্ণিত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ্য বিনষ্ট হওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণœ হয়েছে।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তারেক রহমানকে নিষিদ্ধ করা হলেও তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান, মেয়ে জাইমা ও তারেক রহমানের মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিষয়ে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা যেন আরোপ না করা হয়, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। তারেকের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার সুপারিশের বিষয়ে প্রেক্ষাপটও তুলে ধরা হয়েছে ঢাকার বার্তায়।
ঢাকা থেকে পাঠানো গোপন বার্তায় বলা হয়, উন্নয়নশীল বাংলাদেশের জনজীবনে সর্বত্র পদ্ধতিগত দুর্নীতি বিস্তার করেছে। ২০০৬ সালে টানা চারবারের মতো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তালিকায় বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ছিল বাংলাদেশ। কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির মূলোৎপাটন ও দারিদ্র্যপীড়িত জাতিকে দুর্নীতির কশাঘাত থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রতিবছর দুই শতাংশ করে কমে গেছে।
দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বাসের শূন্যতা তৈরি করেছে, যে কারণে বেসরকারী বিনিয়োগের সুযোগ কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের প্রতি জনগণের আস্থা কমে যাচ্ছে।
বার্তায় তারেক রহমান সম্পর্কে বলা হয়, সরকারী ক্রয়সংক্রান্ত বিষয় এবং রাজনৈতিক পদ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে যত্রতত্র ঘুষ চাওয়ার জন্য তারেক রহমান কুখ্যাত। দুর্নীতিপ্রবণ সরকার এবং বাংলাদেশের সহিংস রাজনীতির এক দৃষ্টান্ত সে।
ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অর্থ আত্মসাত ও কর ফাঁকিসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা চললেও তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয় বলে বার্তায় উল্লেখ করা হয়।
তারেক রহমানের বেশ কয়েকটি পাসপোর্ট উল্লেখ করে বলা হয়, এ সব পাসপোর্টের মধ্যে একটি নতুন পাসপোর্ট যুক্তরাজ্য থেকে গত সেপ্টেম্বরে ইস্যু করা হয়েছে। আরেকটি পাসপোর্টে ৫ বছরের মাল্টিপল বি-১/বি-২ ভিসা রয়েছে। এই ভিসা ২০০৫ সালের ১১ মে ইস্যু করা হয়েছে। তবে আমাদের ধারণা সরকার এই পাসপোর্ট স্থগিত করেছে।
বার্তায় তারেক রহমানকে কুখ্যাত এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে, যাকে সবাই ভয় পায় বলে বর্ণনা করা হয়। জামিনে মুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে তার যাত্রা করার কথাও তুলে ধরে মার্কিন দূতাবাস।
গভীর রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, যা দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত পৌঁছেছে। তার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাধা কাটিয়ে বিচারিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে তারেক জামিন পেয়েছে।
গোপন বার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে, জনশ্রুতি রয়েছে যে, তারেক রহমান অবৈধভাবে লাখ লাখ মার্কিন ডলারের মালিক হয়েছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে একজন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী জবানবন্দী দিয়েছেন। সেই ব্যবসায়ী ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হয়েছেন।
বার্তায় বলা হয়, একটি মামলায় তারেক আল আমিন কনস্ট্রাকশনের মালিক আমিন আহমেদকে হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। দেড় লাখ ডলার না দিলে তাঁর প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের মোহাম্মদ আফতাব উদ্দীন খান, মীর আখতার হোসেন লিমিটেডের মীর জহির হোসেন ও হারুন ফেরদৌসিসহ অন্য অনেক স্থানীয় ব্যবসায়ী তার বিরুদ্ধে কয়েক মিলিয়ন ডলারের চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনও তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর ফাঁকির মামলা দিয়েছে।
মার্কিন দূতাবাস বলেছে, তারেকের দুর্নীতির কর্মকাণ্ড শুধু স্থানীয় কোম্পানির কাছে চাঁদাবাজির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার অনেকগুলো ঘটনায় জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
সিমেন্স কোম্পানি ॥ সিমেন্সের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে তারেক ও তার ভাই কোকোকে দেয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজনের সাক্ষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সিমেন্সের সব চুক্তির ক্ষেত্রে তারেক প্রায় দুই শতাংশ ঘুষ নিয়েছে। বর্তমানে এ মামলাটি যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের সম্পদ বাজেয়াফতকরণ শাখা ও এফবিআই খতিয়ে দেখছে।
হার্বিন কোম্পানি ॥ দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, একটি বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের জন্য চীনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তারেক রহমানকে সাড়ে ৭ লাখ ডলার দেয়। তারেকের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এ ঘুষের অর্থ নিয়ে তা সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকে রাখে।
মোনেম কনস্ট্রাকশন ॥ দুর্নীতি দমন কমিশনের এক কর্মকর্তা দূতাবাসকে জানিয়েছেন, মোনেম কনস্ট্রাকশন একটি কার্যাদেশ পেতে তারেক রহমানকে সাড়ে ৪ লাখ ডলার দেয়।
কবীর হত্যা মামলা ॥ দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে তথ্য রয়েছে যে, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের ছেলে সানভীর সোবহানকে একটি হত্যা মামলা থেকে রক্ষায় ২১ কোটি টাকা ঘুষ নেয় তারেক রহমান। বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক হুমায়ুন কবীর হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে একজন ছিলেন সানভীর। এ হত্যা মামলা থেকে সানভীরকে রেহাই দেয়ার আশ্বাস দিয়ে তারেক ওই অর্থ নেয় বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
ঘুষ ও চাঁদাবাজি ছাড়াও তারেক বড় অংকের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে দুর্নীতি দমন কমিশন জানিয়েছে। কয়েক সহযোগীর সহায়তা নিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ২ কোটি টাকা লুট করে তারেক। দুর্নীতি দমন কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, ওই ট্রাস্ট ফান্ডের ব্যাংক হিসাবের সহ-স্বাক্ষরকারী হিসেবে ফান্ড থেকে টাকা তুলে নিজের শহরে তিনি জমি কেনেন। ২০০৬ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ওই ফান্ডের চেক তিনি কর্মীদের দেন।
মার্কিন দূতাবাস বলেছে, তারেকের দুর্নীতি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করেছে। তার ব্যক্তিক্রমী কর্মকা-ে সরকার এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতার প্রতি জনগণের ভরসা কমে গেছে। আইন লঙ্ঘনে তারেক যে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে তা আইন সংশোধন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তা লক্ষ্য অর্জন ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশে ঘুষ, অর্থ আত্মসাত ও দুর্নীতির সংস্কৃতি গড়ে তোলা ও বজায় রাখার ক্ষেত্রে তারেক যা করেছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেক সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। তিনি মিলিয়ন ডলার জনগণের অর্থ চুরি করায় মুসলিম প্রধান এ উদারপন্থী দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়েছে। এ ছাড়া একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ ব্যাহত হয়েছে, যা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে একটি অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
তারেকের বেপরোয়া দুর্নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র মিশনের লক্ষ্যগুলোও ব্যাপকভাবে হুমকিতে পড়েছে। ঢাকা দূতাবাসের বাংলাদেশের জন্য তিনটি বিষয়ে অগ্রাধিকার রয়েছে। গণতন্ত্রায়ন, উন্নয়ন ও সন্ত্রাসীদের জায়গা না দেয়া। তারেকের দুর্নীতিতে তিনটি লক্ষ্য অর্জনই বিত হয়েছে। তার অর্থ আত্মসাত, চাঁদাবাজি ও বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের কারণে আইনের শাসন ব্যাহত হয়েছে এবং স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যকে হুমকিতে ফেলেছে।
ব্যবসায় দুর্নীতি ও ঘুষের যে চর্চা তারেক গড়ে তুলেছে তাতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচষ্টা ব্যাহত হয়েছে। উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিদেশী বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক কার্যক্রম জটিল হয়ে পড়েছে।
চূড়ান্তভাবে আইনের শাসনের প্রতি তার চরম অবাধ্যতা বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের আস্তানা গাড়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরির সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করেছে। সংক্ষেপে বলা হয়, বাংলাদেশে যা কিছু খারাপ তার বেশিরভাগের জন্যই তারেক ও তার সহযোগীদের দায়ী করা যায়।
উল্লেখ্য, বিএনপি নেতা তারেক রহমান ২০০৭ সালের ৭ মার্চ দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার হয়। পরে তার বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা দায়ের করা হয়। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সে জামিনে মুক্তি পায়। একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে তারেক রহমান দেশ ছাড়ে। সেখানে তিনি লন্ডনের সাউথ ওয়েলিংটন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত তারেক লন্ডনেই সপরিবারে বাস করছে। ২০১৩ সালের মে মাসে আদালত থেকে তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো ওই গোপন বার্তায় বলা হয়, রাজনৈতিকভাবে সংঘটিত গুরুতর দুর্নীতির জন্য তারেক দায়ী বলে দূতাবাস মনে করে। তার দুর্নীতির কারণে মার্কিন ঘোষণাপত্রের ৪ নম্বর ধারায় বর্ণিত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ্য বিনষ্ট হওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণœ হয়েছে।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তারেক রহমানকে নিষিদ্ধ করা হলেও তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান, মেয়ে জাইমা ও তারেক রহমানের মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিষয়ে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা যেন আরোপ না করা হয়, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। তারেকের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার সুপারিশের বিষয়ে প্রেক্ষাপটও তুলে ধরা হয়েছে ঢাকার বার্তায়।
ঢাকা থেকে পাঠানো গোপন বার্তায় বলা হয়, উন্নয়নশীল বাংলাদেশের জনজীবনে সর্বত্র পদ্ধতিগত দুর্নীতি বিস্তার করেছে। ২০০৬ সালে টানা চারবারের মতো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তালিকায় বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ছিল বাংলাদেশ। কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির মূলোৎপাটন ও দারিদ্র্যপীড়িত জাতিকে দুর্নীতির কশাঘাত থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রতিবছর দুই শতাংশ করে কমে গেছে।
দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বাসের শূন্যতা তৈরি করেছে, যে কারণে বেসরকারী বিনিয়োগের সুযোগ কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের প্রতি জনগণের আস্থা কমে যাচ্ছে।
বার্তায় তারেক রহমান সম্পর্কে বলা হয়, সরকারী ক্রয়সংক্রান্ত বিষয় এবং রাজনৈতিক পদ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে যত্রতত্র ঘুষ চাওয়ার জন্য তারেক রহমান কুখ্যাত। দুর্নীতিপ্রবণ সরকার এবং বাংলাদেশের সহিংস রাজনীতির এক দৃষ্টান্ত সে।
ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অর্থ আত্মসাত ও কর ফাঁকিসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা চললেও তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয় বলে বার্তায় উল্লেখ করা হয়।
তারেক রহমানের বেশ কয়েকটি পাসপোর্ট উল্লেখ করে বলা হয়, এ সব পাসপোর্টের মধ্যে একটি নতুন পাসপোর্ট যুক্তরাজ্য থেকে গত সেপ্টেম্বরে ইস্যু করা হয়েছে। আরেকটি পাসপোর্টে ৫ বছরের মাল্টিপল বি-১/বি-২ ভিসা রয়েছে। এই ভিসা ২০০৫ সালের ১১ মে ইস্যু করা হয়েছে। তবে আমাদের ধারণা সরকার এই পাসপোর্ট স্থগিত করেছে।
বার্তায় তারেক রহমানকে কুখ্যাত এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে, যাকে সবাই ভয় পায় বলে বর্ণনা করা হয়। জামিনে মুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে তার যাত্রা করার কথাও তুলে ধরে মার্কিন দূতাবাস।
গভীর রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, যা দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত পৌঁছেছে। তার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাধা কাটিয়ে বিচারিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে তারেক জামিন পেয়েছে।
গোপন বার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে, জনশ্রুতি রয়েছে যে, তারেক রহমান অবৈধভাবে লাখ লাখ মার্কিন ডলারের মালিক হয়েছে। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে একজন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী জবানবন্দী দিয়েছেন। সেই ব্যবসায়ী ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হয়েছেন।
বার্তায় বলা হয়, একটি মামলায় তারেক আল আমিন কনস্ট্রাকশনের মালিক আমিন আহমেদকে হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। দেড় লাখ ডলার না দিলে তাঁর প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। রেজা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের মোহাম্মদ আফতাব উদ্দীন খান, মীর আখতার হোসেন লিমিটেডের মীর জহির হোসেন ও হারুন ফেরদৌসিসহ অন্য অনেক স্থানীয় ব্যবসায়ী তার বিরুদ্ধে কয়েক মিলিয়ন ডলারের চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনও তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর ফাঁকির মামলা দিয়েছে।
মার্কিন দূতাবাস বলেছে, তারেকের দুর্নীতির কর্মকাণ্ড শুধু স্থানীয় কোম্পানির কাছে চাঁদাবাজির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার অনেকগুলো ঘটনায় জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
সিমেন্স কোম্পানি ॥ সিমেন্সের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে তারেক ও তার ভাই কোকোকে দেয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজনের সাক্ষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সিমেন্সের সব চুক্তির ক্ষেত্রে তারেক প্রায় দুই শতাংশ ঘুষ নিয়েছে। বর্তমানে এ মামলাটি যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের সম্পদ বাজেয়াফতকরণ শাখা ও এফবিআই খতিয়ে দেখছে।
হার্বিন কোম্পানি ॥ দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, একটি বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের জন্য চীনের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তারেক রহমানকে সাড়ে ৭ লাখ ডলার দেয়। তারেকের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু এ ঘুষের অর্থ নিয়ে তা সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকে রাখে।
মোনেম কনস্ট্রাকশন ॥ দুর্নীতি দমন কমিশনের এক কর্মকর্তা দূতাবাসকে জানিয়েছেন, মোনেম কনস্ট্রাকশন একটি কার্যাদেশ পেতে তারেক রহমানকে সাড়ে ৪ লাখ ডলার দেয়।
কবীর হত্যা মামলা ॥ দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে তথ্য রয়েছে যে, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যানের ছেলে সানভীর সোবহানকে একটি হত্যা মামলা থেকে রক্ষায় ২১ কোটি টাকা ঘুষ নেয় তারেক রহমান। বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক হুমায়ুন কবীর হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে একজন ছিলেন সানভীর। এ হত্যা মামলা থেকে সানভীরকে রেহাই দেয়ার আশ্বাস দিয়ে তারেক ওই অর্থ নেয় বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
ঘুষ ও চাঁদাবাজি ছাড়াও তারেক বড় অংকের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে দুর্নীতি দমন কমিশন জানিয়েছে। কয়েক সহযোগীর সহায়তা নিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ২ কোটি টাকা লুট করে তারেক। দুর্নীতি দমন কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, ওই ট্রাস্ট ফান্ডের ব্যাংক হিসাবের সহ-স্বাক্ষরকারী হিসেবে ফান্ড থেকে টাকা তুলে নিজের শহরে তিনি জমি কেনেন। ২০০৬ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ওই ফান্ডের চেক তিনি কর্মীদের দেন।
মার্কিন দূতাবাস বলেছে, তারেকের দুর্নীতি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে ক্ষুণ্ণ করেছে। তার ব্যক্তিক্রমী কর্মকা-ে সরকার এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্থিতিশীলতার প্রতি জনগণের ভরসা কমে গেছে। আইন লঙ্ঘনে তারেক যে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে তা আইন সংশোধন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তা লক্ষ্য অর্জন ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশে ঘুষ, অর্থ আত্মসাত ও দুর্নীতির সংস্কৃতি গড়ে তোলা ও বজায় রাখার ক্ষেত্রে তারেক যা করেছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেক সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। তিনি মিলিয়ন ডলার জনগণের অর্থ চুরি করায় মুসলিম প্রধান এ উদারপন্থী দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়েছে। এ ছাড়া একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগ ব্যাহত হয়েছে, যা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলে একটি অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
তারেকের বেপরোয়া দুর্নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র মিশনের লক্ষ্যগুলোও ব্যাপকভাবে হুমকিতে পড়েছে। ঢাকা দূতাবাসের বাংলাদেশের জন্য তিনটি বিষয়ে অগ্রাধিকার রয়েছে। গণতন্ত্রায়ন, উন্নয়ন ও সন্ত্রাসীদের জায়গা না দেয়া। তারেকের দুর্নীতিতে তিনটি লক্ষ্য অর্জনই বিত হয়েছে। তার অর্থ আত্মসাত, চাঁদাবাজি ও বিচার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপের কারণে আইনের শাসন ব্যাহত হয়েছে এবং স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যকে হুমকিতে ফেলেছে।
ব্যবসায় দুর্নীতি ও ঘুষের যে চর্চা তারেক গড়ে তুলেছে তাতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচষ্টা ব্যাহত হয়েছে। উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিদেশী বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর আন্তর্জাতিক কার্যক্রম জটিল হয়ে পড়েছে।
চূড়ান্তভাবে আইনের শাসনের প্রতি তার চরম অবাধ্যতা বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের আস্তানা গাড়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরির সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করেছে। সংক্ষেপে বলা হয়, বাংলাদেশে যা কিছু খারাপ তার বেশিরভাগের জন্যই তারেক ও তার সহযোগীদের দায়ী করা যায়।
উল্লেখ্য, বিএনপি নেতা তারেক রহমান ২০০৭ সালের ৭ মার্চ দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার হয়। পরে তার বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা দায়ের করা হয়। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সে জামিনে মুক্তি পায়। একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের উদ্দেশে তারেক রহমান দেশ ছাড়ে। সেখানে তিনি লন্ডনের সাউথ ওয়েলিংটন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত তারেক লন্ডনেই সপরিবারে বাস করছে। ২০১৩ সালের মে মাসে আদালত থেকে তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০১৪, ৩০ মাঘ ১৪২০
__._,_.___