অবরোধের আভিধানিক অর্থ বেষ্টিত করে রাখা। চলতি ভাষায় বলা যেতে পারে ঘেরাও। খালেদা জিয়া যখন তাঁর অনুসারীদের নির্দেশ দিলেন লাগাতার অবরোধের, তখন বেশ আশ্চর্য হয়েছিলাম। বিএনপির গত বছরের আন্দোলনে বেশি মানুষের অংশগ্রহণ দেখিনি। দেখেছিলাম নওজোয়ানদের তাণ্ডব। অবরোধ করতে গেলে তো অনেক মানুষ লাগবে এবং তাদের হতে হবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। খালেদা জিয়ার অবরোধ ঘোষণার সময় তারেক রহমান একটি নির্দেশ দিয়েছিলেন যেটির কথা কারো মুখে এখন শুনছি না। নির্দেশটি ছিল দেশের এক অংশ থেকে আরেক অংশ বিচ্ছিন্ন করে ফেলার। বিষয়টি আরো জটিল। দেশের এক অংশ থেকে আরেক অংশ বিচ্ছিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করলে সরকারের বাহিনী বেষ্টন করা মানুষদের সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করবে অবশ্যই। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জেগেছিল, বিএনপির এত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমর্থক আছে কি, যারা পুলিশের হস্তক্ষেপ ভণ্ডুল করে দিতে পারবে? মনে মনে ভেবেছিলাম, দেখা যাক কী হয়?
দেখলাম, ৫ জানুয়ারি তেমন কিছুই ঘটল না। যেটা ঘটল, সেটা হচ্ছে খালেদা জিয়া নিজেই অবরুদ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি ও তাঁর সমর্থকরা সরকারকে দোষারোপ করলেন খালেদা জিয়াকে অবরোধের শিকার বানানোর জন্য। এটা একটা মজার ব্যাপার। তিনি কার্যালয়ে অবরুদ্ধ। কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন দলের নেতারা। প্রচুর খাদ্য হাতে দেখা করতে আসছেন দলের মহিলা নেতারাও। এক বন্ধু বললেন, 'নেত্রীর জন্য খাবার আনার লোক তো অনেক রয়েছে, কিন্তু বাসে পোড়া মানুষদের পরিবারকে খাওয়ানোর কেউ নেই।' কেমন আমাদের রাজনীতি! বামপন্থীরা হয়তো বলবেন, 'শ্রেণিস্বার্থের ব্যপার।' তাঁরা সবাই নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে মুখ বন্ধ করে নত মস্তকে চলে যাচ্ছেন না। তাঁরা নেত্রীর সরকারবিরোধী বক্তব্য সবিস্তারে সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের বলছেন। নিজেদের কড়া কড়া কথাও বলছেন। এ কেমন অবরোধের ব্যবস্থা সরকার করেছে! সরকার বলছে, তারা অবরোধের আয়োজন করেনি। বেশ মজার ব্যাপার। কাগজে বেরিয়েছে যে খালেদা জিয়া সোফায় শুয়েছেন। তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এভাবে শুয়েছেন শুনে অনেকের চোখ নিশ্চয়ই অশ্রুসিক্ত হয়েছিল। কিন্তু তাঁর এই দুর্ভোগের কারণ 'টাইমিংয়ের ভুল'। কার্যালয় থেকে বাড়ি ফিরে তারপর অবরোধের ঘোষণা দেওয়া উচিত ছিল। যাক, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কার্যালয়ে বিছানার ব্যবস্থা করা উচিত।
তবে বিএনপির মহিলা কর্মীদের নিয়ে আসা খাবারগুলো সরকারের জন্য একটা সম্ভাব্য সমস্যা হতে পারে। এই খাবারগুলো খেয়ে যদি খালেদা জিয়ার পেট খারাপ হয়, তবে কেউ কেউ হয়তো বলবে যে আওয়ামী লীগ কিছু করেছে। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। এসব মহিলা কর্মীর মধ্যে যিনি সবচেয়ে ভালো খাবার নিয়ে আসবেন নেত্রীর জন্য, তিনিই হবেন খাদ্যমন্ত্রী, বিএনপি ক্ষমতায় এলে। পত্রিকায় দেখলাম, প্রবাসী ৪০ জন তারেক রহমানকে টাকা জোগাচ্ছেন। তাঁদের নামগুলো জানতে পারলে মনে রাখার মতো হতো। বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে তবে দেখতে হবে তাঁদের কে কী সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। তখন বুঝতে হবে যে তাঁরা তাঁদের টাকার 'গুড ইনভেস্টমেন্ট' করতে জানেন। আর যাঁরা কোনো সুযোগ-সুবিধাই নেবেন না কিংবা পাবেন না, চিন্তা করে দেখতে হবে যে তাঁরা কি নিঃস্বার্থ, না টাকা ভালো করে ইনভেস্ট করতে জানেন না! যাই হোক না কেন, নাম জানা থাকলে তাঁদের কাছে চাঁদা চাওয়া যেতে পারে। যদি চাঁদা না দেন তাহলে বলা যেতে পারে যে আপনি শুধু নেতাদের পয়সা দেন। ঠিক আছে, আমরা নেতা হওয়ার চেষ্টা করব। রিয়াজ রহমানকে কে বা কারা গুলি করেছে। আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপির লোকরা করেছে। কেউ কোনো প্রমাণ এখনো খাড়া করতে পেরেছে বলে জানি না। তাঁর ও তাঁর পরিবারের জন্য দুঃখ লাগে। যাঁরা অবরোধের শিকার হচ্ছেন, আহত বা নিহত হচ্ছেন তাঁরা নেতা নন, তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা রইল।
বিএনপির গত আন্দোলন ব্যর্থ হলে বলা হয়েছিল, ঢাকায় আন্দোলন-সংগঠন ওভাবে জোরদার হয়নি বলেই এমনটা হয়েছিল। এ জন্য খোকাবাবুকে দোষারোপ করা হয়েছিল। মির্জা আব্বাসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ঢাকা সংগঠিত করার। কিন্তু এবারও ঢাকায় আন্দোলন (জ্বালাও-পোড়াও) শক্তিশালী হলো না। তাহলে কী হবে? আব্বাস কি চাকরি হারাবেন? খোকাবাবু কি স্বেচ্ছানির্বাসন ছেড়ে সগর্বে দেশে ফিরবেন? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ফিরে কী করবেন?
একটি পত্রিকায় দেখলাম, খালেদা জিয়া আবার দুঃখ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অনেকেই নিষ্ক্রিয়। এই নেতাদের প্রতি আমাদের সমবেদনা হয়। যদিও আমাদের দেশে ভুঁইফোঁড় নেতাদের অনেকেই শ্রদ্ধা করেন তবু নেতা হতে তাঁদের কিছু সময় লাগে। তাঁদের বয়স বাড়ে। খালেদা জিয়ার নির্দেশে যে আন্দোলন হচ্ছে, তার প্রধান কর্মটি হচ্ছে বাস পোড়ানো। এসব কাজ কোন বয়সের লোকরা করতে পারে? যাঁরা বিএনপির নেতা হয়েছেন তাঁরা আর কিশোর নেই। তাঁরা বাস পোড়াতে যেতে পারেন না কিশোরদের সঙ্গে মিলে। কাজেই বাস পোড়ানোর এই মহোৎসবে তাঁরা বিভ্রান্ত। কী করে নেত্রীকে দেখাবেন তাঁরা উৎসাহী হয়ে কিছু একটা করছেন।
৫ জানুয়ারির আগে দু-একটি পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, এই আন্দোলন বিএনপির বাঁচা-মরার লড়াই। তাই যদি হয় তবে এই আন্দোলনে আওয়ামী লীগকে হটাতে না পারলে কী হবে বিএনপির? সবচেয়ে বড় কথা, কী হবে 'ম্যাডামের'? তাঁর ও তাঁর দলের নিয়তি একই সূত্রে গাঁথা। তিনি কি প্রবাসে বসবাসরত দুই ছেলের কাছে চলে যাবেন? নাকি আবার চেষ্টা করবেন? কী করবেন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান? ব্যাধি দীর্ঘায়িত করে প্রবাসে থেকে যাবেন? কী করবে জামায়াত? তাদের সম্পর্কে তো নানা কথা শোনা যাচ্ছে। কী হবে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের?
আর যদি বিএনপি ক্ষমতায় যায় তাহলেই বা কী হবে? জনগণ আগে কিছু পায়নি। এবার কি কিছু পাবে? জামায়াতের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানোর জন্য যুদ্ধাপরাধীদের কি ছেড়ে দেবে? সে ক্ষেত্রে বিরাট ঝামেলার আশঙ্কা।
লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো
- See more at: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2015/01/20/177437#sthash.ZnNZdidy.dpufঅবরোধ চলবে: খালেদা
এই মুহূর্তে অন্য কোনো কর্মসূচির চিন্তা নেই, বলেছেন বিএনপি চেয়ারপাসন।
http://bangla.bdnews24.com/politics/article912530.bdnews
__._,_.___