ভুট্টা চাষের মতো লাখ লাখ হেক্টর আমাদের পতিত থাকে। ভুট্টা চাষের পর আবারো বোরো বা আউশ চাষ করা সম্ভব ওই একই জমিতে।
সরকার ও কৃষক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পল্লী ও চরাঞ্চলে সংরক্ষণের জন্য গুদাম নির্মাণ করলে কৃষক তিন-চার মাস ভুট্টা মজুদ করে দ্বিগুণ লাভবান হতে পারতো। ভালো বাজারদর পেয়ে কৃষক আরো বেশি জমিতে ভুট্টা চাষে উৎসাহী হতো। এতে বিদেশ থেকে আর ভুট্টা আমদানি করতে হতো না।
আমদানি করতে না হলে দেশে বাজারদর কম থাকবে। মৎস্য, পোলট্রি ও পশু খাদ্যের দাম কম থাকবে। আমিষ উৎপাদন খরচ কমবে। মাছ ও গোশতের দাম কমবে। দরিদ্র মানুষ অপুষ্টিতে ভুগবে না।
দেশের ভুট্টা চাষীরা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে চরম হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত । অনুকূল আবহাওয়া ও সহজসাধ্য উৎপাদন ব্যবস্থা এবং গম ও অন্যান্য ফসল চাষে ব্যয় বৃদ্ধির কারণে দেশে এবারও ভুট্টার বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম কম এবং সিন্ডিকেট দৌরাত্ম্যের ফলে চাষীরা উৎপাদিত ভুট্টার দাম পাচ্ছে না। ভুট্টা চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। চাষীদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির এই অনিশ্চয়তাকে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থার বেদনাদায়ক দিক ।
দেশে পশু, মৎস্য ও মুরগির খাদ্যের জন্য ভুট্টার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৬০ লাখ টন। প্রতি বছর দেশে গড়ে ২৫ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদন হয় এবং চাহিদার বাকি ৩৫ লাখ টনই আমদানি করতে হয়। ভুট্টা চাল-গমের চেয়ে বেশি আমদানি হয়।
দেশে যখন ভুট্টার মৌসুম শুরু হয় তখন ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম অর্ধেকে নামিয়ে এনে কৃষকের কাছ থেকে কিনে মজুদ করে। অথচ মৌসুম শেষ হলে তারাই আবার দ্বিগুণ দামে আমদানি করে। মৌসুমে ফিড মিল মালিকেরাও কম দামে ভুট্টা কেনার সুযোগ নেয়। মৌসুমের শুরুতে কাঁচা ভুট্টা কেনা শুরু হয় ১০-১২ টাকা কেজি দরে। মৌসুম শেষেই বাজারে দর উঠে ১৭ থেকে ২০ টাকা কেজি। অথচ তখন আর কৃষকের ঘরে ভুট্টা থাকে না। কৃষক বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সার কীটনাশক বাকিতে কেনেন। দ্রুত এ টাকা পরিশোধে কৃষক কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
লাখ লাখ ভুট্টাচাষীর লাভের হাজার কোটি টাকা এখন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী মজুদদার সিন্ডিকেটের পকেটে। প্রতি বছরই সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ভুট্টার দাম পড়ে যায়। অনেক সময় উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে ভুট্টা বিক্রি করতে কৃষকেরা বাধ্য হচ্ছে। এ সুযোগে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা কম দামে ভুট্টা কিনে মজুদ গড়ে তোলে। তারা কেনার দুই তিন মাস পরেই বেশি দামে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এভাবেই তাদের জালে পড়ে প্রতি বছরই কৃষকদের লাভের অংশ খোয়াতে হচ্ছে। অথচ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে চাষী ভুট্টা ফলায় সে লাভের মুখ দেখে না। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় চাষিরাও ভুট্টা চাষে আগ্রহ হারাবে বলে আশঙ্কা কৃষি বিশেষজ্ঞদের।
দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট ও নবাবগঞ্জ অঞ্চলের কৃষকেরা জানায়, ভুট্টার দর ৬০০-৭০০ টাকা মণ উঠেছিল কয়েক দিন মাত্র। এ দর এক সপ্তাহ স্থায়ী থাকার পর আবারো নেমে যায়। এখন ৫২০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। এক কেজি ১৩ টাকা থেকে ১৩ টাকা ২৫ পয়সা পর্যন্ত। বড় ব্যবসায়ী ও ফিড মিল মালিকেরা ভুট্টার বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
উত্তরাঞ্চলে এবার ১৬ লাখ টন অর্থাৎ ১৬০ কোটি কেজি ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে। প্রতি কেজিতে পাঁচ টাকা লোকসান গুনলে কৃষকের লোকসান হবে ৮০০ কোটি টাকা। মৌসুম শেষ হলে ফিড মিল মালিকেরা ঠিকই আমদানি করা ভুট্টা ১৭-১৮ টাকা কেজি দরে অথবা আরো বেশি দামে কিনবে। অথচ এখন কিনছে ১৩ টাকা কেজি দরে।
দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের ভুট্টাচাষীরা জানিয়েছে, একবিঘা ভুট্টা চাষ করতে তাদের খরচ হয়েছে ৭-৯ হাজার টাকা। তবে যারা জমি লিজ নিয়ে চাষ করেছে তাদের খরচ হয়েছে ১৩-১৪ হাজার টাকা। এবার খরার কারণে দুই-তিনবার সেচ দিতে হয়েছে। এ জন্য উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ফলন কিছুটা কম হয়েছে। প্রতি বিঘায় ফলন হয়েছে ২৬-৩০ মণ।
আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়া উচ্চ ফলনশীল ভুট্টা চাষের উপযোগী। ব্যভস্থা নিলে বিঘাপ্রতি ৫০-৬০ মণ ভুট্টা ফলে। সেচ দিতে হয় খুব কম। চরের বেলে মাটিতেও প্রচুর ভুট্টা ফলে। মাটির নিচের পানির স্তর প্রতি বছর এক মিটার করে কমছে। বোরো চাষে সব খরচের সাথে সেচ খরচ বাড়ছে। বোরো চাষে যে পরিমাণ পানি লাগে তার ২-৩ শতাংশ পানি হলেই গম ভুট্টা চাষ হয়।
ভুট্টা চাষীদের যাবতীয় পৃষ্ঠপোষকতা করাসহ সরকারকে অবশ্যই বিদেশ থেকে ভুট্টা আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। একদিকে যেমন দেশের ডলার সাশ্রয় হবে, অন্যদিকে তৃণমূল পর্যায়ের কৃষকরাও ব্যাপকভাবে লাভবান হবে।
সিন্ডিকেট কী সরকারের চেয়েও বড়?না- সরকারই সিন্ডিকেট থেকে কমিশন খায়? লাভজনক ভুট্টাচাষে চাই সরকারের সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা।
ভুট্টা চাষীদের আগ্রহ ধরে রাখতে সরকারিভাবে ভুট্টা সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে
__._,_.___