অভিজিত হত্যার পর অনেকে দেশে যেতে চাইবেন না!
অভিজিত নিহত হবার পর 'ব্লগার অভিজিত' হয়ে গেছেন। অথচ তিনি একজন বিজ্ঞানী, বুয়েটের সাবেক শিক্ষক ও প্রকৌশলী, লেখক, মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা, একজন পিতা, স্বামী, পুত্র এবং ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি। এমনকি তার নামের আগে ডা: অভিজিত লিখতেও আমরা ভুলে গেছি, অথচ ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি'র সংখ্যা পুরো বাংলাদেশে হাতেগোনা। ক'দিন বাদে আমরা তাকেও ভুলে যাবো। এটাই স্বাভাবিক, বিশেষত: আমরা হুজুগে বাঙ্গালীরা একেক সময় একেকটি ইস্যু নিয়ে হুজুগে মেতে থাকি, তারপর সব ভুলে যাই এবং আর একটি ইস্যুর অপেক্ষায় থাকি।
আগে অতটা না হলেও মৃত্যুর পর বোঝা গেল ডা: অভিজিত বিখ্যাত ছিলেন এবং ভবিষ্যতে তিনি রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহৃত হবেন। ডা: অভিজিত হত্যায় বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে এবং এমনকি আমরা মমতা ব্যানার্জীর বিবৃতি পর্যন্ত দেখেছি। তবে কি অভিজিতের মৃত্যুতে মমতা তার ভুল বুঝতে পেরে মৌলবাদের পক্ষ ত্যাগ করে প্রগতির পক্ষে এসেছেন? এমনটা যদি হয় এবং একজন মৌলবাদও যদি মানুষ হয়, তবে মরেও ব্লগার অভিজিত শান্তি পাবেন। এই জায়গায় 'ব্লগার' লেখার কারণ হলো, আমার ধারনায় মরেছেন ব্লগার অভিজিত, বেচেও থাকবেন ব্লগার অভিজিত!
পৃথিবীর তাবৎ বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে প্রায় সবাই ডা: অভিজিত হত্যার বিচার চেয়েছেন। ছয়জন মার্কিন কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশে যারা মুক্তচিন্তা করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলেছেন। অনেকেই মুক্তমনা অভিজিত হত্যার সাথে প্যারিসের চার্লি হেবডো হত্যাকান্ড ও ডেনমার্কের সিনেগগ আক্রমনের সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছেন এবং এগুলোকে স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর আক্রমন হিসাবে অভিহিত করেছেন। তাই যদি হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি এবার পাকাপোক্তভাবে বাংলাদেশের ওপর পড়বে। এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ সাম্প্রতিক 'ইসলামিক স্টেটের' বক্তব্যের কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন। বেশিদিনের কথা নয়, 'আইএস' বলছিলো, দক্ষিন এশিয়ায় তাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং বাংলাদেশের নাম সেখানে ছিলো। অতি সম্প্রতি ব্রিটেন থেকে দুই তরুণী ও কানাডা থেকে চার তরুণের ইসলামিক স্টেটে যোগদানের ঘটনায় বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছিলো, কারণ তারা যারা সবাই বাংলাদেশী বংশদ্ভুত। তাহলে বাংলাদেশ কোথায় যাচ্ছে?
আন্তর্জাতিক বা দেশীয় মহল, সবারই ধারণা অভিজিত হত্যা জঙ্গীদের কাজ। আমেরিকায় বসে খোকা যখন বলেন, নাসিমের নির্দ্দেশে এ হত্যাকান্ড বা দেশে কাদের সিদ্দিকী যখন বলেন, মান্নার কথা প্রমান করতে একাজ, তখন একথা বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয় যে, তারা ঘটনা অন্যখাতে প্রবাহিত করতে চান। কিন্তু এতে কাজ হবে না বরং মৌলবাদ ও তাদের দোসররা আরো অন্ধকারে নিপতিত হবেন। ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, আমি নিহত হলে, আমার রক্তে ভারত ঐক্যবদ্ধ হবে; তাই হয়েছিলো। অভিজিতের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশে মৌলবাদী-সন্ত্রাসীরা দ্রুত পরাজিত হতেও পারে এবং সরকারকেও প্রমান করতে হতে পারে যে, তারাও সত্যিকার অর্থেই জঙ্গীবিরোধী। একইভাবে অভিজিত হত্যার বিচার করে সরকারকে প্রমান করতে হবে, তারা আন্তরিক। সুতরাং অভিজিত হত্যার বিচার হবে কিনা তা নিয়ে যাদের সংশয় আছে, তারা আস্বস্থ্য হতে পারেন যে, বিচারটি হবে।
ডা: অভিজিতকে নিয়ে এটা আমার দ্বিতীয় লেখা এবং এটা প্রথমটির ধারাবাহিকতা। স্বাভাবিকভাবে কিছু প্রতিক্রিয়া আমার কাছে এসেছে। একজন বিশ্বজিত ও অভিজিত হত্যায় সমান্তরাল রেখা টানতে চেয়েছেন, আসলে কি তাই? বিশ্বজিত হত্যা অকস্মাৎ 'সেম-সাইড' কিলিং ; আর অভিজিত হত্যা পরিকল্পিত এবং যুক্তিবাদ-মৌলবাদের ফাইট। তাই এটাকে কেউ সাদামাটা সাম্প্রদায়িক ঘটনা বলছেনা। এটা তারচেয়েও অনেক বড় ঘটনা, আদর্শের লড়াই। ঢাকা থেকে আমার এক বন্ধু লিখেছেন, খুনের সাথে অভিজিতের বিয়ের কোন সম্পর্ক নেই এবং এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে আজকাল হামেশাই ঘটছে। হয়তো তাই। এ হত্যাকান্ড নিয়ে রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে কিছু কথা আমরা শুনেছি, তবে বড় দলগুলোর কোন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আমার চোখে পড়েনি। একজন চমত্কার বলেছেন যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মানবিকতার তাগিদে দন্ডিত অপরাধী মৃত কোকোর পরিবারের সাথে দেখা করতে ছুটে গিয়েছিলেন, কিন্তু একজন নিরপরাধ অভিজিতের হত্যার পর তার পরিবারের কাছে ছুটে যাননি। কেন যাননি? তিনি নিজেই উত্তর দিয়েছেন, ক্ষমতার রাজনীতি বড়ই বিচিত্র।
আজই পত্রিকায় দেখলাম, আমাদের অজয় স্যার বলেছেন, ফারাবীকে ধরে কি হবে, সে তো ঘটনাস্থলেই ছিলোনা, সে উস্কানীদাতা হতে পারে, হত্যাকারী নয়। একই সাথে তিনি উষ্মা প্রকাশ করেছেন, কেন পুলিশ পারছেনা দুই খুনিকে ধরতে! এফবিআই তদন্তে তিনি আশাও ব্যক্ত করেছেন। সরকার এফবিআই তদন্ত মেনে নিলেও কেউ কেউ এ ব্যাপারে মৃদু আপত্তি তুলেছেন বটে! নিহতের বাবার কথায় কি এটা পরিস্কার নয়, কেন আমাদের এফবিআই তদন্ত দরকার? আমেরিকান বাংলাদেশীরা প্রায় সবাই একই কারণে এফবিআই তদন্ত চান; নিহতের পরিবার বা অন্য বহুলোক তাই চান। ধারণা করি আমাদের দেশের এযাবৎ সকল হত্যাকান্ডে নিহতের পরিবার সুযোগ থাকলে এফবিআই তদন্ত চাইতো। এর কারণ আস্থা-হীনতা এবং এটা আমাদের দেশের সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান, রাজনৈতিক বলয়ে তো বটেই। এই নৌরাজ্য ভালো নয় এবং দেশকে তা কুঁড়ে কুঁড়ে খায়।
অভিজিতের মৃত্যুতে আমেরিকা-ইউরোপ থেকে শুভবুদ্ভি সম্পন্ন মানুষের বাংলাদেশ যাতায়াত কমবে তা বলা বাহুল্য। এমনিতে ট্রাফিক জ্যাম বা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অনেকে দেশে যেতে চাননা, তারওপর খুনাখুনি হলে তো কথাই নেই। সাধারনত: উন্নত দেশের প্রবাসী পিতামাতা তাদের ছেলেমেয়েকে একা একা ইউরোপ-আমেরিকা বা ভারত-জাপানে যেতে দেন, কিন্তু নিজদেশ বাংলাদেশে দেননা। এভাবে খুনাখুনি হলে সেটা আরো কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। ফেইসবুকে দেখলাম, এক মহিলা লিখেছেন, ভেবেছিলাম দেশে যাবো, অভিজিতের মৃত্যু দোটানায় ফেলে দিলো। এতে অবশ্য দেশে কারো কিছু আসে যায়না, কারণ প্রবাসীদের কেউ চায়না, শুধু তাদের ডলার চায়। প্রবাসীদের অপরাধ, বিদেশে থাকতে থাকতে তারাও নিজের দেশে সবকিছু ভালো দেখতে চান এবং তা নিয়ে লেখালেখি বা কথাবার্তা বলেন। ডা: অভিজিতও তাই করেছিলেন, এবং এজন্যে তাকে মরতে হয়েছে। একজন তসলিমা বা একজন অভিজিত কি লিখলো তা নিয়ে কি ধর্মের কিছু আসে যায়? ধর্মটা কি এতই ঠুনকো? আমার স্রষ্টা কি এতটাই দুর্বল যে আমাকে তাকে রক্ষা করতে হবে তারই সর্বশ্রেষ্ট সৃষ্টির রক্ত ঝরিয়ে? আমেরিকায় একটা কথা আছে, 'কম অন ম্যান, গিভ আছ্ এ ব্রেক!' মৌলবাদী-সন্ত্রাসীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, এবং তাদের উদ্দেশ্যে বলতে হয়, 'কাম অন ম্যান, মানবতাই ধর্ম।'
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
নিউইয়র্ক, ১৩ই মার্চ ২০১৫।
__._,_.___