সুচিত্রা সেন সাতচল্লিশে যেমন। তেমনি এখন। বাংলা চলচ্চিত্রের মহারানী সুচিত্রা সেন।
বাংলা চলচ্চিত্রের ভা-ারে তাঁর ছবির সংখ্যা তিপ্পান্ন। আর হিন্দীতে সাত। সব মিলিয়ে ষাট। চরিত্র চিত্রনে তাঁর অনায়াস অভিনয় নৈপুণ্য দর্শক হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। আজও যায়। কাহিনীর বৈচিত্র্যে, অভিনয় পারঙ্গমতায় তিনি অর্জন করেছেন সময় ও কাল ছাপিয়ে বাঙালী নারীর মোহনীয় রূপটি। আজও তাই অধরা-চির প্রেয়সীর আসনে তাঁর ঠাঁই। তিনি চিরযৌবনা, স্বপ্নকাতর বাঙালী যুব মানসের স্বপ্নের রানী। আমাদের সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই বলি না কেন, তিনি এই জনপদ পাবনার মেয়ে। পাবনার ভূমি-কন্যা।
সুচিত্রার বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত। মা ইন্দিরা দাশগুপ্তা। বাবা ছিলেন পাবনা মিউনিসিপ্যালিটির স্যানিটারি ইনস্পেক্টর। পরে কর্ম-যোগ্যতায় পদোন্নতি পেয়েছিলেন হেডক্লার্ক হিসেবে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে হেড ক্লার্ক পদে কর্মরত থাকাবস্থায় অবসর গ্রহণ করেন। ২৭ মে তারিখে অনুষ্ঠিত পাবনা মিউনিসিপ্যাল কমিটির সভার সিদ্ধান্ত থেকে এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। করুণাময় ও ইন্দিরা দম্পতির সন্তান সংখ্যা আট। প্রথম দু'জন ছেলে। নিতাই আর গৌর। এর পর পাঁচ মেয়ে। এরা হলেন উমা, রমা, মীনা, লীনা ও রুনা। শেষোক্তজন ছেলে। নাম গৌতম। নিতাই আর গৌর পাবনায় প্রাথমিক শিক্ষার পাট চুকিয়ে পড়তে গিয়েছিলেন শান্তি নিকেতনে। আশির দশকে, সুচিত্রা সেনের গৌরবগাথা যখন মধ্য গগনে এবং পাদপ্রদীপের আলো থেকে নিজেকে আড়াল করে নিলেন তিনি তখন, অভিভাবক হিসেবে তাঁর মেজদা গৌর তাঁর বাড়িতে এসে থাকতেন।
দিবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ের সুবাদে রমা দাশগুপ্তার হয়ে যান রমা সেন। তখন দিবানাথরা থাকতেন ৩২ বালিগঞ্জ প্লেসে। রমার শ্বশুরের প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ভাই বিমল রায়। মামাশ্বশুর বিমল রায় রমাকে সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। বর্ধিষ্ণু পরিবারের রাশভারী গৃহকর্তা আদিনাথ সেনের অনুমতি তো চাই। একদিন রমাই বললেন তাঁর শ্বশুরকে। শ্বশুর মত দিলেন। দিবানাথ-রমা যাত্রা শুরু করলেন স্টুডিও পাড়ায়। ফিল্মে পা দিয়ে বিবাহিতা রমা সেনের নামটাও পাল্টে যায়। সাত নম্বর কয়েদির পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্তের সহকারী নীতিশ রায় রমার নাম দেন সুচিত্রা। রমা সেন থেকে সুচিত্রা সেনে উত্তরণ ঘটে পাবনার এই মেয়ের। এর আগেও রমা অভিনয় করেছিলেন 'শেষ কোথায়' ছবিতে। কিন্তু ছবিটা আর মুক্তি পায়নি। ১৯৫০-৫১'র দিকে শুরু হওয়া 'এ্যাটম বোম' ছবিতে এক্সট্রার রোলও করেছেন তিনি। তবুও, চলচ্চিত্রে তার নায়িকা হিসেবে অভিষেক ঘটে ঐ 'সাত নম্বর কয়েদী' ছবিতেই। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ ফেব্রুয়ারি।
পাবনার এক বিখ্যাত উকিল জগদীশচন্দ্র গুহ। এঁদের বাড়িটি ছিল আজকের পাবনা অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির লাগোয়া পূর্বে। উত্তরে-দক্ষিণে দুটো বাড়ি। একটি গুহ ভিলা। অন্যটি গুহ ভবন। গুহ ভিলাটি ছিল দোতলা। এখানেই পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন গুহ বাবু। এঁর ছেলে অমল গুহ পিনু, শ্যামল কৃষ্ণ গুহ, আর মেয়েরা হলেন রেবা গুহ, রেখা গুহ মিনা, কৃষ্ণা আর শিলা। গুহ বাবুর এক বোন ছিলেন চায়না। রেখার সমবয়সী। এই রেখা গুহ মিনার সঙ্গে কথা বলছিলাম ২১ অক্টোবর সন্ধ্যার পর। দেড় ঘণ্টারও বেশি সে আলাপচারিতা চলে।
পুরনো দিনের নানা স্মৃতি চর্চায় জানা গেল আমাদের মেজ বোন সারা ছিলেন তাঁরই সহপাঠী। সেজ বোন ড. সফুরা নবী তাঁর এক বছরের জুনিয়র। এটা পাবনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াকালীন। সুচিত্রা সেন-স্কুলের নাম ছিল যার কৃষ্ণা দাশগুপ্তা- তিনি ছিলেন বড়দি রেবার সহপাঠী। ঘনিষ্ঠ বান্ধবীও। রেখা একবার ডাবল প্রমোশন পেয়ে ধরে ফেলেন ওদের সঙ্গ। পাবনার আরেক প্রখ্যাত উকিল খান বাহাদুর আব্দুল আজিজ খানের বড় ও মেজ মেয়ে ইরানী ও তুরানি দিও ছিলেন তাদের সহপাঠী। কৃষ্ণার ডাকনাম ছিল রমা। বড়দি'র বান্ধবী জন্য ওঁকে আমরা রমাদি বলেই ডাকতাম। তখন মুসলমান বাড়ির মেয়ের সহপাঠি ছিল হাতে গোনা। ওরা সবাই রীতিমতো বোরখা পড়ে স্কুলে আসতেন। আমাদের মতো হেঁটে হেঁটে আয়ার পিছু পিছু নয়। টমটম গাড়ির ঘেরা দেওয়া আব্রুর মধ্য দিয়ে তারা যাতায়াত করতেন। স্মৃতিচারণায় সেকালের নানা কথাই উঠে আসে। রমার ছাত্রী জীবন, সাংস্কৃতিক কর্মকা-, বিয়ে এবং আটত্রিশ বছর পরে রমার সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার প্রসঙ্গ। রমা মিনা চৌধুরীদের চেয়ে একটু বেশিই ডাগর ছিলেন। যদিও পড়াশোনায় নয়। মহাকালী পাঠশালা থেকে ওখানে গিয়ে ভর্তি হন রমা। মিনা সেই তৃতীয় শ্রেণী থেকে। রমার সঙ্গে সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণীতে এক সঙ্গে পড়েছেন মিনা ও তার বড়দি রেবা গুহ (অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, বর্তমানে সোদপুরে)। সমবয়সী হিসেবে রেবাদির সঙ্গে রমার ঘনিষ্ঠতা একটু বাড়াবাড়ি রকমের ছিল। মিনা চৌধুরীর ভাষায়, আমরা প্রতিদিনই প্রায় বিকেলে খেলাধুলার জন্য যেতাম দিলালপুর মহল্লার চৌধুরীদের বাড়িতে। বিশাল আঙিনায় বৌচি, এক্কা দোক্কা খেলা করতেন। বাড়ি থেকে রেবাদি, চায়না পিসিসহ বেড়িয়ে যেতেন রমাদিদের বাড়িতে। রমাদির বের হতে সময় লাগত বেশি। শাড়িটা আবার পড়া বা টিপটা বদলে বদলে কপালে লাগান এসব নিয়ে। দল বেঁধে টেকনিক্যাল স্কুলের সামনের রাস্তা ধরে পূর্বে চৌধুরীদের বাড়ির দিকে। পথে আরেক সহপাঠী যোগ দিতেন তাদের সঙ্গে। চৌধুরীদের বাড়িতেও ছিল সহপাঠী রেজিয়া। ও বাড়ির বড় ছেলে রওশনজান চৌধুরী বিকেলে পাবলিক লাইব্রেরির উদ্দেশে না বের হওয়া পর্যন্ত সবাই হৈচৈ করতেন বান্ধবীর ঘরে। উনি বেরিয়ে গেলেই শুরু হত খেলাধুলা। রেখা গুহ মিনার মিনা চৌধুরীতে রূপান্তরের কাহিনীর সূত্রপাত ঘটেছিল এভাবেই। রমাদিরা ছুটিছাঁটায় বেশ ঘুরতেন। ভ্রমণ ছিল ওদের পরিবারে নৈমিত্তিক বিষয়। বড়দাদের জন্য শান্তি নিকেতন তো ছিলই। কলকাতাতেও ছিল অনেক আত্মীয় স্বজন। এক পিসে মশাই ছিলেন হাইকোর্টের বিচারপতি। আত্মীয় বাড়িতে ঘোরাঘুরির একদিন রমাদি দিবানাথ বাবুর চোখে ধরা পড়েন এক ট্রামে। দিবানাথ বাবু ট্রাম থেকে পিছু নিয়ে রমাদির পিসে মশাই-এর বাড়ি দেখে যান। সে যাত্রা কনে দেখা ও আশীর্বাদে। সেবারে কলকাতা থেকে রমাদি ফিরে আসেন দিবানাথ বাবুর বাগদত্তা হয়ে। সাতচল্লিশে যখন রমাদি নবম শ্রেণীর ছাত্রী, তখন বিয়ে হয় রমাদির। পাবনায়। স্কুলে তার সহপাঠীরাও বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিলেন দুপুরে। দলবেঁধে স্কুল থেকে। গায়ে হলুদ হয়ে গেছে। বধূর সাজে রমাদির সে ছবিটি আজও ভাসে মিনা চৌধুরীর চোখে। অনেক রাতে বিয়ের লগ্ন থাকায় অনেকেই উপস্থিত থাকতে পারেননি। বিয়ের পর বরকে নিয়ে মাঝে মাঝেই রমাদি পাবনায় নাইওরে এসেছেন। ঈশ্বরদী থেকে বিশ্বাস কোম্পানির বাসে চেপে পাবনা শহর। সেখান থেকে রিকশায় বাপের বাড়ি। পথে জগদীশচন্দ্র গুহর বাড়ি। রিকশা থামিয়ে জামাইসহ রমাদি সটান ঢুকে পড়তেন তাদের বাড়িতে। জ্যাঠা মশাইকে প্রণাম করে, জামাইকে পরিচয় করিয়ে দিতেন। অন্দর মহলে তখন জামাইয়ের জন্য সাজ সাজ রব। এদিকে রেবাদির সঙ্গে চলত নানা ফিসফিসানি। হাসাহাসি। বিয়ের পরও রমাদি স্কুলে গিয়েছেন সহপাঠীদের সঙ্গে মোলাকাত করার জন্য। শিক্ষিকাদের প্রণাম করার জন্য। পরে হয়ত সাংসারিক ব্যস্ততায়, বিশেষ করে মুনমুনের জন্মের কারণে আর পাবনায় আসা হয়ে ওঠেনি। দেশ বিভাগের কারণও থাকতে পারে। সেটা তখন বোঝা যায়নি।
ডাক্তার মিনা চেধুরীর কথার সূত্র ধরে বর্তমানে রাজশাহীতে বসবাসরত আমাদের মেজবোন সারা আহমদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানা গেল, রমা ছিল আলট্রা মডার্ন। পোশাকে আশাকে। ওর আচরণ ছিল সপ্রতিভ। স্মার্টনেস ওর প্রতিটি আচরণে। তখন তো মুসলমান মেয়েরা পড়ালেখায় অত এগিয়ে আসেনি। আর স্কুলের যত ফাংশন সেখানে লিড দিত রমাই। ঢাকায় বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআই আবু) থেকে পরিচালক হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত ডক্টর সফুরা নবীর সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানা গেল আরও কিছু তথ্য। স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রমাদিই ছিলেন সর্বেসর্বা। কি নাচের তালিম, গানের রিহার্সেল সর্বত্রই রমাদির নেতৃত্ব। অনুষ্ঠানটা কেমন করে আগের বারের চেয়ে আকর্ষণীয় হবে- এমন সব বুদ্ধিও বের হতো ওর মাথা থেকেই। আবৃত্তিতেও রমাদির কুশলতা ছিল সাবলীল। এক ক্লাস উপরে পড়া রমাদি সেই তখন থেকেই অর্জন করেছিলেন নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা। নাচ-গান-আবৃত্তি-অভিনয়-এসবের জন্য বছরে তাঁর পুরস্কার ছিল বাঁধা। ডক্টর নবী জানালেন রমা অর্থাৎ সুচিত্রাদির বিয়েটা ছিল পাবনার টক অব দা টাউন। কারণ জানতে চাইলে তিনি জানালেন, সুচিত্রার বিয়েতে কোন 'বরপণ' দিতে হয়নি। আদিনাথ সেন এসব পছন্দ করতেন না। তাছাড়া কলকাতা থেকে যত বরযাত্রী এসেছিলেন পাবনায়-তাদের যাতায়াত পাবনায় থাকা ও খাওয়ার যাবতীয় বন্দোবস্ত আদিনাথ বাবু নিজের ব্যয়ে নিজের উদ্যোগে করেছিলেন। পণ না নেবার মানসিকতা ও সাহসিকতাই ছিল-টক অব দা টাউন, জানালেন তিনি।
ডাক্তার মিনার সঙ্গে রমাদির আবার দেখা হয় ১৯৮৬-এর নবেম্বরে। বড়দা অমল গুহ তখন লেক টাউন প্রজেক্টের ডিরেক্টর। রমাদির জন্য ছোটবেলায় পক্ষপাত ছিল কিছুটা। কলকাতায় এসেও পূর্ব পরিচিতির রেশটা মিইয়ে যায়নি। অমলদার চেষ্টায় দেখা হয় রমাদির সাথে। রাতে গাড়ি থেকে নেমেই রমাদির উষ্ণ আলিঙ্গনে বাঁধা পড়েন ডাক্তার মিনা। সঙ্গে বৌদি সুস্মিতা গুহ। বাচ্চা-কাচ্চা। ছোট বোন। এমন এক দঙ্গল লটবহর। আসলে ওরা তো বিশ্বাসই করতে চায়নি, সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিল বা আছে। গল্পে গল্পে আপ্যায়নে আড়াই ঘণ্টা কেটে গেলে বিদায় নেন ডাক্তার মিনা। এর মধ্যে কুড়ি বছরেরও বেশি সময় বাইরে বাইরে কাটিয়েছেন তিনি। আবার দেখাও হলো কমবেশি চল্লিশ বছরের ব্যবধানে। কলকাতার নিউ থিয়েটার্সে পাবনার অনেক মানুষ কাজ করেছেন। এদের কাছ থেকেই রমাদি পাবনার পরিচিত মানুষদের খোঁজ খবর নিয়েছেন প্রতিনিয়ত। জন্মভূমির টান বলে কথা। কেন পর্দার আড়ালে অন্তরালবাসিনী? এমন প্রশ্নের জবাবে খুবই সাধারণ আটপৌঢ়ে জীবন যাপনকারী সুচিত্রার সাফ জবাব, দর্শক হৃদয়ে আমি নায়িকা হয়েই বেঁচে থাকতে চাই। স্বপ্নের রানী হয়ে।'
__._,_.___