ত্রিপুরার স্বাধীনতা সংগ্রাম
09 June 2014, Monday
ব্রিটিশ শাসনামলে সাবেক কুমিল্লা জেলাকে বলা হতো ত্রিপুরা। আর এখন যেটাকে বলা হচ্ছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, সেটাকেই বলা হতো পার্বত্য ত্রিপুরা। পার্বত্য ত্রিপুরা ছিল একটি করদমিত্র রাজ্য, যার রাজধানী ছিল আগরতলা। বাইরে থেকে আগরতলায় যেতে হলে যেতে হতো আখাউড়া রেলস্টেশন থেকে ঘোড়াগাড়ি অথবা মোটরগাড়িতে করে। পর্বত্য ত্রিপুরা ছিল গভীর বনভূমিপূর্ণ অঞ্চল। এখনো ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় শতকরা ৫৮ ভাগ ভূমি অরণ্যে ঢাকা। পর্বত্য ত্রিপুরা এককালে ছিল একটা স্বাধীন রাজ্য। এদের রাজাদের উপাধি ছিল 'ফা'। ত্রিপুরী ভাষায় 'ফা' শব্দের অর্থ হলো 'পিতা'। পরে এই ফা উপাধি পরিত্যক্ত হয়। ফা উপাধির জায়গায় রাজারা গ্রহণ করেন মাণিক্য উপাধি। রাজকার্য পরিচালনা গ্রহণ করেন ত্রিপুরী ভাষার স্থলে বাংলা ভাষাকে। ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দ মাণিক্যের সাথে তার ছোট ভাই নত্র রায়ের বিবাদ বাধে সিংহাসন নিয়ে। নত্র রায় চান বাংলার সে সময়ের মোগল সুবেদারের সাহায্য নিয়ে ত্রিপুরার সিংহাসন অধিকার করতে। বড় ভাই গোবিন্দ মাণিক্য সিংহাসন ছেড়ে দেন ছোট ভাইকে। ছোট ভাইয়ের সাথে তিনি চান না যুদ্ধ করতে। ছোট ভাই নত্র রায় ছত্র মাণিক্য নামে সিংহাসনে আরোহণ করেন (১৬৬১)।
ব্রিটিশ শাসনামলে রবীন্দ্রনাথের সাথে সে সময়ের ত্রিপুরা রাজা কিশোর দেব বর্মণের সখ্য হয়। এ সময় ত্রিপুরার রাজারা বর্মণ উপাধি ধারণ করতেন। ত্রিপুরার রাজপরিবারের সন্তান হলেন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ও সুরকার সচীন দেব বর্মণ। রবীন্দ্রনাথ রাজা গোবিন্দ মাণিক্যের কাহিনী অবলম্বন করে রচনা করেন তার 'রাজর্ষি' উপন্যাস ও 'বিসর্জন' নাটক। এভাবে ত্রিপুরার রাজপরিবার স্থান পায় বাংলা সাহিত্যে। 'রাজমালা' নামক গ্রন্থে ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাস লিখিত আছে। আগে রাজমালা ত্রিপুরী ভাষায় লিখিত ছিল। ১৪৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মহারাজ ধর্ম মাণিক্যের আদেশে রাজমালা লেখা হতে থাকে বাংলায়। বর্তমানে ত্রিপুরার শতকরা প্রায় ৬৪ ভাগ লোক কথা বলেন বাংলা ভাষায়। আর অন্যরা বলেন অন্যান্য ভাষায়। ত্রিপুরী ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা নেমে এসেছে প্রায় শতকরা ২৫ ভাগে। ত্রিপুরা ভারতের সাথে একীভূত হয় ১৯৪৯ সালের ১৫ অক্টোবর। প্রথমে এটা থাকে একটা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। পরে উন্নীত হয় একটি প্রদেশে ( জানুয়ারি ২১, ১৯৭২)। ত্রিপুরার তিন দিকে হলো বাংলাদেশ। কেবল উত্তর-পশ্চিমে এর সামান্য কিছু অংশ যুক্ত হলো আসামের কাছাড় জেলার সাথে। আর পুবের কিছুটা আছে মিজোরামের সাথে।
ত্রিপুরার মানুষের একাংশ চাননি ভারতের সাথে যুক্ত হতে। তারা চেয়েছেন ত্রিপুরাকে একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। ১৯৪৯ সালের পর থেকেই বলতে গেলে শুরু হয় ত্রিপুরার স্বাধীনতা সংগ্রাম। স্বাধীন ত্রিপুরা রাষ্ট্র গঠনের জন্য গঠিত হয় জঙ্গি সংগঠন এটিটিএফ (অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স)। সম্প্রতি এর অন্যতম নেতা রঞ্জিত দেব বর্মণ ধরা পড়েন ভারতীয় কর্তৃপরে হাতে। তার ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। তিনি বলতে বাধ্য হন তাদের অস্ত্র কোথায় লুকানো আছে সে সম্বন্ধে। ভারতীয় কর্তৃপ এ সংক্রান্ত সংবাদ জ্ঞাত করেন বাংলাদেশ সরকারকে। বাংলাদেশ সরকার ভার দেন র্যাবকে হবিগঞ্জের ঘন বনে অস্ত্র খোঁজার জন্য। বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার সাতছড়ি নামক স্থানে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে কয়েকটি কূপের সন্ধান মেলে। এই কূপের মধ্যে নেমে লাভ করা সম্ভব হয় লুকানো অস্ত্রের ভাণ্ডার। যে জায়গায় এই অস্ত্রের ভাণ্ডারের খোঁজ মিলেছে তার দূরত্ব ত্রিপুরা থেকে তিন
কিলোমিটারেরও কম। এখানে ত্রিপুরা থেকে এসে অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্সের সদস্যদের পে অস্ত্র মজুদ করা মোটেও কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল না। ওই অঞ্চলে গভীর বনের মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্তরীরা টহলদারিতেও ছিলেন না সেভাবে নিয়োজিত। আসলে জায়গাটি খুবই দুর্গম। যেসব অস্ত্র এ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে তাদের মধ্যে ১৮৪টি শক্তিশালী রকেট লাঞ্চার আছে, আছে বেশকিছু ট্যাঙ্কবিধ্বংসী কামানের গোলা, ১৫৩টি রকেট চার্জার, শ দুয়েক মর্টারের গোলা। আরো অনুসন্ধান চালিয়ে অস্ত্র ও গোলা বারুদের সন্ধান পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরকম অস্ত্র ভাণ্ডার ওই দুর্গম বনে গড়ে তুলতে সময় লেগেছে। ভারতের গোয়েন্দা চক্র আগে যার সন্ধান পেতে পারেনি। অথবা সন্ধান পেলেও তার কথা সেভাবে বলার প্রয়োজন দেখেনি। ঘটনাটি ফাঁস করা হলো দিল্লিতে মন্ত্রিসভা গঠনের ঠিক পরপরই। নরেন্দ্র মোদির সরকার নীতি নির্ধারণে এর দ্বারা কিভাবে প্রভাবিত হবেন আমরা তা জানি না। ইতঃপূর্বে নির্বাচনকালীন বিজিপির একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বলেছিলেন সিলেট ও খুলনা বিভাগের কিছু অংশ দখল করে সেখানে বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া হিন্দুদের উপনিবিষ্ট করা উচিত। এই অস্ত্র ভাণ্ডারের খোঁজ ভারত সরকারকে এই উদ্দেশ্যে কোনো যুক্তি দেবে কিনা, তা আমরা বলতে পারি না।
ভারতের পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে, আসামের উলফারা নাকি বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে ত্রিপুরায় অস্ত্র নিয়ে যেত। ত্রিপুরা থেকে ওই সব অস্ত্র নিয়ে যাওয়া হতো আসামে, যা ব্যবহার করত উলফারা। বলা হচ্ছে, উলফা নেতা পরেশ বড়–য়া আছেন চীনে। তিনি নাকি চীন থেকে এসব অস্ত্র পাঠাতেন চট্টগ্রাম বন্দরে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বাংলাদেশে একটি মুসলিম মৌলবাদী দল এই সব অস্ত্র নিয়ে পৌঁছে দিত ত্রিপুরা সীমান্তে, অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্সের সদস্যদের কাছে। বলা হচ্ছে, অনেক দিন ধরেই হচ্ছে এ রকম অস্ত্রের সরবরাহ।
বাংলাদেশ সরকার এখন চাচ্ছে চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের। চীনকে জড়িয়ে এরকম সংবাদ সরবরাহ চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে কোন বাধা হবে কি না, আমরা তা বলতে পারি না। সব কিছুই যেন করা হচ্ছে বিশেষ এক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করার ল্েয। আমরা সমর বিশারদ নই। যতদূর জানি, উলফারা আসামে করে চলেছে গেরিলাযুদ্ধ। গেরিলাযুদ্ধ করা হয় হালকা অস্ত্রপাতি নিয়ে। কারণ গেরিলারা হঠাৎ শত্র" পকে আক্রমণ করে সরে যায়। গেরিলাযুদ্ধ হয় এলোমেলোভাবে নানা জায়গায়। এর কোনো সুনির্দিষ্ট ফ্রন্ট বা রণত্রে বলে কিছু থাকে না। আসামে কোথাও উলফারা রকেট অথবা ট্যাঙ্ক ধ্বংসী কামান ব্যবহার করেছে বলে আমরা শুনিনি। বিশ্বের পত্রপত্রিকায়ও এমন কোনো খবর প্রকাশিত হয়নি। অথচ হবিগঞ্জের গহিন জঙ্গলে পাওয়া গেল রকেট লাঞ্চার ও ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী গোলা। ভারতীয় সৈন্যরা উলফাদের দমন করার জন্য আসামে ট্যাঙ্ক ব্যবহার করেছে বলে আমরা কোনো সংবাদ পত্রপত্রিকায় দেখিনি। সবকিছুই তাই আমাদের কাছে ঠেকছে খুব গোলমেলে। চীন আসামে অস্ত্র পাঠাতে চাইলে অনেক সহজেই তা পাঠাতে পারে উত্তর মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে চীন আসামে অস্ত্র পাঠাতে চাইবে কেন, সেটাও আমাদের বোধগম্য নয়। আর আসলে অস্ত্রগুলো যে চীনেরই তৈরি তারও কোনো প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার চাচ্ছে চীনের সাথে সম্পর্কো উন্নয়ন। আর এ সময় বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে আসামে চীনের অস্ত্র যাওয়ার কথা আমাদের কিছু পত্রপত্রিকায় খুব জোরেসোরে প্রচার করা হচ্ছে। যেটাকে ধরা যায় না সাধারণ কূটনৈতিক শিষ্টাচারসম্পন্ন। আমরা চাচ্ছি চীন টেকনাফে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সাহায্য করুক। চীনকে আমরা দিলাম পদ্মাসেতু নির্মাণের ভার। চীন আমাদের কাছে বিক্রি করতে চাচ্ছে দু'টি আধুনিক সাবমেরিন। ভারতের সমর বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যেই যা নিয়ে তুলেছেন প্রশ্ন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এখন আছেন চীনে। খালেদা জিয়াকে বলা হতো তিনি হলেন পাকিস্তানপন্থী। পাকিস্তানের আইএসআইয়ের পরামর্শে তিনি ঝুঁকে পড়তে চাচ্ছেন চীনের দিকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার েেত্র আইএসআইয়ের কোনো চক্রান্তের কথা উঠতেই পারে না। তার চীনে যাওয়ার আগে দিয়ে হবিগঞ্জের জঙ্গলে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে পাওয়া গেল অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্সের লুকিয়ে রাখা অস্ত্র।
(নয়া দিগন্ত)
__._,_.___