যে সব অপরাধে গোলাম আযমের ৯০ বছরের কারাদণ্ড
সদ্যপ্রয়াত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযমকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সুনির্দিষ্ট ৬১ ঘটনায় ৫টি অভিযোগে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সঙ্গে পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত ৬টি, তাদের সঙ্গে সহযোগিতা সংক্রান্ত ৩টি, উস্কানি দেওয়ার ২৮টি, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও হত্যা-নির্যাতনে বাধা না দেওয়ার ২৩টি এবং ব্যক্তিগত হত্যা ও নির্যাতন সংক্রান্ত একটি অভিযোগ।
আদেশে ট্রাইব্যুনাল বলে, প্রথম অভিযোগের (ষড়যন্ত্র) জন্য ১০ বছর কারাদণ্ড, দ্বিতীয় অভিযোগে (পরিকল্পনা) ১০ বছর কারাদণ্ড,তৃতীয় অভিযোগে (উস্কানি) ২০ বছর কারাদণ্ড, চতুর্থ অভিযোগে (সহযোগিতা) ২০ বছর কারাদণ্ড এবং পঞ্চম অভিযোগে (সিরু মিয়া হত্যাকাণ্ড) ৩০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ :
অভিযোগ ১ (ষড়যন্ত্র) : একাত্তরের ৪ এপ্রিল গোলাম আযম, নুরুল আমীন, মৌলভী ফরিদ আহমেদ, খাজা খয়েরউদ্দিন, এ কে এম শফিকুল ইসলাম, মাওলানা নুরুজ্জামান, হামিদুল হক চৌধুরী, মোহসিনউদ্দিন আহমেদ ও এ টি সাদীসহ ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের 'খ' অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের ষড়যন্ত্র করে। আগের সাক্ষাতের সূত্র ধরে ৬ এপ্রিল গোলাম আযম আবারও টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন এবং পূর্বোল্লিখিত ষড়যন্ত্রে অংশ নেন। ১৯ জুন এই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় গোলাম আযম রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক করেন। ১ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে আবারও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষকে মোকাবেলার জন্য রাজাকার বাহিনীর শক্তি বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
এ অভিযোগে তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
অভিযোগ ২ (পরিকল্পনা) : ৪ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠকে সারাদেশে শান্তি কমিটি গঠনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ এপ্রিল গোলাম আযম ও অন্যরা ঢাকায় ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করেন। ৪ মে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে এ কিউ এম শফিকুল ইসলামের বাসভবনে খাজা খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির সভা হয়, যেখানে গোলাম আযম উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠনের বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়।
এই অভিযোগেও তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
অভিযোগ ৩ (উস্কানি) : ৭ এপ্রিল গোলাম আযম এক যুক্ত বিবৃতিতে স্বাধীনতাকামী মানুষকে 'ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী' হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, তাদের যেখানেই দেখা যাবে, সেখানেই ধ্বংস করা হবে। ২২ এপ্রিল শান্তি কমিটির সভা শেষে এক বিবৃতিতে গোলাম আযম অধীনস্থ সংগঠনগুলোর সদস্যদের 'দেশপ্রেমিক নাগরিক' উল্লেখ করেন। ১৭ মে গোলাম আযম ঢাকায় এক সভায় স্বাধীনতা আন্দোলনকে 'রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ' ও মুক্তিযোদ্ধাদের 'বিশ্বাসঘাতক' হিসেবে উল্লেখ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর 'অপারেশন সার্চলাইট' নামের সেনা অভিযানের প্রশংসা করেন।
১৯৭১ সালের ১৬ জুলাই রাজশাহী, ১৮ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৪ আগস্ট খুলনা ও ৭ আগস্ট কুষ্টিয়ায় আয়োজিত বিভিন্ন সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও উত্তেজনাকর বক্তব্য দেন তিনি। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ২৫তম আজাদী দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে, ১৭ ও ২৩ আগস্ট দলীয় সভায় এবং ২৬ আগস্ট পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত দলীয় অনুষ্ঠানে গোলাম আযম বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। ১৭ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল এডুকেশন সেন্টারে শিক্ষাগ্রহণরত রাজাকারদের শিবির পরিদর্শন করে তাদের সশস্ত্র হওয়ার আহ্বান জানান। ৩ অক্টোবর ঢাকায় মজলিসে শূরার সভায় একই ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন গোলাম আযম।
এই অভিযোগে তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
অভিযোগ ৪ (সহযোগিতা) : ১৯৭১ সালের ৪ ও ৬ এপ্রিল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে গোলাম আযমসহ অন্যরা সহযোগিতার আশ্বাস দেন বলে অভিযোগ করা হয়। ৯ এপ্রিল গোলাম আযমের সহযোগিতায় নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত হলে ১৫ এপ্রিল এর নাম পরিবর্তন করে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি করা হয়। শান্তি কমিটির ২১ সদস্যের কার্যকরী কমিটির একজন সদস্য ছিলেন গোলাম আযম। ১৮ জুন লাহোর বিমানবন্দরে গোলাম আযম বলেন, জনগণ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে চায়। ১৯ জুন রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবেলার জন্য রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের আহ্বান জানান। পরদিন লাহোরে জামায়াতের পশ্চিম পাকিস্তান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে দুষ্কৃতকারীরা সক্রিয় রয়েছে। তাদের প্রতিরোধে ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রসজ্জিত হওয়া উচিত।
এই অভিযোগেও তাকে ২০ বছর কারাদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ ৫ (হত্যা ও নির্যাতন) : কুমিল্লার হোমনা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের সিরু মিয়া একাত্তরে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় দারোগা (সাব-ইন্সপেক্টর) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৮ মার্চ তিনি স্ত্রী আনোয়ারা বেগম ও ১৪ বছরের ছেলে আনোয়ার কামালকে নিয়ে কুমিল্লার নিজ বাড়িতে যান। সেখানে সিরু মিয়া শরণার্থীদের ভারতে যাতায়াতে সাহায্য করতেন। ২৭ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে কসবা থানার তন্তর চেকপোস্টের কাছে সিরু মিয়া ও তার ছেলেসহ ৬ জন ভারতে যাওয়ার সময় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। তাদের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে কয়েক দিন নির্যাতনের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। স্বামী-সন্তানের ধরা পড়ার খবর পেয়ে সিরু মিয়ার স্ত্রী গোলাম আযমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সিরু মিয়ার ভগ্নিপতি ছিলেন গোলাম আযমের দুই ছেলে আজমী ও আমীনের শিক্ষক। তিনি গোলাম আযমের কাছে সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে মুক্তি দিতে অনুরোধ জানান। গোলাম আযম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শান্তি কমিটির নেতা পেয়ারা মিয়ার কাছে একটি চিঠি পাঠান, যাতে সিরু মিয়া ও তার ছেলেকে হত্যার নির্দেশ ছিল। চিঠি পাওয়ার পর ঈদের দিন রাতে সিরু মিয়াসহ ৩৯ জনকে পাকিস্তানী সেনারা রাজাকার ও আলবদরদের সহযোগিতায় গুলি করে। সেখানে পাকিস্তানী সেনাদের গুলিতে ৩৮ জন মারা গেলেও একজন প্রাণে বেঁচে যান।
এই অভিযোগে অধ্যাপক গোলাম আযমকে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
সব মিলিয়ে ৫টি অভিযোগে গত বছরের ১৫ জুলাই গোলাম আযমকে যথাক্রমে ১০, ১০, ২০, ২০ ও ৩০ বছরের মোট ৯০ বছরের কারাদণ্ডের রায় দেয় আদালত।
মাত্র ৪৬৫ দিন সাজাভোগ করে বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
http://capitalnewsbd.com/wp-content/uploads/2014/10/Golam-Azom.jpg
Related:
- 1. Muldhara '71 (মূলধারা '৭১ Mainstream '71) by Moidul Hasan, page. 128, footnote. 177. published
- by University Press Limited ]
মানবতাবিরোধী অপরাধী গোলাম আযমের মৃত্যু
__._,_.___