http://www.bkagoj1.com/print-edition/2014/11/12/
'পৃথিবী আমাদের চায়না'
'পৃথিবী আমাকে চায়--' এ গান বা ডায়লগ একদা বাংলায় বেশ জনপ্রিয় ছিলো। অনেকদিন পর ইরানের মেয়ে রিহানার মুখে আমরা উল্টোটা শুনলাম, 'পৃথিবী আমাদের চায়না'। ফাঁসির আগে মায়ের কাঁছে লেখা শেষ চিঠিতে রিহানা লিখেছে, 'কেঁদোনা মা, এই পৃথিবী আমাদের চায়না, তাই বিদায়'। রিহানার অপরাধ, তাকে যে পাষন্ড ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়েছিলো, সেই অসুরের বুকে তিনি সজোরে ছুরি বসিয়ে দিয়েছিলেন। ইরানের ধর্মীয় আদালতে রিহানা সবকথা খুলে বলেন, কিন্তু মোল্লাতন্ত্র সেকথায় কান দেননি। শরিয়া আদালত যেখানে ধর্ষিতাকে পাথর ছুড়ে মারে, সেখানে ওদের কান দেয়ার কথাও নয়। ফলে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন রিহানা। উচ্চতর আদালত সেই রায় বহাল রাখে। ওই ঘটনার সময় রিহানার বয়স ছিলো ১৯। ৮ বছর টানাহেচড়ার পর ১৯শে অক্টোবর ২৭ বছরের রিহানার ফাঁসী কার্যকর হয়।
রিহানা নাই, কিন্তু তার মৃত্যু ইরানের মৌলবাদী সমাজকে একটি ধাক্কা দিয়েছে। বহির্বিশ্বে, বিশেষত: মুসলিম দেশগুলোতে সেই ধাক্কা কিছুটা হলেও লেগেছে। প্রশ্ন উঠেছে, এ কেমন বর্বরতা? এদিকে গত ২০শে জুন তেহরান স্টেডিয়ামে ইরান-ইতালি ভলিবল ম্যাচ দেখার অপরাধে গোন্চেহ গাভামী নান্মী ২৫ বছরের এক যুবতীকে আদালত ১ বছর কারাদন্ড দিয়েছে। পুরুষের খেলা দেখার অপরাধে এ দন্ডের বিরুদ্ধে তিনি আমরণ অনশন করছেন। আবার দেখলাম পাকিস্তান স্কুল এসোসিয়েশনের ডাকে সেখানে 'আমি মালালা নই' দিবস পালিত হয়েছে। এসব কি এবং কেন? এ সময়ে আমরা দেখছি, 'অনার কিলিং'; বোকা হারামের কয়েকশ স্কুলছাত্রী অপহরণ, শ্লীলতাহানি, ধর্মান্তকরণ এবং অত:পর ধর্ষকের সাথে বিয়ে বা ইসলামিক স্টেটের নামে প্রকাশ্যে নারী বেচাকেনা। নারী স্বাধীনতার এ যুগে নারীর প্রতি এ অসন্মান বিবেকবান পুরুষ মেন নেন কি করে? নারী অবলা, দুর্বল, অসহায়, তাই ধরিত্রী বেশিদিন নারীর অপমান সহ্য করেনা। প্রকৃতি আপন নিয়মে প্রতিশোধ নেয়।
রিহানার ধর্ষন প্রচেস্টাকারী তাকে যে পানীয় খেতে দেয় তাতে মাদক মেশানো ছিলো, অর্থাৎ ধর্ষক রিহানাকে মাদকাসক্ত করে তার কামনা চরিতার্থ করতে চেয়েছিলো। আদালতে তা প্রমানিতও হয়, কিন্তু 'চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী'। এ থেকে মোল্লাতন্ত্রে বিচার ব্যাবস্থা আঁচ করতে অসুবিধা হবার কথা নয়! বোঝা যায়, ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে রিহানা রাষ্ট্রের হাতে মরেছেন, ইজ্জত গেলে আরো করুন ভাবে মরতে হতো। ইরান বা মোল্লাতন্ত্রে ধর্ষিতা রমণী বা 'ভিকটিম' দ্বিতীয়বার ধর্ষিত হন রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা! ধর্ষণ সর্বকালে সবদেশেই হয়, প্রশ্ন হলো, ধর্ষিতা বিচার পায় কিনা? পশ্চিমা দেশে ব্যাপক নারী স্বাধীনতা এবং 'ফ্রী সেক্স' হবার পরও ধর্ষণ হয়, কিন্তু এখানে ১শ শতাংশ ভিকটিম বিচার পান। ইরান বা মৌলবাদী রাষ্ট্রে বিচার পাননা, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের দু:শাসন বজায় রাখতে রিহানারা বলি হয়ে যান। বাংলাদেশেও ধর্ষণের বিচারের রেকর্ড অনুজ্জ্বল। পূর্নিমা-রীতা-রহিমা আজো বিচার পায়নি।২০১১-এর হাজারো ধর্ষণ ঘটনার বিচার হয়নি। রাষ্ট্র এই বিচারে আগ্রহী নয়। ধর্ষণ ও শরিয়া আইনের ওপর কানাডার ফাতেমোল্লার একটি ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন যে, এক মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন। গ্রাম্য বিচার বসেছে। ধর্ষক শরিয়া আইন অনুযায়ী ৪জন পুরুষ সাক্ষী দেখানোর দাবি জানালেন। ভিকটিম তা দেখাবেন কি করে? সাক্ষী রেখে কি কেউ ধর্ষণ করে? আসামী খালাস। ফাতেমোল্লা অবশ্য অপরাধীকে ছেড়ে দেননি বরং ধর্ষিতার হাত দিয়েই চূড়ান্ত শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছেন। যেকোন সভ্য সমাজ বা জাতি তাই করবেন। নইলে মানুষ আর জানোয়ারে প্রভেদ থাকলো কই?
এতক্ষণ মহিলাদের পক্ষে সাফাই গাইলাম, এবার একটি ঘটনা বলি: সত্য কাহিনী। নিউইয়র্কে বাঙালী পাড়ায় একটি ছেলে ও মেয়ের মধ্যে অবাধ মেলামেশা অনেকেরই চোখে পড়েছে। একদিন জানা গেলো, মেয়েটি ধর্ষণের অভিযোগ এনেছে, তাই ছেলেটি জেলে। কমিউনিটি মেয়েটির দ্বারস্থ হয়, মামলা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানায়। শেষমেষ মেয়েটি মামলা নিয়ে আর না এগোনোর কথা পুলিশকে জানায়। ছেলেটি ছাড়া পায় এবং বাংলাদেশে চলে যায়। অনেকদিন পর মেয়েটির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, 'আসলে কি হয়েছিলো?' মেয়েটি খোলামেলা বলে, ' আমি স্বেচ্ছায় ওর কাছে যাই, আমরা একত্রে ঘুমাই এবং তারপর পুলিশ ডেকে ওকে ধরিয়ে দেই'। কেন? উত্তরে ও বলেছিলো, 'আমাকে বিয়ে করবে বলে প্রতারণা করেছে।' মেয়েটি ঠিক করেছে না বেঠিক করেছে সেটা প্রশ্ন বটে, কিন্তু এটা ধর্ষণের ঘটনা নয়, প্রতারণার। অথবা এমন ঘটনা আর কয়টি, ধর্ষণ তো অসংখ্য। খুন হলে যেমন রাষ্ট্রের দাযিত্ব খুনির বিচার করা, ধর্ষণের ক্ষেত্রেও তাই। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কার ধর্ষিতা রমণীরাও ন্যায় বিচার পাননি, তবে রিহানার মত রাষ্ট্র তাদের ফাঁসী দেয়নি। এটাই হোক আমাদের আপাতত: স্বান্তনা! এরই মধ্যে পত্রিকায় দেখলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ধর্ষণ, এবং আবার, একই অভিযোগ, বিচার নাই! ধর্ষণ যে খুনের মতই একটি জঘন্য অপরাধ, তা আমরা মানবো কবে? কোথায় যেন পড়েছি, একটি কিশোর একটি মেয়ের সর্বনাশ করেছে। আদালতে বিচার উঠলে, বিবাদী পক্ষ আসামীর বয়স কম, এই অজুহাতে নমনীয় হবার আর্জি জানালে বিচারক বলেন, অভিযুক্ত আসামী যদি ধর্ষণ করতে সক্ষম হন, তবে বিচারের মুখোমুখি হতেও সমর্থ হবেন।
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
নিউইয়র্ক, ১১ নভেম্বর ২০১৪।
__._,_.___