সোমবার, ১০ মার্চ ২০১৪, ২৬ ফাল্গুন ১৪২০
সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গীবাদ ও বাংলাদেশ
হারুন হাবীব
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর চার যুগেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। বারংবারের সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভিত এখনো টেকসই অবস্থান লাভ করেনি। আরও দুর্ভাগ্য যে, এ রাষ্ট্রের রক্তার্জিত স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আজো ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। এই ষড়যন্ত্রকারীরা দেশীবিদেশী পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও সকল মৌলিক অর্জনকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
যে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদকে সকল ধর্মবর্ণের মানুষ ১৯৭১ সালে পরাজিত করেছিল, সেই সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ দেশের মাটিতে পুনঃজন্ম পেতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেই সব অশুভ শক্তির ভয়ঙ্কর চেহারা নতুন করে চোখে পড়েছে। তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বাড়িঘরসহ ধর্মীয় উপাসনালয়ে বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে। তাদের বিপন্ন, নিরাপত্তাহীন করেছে। অন্যদিকে আতঙ্কিত করেছে বিবেকবান দেশবাসীকে।
জঙ্গীবাদের হুমকি
বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো জঙ্গীবাদের হুমকির মুখে। এই তত্ত্বধারীরা দ্বিমত প্রকাশের সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির অবস্থানকে সহিংস পন্থায় ধ্বংস করে। তারা মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অস্বীকার করে, নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতাকে নস্যাত করে। অর্থাৎ জঙ্গীবাদ সার্বিকভাবে আদিম, জংলি সমাজের পথে মানুষকে অগ্রসর করে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সার্বিক নিরাপত্তাহীনতার দিকে তাকালে জঙ্গীবাদের ভয়াবহ চেহারা পরিষ্কার হয়।
সম্প্রতি, বিশেষত ২০১৩ সালে, যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রতিহত করার নামে স্বাধীনতা বিরোধী পুনর্গঠিত জঙ্গীরা দেশজুড়ে যে সহিংস তা-ব ও নৈরাজ্য চালিয়েছে, তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না যেÑ এরা দেশীবিদেশী পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেই আঘাত করতে উদ্যত হয়েছে। কাজেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে।
ধর্ম ব্যক্তির, সমাজ বা রাষ্ট্রের নয়। সহিংস পথ বা জঙ্গীবাদ কোন ধর্মেরই পরিপূরক নয়। কিন্তু বাংলাদেশে ধর্ম ও জঙ্গীবাদকে পরিপূরক করা হয়েছে, সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করে পরিকল্পিতভাবে ধর্ম চর্চার আবরণে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানো হয়েছে। এর পেছনে আছে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিতদের প্রতিশোধ স্পৃহা, আছে তাদের সেদিনের রাজনীতিদর্শনকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা দেয়ার স্বপ্ন।
বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ
বাংলাদেশের মাটিতে জঙ্গীবাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৭১ সালে, দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর হাতে। তাদেরই প্রত্যক্ষ মদদে, এ দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো জঙ্গী গোষ্ঠীর ভিত রোপণ করা হয় আলবদর, রাজাকার, আলশামস নামের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে পাকিস্তান বাহিনী পরাজিত এবং আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু তাদের অক্সিলারি বাহিনীগুলো আত্মগোপন করেছিল। পরবর্তী সামরিক ও আধা-সামরিক শাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা নিজেদের বিকশিত করেছে, সংগঠিত করেছে। মোটকথা, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকেই পরাজিতরা বিজয়ীদের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ শুরু করেছে। দুর্ভাগ্য যে, আমরা অনেকেই সেই নতুন যুদ্ধের কৌশল বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি।
বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের সংগঠিত চেহারা ভেসে ওঠে মূলত ১৯৮৫ সালে। ২০০৪-৫ সালে ভয়ঙ্কর আগ্রাসী চেহারা ধারণ করে এসব জঙ্গীরা। এদের সাহায্য-সহযোগিতায় বেশকিছু বিদেশি অর্থাৎ পাকিস্তানী নাগরিকদের দেখা যায়। বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে, ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে বর্তমানে দেশে ৪০টি জঙ্গী গোষ্ঠী কিংবা তারও কিছু বেশির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এরা নানা নামে নানা সময়ে আবির্ভূত হয়।
জঙ্গীবাদ বিশ্বজুড়েই একটি ক্রমবর্ধমান বিপদ। এরপরও নানা কারণে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্যে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ, আমার বিশ্বাস, দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং এর অগ্রযাত্রা ঠেকানো না গেলে তা জাতীয় গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ, তার মৌলিক অর্জন ও জাতির প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
বিশ্বের সকল প্রান্তের ধর্মীয় জঙ্গীরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কবর রচনা করে বোমা ও বন্দুকের জোরে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চায়। এদিক থেকে বাংলাদেশের জঙ্গীবাদীদের আলাদা করা না গেলেও তারা আরও বেশি ঘৃণা ও আতঙ্কের। কারণ এরা একই সঙ্গে জাতীয় স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ এবং একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত পালিত।
জঙ্গীবাদবিরোধী লড়াই
জঙ্গীবাদ ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক সমাজের মৌলিক ভিত্তি নষ্ট করে। সমাজকে কূলশিত করে, বিভাজিত করে, ঘৃণা ছড়ায়, অসহিষ্ণু করে। কাজেই এই অপশক্তির বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই।
তবে, আমার ধারণা, জঙ্গীবাদ বিরোধী লড়াইকে কেবলই পুলিশি তৎপরতা বা নিছক আইনশৃঙ্খলার বিষয় হিসেবে দেখা উচিত হবে না। এ লড়াই হতে হবে বহুমাত্রিক, বহু অঙ্গনে এবং এর ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হতে হবে চিরাচরিত সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রমের সীমানা ছাড়িয়ে।
আমার আরও বিশ্বাস, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিরোধী লড়াই এর সাফল্য নির্ভর করবে কতটা সার্থকভাবে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী মহলের মূল আস্তানা জামাতে ইসলামীর বিরুদ্ধে এ লড়াই চালানো যেতে পারে। কারণ দেশীবিদেশী সংস্থা ও নানান সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে কোন নামেই আবির্ভূত হোক না কেন জঙ্গীবাদীদের সাথে এই দলটির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা আছে।
জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে ব্যর্থতা
উগ্র-সাম্প্রদায়িক শক্তি ও জঙ্গীবাদ পরিপূরক। রাজনীতি থেকে ধর্ম ও ধর্মীয় সন্ত্রাস দূর করা না গেলে জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিতে বাধ্য। বলাই বাহুল্য, এদের উত্থান প্রতিরোধে বাংলাদেশের অতীত রাষ্ট্রশক্তিগুলোর বড় ব্যর্থতা আছে।
১৯৭৫-এর রক্তাক্ত পালাবদলের পর দুর্ভাগ্যজনক রাজনৈতিক পরিবেশে বেশকিছু বড় দলের রাজনীতির জন্যে জঙ্গীবাদ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মুখে যাই বলা হোক না কেন, উদার গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধপন্থী প্রগতিশীল সমাজ ও সাংস্কৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে আঘাত হানতে তারা জঙ্গীদের ব্যবহার করছে। এর দৃষ্টান্ত অনেক। বাংলাদেশের সামরিক ও আধা-সামরিক রাষ্ট্রশক্তিগুলো যেমন জঙ্গীবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, একইভাবে বেশকিছু বড় রাজনৈতিক দল জঙ্গীবাদকে লালন করেছে, কেউ আবার আপোস করেছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির আবরণে এই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জঙ্গী পৃষ্ঠপোষকতা দূর করা না গেলে সঙ্কটের মাত্রা ক্রমান্বয়েই বাড়বে।
ব্যর্থতা আরও আছে। জঙ্গীবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে হত্যা-নির্যাতন-হামলার নিরন্তর ঘটনার পরও তাদের উত্থানের উদ্দেশ্য, তাদের মতবাদের অসারতা, মানবতা ও প্রগতি বিরোধী, এমন কি তাদের ধর্মবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে যথাযথ প্রচারণার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপেক্ষিত রয়েছে। এই উগ্র তত্ত্বধারীরা মূলত গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় মূলত দুটি কারণে। এক. তারা ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় লেবাসের আবরণে একচেটিয়া প্রচারের মাধ্যমে গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ জনগোষ্ঠীকে প্রলুব্ধ করে। দুই. তারা গরিব জনগোষ্ঠীকে বৈষয়িক বা আর্থিক সুবিধে সরবরাহ করে ধর্মীয় শিক্ষার নামে জঙ্গীবাদের ঝা-া হাতে তুলে নিতে বাধ্য করে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এদের এই কৌশলের বিরুদ্ধে কার্যকর পাল্টা প্রচারণার বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। জঙ্গীবাদীরা গ্রাম-গঞ্জের মানুষের কাছে প্রায় একচেটিয়াভাবে ইসলাম রক্ষা বা ধর্মরক্ষার সেøাগান তোলে, যেখানে তাদের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
বাংলার মাটি, আলো, বাতাসে জঙ্গীবাদ ক্ষতিকর বিজাতীয় আগাছা বা বিষবৃক্ষ। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে পরমত সহনশীলতার যে সংস্কৃতি তারই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই আগাছা বা বিষবৃক্ষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। সে কারণে জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জাতির দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন। এ লড়াই কোন বিশেষ দলের বা মতের নয়, এ লাড়াই 'হাফ হার্টেট' নয়; একে হতে হবে 'ডিসাইসিভ', অর্থাৎ চূড়ান্ত লড়াই।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতি
লক্ষ্য করা গেছে যে, জঙ্গীবাদবিরোধী ঘোষিত নীতি-অবস্থানের পরও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী দল-গোষ্ঠী সম্পর্কে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র দ্বৈতনীতি অবলম্বন করে চলেছে। তারা কখনও উগ্রবাদীদের 'মডারেট ইসলাম' বলছে, কখনো আবার তাদের সাথে সখ্যতা স্থাপন করে রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার নীতি অবলম্বন করছে। ওয়াশিংটনের এই দ্বিমুখী নীতি কেবলই দুর্ভাগ্যজনক নয়Ñ জঙ্গীবাদবিরোধী লড়াই এর বড় অন্তরায়। এই নীতির পরিবর্তন জরুরী।
উল্লেখ করা যেতে পারে, যুদ্ধাপরাধের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং জীবন্ত ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দন্ডপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন শীর্ষ জামাতি নেতাদের পক্ষে মার্কিনী সাফাই সে দেশটির জঙ্গীবিরোধী অবস্থানকে প্রবলভাবে প্রশ্নবিধ্য করেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদবিরোধী লড়াই এর সাফল্যের সাথে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জঙ্গিবাদ বিরোধী লড়াই এর সাফল্য নির্ভর করছে।
'গ্লোবাল নেট-ওয়ার্ক'
জঙ্গিদের 'গ্লোবাল নেটওয়ার্ক' আছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্য বা এশিয়া নয়, ইউরোপ-আমেরিকার মাটিতে তাদের ঘাঁটি শক্ত। বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশগুলিতে ইতোমধ্যেই সে 'নেট-ওয়ার্ক' জায়গা করে নিয়েছে। বলা যায়, তুরস্ক থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে এই জঙ্গিরা হুমকির মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশে তাদের বিচরণ কম না হলেও একমাত্র বাংলাদেশই এই অপশক্তির অগ্রযাত্রা কমবেশি রুখতে পেরেছে। এর প্রধান কারণ, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার দৃঢ় ভিত্তি। আমার বিশ্বাস, যে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়, সে বাঙালি জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এ অবশ্যই সফল হবে। প্রয়োজন শুধু উপযুক্ত নীতি নির্ধারণ এবং এ লড়াই এর সাথে গণমানুষের সম্পৃক্ততা।
কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ বিরোধী লড়াই এ জিততে হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে, কেবল ইতিহাসের প্রয়োজনে নয়, সময়ের প্রয়োজনেও চর্চা করতে হবে। এ লড়াইকে একটি সামাজিক ও সংস্কৃতিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতানায় পরিপূর্ণ ভাবে ফিরিয়ে নিতে হবে।
আগে উল্লেখ করেছি, জঙ্গীবাদের 'গ্লোবাল নেটওয়ার্ক' আছে। এ নেটওয়ার্ক বেশ শক্ত এবং বিস্তৃত। কাজেই একে বিচ্ছিন্নভাবে দমন করা সম্ভব নয়। সে কারণে জঙ্গীবাদ দমনে 'আঞ্চলিক ও গ্লোবাল টাস্কফোর্স' গঠন করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। লক্ষ্য করার বিষয় যে, জঙ্গীবাদ প্রচারে মাঠ পর্যায়ে যারা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়Ñ তারা অশিক্ষা ও কুশিক্ষায় আক্রান্ত। সত্যিকারের ধর্মীয় শিক্ষা জঙ্গীবাদের বিস্তার বাধাগ্রস্ত করে। কাজেই মসজিদের ইমাম, সমাজপতি ও ইসলামী চিন্তাশীলদের কাজে লাগাতের হবে। এ অভিযোগ অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বহুলাংশেই বৃহত্তর সমাজ ও আধুনিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাদের অনেকেই বাধ্য হয়ে জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কাজেই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে হবেÑ যাতে এসব শিক্ষার্থীরা বৃহত্তর আধুনিক জীবনের সন্ধান পায়। তবে শুধু মাদ্রাসাতেই নয়, ইংরেজি মাধ্যমের উচ্চবিত্ত শিশুদেরও একটি অংশ পরিবার ও সমাজে বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়, যে কারণে তারা কেউ কেউ উগ্রতত্ত্বে দীক্ষিত হয়। এ ব্যাপারে নীতি নির্ধারকদের অবশ্যই ভাবতে হবে।
মুখ্যত সমাজের দরিদ্র অংশই জঙ্গীবাদের শিকার। কাজেই যেসব এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান জনহিতকর কাজের আড়ালে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেÑ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী পদক্ষেপ নিতে হবে।
গণতন্ত্রের মূল শত্রু জঙ্গীবাদ। কাজেই গণতন্ত্রকে দলীয় স্বার্থে নয় আদর্শিক স্বার্থে চর্চা করতে হবে। কোন ধর্মই জঙ্গীবাদকে সমর্থন করে না। ধর্মচর্চা ব্যক্তির অধিকার। কিন্তু এই অধিকারের নামে জঙ্গীতত্ত্ব ছড়িয়ে যারা রাজনীতি করতে চায়, তাদের দমন করার অধিকার গণতান্ত্রিক মানুষের থাকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধী জামায়াতে ইসলামী দলটি বিগত চার যুগ ধরে জঙ্গীবাদের মূল পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কাজেই এ দলটিকে নিষিদ্ধ করা সময়ের দাবি। পাশাপাশি জঙ্গীবাদের পুঁজি, তার সরবরাহ চ্যানেল, প্রচার ও অর্থ উৎস বন্ধ করার বিষয়টি যতো দ্রুত সম্পন্ন হবেÑ তত দ্রুত বাংলাদেশে জঙ্গীবাধবিরোধী লড়াই সফল হবে বলে আমার বিশ্বাস।
বি.দ্র: লেখাটি ৯ মার্চ ২০১৪ তারিখে অনুষ্ঠিত 'সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদবিরোধী জাতীয় সম্মেলন'Ñএ মূল প্রবন্ধ হিসেবে উপস্থাপিত।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক এবং সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরামের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব
যে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদকে সকল ধর্মবর্ণের মানুষ ১৯৭১ সালে পরাজিত করেছিল, সেই সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ দেশের মাটিতে পুনঃজন্ম পেতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেই সব অশুভ শক্তির ভয়ঙ্কর চেহারা নতুন করে চোখে পড়েছে। তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বাড়িঘরসহ ধর্মীয় উপাসনালয়ে বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে। তাদের বিপন্ন, নিরাপত্তাহীন করেছে। অন্যদিকে আতঙ্কিত করেছে বিবেকবান দেশবাসীকে।
জঙ্গীবাদের হুমকি
বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো জঙ্গীবাদের হুমকির মুখে। এই তত্ত্বধারীরা দ্বিমত প্রকাশের সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির অবস্থানকে সহিংস পন্থায় ধ্বংস করে। তারা মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অস্বীকার করে, নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতাকে নস্যাত করে। অর্থাৎ জঙ্গীবাদ সার্বিকভাবে আদিম, জংলি সমাজের পথে মানুষকে অগ্রসর করে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সার্বিক নিরাপত্তাহীনতার দিকে তাকালে জঙ্গীবাদের ভয়াবহ চেহারা পরিষ্কার হয়।
সম্প্রতি, বিশেষত ২০১৩ সালে, যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রতিহত করার নামে স্বাধীনতা বিরোধী পুনর্গঠিত জঙ্গীরা দেশজুড়ে যে সহিংস তা-ব ও নৈরাজ্য চালিয়েছে, তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না যেÑ এরা দেশীবিদেশী পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেই আঘাত করতে উদ্যত হয়েছে। কাজেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার সময় এসেছে।
ধর্ম ব্যক্তির, সমাজ বা রাষ্ট্রের নয়। সহিংস পথ বা জঙ্গীবাদ কোন ধর্মেরই পরিপূরক নয়। কিন্তু বাংলাদেশে ধর্ম ও জঙ্গীবাদকে পরিপূরক করা হয়েছে, সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করে পরিকল্পিতভাবে ধর্ম চর্চার আবরণে জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানো হয়েছে। এর পেছনে আছে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিতদের প্রতিশোধ স্পৃহা, আছে তাদের সেদিনের রাজনীতিদর্শনকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা দেয়ার স্বপ্ন।
বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ
বাংলাদেশের মাটিতে জঙ্গীবাদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৭১ সালে, দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর হাতে। তাদেরই প্রত্যক্ষ মদদে, এ দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো জঙ্গী গোষ্ঠীর ভিত রোপণ করা হয় আলবদর, রাজাকার, আলশামস নামের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে পাকিস্তান বাহিনী পরাজিত এবং আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু তাদের অক্সিলারি বাহিনীগুলো আত্মগোপন করেছিল। পরবর্তী সামরিক ও আধা-সামরিক শাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা নিজেদের বিকশিত করেছে, সংগঠিত করেছে। মোটকথা, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকেই পরাজিতরা বিজয়ীদের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ শুরু করেছে। দুর্ভাগ্য যে, আমরা অনেকেই সেই নতুন যুদ্ধের কৌশল বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি।
বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের সংগঠিত চেহারা ভেসে ওঠে মূলত ১৯৮৫ সালে। ২০০৪-৫ সালে ভয়ঙ্কর আগ্রাসী চেহারা ধারণ করে এসব জঙ্গীরা। এদের সাহায্য-সহযোগিতায় বেশকিছু বিদেশি অর্থাৎ পাকিস্তানী নাগরিকদের দেখা যায়। বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে, ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে বর্তমানে দেশে ৪০টি জঙ্গী গোষ্ঠী কিংবা তারও কিছু বেশির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এরা নানা নামে নানা সময়ে আবির্ভূত হয়।
জঙ্গীবাদ বিশ্বজুড়েই একটি ক্রমবর্ধমান বিপদ। এরপরও নানা কারণে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্যে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ, আমার বিশ্বাস, দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং এর অগ্রযাত্রা ঠেকানো না গেলে তা জাতীয় গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ, তার মৌলিক অর্জন ও জাতির প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
বিশ্বের সকল প্রান্তের ধর্মীয় জঙ্গীরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কবর রচনা করে বোমা ও বন্দুকের জোরে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চায়। এদিক থেকে বাংলাদেশের জঙ্গীবাদীদের আলাদা করা না গেলেও তারা আরও বেশি ঘৃণা ও আতঙ্কের। কারণ এরা একই সঙ্গে জাতীয় স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ এবং একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত পালিত।
জঙ্গীবাদবিরোধী লড়াই
জঙ্গীবাদ ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক সমাজের মৌলিক ভিত্তি নষ্ট করে। সমাজকে কূলশিত করে, বিভাজিত করে, ঘৃণা ছড়ায়, অসহিষ্ণু করে। কাজেই এই অপশক্তির বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই।
তবে, আমার ধারণা, জঙ্গীবাদ বিরোধী লড়াইকে কেবলই পুলিশি তৎপরতা বা নিছক আইনশৃঙ্খলার বিষয় হিসেবে দেখা উচিত হবে না। এ লড়াই হতে হবে বহুমাত্রিক, বহু অঙ্গনে এবং এর ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হতে হবে চিরাচরিত সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রমের সীমানা ছাড়িয়ে।
আমার আরও বিশ্বাস, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিরোধী লড়াই এর সাফল্য নির্ভর করবে কতটা সার্থকভাবে দেশের স্বাধীনতাবিরোধী মহলের মূল আস্তানা জামাতে ইসলামীর বিরুদ্ধে এ লড়াই চালানো যেতে পারে। কারণ দেশীবিদেশী সংস্থা ও নানান সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে কোন নামেই আবির্ভূত হোক না কেন জঙ্গীবাদীদের সাথে এই দলটির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা আছে।
জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে ব্যর্থতা
উগ্র-সাম্প্রদায়িক শক্তি ও জঙ্গীবাদ পরিপূরক। রাজনীতি থেকে ধর্ম ও ধর্মীয় সন্ত্রাস দূর করা না গেলে জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিতে বাধ্য। বলাই বাহুল্য, এদের উত্থান প্রতিরোধে বাংলাদেশের অতীত রাষ্ট্রশক্তিগুলোর বড় ব্যর্থতা আছে।
১৯৭৫-এর রক্তাক্ত পালাবদলের পর দুর্ভাগ্যজনক রাজনৈতিক পরিবেশে বেশকিছু বড় দলের রাজনীতির জন্যে জঙ্গীবাদ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মুখে যাই বলা হোক না কেন, উদার গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধপন্থী প্রগতিশীল সমাজ ও সাংস্কৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে আঘাত হানতে তারা জঙ্গীদের ব্যবহার করছে। এর দৃষ্টান্ত অনেক। বাংলাদেশের সামরিক ও আধা-সামরিক রাষ্ট্রশক্তিগুলো যেমন জঙ্গীবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, একইভাবে বেশকিছু বড় রাজনৈতিক দল জঙ্গীবাদকে লালন করেছে, কেউ আবার আপোস করেছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির আবরণে এই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ জঙ্গী পৃষ্ঠপোষকতা দূর করা না গেলে সঙ্কটের মাত্রা ক্রমান্বয়েই বাড়বে।
ব্যর্থতা আরও আছে। জঙ্গীবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে হত্যা-নির্যাতন-হামলার নিরন্তর ঘটনার পরও তাদের উত্থানের উদ্দেশ্য, তাদের মতবাদের অসারতা, মানবতা ও প্রগতি বিরোধী, এমন কি তাদের ধর্মবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে যথাযথ প্রচারণার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপেক্ষিত রয়েছে। এই উগ্র তত্ত্বধারীরা মূলত গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় মূলত দুটি কারণে। এক. তারা ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় লেবাসের আবরণে একচেটিয়া প্রচারের মাধ্যমে গ্রাম-গঞ্জের সাধারণ জনগোষ্ঠীকে প্রলুব্ধ করে। দুই. তারা গরিব জনগোষ্ঠীকে বৈষয়িক বা আর্থিক সুবিধে সরবরাহ করে ধর্মীয় শিক্ষার নামে জঙ্গীবাদের ঝা-া হাতে তুলে নিতে বাধ্য করে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এদের এই কৌশলের বিরুদ্ধে কার্যকর পাল্টা প্রচারণার বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে। জঙ্গীবাদীরা গ্রাম-গঞ্জের মানুষের কাছে প্রায় একচেটিয়াভাবে ইসলাম রক্ষা বা ধর্মরক্ষার সেøাগান তোলে, যেখানে তাদের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
বাংলার মাটি, আলো, বাতাসে জঙ্গীবাদ ক্ষতিকর বিজাতীয় আগাছা বা বিষবৃক্ষ। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে পরমত সহনশীলতার যে সংস্কৃতি তারই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই আগাছা বা বিষবৃক্ষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। সে কারণে জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জাতির দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন। এ লড়াই কোন বিশেষ দলের বা মতের নয়, এ লাড়াই 'হাফ হার্টেট' নয়; একে হতে হবে 'ডিসাইসিভ', অর্থাৎ চূড়ান্ত লড়াই।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতি
লক্ষ্য করা গেছে যে, জঙ্গীবাদবিরোধী ঘোষিত নীতি-অবস্থানের পরও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী দল-গোষ্ঠী সম্পর্কে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র দ্বৈতনীতি অবলম্বন করে চলেছে। তারা কখনও উগ্রবাদীদের 'মডারেট ইসলাম' বলছে, কখনো আবার তাদের সাথে সখ্যতা স্থাপন করে রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার নীতি অবলম্বন করছে। ওয়াশিংটনের এই দ্বিমুখী নীতি কেবলই দুর্ভাগ্যজনক নয়Ñ জঙ্গীবাদবিরোধী লড়াই এর বড় অন্তরায়। এই নীতির পরিবর্তন জরুরী।
উল্লেখ করা যেতে পারে, যুদ্ধাপরাধের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং জীবন্ত ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দন্ডপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন শীর্ষ জামাতি নেতাদের পক্ষে মার্কিনী সাফাই সে দেশটির জঙ্গীবিরোধী অবস্থানকে প্রবলভাবে প্রশ্নবিধ্য করেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদবিরোধী লড়াই এর সাফল্যের সাথে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জঙ্গিবাদ বিরোধী লড়াই এর সাফল্য নির্ভর করছে।
'গ্লোবাল নেট-ওয়ার্ক'
জঙ্গিদের 'গ্লোবাল নেটওয়ার্ক' আছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্য বা এশিয়া নয়, ইউরোপ-আমেরিকার মাটিতে তাদের ঘাঁটি শক্ত। বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশগুলিতে ইতোমধ্যেই সে 'নেট-ওয়ার্ক' জায়গা করে নিয়েছে। বলা যায়, তুরস্ক থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে এই জঙ্গিরা হুমকির মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশে তাদের বিচরণ কম না হলেও একমাত্র বাংলাদেশই এই অপশক্তির অগ্রযাত্রা কমবেশি রুখতে পেরেছে। এর প্রধান কারণ, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার দৃঢ় ভিত্তি। আমার বিশ্বাস, যে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়, সে বাঙালি জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এ অবশ্যই সফল হবে। প্রয়োজন শুধু উপযুক্ত নীতি নির্ধারণ এবং এ লড়াই এর সাথে গণমানুষের সম্পৃক্ততা।
কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ
সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ বিরোধী লড়াই এ জিততে হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে, কেবল ইতিহাসের প্রয়োজনে নয়, সময়ের প্রয়োজনেও চর্চা করতে হবে। এ লড়াইকে একটি সামাজিক ও সংস্কৃতিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানকে মুক্তিযুদ্ধের চেতানায় পরিপূর্ণ ভাবে ফিরিয়ে নিতে হবে।
আগে উল্লেখ করেছি, জঙ্গীবাদের 'গ্লোবাল নেটওয়ার্ক' আছে। এ নেটওয়ার্ক বেশ শক্ত এবং বিস্তৃত। কাজেই একে বিচ্ছিন্নভাবে দমন করা সম্ভব নয়। সে কারণে জঙ্গীবাদ দমনে 'আঞ্চলিক ও গ্লোবাল টাস্কফোর্স' গঠন করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। লক্ষ্য করার বিষয় যে, জঙ্গীবাদ প্রচারে মাঠ পর্যায়ে যারা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়Ñ তারা অশিক্ষা ও কুশিক্ষায় আক্রান্ত। সত্যিকারের ধর্মীয় শিক্ষা জঙ্গীবাদের বিস্তার বাধাগ্রস্ত করে। কাজেই মসজিদের ইমাম, সমাজপতি ও ইসলামী চিন্তাশীলদের কাজে লাগাতের হবে। এ অভিযোগ অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বহুলাংশেই বৃহত্তর সমাজ ও আধুনিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাদের অনেকেই বাধ্য হয়ে জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কাজেই মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে হবেÑ যাতে এসব শিক্ষার্থীরা বৃহত্তর আধুনিক জীবনের সন্ধান পায়। তবে শুধু মাদ্রাসাতেই নয়, ইংরেজি মাধ্যমের উচ্চবিত্ত শিশুদেরও একটি অংশ পরিবার ও সমাজে বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়, যে কারণে তারা কেউ কেউ উগ্রতত্ত্বে দীক্ষিত হয়। এ ব্যাপারে নীতি নির্ধারকদের অবশ্যই ভাবতে হবে।
মুখ্যত সমাজের দরিদ্র অংশই জঙ্গীবাদের শিকার। কাজেই যেসব এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান জনহিতকর কাজের আড়ালে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেÑ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী পদক্ষেপ নিতে হবে।
গণতন্ত্রের মূল শত্রু জঙ্গীবাদ। কাজেই গণতন্ত্রকে দলীয় স্বার্থে নয় আদর্শিক স্বার্থে চর্চা করতে হবে। কোন ধর্মই জঙ্গীবাদকে সমর্থন করে না। ধর্মচর্চা ব্যক্তির অধিকার। কিন্তু এই অধিকারের নামে জঙ্গীতত্ত্ব ছড়িয়ে যারা রাজনীতি করতে চায়, তাদের দমন করার অধিকার গণতান্ত্রিক মানুষের থাকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধী জামায়াতে ইসলামী দলটি বিগত চার যুগ ধরে জঙ্গীবাদের মূল পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কাজেই এ দলটিকে নিষিদ্ধ করা সময়ের দাবি। পাশাপাশি জঙ্গীবাদের পুঁজি, তার সরবরাহ চ্যানেল, প্রচার ও অর্থ উৎস বন্ধ করার বিষয়টি যতো দ্রুত সম্পন্ন হবেÑ তত দ্রুত বাংলাদেশে জঙ্গীবাধবিরোধী লড়াই সফল হবে বলে আমার বিশ্বাস।
বি.দ্র: লেখাটি ৯ মার্চ ২০১৪ তারিখে অনুষ্ঠিত 'সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদবিরোধী জাতীয় সম্মেলন'Ñএ মূল প্রবন্ধ হিসেবে উপস্থাপিত।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক এবং সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরামের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব
প্রকাশ :সোমবার, ১০ মার্চ ২০১৪, ২৬ ফাল্গুন ১৪২০
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ
০৬ ই মার্চ, ২০০৯ রাত ৮:৪০ |
মনে রাখবা, ''রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ''।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম''।জয় বাংলা।
শুক্রবার, ৭ মার্চ ২০১৪, ২৩ ফাল্গুন ১৪২০
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ॥ নতুন দেশের অভ্যুদয়বার্তা
মোঃ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ : শুক্রবার, ৭ মার্চ ২০১৪, ২৩ ফাল্গুন ১৪২০
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ
SHONO EKTI MUJIBORER THEKE.....SONG. :
শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি
প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি-বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।
প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি-বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।
সেই সবুজের বুক চেরা মেঠো পথে,
আবার এসে ফিরে যাবো আমার
হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাবো।
শিল্পে কাব্যে কোথায় আছে হায় রে
এমন সোনার দেশ।
বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ,
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা
রূপের যে তার নেইকো শেষ, বাংলাদেশ।
'জয় বাংলা' বলতে মনরে আমার এখন কেন ভাবো,
আমার হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাবো,
অন্ধকারে পুবাকাশে উঠবে আবার দিনমণি।।
7th March, 1971 Speech of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman:
__._,_.___