অভিজিৎ, এ দুঃখ রাখবো কোথায়?
প্রকাশিত: দুপুর ১২:৩৫ ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৫
সম্পাদিত: দুপুর ১২:৩৮ ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৫
মোজাম্মেল খান॥
আমি ভাষাহীন। মেনে নিতে পারছি না আমাদের সেই অতি পরিচিত অভিজিৎ রায় আর নেই। যে দেশের মানুষের মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা নিরন্তর যাকে তাড়া করেছে, মানুষ আর মানবতার সেবা ছিল যার জীবনের প্রধানতম ব্রত, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী হয়েও যিনি মাতৃভূমিতে এসেছিলেন হৃদয়ের টানে, তিনি কিনা নৃশংসভাবে নিহত হলেন তারই প্রিয় দেশের মানুষরূপী পশুদের হাতে!
এক অমানবিক জিঘাংসার শিকার হয়ে নিজের জন্মদিনেই অভিজিৎ চলে গেলেন না ফেরার দেশে । মারাত্মকভাবে জখম অভিজিতের স্ত্রী। তিনি স্বামীকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়েছিলেন। এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন।
আমার সাথে অভিজিতের যোগাযোগ হয় ২০০০ সালে যখন সে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ডক্টরেটের জন্য পড়াশোনা করছিল। ওরই অনুরোধে আমি মুক্তমনা ব্লগে লেখা শুরু করি। ওই ব্লগে ইংরেজি এবং বাংলা উভয় ভাষাতেই অামি লিখেছি।
মুক্তমনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০০ সালে একটি প্রগতিশীল এবং ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ নির্মাণে- যে বিষয়গুলো পরম গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো নিয়ে সমালোচনামূলক বিতর্কের মাধ্যমে তুলে ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে, যে বিষয়গুলো সাধারণত মূলধারার বাংলাদেশি এবং দক্ষিণ এশিয়ার মিডিয়াতে উপেক্ষা করা হয়। ২০০১ সালের ২৬ মে অভিজিৎ মুক্তমনা নামে একটি ইয়াহু গ্রুপ তৈরি করে। এক বছর পর এটা একটা সম্পূর্ণ ওয়েব সাইটে (www.mukto-mona.com) রূপান্তরিত হয়, যেটা সম্ভবত প্রথম দক্ষিণ এশিয়ার হিউম্যানিস্ট এবং যুক্তিবাদী ফোরাম ছিল।অভিজিৎ-এর নিজের ভাষায় এর উদ্দেশ্য ছিল, "এমন একটা কুসংস্কারমুক্ত সমাজ তৈরি করা যেখানে অবাধ কর্তৃত্ব, কুসংস্কার, বা শ্বাসরোধী গোঁড়ামির দ্বারা সমাজ নিয়ন্ত্রিত হবে না; বরং যুক্তি, সহানুভূতি, মানবতা, সমতার উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে"।
এর প্রতিষ্ঠার লগ্ন থেকেই, মুক্তমনা অনেক বিশিষ্ট লেখক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং বিশ্বের সব জায়গা থেকে মানবাধিকার কর্মীদের সহ অনেক সদৃশ্যমনা চিন্তাবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। এ গ্রুপটি সবসময় মানুষের স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকার যখন আক্রান্ত হয়েছে, সেটা পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক না কেন, সেখানেই তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ উচ্চারিত করার প্রয়াসে প্রয়াসী হয়েছে।
মানবতাবাদী এবং যুক্তিবাদী হিসাবে সার্বজনীন চিন্তার বাইরেও, ১৯৭১ সালে আমাদের জনগণ এবং জাতির উপর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের ব্যাপারে অভিজিৎ ছিল এক একনিষ্ঠ, অকুতোভয় এবং নিরলস সৈনিক। উদাহরণস্বরূপ, গণজাগরণ মঞ্চের সেই উত্তাল সময়ে সে তার ফেসবুকের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাস করা হাজার হাজার বাঙালির মাঝে জনকণ্ঠে প্রকাশিত আমার সেই বহুল পঠিত লেখা "কাদের মোল্লাকে নিয়ে আমার দেশ পত্রিকার আষাঢ়ে কাহিনী" ছড়িয়ে দিয়েছিল।
তার ফেসবুক স্ট্যাটাস ছিল এরকম, "কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশের পর পরই 'আমার দেশ' সহ কিছু মুখচেনা পত্রিকা নানা ধরণের মিথ্যাচার শুরু করে। আবদুল কাদের মোল্লা নাকি রাজাকার নন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেছিলেন। তিনি নাকি রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিরাট ভক্ত। ... আরো কত কি! সম্প্রতি কাদের মোল্লাকে নিয়ে মিথ্যাচারের মুখোশ খুলে দিয়েছেন, তারই একজন সহপাঠী ড. মোজাম্মেল এইচ খান । আমার দেশের মিথ্যাচারকে তিনি আগাগোড়া খণ্ডন করে দিয়েছেন, পড়ুন তাঁর লেখা – লেখাটা অবশ্যপাঠ্য"।
বাংলাদেশে মুক্তচিন্তাবিদদের বিপদ সম্পর্কে অভিজিৎ সম্যক অবগত ছিল। তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে সে লিখেছিলঃ "দেশে মুক্তচিন্তার প্রেক্ষাপট কখনো কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। মুক্তমত প্রকাশের জন্য হুমায়ুন আজাদকে আক্রান্ত হতে হয়েছে, তসলিমা নাসরিনকে নিগৃহীত হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে আর রাজীব হায়দার (থাবা বাবা)কে অঘোরে প্রাণ দিতে হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র নিপীড়ক এবং হত্যাকারীদের হাতের পুতুল হয়ে থেকেছে বরাবরই। দেশের বাইরে, বিশেষতঃ পশ্চিমা বিশ্বে ঠিক এমনটি নয়। বিশ্বাসের জন্য কাউকে প্রাণ দিতে হয়না, কিংবা হলেও রাষ্ট্রযন্ত্র হত্যাকারীকে রক্ষায় সচেষ্ট হয় না, বরং হয় সঠিক বিচারের ব্যাপারে উদ্যোগী"।
হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণকারী অভিজিৎ নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে আর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলঃ "আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার আশে-পাশের বহু কাছের মানুষজন বন্ধু বান্ধবই মুসলিম। তাদের উপর আমার কোন রাগ নেই, নেই কোনও ঘৃণা। তাদের আনন্দের দিনে আমিও আনন্দিত হই। তাদের উপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত হই। প্যালেস্টাইনে বা কাশ্মীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে কার্পণ্য বোধ করি না। অতীতেও দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা"।
হায়রে দেশ আমার, এমন একজন পাণ্ডিত্যে ভরা মানতাবাদীকে তার নিজের মাতৃভূমিতে এসে মানুষরূপী পশুদের হিংস্রতার শিকার হতে হলো। এ দুঃখ রাখবো কোথায়?
এ জঘন্য শোকাবহ হিংস্রতা আবার আমাদের মানসপটে নিয়ে আসে আমাদের আর এক মহান চিন্তাবিদ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের উপর নিপতিত বিয়োগান্ত নাটকের ভয়ানক অনুস্মারকের বীভৎস স্মৃতি। অনুচ্চারিত মাত্রার এই বিয়োগান্ত অঘটন আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমরা এখনও গোঁড়ামি আর ধর্মান্ধতার কোনও অন্ধকার একটি যুগের মধ্যে বসবাস করছি। এখনও যদি কেউ গলা উঁচিয়ে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ এবং ধর্মীয় উগ্রতাবাদের বিপদকে হাল্কা করে দেখার চেষ্টা করেন এবং বলার চেষ্টা করেন এটা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের এক রাজনৈতিক স্লোগান তাহলে এর থেকে হাস্যকর আর কি হতে পারে? এ মানুষরূপী হিংস্র পশুদের হাতে অভিজিতের মতন এক তরুণ এবং উজ্জ্বল মানবতাবাদীর বিয়োগান্তক মৃত্যু সমস্ত জাতির বিবেকের কাছে সেই প্রশ্ন আবারও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে যে প্রশ্ন অধ্যাপক আজাদ উত্থাপন করেছিলেন: "আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?"
লেখক: কানাডার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক এবং সিনেটের ডেপুটি স্পিকার এবং দীর্ঘ সময় ধরে মুক্তমনা ব্লগের লেখক
__._,_.___