SitangshuGuha 646-696-5569
অভিজিত হত্যা: জাতি আর কত লাশের ভার বইবে?
অভিজিত রায়-কে ঢাকায় টিএসসি'র মোড়ে বৃহস্পতিবার ২৬শে ফেব্রুয়ারী ২০১৫ রাত সাড়ে ৯টায় অজ্ঞাতনামা দুস্কৃতিকারীরা উপর্যুপরি ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা গুরুতর আহত হয়েছেন এবং তার একটি আঙ্গুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পুলিশ বলেছে, কতিপয় অপরিচিত যুবক ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাকে আক্রমন করেছে এবং তারা দু'টি চাপাতি, একটি কাটা আঙ্গুল ও একটি ব্যাগ উদ্ভার করেছে। ঢাকার পত্রপত্রিকায় ছাপা হওয়া এ ধরনের সংবাদ নুতন কিছু নয় বরং কতকগুলি শব্দ যেমন, 'অজ্ঞাতনামা' বা 'চাপাতি' ইত্যাদি বহুল ব্যবহারে অনেকটা ভোতা এবং এই শব্দগুলো কেবল পুলিশের ডিকশেনারিতেই পাওয়া যায়!
অভিজিত মার্কিন নাগরিক। গতরাতে আমরা এ হত্যাকান্ড নিয়ে অনেকে একসাথে কথা বলছিলাম। কেউ কেউ বলতে চাইলেন, মার্কিন নাগরিক হিসাবে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কিছু করার আছে কিনা? আমরা তদন্তের দাবি করতে পারি কিনা? মতামত হিসাবে যা বেড়িয়ে আসে তা হলো, দাবি তো আমরা করতেই পারি এবং অনেকেই তা করবেন। আজ ২৭শে ফেব্রুয়ারী শুক্রবার আমি নিজেই ওয়াশিংটনে কল দেই, প্রথমে ধরেন শ্রীলংকা ডেস্কের মি: রায়েন। ইতিমধ্যে তারা ঘটনা জেনে গেছেন, তিনি বললেন, আমি বাংলাদেশ ডেস্কের নই, তবে আমরা অবহিত এবং এটা অত্যন্ত দু:খজনক। এরপর তিনি আমায় বাংলাদেশ ডেস্কে দিবেন বলে বিদায় নিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই কল এলো, মি: গিলবার্ট মর্টন জানালেন, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ইতিমধ্যেই একটি স্টেটমেন্ট দিয়েছে। ৩১সেকেন্ডের ওই স্টেটমেন্ট শুনলাম। তাকে বলেছি, স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর তদন্ত করা উচিত। তিনি গভীর দুখ ও সমবেদনা জানালেন। পরে প্রতিদিনের প্রেস ব্রিফিং-এর বক্তব্য শুনলাম, এতে আরো বলা হয়েছে, 'চাইলে আমরা তদন্তে সহায়তা করবো'। প্রায় একই সময়ে মিডিয়ায় দেখলাম, এফবিআই তদন্ত করবে। ইন্টারনেটে দেখলাম বিভিন্ন বাংলাদেশী মার্কিন গ্রুপ তাদের কংগ্রেসম্যান, স্থানীয় প্রশাসন, বা মার্কিন প্রশাসনে আর্জি পৌছাবেন বলে জানাচ্ছেন এবং অন্যদেরও তা করার অনুরোধ করছেন।
সদ্য অভিজিতের একটি ই-মেইল হাতে এলো, এক বছর আগের এই ই-মেইলে তিনি জনৈক জামাতী ফারাবী সাফিয়ুর রহমান তাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে বলে জানান এবং এ বিষয়ে একটি তদন্ত চান। সাথে তিনটি লিংক দেন যাতে তার বই বিক্রী না করার হুমকি, রকমারি ডট কম -এ তার বই বিক্রি বন্ধ এবং জনৈক ইসলামী মৌলবাদীর হুমকির কথা স্পষ্টভাবেই উল্লেখ আছে। এসবই মার্চ ২০১৪-এর কথা। মাত্র এক বছরের মাথায় তিনি খুন হলেন। ওই চিঠিতে অভিজিত নিজেকে মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা মডারেটর, বিজ্জান লেখক ও একটিভিস্ট হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং তিনি একই সাথে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ও বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য চেয়েছিলেন, আমার জানা নেই ওই চিঠি যথাস্থানে পৌছেছিল কিনা। অভিজিতের চিঠিতে রাজীব হত্যার প্রসঙ্গ আছে এবং তার অভিযুক্ত বিবাদী জামিনে আছেন তাও জানা যায়। মিডিয়া অভিজিত, রাজীব ও হুমায়ুন আজাদের ওপর চাপাতি আক্রমনের সাদৃশ্যও তুলে ধরেছে। কিন্তু এখন আর এসব বলে কিহবে, 'যাবার যেজন চইল্যা গেছে'।
আমরা কি এদের বাঁচাতে পারবো না? এরা করা? এরা একগ্রুপ, যারা ধর্মের উর্ধ্বে উঠে নিজেদের মানুষ বলে পরিচিত হতে চায়। এরা হিন্দু নয়, এরা মুসলমান নয়, এরা মানুষ। একজন হিন্দু বা মুসলমান হওয়া সহজ, কিন্তু মানুষ হওয়া ততটাই কঠিন। অভিজিত হিন্দু বাবা-মায়ের সন্তান হলেও তিনি মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। এটা তার অপরাধ। দ্ভিতীয় অপরাধ, মানুষ হয়ে তিনি একজন মানবীকে জীবনসঙ্গী করেছিলেন। নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে অভিজিত-বন্যা অপরাধী বটে, এবং মুরতাদের শাস্তি কি তা তো আমাদের ইসলামী স্টেট বারবার জানান দিচ্ছে। হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, 'মন্দির ভাঙ্গে বিশ্বাসীরা, মসজিদ ভাঙ্গে বিশ্বাসীরা, তারপরও তারা ধার্মিক, আর যারা মন্দির-মসজিদ ভাঙ্গতে পারেনা, তারাই অধার্মিক, অবিশ্বাসী!' কে যেন লিখেছিলেন, বিশ্বাসীরা পৃথিবীর যত ক্ষতি করেছেন, অবিশ্বাসীরা তার কনামাত্র করেনি। আবারো বলবো, মানুষ হওয়া সত্যি কঠিন এবং একজন মানুষ অভিজিতের এ মৃত্যু কাম্য নয়।
টার্গেট করে অভিজিত-কে হত্যা করা হয়েছে। কারা এরা? আমরা সবাই একবাক্যে বলবো 'ইসলামী মৌলবাদীরা' এবং তারপর আমাদের দাযিত্ব শেষ। কারা অভিজিতকে টার্গেট করলো, কারা তাকে এত ক্লোজলি 'রেকি' করলো, যে দেশে যাবার দশ দিনের মধ্যে তিনি খুন হলেন? খুব কাছের লোক কি এরসাথে জড়িত থাকা সম্ভব? অভিজিতের বিয়েটা কি উভয় পক্ষ মেনে নিয়েছিলো? এসব প্রশ্নোত্তর ডিটেকটিভরা দিতে পারবেন। তবে সদ্য দেশ থেকে আসা একজন বিজ্ঞানী জানালেন, অভিজিত যেভাবে বইমেলায় প্রকাশ্যে সবার সাথে মিশছিলেন তাতে তাকে রেকি করাটা অসম্ভব ছিলোনা। তারপরও একটি প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠেছে, এত নিরাপত্তার মাঝে অভিজিত খুন হলেন কিভাবে?
অভিজিত নাই। অভিজিতের লাশের ওপর রক্তমাখা বন্যার প্রতিবাদী রণভঙ্গি ও আকুতি আমরা দেখেছি। বন্যাকে সান্তনা দেয়ার যোগ্যতা আমাদের নেই, আমরা কাপুরুষ। রাষ্ট্র থেকে প্রগতির ধ্বজাধারী আমরা সবাই বারবার শুধুই মৌলবাদের সাথে আপোষ করেছি। আশীর্বাদ করি বন্যা স্বামীশোকে 'শ্যামা' হোক। বেদনাহত একজন নারীই পারে মৌলবাদের মূলে আঘাত হানতে, বন্যা আহমেদ-কে তা পারতেই হবে। আমার সবচেয়ে খারাপ লাগছে আমাদের স্যার অজয় রায়-এর জন্যে। স্যারকে আমরা কি সান্তনা দেব, কি করে বলবো, স্যার, পারলাম না আপনার অভিজিতকে বাঁচাতে! আমরা ব্যর্থ, নিজেদের বাঁচাতেও আমরা অক্ষম; আমরা বেঁচে আছি মৌলবাদের কৃপায়। ওরা যাকে একবার টার্গেট করে তিনি খতম। যতক্ষণ না ওরা আমাদের টার্গেট করেছে ততক্ষনই আমাদের শ্বাস! স্বভাবত:ই প্রশ্ন ওঠে, এরপর কে টার্গেটেড?
পত্রিকায় দেখলাম অভিজিতের ৮/১০টি বই বেরিয়েছে এবং একজন লেখক বইমেলায় যাবেন সেটাই স্বাভাবিক। তার একটি বইও পড়িনি, তবে তার লেখার সাথে পরিচিত বহুদিন এবং মুক্তমনায় আমিও বেশ পুরাতন, সম্ভবত: শুরু থেকেই আছি। মনে আছে, ইরাক যুদ্ভ নিয়ে অভিজিত ও ড: জাফর ইকবালের সাথে আমার বেশ বিতর্ক হয়েছিলো এবং আমরা কিছুদিন এনিয়ে প্রচুর লেখালেখি করি। মুক্তমনা নি:সন্দেহে একটি অন্যন্য ব্লগ এবং এতে আস্তিক-নাস্তিক লেখনি ফাইট বেশ রসালো এবং জমজমাট। মুক্তমনার মডারেটর অন্য বন্ধুরা একটু সাবধানে থাকবেন। কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন, অভিজিতের আর একটু সাবধানী হওয়া উচিত ছিলো। টিএসসি-র শোকসভার কিছু ছবি-নিউজ দেখলাম, উত্সাহ-ব্যঞ্জক, কিন্তু কতদিন? শাহবাগ আন্দোলন মাঠে মারা গেছে, কারণ আমরা আপোষ করেছি। আমাদের সময় ঢাকায় একটি শ্লোগান ছিলো, 'আপোষ না সংগ্রাম; সংগ্রাম সংগ্রাম'; ধারণা করি ওটা পাল্টে এখন হয়েছে, 'আপোষ, আপোষ'। যতদিন আপোষ থাকবে, ততদিন মৌলবাদ থাকবে; এবং অভিজিত-রাজীবরা মরবে। আজ অজয় স্যারের বুক খালি হয়েছে, কাল কোন মায়ের কোল খালি হবে কে জানে!
আমার ধারণা, রাজীব হত্যার বিচার না হলেও অভিজিত হত্যার বিচার হবে, কারণ চাপ থাকবে। বাংলাদেশী মার্কিন নাগরিকদের চাপ থাকবে দুই সরকারের ওপর। চাপে না পড়লে তো আমরা কিছু করিনা। তবে হরতাল-অবরোধের সাথে এই হত্যাকান্ড পরিস্থিতিকে আরো একটু ঘোলা করবে তা বলা বাহুল্য। ১৯৭২-এর ২৬শে মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ২৬শে মার্চ, অর্থাৎ জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে যাদের হয় তারা মোটামুটি বিখ্যাত হ'ন, অভিজিত অখ্যাত ছিলেন না, মৃত্যু তাকে প্রখ্যাত করেছে। অভিজিতের মৃত্যু বাংলাদেশের মুক্তমনাদের ঐক্যবদ্ভ করুক, সাহসী করুক এবং প্রতিবাদী করুক, তবেই মরেও তিনি হারবেন না। আনসারউল্লাহ বাংলাটীম-৭ এই হত্যাকান্ডের দাযিত্ব স্বীকার করেছে। এই স্বীকারোক্তি কতোটা নির্ভরযোগ্য? মান্না-খোকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলার কথা বলেছিলেন, মন্ত্রী নাসিম বলেছেন, 'অভিজিত হলো তাদের কাঙ্খিত প্রথম লাশ'। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জাতি আর কত লাশের ভার বইবে?
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
নিউইয়র্ক, ২৭শে ফেব্রুযার ২০১৫।
__._,_.___