আগায় আসেন ভাই, আগুন নিভান
১৭ জানুয়ারি আগুনে জ্বলতে থাকা ট্রাকের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদে মানুষ ডেকেছিলেন রতন মিয়া। সেদিন দুপুরে বগুড়া শহরের বাইপাস সড়কের ঝোপগাতি এলাকায় চিনিভর্তি ট্রাকে আগুন দিয়েছিল অবরোধকারীরা। পুড়ে যাচ্ছিল তাঁর কিস্তিতে কেনা কষ্টের ট্রাক। আসলে পুড়ে যাচ্ছিল তাঁর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। তিনি ডেকেছিলেন তাঁর আশপাশের মানুষকে আগুন নেভানোর জন্য। বড় প্রতীকী এই ডাক।
৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে কিছু ঝামেলার আশঙ্কা ছিলই সবার মনে। তবে তার রূপ এত বীভৎস হবে, ভাবেনি বুঝি কেউ। গত ১৫ দিনের অবরোধ-সহিংসতায় পুড়ে মারা গেছেন ২৮ জন মানুষ। সংখ্যা শুধু নয়, এই মানুষদের পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া শরীর আমরা দেখেছি, যা আজীবন তাড়িত করবে অনেককে। মালিবাগের গৃহকর্মী খোদেজা বেগম পুড়ে মরা স্বামী জলিলের মুখও দেখতে পারেননি। পিকেটারের ইটের আঘাতে মারা গেছেন আহত ব্যবসায়ী। নোয়াখালীতে হরতালের দিন টেম্পোতে করে স্কুলে যাওয়ার অপরাধে ইট দিয়ে আঘাত করে স্কুলশিক্ষককে মেরে ফেলা হয়েছে। মিঠাপুকুরে সন্তানকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা অবস্থায় বাসের মধ্যে কয়লা হয়ে গেলেন মা রহিমা বেগম (৬৫) আর তাঁর সন্তান ১২ বছরের রহিম বাদশা। মারা গেছেন যশোরের ট্রাকচালক মুরাদ হোসেন। আগুনে পুড়েছেন লেগুনার মধ্যে থাকা আনসার মোহাম্মদ মনোয়ার। উজিরপুরে পেট্রলবোমায় পুড়ে কয়লা হওয়া ট্রাক-হেলপার সোহাগের দেহ যেন এক দগ্ধ স্থাপত্য। বার্ন ইউনিটে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দগ্ধ ছাত্রী। মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছেন ৭৫ বছরের আবু তাহের বার্ন ইউনিটে, যন্ত্রণায় ছটফট করছে মায়ের কোলে থেকেও পেট্রলে পুড়ে যাওয়া আড়াই বছরের শিশু সাফির। এসএসসি পরীক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম অনিকের রক্তাক্ত মুখ আজ রাজনীতির খেলায় বিক্ষত বাংলাদেশের মুখ।
ঢাকার সঙ্গে স্বাভাবিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সারা দেশের। ট্রেনের ফিশপ্লেট তুলে নেওয়া হয়েছে। বাসে-ট্রাকে-কাভার্ডভ্যানে আগুন। পুড়ছে দোকান। আগুন পণ্যবাহী ট্রাকে। পুলিশের গাড়িতে পেট্রলবোমা। ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত। অবরোধে আটকে গেছে পণ্যবাহী ট্রাক। অবরোধের বিরুদ্ধে দুধ বিক্রেতারা অভিনব প্রতিবাদ করেছেন রাস্তায় দুধ ঢেলে। ঢাকার রাস্তায় মানুষের চলাচল হালকা। চোরাগোপ্তা হামলার ভয়ে ভীত জনপদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ককটেল, ককটেল কলা ভবনের ক্লাসরুমের সামনে। আগুন টেলিভিশন চ্যানেলের গাড়িতে। গাইবান্ধায় পাকা রাস্তা কেটে সড়ক চলাচল বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে, যেমন দেখেছি গত বছর সাতক্ষীরায় জামায়াতের তাণ্ডবে। আর সহিংসতার সব কল্পনাকে ছাড়িয়ে বরিশাল থেকে ঢাকাগামী দুটি লঞ্চে আগুন দেওয়া হয়েছে নদীর ভেতরে গত রাতে। এর নাম শান্তিপূর্ণ অবরোধ নাকি দেশের নিরীহ মানুষের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া? মারা পড়ছেন কিন্তু সব প্রান্তিক মানুষ, কোনো বিশেষ রাজা যাওয়া বা আসায় যাদের খুব বেশি কিছু যায়-আসে না।
দগ্ধ বাংলাদেশের ওপর দাঁড়িয়ে ১৩ জানুয়ারি বিএনপি অনুরোধ করেছিল 'সাময়িক কষ্ট স্বীকার' করার জন্য। ১৫ জানুয়ারি রুহুল কবির রিজভী ঘোষণা করলেন, 'হরতাল সফল, অবরোধ চলবে'। কেমন সফল হরতাল, যেখানে মানুষ আচমকা পুড়ে মরে পেট্রলবোমায়? হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি দেওয়া যেমন কোনো রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকার, সেই কর্মসূচি মানা না-মানাও গণতান্ত্রিক অধিকার। আগুনে পুড়িয়েই কি গণতান্ত্রিক অধিকার কায়েম করতে হবে? সবচেয়ে হতাশ করেছে খালেদা জিয়ার ১৯ জানুয়ারির ভাষণ। তিনি সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ফের। চলছে হরতাল। মাত্রই খবর পেলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবাসে আগুন দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে সরকার সেই ৫ জানুয়ারি থেকে বিরোধীদলীয় নেতার পথে বালু ও ইটের ট্রাক চাপিয়ে, নেতাদের জোর করে হাসপাতালে পাঠিয়ে, গ্রেপ্তার করে তাদের স্বাভাবিক চলাচলের গতি রুদ্ধ করেছে, যা কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অকল্পনীয়। এ কথা ঠিক যে বর্তমান সরকার ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো কোনো বিধ্বংসী কাজ আজও করেনি, কিন্তু প্রধান বিরোধী দলকে ন্যূনতম নড়াচড়া করার সুযোগ না দেওয়া কোনো গণতান্ত্রিক দেশের স্বাভাবিক রীতি নয়। সরকারের ব্যর্থতা এখানেও যে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যাকে সরকার বন্ধ করতে পারেনি। পারেনি আক্রান্ত মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
আজ একদিকে পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ খুন করাকে আন্দোলন বলে চালানো হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে নাশকতা করতে দেখলেই গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমন দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতেও জনগণ বিভক্ত। তাঁরা সমস্বরে এমন নিন্দনীয় ঘটনার প্রতিবাদ করতে নামছেন না রাস্তায়। অতীতের অভিজ্ঞতায় তাঁরা বোধ হয় জানেন, তাঁদের প্রতিবাদের ফলাফল কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের পকেটে যায়, তাঁদের খুব কাজে আসে, এমন নয়। এদিকে সহিংসতা বন্ধ করতে আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন। সেই পুনরাবৃত্ত দেশীয়-অান্তর্জাতিক রাজনীতি। জনপরিসরে, টক শোতে দ্বিধাবিভক্ত দেখি কার মানবাধিকার নিয়ে তাঁরা সোচ্চার হবেন, সে প্রসঙ্গে। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া কয়লা কঙ্কালের, নাকি পেট্রলবোমার ধারকবাহকদের জীবনের? এটা কোনো অপশন হতে পারে না। এই রাজনীতি বন্ধ হোক।
খালেদা জিয়া দাবি করেছেন, এ ঘটনা সরকার নিজে করে বিএনপির ওপর দায় চাপিয়েছে। ফলে যারা এমন সহিংসতা করছে, তাদের ধরে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তিনি করতেই পারতেন। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী গতকাল সংসদে বিএনপির নেতা খালেদা জিয়াকে মানুষ পুড়িয়ে সরকারের ওপর দায় চাপানোর জন্য দায়ী করেছেন। যেহেতু, দাবি অনুযায়ী কোনো পক্ষই দায়ী নয় এই মানুষ পোড়ানো উৎসবের, তাই তারা অন্তত একবারের জন্য একজোট হয়ে পেট্রলবোমা ছুড়ে জীবন ও জীবিকা শেষ করা 'দুর্বৃত্ত'দের কঠিনতম শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে কি একমত হতে পারেন না? পারেন না এই অবস্থার অবসান ঘটাতে? চাইলেই পারেন, কিন্তু না পারার ব্যাপারে তাঁদের অটল অবস্থান ভীতিকর।
তাহলে কি মুক্তি নেই? এক পথে আছে বৈকি, যদি জনগণ রাস্তায় নামে। যদি তারা বিএনপিকে বুঝতে দিতে পারে যে একজন নেতা-কর্মী রাস্তায় নেই অথচ রাস্তায় যাত্রীবাহী গাড়ি পুড়িয়ে জনগণকে ত্রাসের মধ্যে রাখাকে আন্দোলন বলে না, এই রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করা হলো। দেখে মনে হয়, বিএনপি ভুলে গেছে কী নিয়ে তারা আসলে আন্দোলন শুরু করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে, যা অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে ২০০৭ সালে, যে বিচ্যুতির ধারাবাহিকতায় এ দেশের সমূহ রাজনীতি কারাগারে নিিক্ষপ্ত হয়েছিল। তার পরও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন হতেই পারে, কিন্তু আন্দোলনের ভাষা পাল্টাতে হবে। অন্যদিকে, সরকারকে বুঝিয়ে দিতে পারেন যদি জনগণ যে মৃত্যু ও ধ্বংসকে সামাল দিয়ে জীবন-জনপদ রক্ষার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন শক্তিরই কাজ, সেই কাজে ব্যর্থতার দায় সরকার এড়াতে পারে না। অথচ এসব কথা বলার মতো জনগণের মুখপাত্র কোনো রাজনৈতিক শক্তি আপাতত দৃশ্যপটে নেই। এই সময়ে বাম গণতান্ত্রিক শক্তির প্রভাবশূন্য রাজনীতি অন্যতম সংকটের জায়গা হয়ে উঠেছে। ফলে প্রািন্তক মানুষকে হত্যা-খুনের জবাবদিহিহীন রাজনীতি লাগামহীন হয়েছে।
কিন্তু এই ২৮টি দগ্ধ মৃতদেহের দায় কাউকে না কাউকে তো নিতেই হবে। কেউ না কেউ, কারও না কারও হুকুমে পুড়িয়েছে বলেই মানুষগুলো পুড়ে মরেছেন। দায় নিতে হবে হরতাল-অবরোধে দগ্ধ শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, এনজিও কর্মী, সিএনজিচািলত অটোরিকশাচালক, রিকশাচালক, বাসচালকের সহকারীসহ যাঁরা আছেন বার্ন ইউনিটে, প্রত্যেকের। দায়িত্ব নিতে হবে দেশটির ক্রমাগত বার্ন ইউনিটে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াটির।
কে দেবে ডাক? যখন বিদ্যমান সব রাজনীতি এই মানুষ পোড়ানো রাজনীতি থামানোর কোনো লক্ষণ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে, তখন প্রতিরোধের ডাকটি বুঝি শোনা গেল কেবল ওই ট্রাক পুড়ে যাওয়া রতন মিয়ার গলায়, 'আগায় আসেন ভাই, আগুন নিভান'। তাঁর ডাকটিই পৌঁছে যাক সবার কাছে—দেশ জ্বলছে, মানুষ পুড়ছে, 'আগায় আসেন ভাই, আগুন নিভান'।
কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি, ২০১৫ ১৩:৫৩:১৪ |
অবরোধের আগুনে প্রাণ গেল আরেকজনের
বরিশাল প্রতিনিধি, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 2015-01-18 10:34:19.0 BdST Updated: 2015-01-18 12:40:29.0 BdST
সংসদ এলাকায় বাসে আগুন, ইডেন ছাত্রী দগ্ধ
নিজস্ব প্রতিবেদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 2015-01-18 15:29:31.0 BdST Updated: 2015-01-18 18:56:56.0 BdST
বিএনপির অবরোধের মধ্যে এবার জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় দিনে-দুপুরে একটি বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে আগুন দেওয়া হয়েছে, যাতে আহত হয়েছেন ইডেন কলেজের চার শিক্ষার্থী।
__._,_.___