অঅ-অ+ |
গত শনিবার কে যেন একজন টেলিফোনে জানাল, বিএনপির কিশোরগঞ্জের জেলা কমিটিসহ সব থানা ও পৌর কমিটি কেন্দ্র থেকে ভেঙে দিয়েছে বা দু-একদিনের মধ্যে ভেঙে দেবে। সংবাদটিকে প্রথমে তেমন গুরুত্ব দেইনি। কারণ পুলিশ যেমন তাদের বাড়তি আয় বাড়ানোর জন্য রোজা বা ঈদের আগে পুলিশি তৎপরতা বৃদ্ধির আগাম ঘোষণা দেয়, তেমনি বিএনপির কমিটি ভাঙাগড়ার ব্যাপারেও গদিনসিন কিছু মুখচেনা নেতা ও তাদের পাণ্ডারা আগাম খবর ছেড়ে বাজার চাঙ্গা করে- যাতে গ্রাম, থানা ও জেলা থেকে নেতা খরিদদার নগদ টাকায় নেতৃত্ব কেনার জন্য ঢাকায় ছুটে আসেন। আর এখন তো মধু মাস। সারা দেশেই আম, কাঁঠাল, লিচুতে মও মও। তার ওপর ইলিশের মৌসুমও শুরু হয়ে গেছে। বিএনপির কমিটি ভাঙাগড়ার এখনই তো মোক্ষম সময়!
সেই কবে ঢাকা মহানগর কমিটি ভাঙাগড়া হবে বলে গায়েবি এলান হয়েছিল কিন্তু বাজার এখনো চাঙ্গা বলে ভাঙাগড়ার গায়েবি সিদ্ধান্ত এখনো নাজিল হয়নি। যদি ঢাকা থেকে পাওয়া গায়েবি সিদ্ধান্ত আড়তদার নেতা গংদের মনমতো না হয়, তা হলে লন্ডনি গায়েবি সিদ্ধান্তের জন্য টালবাহানা শুরু করে। লন্ডনি আওয়াজ তাদের মনমতো না হলে সেই আওয়াজ রাতের অন্ধকারের তথাকথিত সম্মিলিত সিদ্ধান্তের সরব আওয়াজে হারিয়ে যায়। কি সুন্দর খেলা! না বোঝেন ম্যাডাম, না বোঝেন বাবাজি! নিজের সিদ্ধান্তের বাইরে চাটুকারদের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিলে বা চাটুকারদের দ্বারা পরিচালিত হলে কি পরিণতি হয় তার ঐতিহাসিক উদাহরণ হয়ে থাকবে ম্যাডাম খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের রাজনৈতিক ইতিহাস।
যাই হোক, বিএনপির কিশোরগঞ্জ কমিটি ভাঙাগড়ার ব্যাপারে প্রথমে তেমন গুরুত্ব না দিলেও গত দুই দিনে কিশোরগঞ্জ জেলা শহর ও বিভিন্ন উপজেলা থেকে বিএনপির পুরনো অনেকের ফোন বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে বাধ্য করেছে। প্রায় সবাই আমাকে দোষারোপ করে এখন এ মুহূর্তে চুপ না থেকে কিছু করার জন্য তাগাদা দিলেন। তাদের কথায়, বাধ্য হয়ে ১২টি উপজেলা ও জেলা শহরের প্রায় ২০০ নেতা-কর্মীর সঙ্গে ফোনে কথা বলে প্রায় একই রকম অনুভূতি পেলাম। তবে আমার ব্যাপারে নেত্রীর মতামত নিয়ে তাদের সবারই ভয় এবং এ ব্যাপারে আমিও তাদের সঙ্গে একমত। তাই আমাকে সাবধানে এগুনো উচিত হবে বলে মনে হলো। এরকম যখন আমার মনের অবস্থা তখন হাইকোর্টে আমার একটি মামলার তদবির করতে গিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে বিএনপির এক সিনিয়র নেতার সঙ্গে দেখা হলো এবং কাকতালীয়ভাবে তিনিও আমাকে কিশোরগঞ্জ বিএনপির ব্যাপারে আগ্রহান্বিত হতে পরামর্শ দিলেন। দলের দুর্দিনে অভিমান করে সরে না থেকে ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করে দলের কাজ করতেও পরামর্শ দিলেন। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই তিনি একটি টেলিফোন করে আমাকে বললেন, 'মহাসচিবকে বলে দিচ্ছি, তুমি কালই মহাসচিবের সঙ্গে দেখা কর।' আমার সামনেই তিনি মহাসচিবের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন এবং কথা শেষ করে অত্যন্ত হতাশ সুরে বললেন, 'না এই দল দিয়ে কিচ্ছু হবে না, এদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ আছে, এরা মোনাফেক।' তিনি আমাকে জানালেন, আমার সঙ্গে দেখা করার কথা শুনে মহাসচিব নাকি ভয়ে অাঁতকে উঠলেন এবং বললেন আমার সঙ্গে দেখা করলে এতদিন তিনি যে ভারপ্রাপ্তটুকু ধরে রেখেছেন সেটুকুও চলে যাবে। ম্যাডাম তোষামোদি ছাড়া কিছুই পছন্দ করেন না। তা ছাড়া ম্যাডাম অপ্রিয় সত্য একদমই পছন্দ করেন না। কাজেই তার পক্ষে ম্যাডামের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ করা সম্ভব নয়। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নেতাকে চুটকি করে বললেন, সাহস থাকলে তিনি যেন আমাকে ম্যাডামের কাছে নিয়ে যান।
আসলেই বিএনপি এখন একটি অভিশপ্ত দল। এখানে অনেক মোনাফেক। এই মোনাফেকরাই দলকে, দলের নেতৃত্বকে ডুবাচ্ছে। সেদিন দলের নেত্রী ভারত সরকারের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দিলি্ল সফর করে এসে বাংলাদেশের মাটিতে মোনাফেকদের বুদ্ধি-পরামর্শে সোয়াশ কোটি ভারতীয় জনগণের রাষ্ট্রপতিকে অসম্মান করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। যে কংগ্রেস সরকার সৌজন্যতা দেখিয়ে বিরোধী দল বিজেপির নেত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিল, আজ কি নির্লজ্জভাবে কংগ্রেসের দুর্দিনে সেই সুষমা স্বরাজকে ধরে ওই মোনাফেকদের শলাপরামর্শে ও মোনাফেকদের নিয়ে মোদি বাহাদুরের কৃপা ম্যাডাম প্রার্থনা করলেন। ভারত-বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর কাছে বিএনপিকে কীভাবে খাটো করা হলো, তা বোঝার ক্ষমতাই তো ওই মোনাফেকদের নেই।
ভারতে নতুন সরকার এসেছে। কিন্তু এতে বিএনপি আনন্দিত এবং আগ্রহান্বিত হওয়ায় বেশ কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যেমন :
(ক) ভারতের নতুন সরকার কি বিভিন্ন দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের বৈদেশিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে? (খ) বিজেপি কি বিএনপির পুরনো বন্ধু? (গ) বিজেপি সরকারের সঙ্গে কি আওয়ামী লীগ সরকারের পূর্ব শত্রুতা বা বৈরিতা আছে? (ঘ) আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি কি বিজেপি সরকারের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক?
(ঙ) ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিএনপির অসৌজন্যমূলক আচরণে কি বিজেপি বা মোদি খুশি হয়েছিলেন?
(চ) বিএনপির রাজনৈতিক আন্দোলনে মোদির সহযোগিতা করার কোনো পূর্বাভাস কি কখনো দিয়েছিল?
(ছ) বিএনপি কার মাধ্যমে বিদেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করল এবং এই যোগাযোগের সঙ্গে সরকারের কোনো গোপন হাত আছে কিনা?
(জ) বিজেপি সরকার যদি আওয়ামী সরকারের সঙ্গে গোলমাল পাকিয়ে বা আপসে বা বিজেপির মুসলমান বা বাঙালি খেদাও নীতিতে বাংলাদেশ আক্রমণ করে বা ভারতীয় মুসলমান ও বাঙালিদের ভারত ত্যাগে বাধ্য করে তখন বিএনপির অবস্থান কী হবে?
(ঞ) বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল কেন ভারত সরকারকে অভিনন্দন জানাবে? সরকারি অভিনন্দন কি যথেষ্ট নয়? এ ধরনের অভিনন্দনে কি দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্য রাষ্ট্রের নাক গলানোর সুযোগ করে দেবে না?
এমন অজস্র প্রশ্নের জবাব জানা না থাকলেও যে কোনো সচেতন মানুষ স্বীকার করবেন, মোদির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে বিএনপি তার ভাবমূর্তি সন্দেহাতীতভাবে নষ্ট করেছে। মোদির কাছে বিএনপি অবিশ্বাসযোগ্য, নীতি, ন্যায় ও দেশপ্রেমবর্জিত একটি সুবিধাবাদী ও স্বার্থপর স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন আঞ্চলিক ক্ষুদ্র দল হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মোদি তার আগামী ভারত শাসনে বিএনপিকে ব্যবহার করার যথেষ্ট সুযোগ অযাচিতভাবেই পেয়ে গেল।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বহুদিন যথার্থই বলেছেন, ম্যাডাম সত্য পছন্দ করেন না এবং তার সঙ্গে আমার দেখা হলে এত দিন ধরে নিলর্জ্জের মতো অাঁকড়ে থাকা ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব পদটিও চলে যেতে পারে! অথচ তার সঙ্গে বা ম্যাডামের সঙ্গে দেখা বা কথা বলতে পারলে আমি এ মুহূর্তে নিদেনপক্ষে কিশোরগঞ্জ জেলার সভাপতি হওয়ার দুর্লভ সৌভাগ্য অর্জন করতে পারতাম। ম্যাডাম যেমন ভারতের হবু প্রধানমন্ত্রীকে দুর্লভ অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশের আগামীদিনের রাজনীতিতে যে বিপুল সম্ভাবনার(!) দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছেন, সে জন্য আমি যদি ম্যাডামকে এ মুহূর্তে অভিনন্দন জানাতে পারতাম তাহলে আমার জন্যও বিএনপির রাজনীতির অসীম সম্ভাবনার দ্বার খুলে যেত। আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশের নির্যাতন ভোগ করে এবং জেল-জুলুম খেটে একজন আদর্শবান ত্যাগী রাজনীতিবিদ(!) হওয়ার সুযোগ পেতাম। কিন্তু এ মহাসুযোগটি নষ্ট করে দিল ভারপ্রাপ্ত ভীতু মহাসচিব মহোদয়।
মানুষ জাগছে। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। প্রশাসনযন্ত্রে ঘুণ ধরেছে। সরকার এককেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সরকারি দলের লোকেরা স্ব স্ব স্বার্থ নিয়ে নিজেরা কামড়া-কামড়ি করছে। শাসন ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ছে। রাজনৈতিক আচার-আচরণ ও প্রথাগত নিয়মনীতি ভেঙে যাচ্ছে। আদর্শহীন ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি প্রাধান্য পাচ্ছে। সব কিছু দ্রুত বদলে যাচ্ছে। গণমানুষের মনের পালে পরিবর্তনের পাগলা হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। বর্তমান অবস্থা থেকে গণমানুষ উন্নতি চায়। চায় শান্তি ও সমৃদ্ধি। মানুষ নৈরাজ্য, অশান্তি, সন্ত্রাস চায় না। গণমানুষ নতুন নেতৃত্ব খুঁজছে। সবার চোখে-মুখে-অন্তরে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিতে একজন দেশীয় মোদি খুঁজছে। গণমানুষ সম্পূর্ণ প্রস্তুত। অপেক্ষা শুধু একজন মোদির আর একটি নির্বাচনের।
ম্যাডামের বুঝতে হবে আন্দোলন করে কিছু হবে না। তাতে কর্মীদের ভোগান্তি বাড়বে, তারা জেল, জুলুম, নির্যাতনের শিকার হবে, ম্যাডামের চারপাশের নেতাদের চিকনাই বাড়বে। যদি রাজনীতিতে টিকে থাকতে হয়, তাহলে ম্যাডামকে শুধু দলের চেয়ারপারসন হয়ে প্রধানমন্ত্রীর জন্য একজন মোদি খুঁজতে হবে। আর যদি ম্যাডাম নিজে প্রধানমন্ত্রী হতে চান তাহলে তো তিনি মোদি হতে পারবেন না, তারপরও প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলে অবশ্যই দলের চেয়ারপারসনের পদটা ম্যাডামকে ছাড়তেই হবে, না হলে আম-ছালা দুটোই যাবে। এ মুহূর্তে চরম সত্য ও বাস্তবতা হলো দলের চেয়ারপারসন হওয়ার শারীরিক যোগ্যতা ও ক্ষমতা কোনোটাই ম্যাডামের নেই। তিনি এখন গৃহে বন্দী। সারা দেশের অগণিত নেতাকর্মীদের সঙ্গে ম্যাডামের সাক্ষাতের কোনো সুযোগ নেই। যাদের সঙ্গে প্রতি রাতে ম্যাডামের টেলিফোনে কথা হয় তাদের দলের নেতা-কর্মীরা চেনে না। ম্যাডামের ও দলের অফিসে যেসব নেতাকে বসানো হয়েছে তাদের কাছ থেকে পদ, পদবি ও কমিটি শুধু উপঢৌকন নয়, নগদ টাকায় কিনে নিয়ে গেছে। যারা বেচেছে আর যারা কিনেছে তাদের কাছে রাজনীতি হলো পণ্য, যা শুধু সরকারি দলেই মানায়, যারা সরকারের পতনে অবদান রাখতে পারে। এখন তো পতন নয়, পতন তো করিয়েছেই, এখন উত্থানের নেতার প্রয়োজন কিন্তু তাদের পরিবর্তন করার ক্ষমতা, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ম্যাডামের নেই। ম্যাডাম দলের নেতা-কর্মী থেকে বিচ্ছিন্ন একজন একঘরে নেত্রী, যিনি কার্যত চার এসের (ঝ) কব্জায় নিয়ন্ত্রিত। সরি, ম্যাডাম তো আবার সত্য পছন্দ করেন না। জানি না, আমার ভাগ্যে কী আছে। তবে কেন্দ্রের দায়িত্ব মোদিকে দিলেও আমার এলাকার দায়িত্ব আমিই নেব। আমার এলাকায় দল ভাঙাগড়ার ব্যবসা আজ থেকে বন্ধ।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।
__._,_.___