উর্দুভাষী বিহারিদের ওপর হামলার ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়
22 June 2014, Sunday
বিগত ১৪ জুন মিরপুরে উর্দুভাষী বিহারিদের ক্যাম্পে এক ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় আগুনে পুড়ে একই পরিবারের ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাইরে থেকে ঘরের দরজায় তালা মেরে দেয়ায় ঘর থেকে বের হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ আটজন ছাড়া আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে। সমস্ত রাত এলাকায় শবেবরাত উপলক্ষে বাঙালি-বিহারি সবাই আতশবাজি করেছে। এ আতশবাজির সুযোগ নিয়েই ওই দিন পরিকল্পিতভাবে উর্দুভাষীদের ওপর এ আক্রমণ পরিচালনা করা হয়েছে। শুধু ঘরে আগুন দেয়াই নয়, অন্যভাবেও কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্প নামে পরিচিত মিরপুরের কালসী এলাকার এ ক্যাম্পে ব্যাপকভাবে হামলা করা হয়েছে। হামলা শুধু ওই দিন ভোররাতেই নয়, পরদিন সকাল থেকে নিয়ে সারাদিনই জারি ছিল।
আক্রান্ত বিহারিদের অভিযোগ, পুলিশের উপস্থিতিতেই এবং পুলিশের সহায়তায়ই কিছুসংখ্যক বাঙালি তাদের ওপর এ হামলা চালায়। শুধু একটি বাসা ভস্মীভূত হওয়াই নয়, অন্য অনেক বাসাও এ হামলার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে বাঙালিরা এ হামলায় অংশগ্রহণ করে তাদের বক্তব্য হল, শবেবরাতের আতশবাজির সময় বিহারিদের নিজেদের দ্বারাই এই অগ্নিকাণ্ড হয়েছে! এ ধরনের পাল্টা এবং উল্টো কথা অপরিচিত অথবা অস্বাভাবিক নয়। হামলাকারীরা দুর্বলদের আক্রমণের পর এসব কথাবার্তা একটা রুটিন হিসেবেই বলে থাকে।
পত্রিকার বিভিন্ন রিপোর্ট এবং সরেজমিন ফিল্ড তদন্তের মাধ্যমে জানা যায়, এটা এক সম্পূর্ণ অন্য কাহিনী। বিহারিদের এ ক্যাম্পের ওপর হামলার চক্রান্ত অনেক দিন থেকে চলে এলেও সম্প্রতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপি ইলিয়াস মোল্লা হামলার সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিকল্পিতভাবে শবেবরাতের সুযোগ নিয়ে কুর্মিটোলা ক্যাম্পে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেন। ২০০৯ সালে ইলিয়াস মোল্লা কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী ৩০ বিঘা জমি দলের স্থানীয় কর্মীদের মাধ্যমে দখল করে সেখানে একটি বস্তি গড়ে তোলেন। তাদের এক যুবলীগ নেতা নিহত হলে তার নামে বস্তিটির নামকরণ করা হয় রাজু বস্তি। বর্তমানে বস্তিটির তদারকির কাজ স্থানীয় যুবলীগ নেতা ও কর্মীরাই করে থাকে। তাদের মাধ্যমে ইলিয়াস মোল্লা পুরো ৩০ বিঘা সরকারি জমির ওপর নিজের দখল কায়েম রেখেছেন। (যুগান্তর ১৯.০৬.২০১৪)।
কুর্মিটোলা ক্যাম্প নামে বিহারিদের এ ক্যাম্পে সরকার বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। ইলিয়াস মোল্লা তার প্রতিষ্ঠিত রাজু বস্তির বাঙালি ভাড়াটিয়াদের জন্য এ ক্যাম্পের বিদ্যুৎ লাইন থেকে বিদ্যুৎ নেয়ার চেষ্টা করলে ক্যাম্পবাসীরা তাতে বাধা দেন। এভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মোল্লা বিহারিদের হুমকি দিয়ে বলেন, তিনি কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। বিহারি ক্যাম্পবাসীদের বক্তব্য হল, তাদের ক্যাম্পের পাশে ৩০ বিঘা সরকারি জমি দখল করে বাঙালিদের বস্তি তৈরি করে সে জমি দখল করার চক্রান্ত তো আছেই। সেই সঙ্গে একটা অজুহাত খাড়া করে বিহারি ক্যাম্পের ওপর হামলা করে তাদের ক্যাম্পের জমি দখল করাই ইলিয়াস মোল্লার চক্রান্তমূলক লক্ষ্য। স্থানীয় যুবলীগ কর্মীদের এ কাজে লাগিয়ে তিনি তার উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টায় ১৪ তারিখের ঘটনা বেশ পরিকল্পিতভাবেই ঘটিয়েছেন। ঢাকা মহানগরীর গোয়েন্দা পুলিশ অবশেষে এ ঘটনার তদন্তে নেমেছে। তাদের একজন কর্মকর্তার বক্তব্য হল, ইলিয়াস মোল্লার প্রধান কর্মীদের অন্যতম জুয়েল রানা ঘটনার পর পলাতক আছে। তাকে গ্রেফতার করলেই তার থেকে ঘটনার বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাবে। কারণ জুয়েলের নেতৃত্বেই সেদিনকার হামলা পরিচালিত হয়েছে বলে তাদের কাছে তথ্য আছে। (যুগান্তর ১৯.০৬.২০১৪)।
১৪ তারিখের ঘটনার পর সমগ্র কালসী এলাকা উত্তপ্ত হয় এবং বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দারা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন। তাদের সঙ্গে দফায় দফায় পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় কিছু বাঙালিও এ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। প্রায় সারাদিন ধরে এ সংঘর্ষ চলে। পরের দিনও এই বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। ক্যাম্পের বিহারি বসবাসকারীরা তাদের অভিযোগে সমস্ত ঘটনার জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগ এমপি ইলিয়াস মোল্লাকে দায়ী করে তার গ্রেফতার দাবি করেন। তাদের এ দাবির যে কোনো কার্যকারিতা নেই এটা বলাই বাহুল্য। কারণ ইলিয়াস মোল্লার মতো লোকেরাই এখন আওয়ামী লীগের ভরসা। এই মাফিয়া চরিত্রের লোকেরা নানাভাবে এলাকায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে ও টিকিয়ে রেখে, পুলিশের থেকে সব রকম সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তি শক্ত রাখে।
১৪ জুন মিরপুরের কালসী এলাকায় বিহারি ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ যে একটি পরিকল্পিত হামলার ব্যাপার, এ নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা লাভ করে সরকারের সঙ্গে নানা সূত্রে সম্পর্কিত ভূমিদস্যুরা দেশজুড়ে এখন নানা দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। গরিবদের জমি তারা জোরপূর্বক দখল করছে। পুলিশের সামনেই এসব দস্যুবৃত্তি হচ্ছে। কিন্তু পুলিশ এ দস্যুদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিচ্ছে না। কাজেই অবাধে এসব হামলা চলছে। মিরপুরের বিহারি ক্যাম্পে যে ঘটনা ঘটেছে, এটা ভূমিদস্যুদের জমি দখলের সঙ্গেই পুরোপুরি সম্পর্কিত। ইলিয়াস মোল্লা ৩০ বিঘা সরকারি জমি দখল করে সেখানে রাজু বস্তি তৈরি করেই ক্ষান্ত নন। এদের লোভ-লালসার কোনো শেষ নেই। এদের এখন বাধা দেয়ারও কেউ নেই। কারণ এরাই হলেন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মেরুদণ্ড। জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগের এরাই এখন ভরসা।
বাংলাদেশ এখন পরিণত হয়েছে ভূমিদস্যুদের স্বর্গরাজ্যে। এ দেশে এখন যে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক সৃষ্টি হয়েছে, এরা সবাই ভূমিদস্যু। ভূমিদস্যুতাই এখন পরিণত হয়েছে রাতারাতি সম্পদশালী হওয়ার সব থেকে সহজ ও নিরাপদ উপায়। এখানে অবশ্য বলা দরকার, ভূমিদস্যুদের এ তৎপরতা ও হামলা এখন দেশের কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা এলাকায় সীমাবদ্ধ নেই। ঢাকা শহর থেকে নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত দেশজুড়ে এখন গরিব ও দুর্বলদের ওপর ভূমিদস্যুদের জমি দখলের এ মহোৎসব চলছে। এ কারণে শুধু অবাঙালি উর্দুভাষী বিহারিরাই যে এ ভূমিদস্যুদের হামলা ও দস্যুবৃত্তির শিকার তাই নয়। সবরকম সংখ্যালঘুরাই এভাবে ভূমিদস্যুদের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি পত্রপত্রিকার রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, উত্তর বাংলায় রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, নওগাঁ ইত্যাদি জেলায় সাঁওতালদের ওপর হামলা হচ্ছে। চেষ্টা হচ্ছে তাদের নিজেদের জমি ও ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে তাদের জমি দখলের। এর বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদ-প্রতিরোধও হচ্ছে, কিন্তু তার ফলে ভূমিদস্যুদের এ হামলা কমছে না। কারণ এ দস্যুদের বড় রক্ষক হচ্ছে সরকার। সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়েই তারা তাদের দস্যুবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছে। কাজেই শুধু সাঁওতাল নয়, খাসিয়া, রাখাইন, গারো, চাকমা ইত্যাদি সংখ্যালঘু জাতিসত্তাভুক্ত জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রায় অবাধে ভূমিদস্যুদের তৎপরতা অব্যাহত আছে। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, এই একই ভূমিদস্যুরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু ও বৌদ্ধদের ওপর জায়গায় জায়গায় হামলা করছে। হাঙ্গামা সৃষ্টি করছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসব হামলা জমি দখলের জন্য হলেও এগুলোকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে সরকারি মহলের লোকজন প্রচার করছে। আশ্চর্য হওয়ার ব্যাপার এই যে, যে সরকারের লোকজন এসব হামলা ও দস্যুবৃত্তি করছে, তারাই আবার এ হামলার বিরুদ্ধে অনেক লম্বা লম্বা বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছে! তাদের এই বক্তৃতা-বিবৃতির মূল উদ্দেশ্য এ হামলাগুলো যে মূলত জমি দখলের জন্য ভূমিদস্যুদের কাজ এ বিষয়টি আড়াল করে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা। এ ভূমিদস্যুদের ব্যাপক তৎপরতার শিকার বাংলাদেশের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠরাও হচ্ছে। কিন্তু সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর যখনই এ আক্রমণ হচ্ছে, তখনই তারা এসব ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলে আখ্যায়িত করে এর দায়িত্ব সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এর সমর্থনে আওয়ামী লীগ এবং তাদের বুদ্ধিজীবী ও পত্রপত্রিকাগুলোও একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে হৈচৈ সৃষ্টি করতে অসুবিধা বোধ করছে না।
বিষয়টিকে এভাবে দেখলে বোঝা যাবে যে, ১৪ জুন মিরপুরের বিহারি ক্যাম্পে আওয়ামী লীগ এমপি ইলিয়াস মোল্লার নেতৃত্বে তাদের কর্মীদের দ্বারা যে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। উত্তর বাংলায় এখন ব্যাপকভাবে সাঁওতালসহ অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামলা চলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর ওপর যে হামলা চলছে, সেগুলোর সঙ্গে বিহারি ক্যাম্পের ওপর হামলা একই সুতায় গাঁথা। কাজেই বিষয়টি এভাবে দেখে ভূমিদস্যুদের এবং সব ধরনের সমাজবিরোধী লুটপাটকারীদের এ দস্যুবৃত্তির বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া এ প্রক্রিয়া বন্ধের অন্য কোনো পথ নেই। পুলিশের কাছে অবশ্যই দাবি করতে হবে এসব দুষ্কৃতির ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে গ্রেফতারের। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারের কোনো সংস্থার বা সংগঠনের দ্বারা এসব বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। জনপ্রতিরোধে এসব হামলা একেবারে বন্ধ করা সম্ভব না হলেও উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনার এটাই একমাত্র পথ। জনগণের সামনে এই পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
২০.০৬.২০১৪
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
(যুগান্তর)
__._,_.___