পাকিস্তানে শিশুহত্যা: আমদের শুভবুদ্ভির উদয় হবেকি?
অনেকদিন পর টুনির কথা মনে পড়লো। আশির দশকের মধ্যভাগে রাশিয়া গেলে তিউনিশিয়ার সাংবাদিক 'টুনী'-র সাথে পরিচয় ঘটে এবং দু'তিন সপ্তাহ একসাথে থাকায় বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে। টুনী মোটামুটি সুন্দরী, তখনো অবিবাহিতা, স্কার্ট বা প্যান্ট-শার্ট পরিহিতা, মাথাভর্তি চুল, অনেকটা 'চুল তার কবেকার--' ইত্যাদি। টুনির আসল নাম জাকিয়া --, পরের টুকু মনে নেই-। তিউনিসিয়া থেকে এসেছে বলে ওর নাম হয়ে যায় টুনী। ওর কথা মনে পরার কারণ হলো, নভেম্বরে তিউনিশিয়ায় নির্বাচন ছিলো এবং ওই নির্বাচনে ইসলামপন্থীরা হেরেছে এবং গণতন্ত্র বিজয়ী হয়েছে। টুনির সাথে আর যোগাযোগ নেই, ওর বিয়েতেও যেতে পারিনি। কিন্তু টুনিরা যাতে মার্জিত-শালীন পোশাকে ঘুরে বেড়াতে পারে তৎজ্জন্যে ওদের দেশে গণতন্ত্রের বিজয়ে খুশি হয়েছি।
আমেরিকায় তেলের দাম কমছে তো কমছেই। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। সবাই খুশি। তেলের বাচানো পয়সায় মানুষ বড়দিনের বাড়তি বাজার করছে। বাংলাদেশে কি তেলের দাম কমেছে? জানিনা, এমন কোন সংবাদও দেখিনি। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার সাথে সাথে আমদের দেশেও বাড়ে, কিন্তু কমলে কমেনা। আমাদের দেশে ঈদ বা পূজায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, আমেরিকায় উল্টো, দাম কমে, এখন বড়দিনের মৌসুম, সবকিছুর দাম কিঞ্চিত কম। তেলের হিসাবটা ওরকম না হলেও এবার তাই। হটাত করে তেলের দাম কমার কারণ কি? একজন জানালেন, রাশিয়াকে শাস্তি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের এই ব্যবস্থা। কি রকম? রাশিয়া এক বড় তেল রফতানীকারক দেশ এবং পূর্ব-ইউরোপে রাশিয়ার পাইপ-লাইনেই তেল যায়। দাম কমলে রাশিয়ার রোজগার কমবে। এছাড়াও সৌদি আরব মার্কিন অনুরোধে তেল উত্তোলন বাড়িয়েছে যাতে সরবরাহ বাড়ে ও দাম কমে। যুক্তি মন্দ নয়। তবে, যারা 'তেল দিতে' ওস্তাদ তাদের জন্যে কোন সুখবর নেই, কারণ 'এ তেল সে তেল নয়'। এ সময় মন্ত্রী পরিষদে রদবদলের জোর গুজব রয়েছে, তেলের দাম একটু কমলে তেল মারার পক্ষে সুবিধা হতো। মন্ত্রী বানানোর সর্বময় ক্ষমতা যদিও একজনের হাতে, কিন্তু যত্রতত্র তব্দির চলছে সমানে। মন্ত্রী হতে ইচ্ছুক সবাইকে পরামর্শ দিচ্ছি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর 'তৈল' প্রবদ্ধটি পড়ার জন্যে, তাতে জায়গামত তেল দেয়ার শুভবুদ্ভি উদয় হতে পারে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আরো জবর খবর হলো, যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পর এ ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছে ওবামা ও রাহুল ক্যাস্ট্রো। যদিও কিউবার বিরুদ্বে আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাগ্গা এখনই উঠে যাবে তা মনে হয়না। আর যা হোক, বরফ তো গলছে! জানুয়ারীতে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রথম বারের মত একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট অংশ নিচ্ছেন এবং ওবামা দিল্লি যাচ্ছেন। ফেব্রুয়ারী-মার্চে মোদী বাংলাদেশে যাচ্ছেন বলে কথা শোনা যাচ্ছে। এরমধ্যে খবর বেরিয়েছে, ২০১৬-তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেব বুশ-হিলারী ক্লিন্টন প্রতিদ্বন্দিতার সম্ভবনা উজ্জ্বল। এখনো তারা প্রার্থিতা ঘোষণা করেননি, তবে প্রস্তুতি চলছে। যদি এমন হয়, তাহলে কে জিতবে? বলা মুশকিল, তবে যেই জিতুক, হিলারী হারবে। বাংলাদেশীরা অজানা কারণে হিলারীর প্রতি দুর্বল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: তিনি হয়তো জিতবেন না। নির্বাচন দুই বছর বাকি, ব্যাখ্যাও তাই আপাতত: থাক। এদিকে ইন্টারনেট হুমকির কারণে সোনি পিকচার্স এদের 'ইন্টারভিউ' ছবির প্রকাশনা বাতিল করেছে। ওবামা বলেছেন, 'এটা সনির ভুল সিদ্বান্ত'। সবআঙ্গুল উত্তর কোরিয়ার দিকে, কারণ ছবিটি উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টকে হত্যা ষড়যন্ত্র নিয়ে। ওবামা অবশ্য বলেছেন, হুমকির বিরুদ্ভে যথাসময়ে তারা যথাবিহিত ব্যবস্থা নেবেন।
এবার পাকিস্তান, পৃথিবীর মানচিত্রে একটি জঘন্যতম রাষ্ট্র। অথচ এই রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের দেশের অনেক মানুষের পিরীতির কোন কমতি নেই। ওই নিকৃস্ট রাষ্ট্রে আর একটি নিকৃষ্টতম অপকর্ম হয়েছে। স্কুলে তালেবান হামলায় ১৪৫জনের মৃত্যু ঘটেছে, যাদের বেশিরভাগই বাচ্চা-বাচ্চা টিনেজার। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর নওয়াজ শরিফ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি তালেবানদের নিশ্চিহ্ন করবেন এবং ইতিমধ্যেই মিলিটারী সামরিক অভিযান চালিয়ে তালেবান ও বেসামরিক নাগরিক খতম শুরু করেছেন। সেই ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো হয়েছে যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অত্যন্ত চৌকস! কিন্তু ওরা কোন যুদ্ভে জিতেছে এমন রেকর্ড দেখিনা। তবে পাবলিক মারতে তাদের জুরি মেলা ভার। আর তালেবানদের সাথে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সু-সম্পর্কের কথা কারো না-জানার কথা নয়। সেনা-ছাউনির কাছে বিন-লাদেনের অবস্থান তা প্রমান করে? পাকিস্তানের পক্ষে কি সম্ভব তালেবান নিশ্চিহ্ন করা? সেই সদিচ্ছা কি আছে? শেষপর্যন্ত শুভবুদ্ভির উদয় হলেও তা কি সম্ভব? তাহলে তো 'লোম বাছতে কম্বল উজার হয়ে যাবে'। পাকিস্তানী সরকার বা সেনাবাহিনী এখন তালেবান ছাড়তে চাইলেও কি তালেবানরা চাইবে তাদের ছাড়তে? এরকম হবে না তো যে, 'কমলী তো হ্যাম ছোড় দিয়া, মাগার কমলী হামকো নেহি ছোড়তা'।
গল্পটা এরকম: নদী দিয়ে একটি কম্বল ভেসে যাচ্ছিলো। পাড়ে দু'জন লোক তা দেখে।একজন সাঁতার কেটে কম্বলটি আনতে যায়। পৌঁছেও যায় এবং কম্বল ধরে টানাটানি করতে কম্বল তাকেও জাপটে ধরে। সে তখন কম্বল ছেড়ে দিয়ে আসতে চাইলেও অর্ধ-মৃত ভাল্লুক 'শেষ অবলম্বন' হিসাবে তাকে এমনভাবে জাপটে ধরে যে সে ছুটতে পারছিলো না, বরং স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছিলো। পাড়ে দাড়ানো বন্ধু কিহচ্ছে ঠিক বুঝতে না পেরে কম্বল ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে পরামর্শ দেয়। আধমরা ভাল্লুক কবলিত অসহায় বন্ধু তখন ওই উত্তর দেয়, 'কমলী হামকো নেহি ছোড়তা'। ।
প্রশ্ন হলো, অর্ধ-মৃত তালেবান কি সেনাবাহিনীকে ছাড়বে? পুরো বিশ্ব এখন পাকিস্তানী কোমলমতি শিশুদের মৃত্যুকে কাতর এবং সংবেদনশীল। মোদী ফোন করে যেকোন সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন পাক-প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে। মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানরা কি তা করেছেন? প্রশ্ন হলো: ধর্মান্ধ রাষ্ট্র পাকিস্তানে কি এর চাইতে ভালো কিছু আশা করা যায়? ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র এযুগে অচল। রাষ্ট্র ও ধর্ম পৃথক নাহলে ওই রাষ্ট্র মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য, যেমন পাকিস্তান। এরপরও কি আমাদের পাকিস্তান প্রেম কমবেনা? বাংলাদেশকে 'মিনি পাকিস্তান' বানানোর ষড়যন্ত্র থামবে না? কে যেন বলেছিলেন, 'একজন হিন্দু হওয়া বা একজন মুসলমান হওয়া খুব সহজ, কিন্তু একজন মানুষ হওয়া বেশ কঠিন'। 'আবার তোরা মানুষ হ' এ ডায়লগ কি ভুলবার মত! সেদিন 'আলো আমার আলো' নামক এক বই প্রকাশ অনুষ্টানে বক্তারা সমস্বরে বলছিলেন, এখন দেশে অনুসরণ করার মত মানুষের বড় অভাব। কথাটা সত্য, কিন্তু কেন? কারণ হলো, ধর্মের মূলকথা মানুষকে ভালবাসতে আমরা ভুলে গেছি। মানুষ হতে ভুলে গেছি। তালেবানদের মত আমরাও 'ধর্মের ষাড়' হবার জন্যে উর্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছি। অনেক আগে থেকেই আমরা বারবার বলছি, বাংলাদেশেও পাকিস্তানের ন্যায় ধর্মান্ধতা বাড়ছে, ধর্মীয় গোষ্ঠী শক্তি সঞ্চয় করছে। সময় থাকতে তা ঠেকানো না গেলে পরে পস্তাতে হবে। পরিশেষে, সবাইকে 'বড়দিনের শুভেচ্ছা'।
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
নিউইয়র্ক, ২২সে ডিসেম্বর ২০১৪।
__._,_.___