মামলার জালে জিয়া পরিবার
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবার একের পর এক মামলার জালে আটকা পড়ছে। অর্থ আত্মসাৎ, মানহানি, হত্যা, দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও উসকানি দেওয়ার অভিযোগে মামলা হয়েছে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ এ বছরের ২১ অক্টোবর পর্যন্ত জিয়া পরিবারের ৩ সদস্যের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে মোট ২৯টি মামলা।
ধর্মীয় উসকানি ও বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে সর্বশেষ মঙ্গলবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলা করেন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী।
ঢাকা মহানগর হাকিম মোস্তাফিজুর রহমান মামলাটি শাহবাগ থানার একজন ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে তদন্ত করে ১৯ নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
এজাহারে বলা হয়, বেগম খালেদা জিয়া রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে গত ১৪ অক্টোবর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগ নিয়ে কটূক্তিপূর্ণ নানা কথা বলেন। বক্তৃতার একপর্যায়ে তিনি (খালেদা জিয়া) বলেন, 'আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ পরে আছে। আসলে দলটি ধর্মহীনতায় বিশ্বাসী।'
ধর্মীয় উস্কানি ও বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেওয়ায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৫৩ (ক) ও ২৯৫ (ক) ধারায় মামলা করা হয়।
জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় দায়ের করা মামলাগুলো হলো-
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬শ ৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে খালেদা জিয়া ও তারেকসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১০ সালের ৫ আগস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি : 'শহীদ জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্ট'র নামে অবৈধভাবে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ৮ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় মামলাটি করে দুদক। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। একই বছরের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এ মামলাটিও বিচারাধীন।
গ্যাটকো দুর্নীতি : কনটেনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য গ্যাটকো লিমিটেডকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রাষ্ট্রের এক হাজার কোটি টাকা ক্ষতির অভিযোগে খালেদা জিয়া ও তার ছোট ছেলে কোকোসহ ১৩ জনকে আসামি করে ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। মামলাটি বিচারাধীন।
বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি : দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির ঠিকাদারি কাজে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় মামলা করে দুদক। মামলায় খালেদা জিয়াসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়। উচ্চ আদালতের আদেশে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
নাইকো দুর্নীতি : কানাডীয় তেল গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি নাইকো রিসোর্সকে অবৈধভাবে কাজ দেওয়ার অভিযোগে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এ মামলার কার্যক্রমও স্থগিত রয়েছে।
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগে মামলা : লন্ডনের বেতনাম গ্রিনইয়র্ক হলে ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এবি সিদ্দিকী ৮ অক্টোবর ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলাটি করেন। এদিকে ১৯ অক্টোবর একই ঘটনায় অপর একটি মামলা করেন বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মশিউর মালেক। দুটি মামলা তদন্তাধীন।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা এবং ২২ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করা হয়। এ সরকারের আমলে দেওয়া সম্পূরক চার্জশিটে তারেক রহমানকেও আসামি করা হয়। মামলাটির বিচার চলছে।
ঘুষগ্রহণ : বসুন্ধরা গ্রুপের কর্মকর্তা সাব্বির হত্যা মামলা ভিন্নখাতে নিতে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে ২০০৭ সালে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করে দুদক।মামলাটি হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে।
কর ফাঁকি : কর ফাঁকির অভিযোগে ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট ঢাকার বিশেষ আদালতে তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাটি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এটি আদালতে বিচারাধীন।
ঋণখেলাপি : ঋণ খেলাপীর অভিযোগে ২০১২ সালের ২ অক্টোবর তারেক রহমান ও ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে ঢাকার অর্থঋণ আদালতে মামলা করে সোনালী ব্যাংক। মামলাটি বিচারাধীন।
অর্থপাচার : সিঙ্গাপুরে প্রায় ২১ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করে দুদক। মামলায় তারেকের বন্ধু ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকেও আসামি করা হয়। তদন্ত শেষে ২০১০ সালের ৬ জুলাই অভিযোগপত্র দেয় দুদক। গত বছরের ১৭ নভেম্বর মামলাটির রায় ঘোষণা হয়। রায়ে তারেক রহমানকে খালাস এবং গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে সাত বছর কারাদণ্ড ও ৪০ কোটি টাকা জরিমানা করেন আদালত। রায়ের বিরুদ্ধে দুদক আপিল করলে তা উচ্চ আদালত আমলে নেন।
অবৈধ সম্পদ অর্জন : অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কাফরুল থানায় মামলা করে দুদক। মামলায় তারেক জিয়া ও তার স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানকেও আসামি করা হয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলাটি স্থগিত রয়েছে।
ফৌজদারি আইনে ১১ মামলা : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেফতারের পর তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে গুলশান, কাফরুল, শাহবাগ ও ধানমন্ডি থানায় চাঁদাবাজি-হুমকিসহ ফৌজদারি আইনে ১১টি মামলা হয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশে এ সব মামলার কার্যক্রম স্থগিত আছে।
অর্থপাচার : ৯ লাখ ৩২ হাজার ৬৭২ মার্কিন ডলার এবং ২৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬০৪ সিঙ্গাপুর ডলার (বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৩ কোটি টাকা) পাচারের অভিযোগে ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ কাফরুল থানায় মামলা করে দুদক। ২০১০ সালের ১২ নভেম্বর অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। ২০১১ সালের ২৩ জুন কোকোর ছয় বছরের কারাদণ্ড ও সাড়ে ১৯ কোটি টাকা জরিমানা করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। এরই মধ্যে সিঙ্গাপুর থেকে কোকোর পাচার টাকার আংশিক ফিরিয়ে এনেছে দুদক।
অবৈধ সম্পদ অর্জন : দুই কোটি চার লাখ ৬১ হাজার ২০৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ১১ লাখ ২০ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৮ সালের ২৩ এপ্রিল রমনা থানায় কোকোর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলাটির অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। মামলাটির কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে।
চাঁদাবাজি : চাঁদাবাজির অভিযোগে গুলশান থানায় ২০০৭ সালের ১৬ মে ও ২৭ মার্চ দুটি মামলা হয়।এতে আসামি করা হয় কোকোকে। মামলা দুটির কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। এ ছাড়া কোকো খালেদা জিয়ার সঙ্গে গ্যাটকো মামলা এবং ভাই তারেক রহমানের সঙ্গে ঋণ খেলাপির মামলায় আসামি হয়েছেন।
আয়কর ফাঁকি : ২৪ লাখ ৩৯ হাজার ২২৬ টাকার আয়কর ফাঁকির অভিযোগে গত বছর ১ মার্চ অর্থঋণ আদালতে মামলা করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে আসামি করা হয় কোকোকে। মামলাটি বিচারাধীন।
জিয়া পরিবারের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন মেজবা দ্য রিপোর্টকে বলেন, 'সরকার রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করছে। এ মামলা মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক।'
বিএনপির গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া দ্য রিপোর্টকে বলেন, 'দেশে কোনো স্বাধীনতা নেই। মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্যের ওপর আওয়ামী লীগের লোকেরা জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা করছে। মামলার উদ্দেশ্য জিয়া পরিবারকে হয়রানি করা।'
ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু দ্য রিপোর্টকে বলেন, 'জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে মামলাগুলো তথ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি।'
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, 'পায়ের নিচে মাটি নেই জেনে সরকার একের পর এক মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্য এ রকম নজির পৃথিবীর কোথাও নেই। চেয়ারপারসন ও তার পরিবারকে হয়রানি করার জন্য তারা (সরকার) এ মামলা দিচ্ছে।'
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, 'বেশিরভাগ মামলা দুর্নীতির কারণে ওয়ান ইলেভেনের সময় দায়ের করা হয়েছে। বর্তমানে জিয়া পরিবার যে সব আবোল-তাবোল ও অসংলগ্ন কথা বলে এ জন্য মামলা হতেই পারে। তাদের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ যে কেউ চাইলে মামলা করতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, দেশকে হেয়প্রতিপন্ন ও জাতির পিতাকে নিয়ে কটূক্তি করায় জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।'
(দ্য রিপোর্ট/জেএ/একে/এনআই/অক্টোবর ২১, ২০১৪)
__._,_.___