রবিবার, ৩০ মার্চ ২০১৪, ১৬ চৈত্র ১৪২০
খালেদা-তারেকের উদ্ভট তত্ত্বে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড়
বিশেষ প্রতিনিধি ॥ স্বাধীনতার ৪৩ বছর খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের নতুন 'উদ্ভট তত্ত্ব ও তথ্য' দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, সংবিধান লঙ্ঘন এবং সর্বোচ্চ আদালতের রায় অবমাননা করে রাষ্ট্রদ্রোহীমূলক বক্তব্যের জন্য দ্রুত তাঁদের দুজনকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিরা। একই সঙ্গে সাবেক বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে জাতির সামনে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও স্বাধীনতার সপক্ষের বিভিন্ন সংগঠন থেকে এমন দাবি জানিয়ে বলা হয়, 'মা-ছেলে বেসামাল হয়ে উদ্ভট তত্ত্ব দিচ্ছেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় ছিলেন সাড়ে পাঁচ বছর, খালেদা জিয়া ছিলেন ১০ বছরের বেশি। এই দীর্ঘ সময়ে বিএনপির কোন নেতা-নেত্রী কিংবা সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও দাবি করেননি যে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এখন খালেদা-তারেকের এমন উদ্ভট আবিষ্কার ও নতুন তত্ত্ব রাষ্ট্রদ্রোহী, সংবিধান পরিপন্থী এবং ষড়যন্ত্রমূলক। এ জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে গ্রেফতার করা প্রয়োজন। অবিলম্বে খালেদা জিয়াকে এমন ইতিহাস বিকৃতকারী বক্তব্যে প্রত্যাহার এবং জাতির সামনে ক্ষমা প্রার্থনার দাবি জানিয়ে শনিবার বিভিন্ন সংগঠন ও আলোচনায় সভায় বলা হয়, এমনকি জীবদ্দশায় জিয়াউর রহমানও নিজেকে কখনও রাষ্ট্রপতি কিংবা স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করেননি। নিজের লেখায় ও ঘোষণায় স্বীকার করে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগোষ্ঠী, ভূখ-, সংবিধান ও সরকারÑ এই চারটি মূল শর্ত পূরণ করেই দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭১ সালের মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু আর রাষ্ট্রপতি হওয়ার একমাত্র জনগণের ম্যান্ডেটও ছিল তাঁর প্রতি। তাঁরা প্রশ্ন রেখে বলেন, একজন রাষ্ট্রপতি কী ভাবে 'মেজর' হলেন? প্রথম সরকারের ৪শ' টাকার বেতনভোগী সামরিক কর্মকর্তা কী ভাবে রাষ্ট্রপতি হন? ইতিহাসকে নির্বাসনে পাঠিয়ে বা হত্যা করে কেউ রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারেনি, খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানরাও পারবেন না। মা-ছেলে বেসামাল হয়ে উদ্ভট তত্ত্ব দিচ্ছেনÑ সুরঞ্জিত ॥ প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, রাজনীতি করতে কিছু তো জ্ঞান-গরিমা থাকতে হয়, কিন্তু খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের তা নেই। মা-ছেলে বেসামাল হয়ে উদ্ভট তত্ত্ব দিচ্ছেন। এরা দুজনই রাজনীতি-মূর্খ, ইতিহাস মূর্খ। বিশেষ করে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীতের মতো সফল কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার যখন দেশ ও গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার পথে এগিয়ে চলেছে, তখন মা ও ছেলে বেসামাল হয়ে এমন উদ্ভট তত্ত্ব ও তথ্য দিচ্ছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বিডিনিউজকে দেয়া সাক্ষাতকারে প্রবীণ এই রাজনীতিক বলেন, দেশের মানুষ তো তাদের ভোট দিচ্ছে, তাদের যদি আরও ভোটের প্রয়োজন হয় তা অন্য কথা বলেও নিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু এমন মূর্খতা তাদের ভোট কমাবে, বাড়াবে না। আমি ইতিহাসের ছাত্র, ইতিহাসে এমন মূর্খদের স্থান নেই, তাই তাদের কোন রাজনৈতিক ভবিষ্যত আছে বলেও আমি মনে করি না। আর ইতিহাস নিয়ে এমন বাতুলতা আর কোথাও দেখিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি করা হলো, একদিন হয়ত জিয়াউর রহমানকে শাহানশাহ দাবি করা হবে। আর এই মূর্খদের মুখ থেকে একদিন জিয়াকে নবাব আলীবর্দী খাঁ দাবি করা হয়, তাতেও আমি বিস্মিত হব না। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানকে গ্লোরিফাই করার জন্য তাঁর ছেলের কিংবা স্ত্রীর কাছে মিথ্যাচারই একমাত্র পথ মনে হয়েছে। তারা চাইলে অন্য অনেক কথা বলতে পারতেন, কিন্তু সেটা করেননি। এটা মূর্খ রাজনীতিরই প্রকাশ। তাদের দুই জনের এই বক্তব্য জাতির সঙ্গে উদ্ভট ও নির্মম রসিকতা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আরও বলেন, জাতির কাছে ইতিহাসের এই বিষয়টি সুস্পষ্ট থাকা প্রয়োজন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগোষ্ঠী, ভূখ-, সংবিধান ও সরকারÑ এই চারটি মূল শর্ত পূরণ করেই দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। একটি দেশে খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের মতো নেতৃত্বকে দেশে গণতন্ত্রের পশ্চাৎপদতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গণতন্ত্র এমন অশিক্ষিতদের নেতৃত্বে নিয়ে আসতে পারে, ধর্মান্ধরা পেয়ে যেতে পারে গুরু দায়িত্ব, জাতির জন্য তা হবে সবচেয়ে বিপদের। খালেদা-তারেককে বিচারের আওতায় আনতে হবেÑ ড. হাছান ॥ আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানকে বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের সংবিধানে প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। সুতরাং তাঁদের এ বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহী, সংবিধান পরিপন্থী ও ষড়যন্ত্রমূলক। এ জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে গ্রেফতার করা প্রয়োজন।' শনিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচার বীর উত্তম খাজা নিজামুদ্দিন মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু একাডেমি আয়োজিত আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, জিয়াউর রহমান মুজিবনগর সরকারের শুধু একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী ছিলেন, তার নথিপত্র আমাদের কাছে আছে। প্রয়োজনে সেটা প্রকাশ করব। জিয়াউর রহমান প্রকৃতপক্ষে স্বেচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে যাননি, বাধ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধে গেছেন। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান আসলে যুদ্ধ করেননি। পাকিস্তানীদের গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিগেডিয়ার বেগ জিয়াউর রহমানকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। সেখানে লেখেন- তোমার কাজে আমরা খুশি। তোমার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চিন্তা করো না। এই চিঠিই প্রমাণ করে জিয়া ছদ্মাবরণে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। এরপর তিনি সম্প্রতি প্রকাশিত সেই চিঠি সাংবাদিকদের দেখান। আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, জিয়াউর রহমান জীবদ্দশায় কখনও নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক কিংবা প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি করেননি। তাহলে এরা এ ধরনের তথ্য কোথায় পেল? যে নেত্রী নিজের জন্মদিন চারবার বদলাতে পারেন, তাঁদের দিয়ে যে কোন মিথ্যাচার করা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে, বিএনপির রাজনীতি মিথ্যাচারের ওপর নির্ভরশীল। সংগঠনের সভাপতি হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রমের সভাপতিত্বে আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ফয়েজ উদ্দিন মিয়া, সাম্যবাদী দলের নেতা হারুন চৌধুরী প্রমুখ। ২৫১ সংস্কৃতি কর্মীর নিন্দা ও প্রতিবাদ ॥ বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের ২৫১ সংস্কৃতি কর্মী শনিবার এক যুক্ত বিবৃতিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের রাষ্ট্রদ্রোহীমূলক বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, সংবিধান লঙ্ঘন ও ইতিহাস বিকৃতির জন্য খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করার দাবি জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, জিয়াউর রহমান প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন পাকিস্তানের চর হিসেবে। তাঁরা প্রশ্ন রেখে বলেন, জিয়াউর রহমান যদি প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক হন তবে একাত্তরের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের সময় জিয়াউর রহমান কোথায় ছিলেন? সেদিন কেন শপথ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক হলে ২৭ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হতো, ২৬ মার্চ নয়। বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতারা হলেন- তারানা হালিম এমপি, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী যাকের, ফেরদৌসী মজুমদার, এটিএম শামসুজ্জামান, পীযুষ বন্দোপাধ্যায়, মোবারক আলী শিকদার, ড. ইনামুল হক, ফাল্গুনী হামিদ, চিত্রনায়ক রাজ্জাক, আলমগীর, মাহমুদ কলি, চিত্র নায়িকা দিতি, নতুন, অরুণা বিশ্বাস, খায়রুল আলম সবুজ, লিয়াকত আলী লাকি, লাকী ইমাম, লুৎফুন্নাহার লতা, কবি রবীন্দ্র গোপ, রোকেয়া প্রাচী, ডা. সামন্ত লাল সেন প্রমুখ। ২০১ জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের নিন্দা ॥ 'আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান' সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও মহানগরের ২০১ জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এক যুক্ত বিবৃতিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে তাঁদের বক্তব্যে প্রত্যাহার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন, সংবিধান স্বীকৃত বিষয় নিয়ে মিথ্যাচারীদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। মিথ্যাচারকারীদের শাস্তির ব্যবস্থা করলে ভবিষ্যতে কেউ আর মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করার সাহস পাবে না। বাংলাদেশ টেলিভিশন শিল্পী সমন্বয় পরিষদ ও বাংলাদেশ আওয়ামী হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য লীগ পৃথক বিবৃতিতে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বক্তব্যেকে সংবিধানবিরোধী আখ্যায়িত করে অবিলম্বে তাঁদের দুজনকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে। নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে আরও বিবৃতি দিয়েছে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোটসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন সংগঠন। প্রকাশ: রবিবার, ৩০ মার্চ ২০১৪, ১৬ চৈত্র ১৪২০
Also read: