তার নাম ইয়াছিন আলী। তার ''গুণের'' শেষ নেই। আমাদের দেশের রাজনৈতিক 'সংস্কৃতিতে' সাধারনত বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা প্রতিপক্ষ দলের কাছে চাঁদাবাজি করেন। কিন্তু ইয়াছিন চাঁদাবাজি করেন নিজ দলের লোকদের কাছেই। না হলে তিনি নিজ দলের নেতাকর্মীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেন। এসব কারণে ইয়াছিনকে সমঝে চলেন দলের নেতাকর্মীরা। হরতাল-অবরোধের সময় ইয়াছিন পালান না, পালাতে হয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারি দলের নেতাদের ম্যানেজ করে বাসাতেই ঘুম দেন। অন্যরা ভয়ে তটস্থ হয়ে গা ঢাকা দেন। উপরন্তু ইয়াছিনের 'ধরিয়ে দেয়ার' ভয়ে কর্মীদেরকে সুরা ইয়াছিন পাঠ করতে হয়।
আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি রাজধানী জুড়ে পোস্টার সাঁটানো শুরু করেছেন। তাতে তিনি পাকিস্তানের পতাকার রঙ ও চাঁদ-তারা প্রতিক ব্যবহারও করেছেন। এই পোস্টার তার ফেসবুক ওয়ালেও শোভা পাচ্ছে। কী কারণে চাঁদ-তারার প্রতি তার এতো অনুরাগ সে কথা জানাতে পারেনি কর্মীরা।
রাজনীতির 'বিরল প্রতিভাধর' এই ইয়াছিন আলী জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আহবায়ক। তারেক রহমানের বন্ধু আশিকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি তার সকল কর্মকাণ্ড চালিয়ে থাকেন।
দলের কয়েকজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ইয়াছিন আলী সন্ত্রাসী শাহাদাত বাহিনীর কালেক্টর হিসেবেও কাজ করেন। কলকাতায় শাহাদাতের কাছে টাকা পৌঁছে দেয়া তার কাজ। হরহামেশাই মালয়েশিয়া, লন্ডনসহ নানা দেশ সফর করেন আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে। মালয়েশিয়ায় তার হোটেল ব্যবসা আছে। উত্তরা এলাকা হচ্ছে তার চাঁদাবাজির ব্যবসার মূল ক্ষেত্র। এখন ঈদ উপলক্ষে তিনি চাঁদাবাজি করছেন প্রকাশ্যে। দলের জুনিয়র নেতারা নিরুপায় হয়ে কমিটিতে স্থান পেতে তাকে নিয়মিত চাঁদা দেন।
ঢাকা মহানগর বিএনপির একাধিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতা পরিবর্তনকে জানান, ইয়াছিন আলী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে রাজধানীর উত্তরায় ২ কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন। কিন্তু দলের কর্মীদের কাছ থেকে সেই ফ্ল্যাট বাবদ আবার টাকা ধার নিয়ে তা শোধ করেন না। যিনি টাকা দেন, তিনি জানেন সেই টাকা ফেরত মিলবে না।
ইয়াছিন আলী এখন স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য তদ্বিরে ব্যাস্ত। কিন্তু সংগঠনের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তাকে পছন্দ করে না। ঢাকা মহানগর উত্তরের আহবায়ক হওয়ার পর থেকে তার একনায়কতন্ত্র, স্বজনপ্রীতি আর ঔদ্ধরতপূর্ণ আচরনের জন্য আজ মহানগর উত্তরের বেহাল অবস্থা হয়েছে বলে নেতারা জানিয়েছেন। গত ২৫ অক্টোবর ঢাকা অচল কর্মসূচী পণ্ড হয়েছে তার মতো নেতাদের কারণেই। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা।
ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন যুগ্ম আহ্বায়ক জানান, যেকোন থানা কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ইয়াছিনকে নগদ তিন থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা এবং তার বাসায় আসবাবপত্র প্রদান করা বাধ্যতামূলক। তাছাড়া কেন্দ্র থেকে হরতাল অবরোধের সময় আন্দোলন পরিচালনার জন্য যে টাকা সংগ্রহ করা হয় তার ১০ ভাগও দলের নেতাকর্মীদের দেন না । বরং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কথা বলে প্রায়ই স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন। থানা ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা পদ হারানোর ভয়ে তা প্রকাশ করেন না।
নেতাকর্মীরা জানান, কয়েক মাস আগে ইয়াছিন পল্লবীতে সোয়া কোটি টাকায় আরেকটি ফ্ল্যাট কেনেন। অর্ধ শতাধিক মামলা থাকার পরেও পুলিশ ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কয়েকদিন পর পর তিনি লন্ডন, মালেয়েশিয়া, ভারত ভ্রমন করতে যান সপরিবারে। পুলিশ ও প্রশাসনের সাথে রয়েছে তার মধুর সম্পর্ক। হরতাল এবং অবরোধে নির্বিঘ্নে তিনি তার ফ্ল্যাটে থাকেন। অথচ সবাইকে বলে বেড়ান তিনি এলাকাতে থাকে না। তিনি যুবদল ও ছাত্রদলের কর্মীদের অবস্থান আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে খবর দিয়ে তাদের ধরিয়ে দেন। আবার নিজেই ওই কর্মীদের পরিবারের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন নিজের কমিশন রেখে দিয়ে।
ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন যুগ্ম আহবায়ক পরিবর্তনকে বলেন, 'পল্লবীতে এক কর্মীকে সহায়তা করার জন্য আমি ইয়াছিনের কাছে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। ইয়াছিনের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে। সে দলের কোনো নেতাকে পাত্তা দেয় না।'
পরিবর্তন-এর পক্ষ থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই নেতার দেয়া টাকা সেই কর্মী পাননি।
জানা গেছে, মিরপুর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক মহসিন বাবুল মাষ্টার মারা যাওয়ার পর দলের নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে তার পরিবারকে আর্থিক অনুদান প্রদানের জন্য কয়েক লাখ টাকা সাহায্য তোলা হয়। সেই টাকাও ইয়াছিল আলী বাবুল মাষ্টারের পরিবারকে দেননি।
রাজধানীর রুপনগর থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি করতে ইয়াছিন দুটি গ্রুপের কাছ থেকে টাকা নেন। সেখানে তিনি একটি কমিটির স্থলে দু'টি কমিটি গঠন করে দেন।
টাকা সম্পর্কে বিএনপির এক কর্মী জানান, কায়সার ও শামিম গ্রুপের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন ইয়াছিন। শামীম যোগ্য ছিল, কিন্তু কায়সারের কাছ থেকে সে বিভিন্ন সময় অর্থ নিয়ে বিভিন্ন সময় বিদেশ ভ্রমণ করেছে। শামীমকে একটি কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক বানিয়ে দেন। আর কায়সারকে সভাপতি করে আরেকটি কমিটি করেন।
বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সকল ফান্ডের টাকা ইয়াছিল আলী আত্মসাত করেছে বলেও দলের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করছেন।
মিরপুরের একাধিক নেতাকর্মী পরিবর্তনকে জানান, ইয়াছিন আলী ৭ নং ওয়ার্ডের সেচ্ছাসেবক লীগের প্রচার সম্পাদক নাসিম হায়দার সুমনকে টাকার বিনিময়ে সেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব বানান।
বিএনপির মিরপুর থানার নেতাকর্মীরা বলছেন, বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের সাথে ইয়াছিনের সু-সম্পর্ক রয়েছে। তিনিই সিনিয়র নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে আন্দোলন পরিচালনার অর্থ ইয়াছিনের হাতে দেন। এছাড়া ইয়াছিন আলী লন্ডন সফর করে তারেক রহমানের সাথে যোগাযোগ করেছেন এবং তারেক তাকে 'ক্লিয়ারেন্স' দিয়েছেন বলে তিনি সবার কাছে বলে বেড়ান।
বিএনপির একাধিক নেতাকর্মীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, মূলত পুলিশ-র্যাবের সাথে ইয়াছিন আলীর সু-সম্পর্কে রয়েছে। তিনি পল্লবী থানার একাধিক পুলিশ-র্যাব কর্মকর্তাকে নিয়মিত মাসোহারা দেন। তাই তাকে গ্রেপ্তার করা হয় না। আর গ্রেপ্তার হলেও খুব দ্রুত জামিনে বেরিয়ে যান।
জানা গেছে, ইয়াছিন আলীর সাথে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তিনি নিজেকে ইলিয়াস মোল্লার সহপাঠি বলে দাবি করেন। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি ইলিয়াস মোল্লাকে নির্বাচনে সহযোগিতা করেন বলে জানিয়েছেন নেতা-কর্মীরা।
সর্বশেষ ইয়াছিন আলীর বিরুদ্ধে নেতারা অভিযোগ করছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে 'আমরা জিয়ার সৈনিক' নামে একটি ফ্যান পেজ খোলা হলে তা ইয়াছিন আলী বিটিসিএলের মাধ্যমে তা মুছে দেন। বিটিসিএলের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে তার সু-সম্পর্ক রয়েছে বলে জানায় নেতাকর্মীরা।
এ ব্যাপারে জানতে শনিবার বিকেল ৩টা ২২ মিনিট ও ৩টা ৫৬ মিনিটে ইয়াছিন আলীর সাথে মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের সাথে টেলিফোনে বহুবার যোগাযোগ করা হয়। তবে রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
ফুল সাইজ পোস্টার দেখতে ক্লিক করুন।
এআইএম/রর
__._,_.___