প্রিন্ট সংস্করণ, প্রকাশ : ১৩ এপ্রিল ২০১৫ পাপ বাপকেও ছাড়ে না | | Samakal Online Version | অঅ-অ+ |
পাপ বাপকেও ছাড়ে না
বদর নেতার ফাঁসি
ড. মো. আনোয়ার হোসেন
শনিবার রাতে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসির রশিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে-পরে অনেক দৃশ্যই আমরা দেখেছি। এর মধ্যে দুটি দৃশ্যের কথা আমার বিশেষভাবে মনে পড়ে। একটি দৃশ্য হচ্ছে শেরপুরের সোহাগপুরের বিধবাপল্লীর। একাত্তরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর বর্বরতায় ওই বিধবারা জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে ছিলেন। আরেকটি দৃশ্য হচ্ছে, ঘাতক কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা। তার সঙ্গে শেষ দেখা করার জন্য আত্মীয়-স্বজনসহ মোট ২১ জন শনিবার বিকেলে কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়েছিল। পরে টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম, তার এক পুত্র উচ্চস্বরে কিছু কথা বলছে। তার কথার মধ্যে ছিল যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তার বাবার জীবন দিতেও পারেন না, নিতেও পারেন না। সুতরাং তার বাবার পক্ষে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। অথচ আমরা জানি, প্রাণভিক্ষা চাওয়ার নামেই কামারুজ্জামান নানা ছলে সময়ক্ষেপণ করছিলেন। কামারুজ্জামানের এক মেয়েকে দেখলাম গাড়িতে বসে টিভি ক্যামেরা দেখে প্রথমে মুখ আড়াল করল, তারপর আবার 'ভি সাইন' দেখাল। এই 'বিজয় চিহ্ন' আসলে পরাজিতের আত্মসান্ত্বনা ছাড়া কিছু নয়। আমার মনে পড়ছে, ২০০৬ সালে ঘাতক কামারুজ্জামানের এক পুত্র মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে উদ্দেশ করে অনলাইনে লিখেছিল_ তোমাদের কারও ক্ষমতা থাকলে ট্রাইব্যুনাল গঠন করো, আমার বাবার বিচার করো। সেই দম্ভ আজ কোথায়? শেষ পর্যন্ত তার স্বাধীনতাবিরোধী বাবাকে স্বাধীন বাংলাদেশে ন্যায়বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে এবং উপযুক্ত শাস্তি মিলেছে। সেই ঔদ্ধত্যের নয় বছর পরে হলেও ঘাতক কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
আমরা দেখেছি, বিপুল জনমতের প্রতি সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বহুল প্রত্যাশিত বিচার কাজ শুরু হয়েছিল। ওই বছর ২১ জুলাই কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত দল। একই বছর ২৯ জুলাই তাকে আটক করা হয়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়েছিল ২০১২ সালের ৪ জুন। ২০১৩ সালের ৯ মে হত্যা ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে গত বছরের ৬ জুন আপিল করেন কামারুজ্জামান। গত বছর ৫ জুন এ বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ রাখেন। এর এক মাস ১৬ দিনের মাথায় রায় হয়। এ বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে রিভিউর আবেদন করেন কামারুজ্জামান। গত সপ্তাহের ৬ এপ্রিল তার রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তার মানে, কামারুজ্জামানকে আটকের পর গত পাঁচ বছর ধরে বিচার প্রক্রিয়া চলেছে। ট্রাইব্যুনাল ছাড়াও সর্বোচ্চ আদালতে আপিলের ও রিভিউ আবেদনের সুযোগ পেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থায় যত রকম সুযোগ রয়েছে, তার সবই পেয়েছেন তিনি। কিন্তু তার অপরাধ এত ব্যাপক এবং এমন মাত্রায় প্রমাণিত যে, ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে বাঁচার কোনো উপায় তার ছিল না।
আমি নিজে মুক্তিযুদ্ধ করেছি ১১ নম্বর সেক্টরে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও রংপুরের কিছু অংশ নিয়ে ওই সেক্টর গঠিত হয়েছিল। কামারুজ্জামানের বর্বরতার সাক্ষীও ওই সেক্টর। সেক্টর হেডকোয়ার্টারে একজন স্টাফ অফিসার হিসেবে আগস্টের শেষ দিকে আমি জানতে পারি যে, কামারুজ্জামান শেরপুর এলাকায় কীভাবে হত্যা, অগি্নকাণ্ড, ধর্ষণ চালিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি জামালপুরের সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বদর বাহিনীর কমান্ডার এই কামারুজ্জামান মানবতাবিরোধী ধ্বংসযজ্ঞে পাকিস্তান বাহিনীর সহায়তাকারী ও ঘাতক হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের মতো সামরিক শাসকদের স্বাধীনতাবিরোধী পুনর্বাসনের সুযোগে দেশে কামারুজ্জামানের মতো ঘাতকদের রাজত্ব ফিরে আসে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে এলেও খালেদা জিয়া সরকারের ছত্রছায়ায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির প্রবল প্রতাপ এতটুকু কমেনি। বরং তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত হন। এমনকি খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় সরকারের সময় তারা মন্ত্রিপরিষদেও স্থান পান।
আমি মনে করি, কামারুজ্জামানের ফাঁসির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এতে আইনের প্রয়োগ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা গেছে। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের কাছে, বিশ্ববাসীর কাছে দৃশ্যমান করা সম্ভব হয়েছে যে, যত বড় অপরাধীই হোক, তার ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে আমি মনে করি। খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, এত আইনি সুযোগ দেওয়ার পরও জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো প্রতিষ্ঠান বিচারটি নিয়ে অভিযোগের সুরে কথা বলেছে। এমনকি তারা মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করার কথাও বলেছে! একাত্তরে কামারুজ্জামানের কীর্তিকলাপ বিবেচনা করলে, পুরো বিচার প্রক্রিয়া দেখলে; সজ্ঞানে কেউ এ নিয়ে অভিযোগ তোলার কথা নয়।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলতে হবে তা হচ্ছে, আরেক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি। প্রথমে ট্রাইব্যুনালের রায়ে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে দেখা দেয় অভূতপূর্ব 'গণজাগরণ'। সেটা যেন ছিল একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাধারণ মানুষের পুনর্জাগরণ। এর ফলশ্রুতিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আইনে সংশোধন আনা হয় এবং আপিল বিভাগে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। তখন দেশ-বিদেশে সমালোচনা হয়েছিল যে, এটা সরকারের একটা চমক। নির্বাচনের আগে তারা ভোটের জন্য এটা করেছে। আদতে জামায়াতের সঙ্গে সরকারের গোপন সমঝোতা হয়েছে, অন্যান্য ঘাতকের রায় তেমনভাবে কার্যকর হবে না। সেসব সমালোচনার মুখে ছাই দিয়ে জামায়াতের দিক থেকে কামারুজ্জামানের মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হলো।
কামারুজ্জামানের বিচারের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হলো যে, বঙ্গবন্ধুকন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে কোনো ছাড় দেবেন না। সাময়িক সুবিধার জন্য স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আপস করবেন না। প্রাণভিক্ষার আবেদনের জন্য চিন্তা-ভাবনার সময় নেওয়ার পেছনে কামারুজ্জামান ও তার দলের মতলব ছিল সময়ক্ষেপণ করা। আসলে পরে দেখা গেছে, একদিকে সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করতে চেয়েছে; অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সমঝোতার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গেছে।
আমি মনে করি, এই বিচার ও শাস্তির তাৎপর্য অনেক। একটি দেশ সভ্যতার ক্ষেত্রে কোন অবস্থানে, তার একটি পরিমাপক হচ্ছে ন্যায়বিচার হচ্ছে কি-না, অপরাধের শাস্তি হচ্ছে কি-না, ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি রাষ্ট্র সহানুভূতিশীল কি-না, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর হচ্ছে কি-না। বাংলাদেশ নানা দিক থেকে পিছিয়ে থাকতে পারে; কিন্তু বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ছিল, সেখান থেকে মুক্ত হচ্ছে। এটা শুরু হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচারের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ চলছে। জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারও হবে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারও হবে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের বিচারের মধ্য দিয়ে অন্ততপক্ষে সবার কাছে হাজার বছর ধরে প্রচলিত বাংলার সেই প্রাচীন প্রবাদ বাস্তবে পরিণত হচ্ছে যে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না।
আমি মনে করি, দেশ যে সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাচ্ছে, কামারুজ্জামানসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তার প্রমাণ। আমরা জানি, গণতন্ত্রের পথে বারবার আঘাত এসেছে। যুদ্ধাপরাধীরা অনির্বাচিত শাসকের সঙ্গে আঁতাত করে গণতন্ত্র হত্যা করেছে। কিন্তু বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাহাত্তরের সংবিধান অনেকাংশে ফিরিয়ে এনে সেখানে বিধান করেছে যে, সরকার ব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ করে, সেনাশাসন এনে আর আগের মতো পার পাওয়া যাবে না। অসাংবিধানিকভাবে সরকার হটানোর ষড়যন্ত্র করলে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট অপেক্ষা করবে। ফলে যুদ্ধাপরাধীরা আর আগের মতো সেই অসাংবিধানিক সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ার স্বপ্নও দেখতে পারবে না।
কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানের বিচারের মধ্য দিয়ে আরেকটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মোড়লরা, যারা কথায় কথায় আমাদের উপদেশ দেয়, সেগুলো অসার। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়, আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব চাপ উপেক্ষা করে এই বিচারের প্রশ্নে অনড় থেকেছেন। এই দৃঢ়চিত্ত তিনি পিতার কাছ থেকে পেয়েছেন। রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা আমাদের মুগ্ধ করেছে। গত ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট যে হরতাল-অবরোধ চালিয়ে আসছিল, তার নেপথ্য কারণও ছিল কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার ব্যাহত করা। কিন্তু আমরা দেখলাম, তাদের নেত্রী খালেদা জিয়া শেষ পর্যন্ত পোড়া মানুষের মৃতদেহের ওপর দিয়ে হেঁটে আদালতে গেলেন এবং সুবোধ বালিকার মতো গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, সততা, প্রজ্ঞার কারণে এখন বিদেশি মোড়লরাও সুর পাল্টেছেনে। বলছেন যে, রাজনৈতিক সংকট কেটে গেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রতি আমাদের অভিবাদন।
শেষ করতে চাই সোহাগপুরের বিধবাদের কথা দিয়ে। তারা তো বেশি কিছু চাননি। তারা শুধু স্বামী হত্যার বিচার চেয়েছেন। তাদের স্বামীকে যারা হত্যা করেছেন, তাদের সম্ভ্রমহানি যারা করেছেন, মৃত্যুর আগে তাদের শাস্তি দেখে যেতে চেয়েছেন। ৪৩ বছর পরে হলেও তারা ন্যায়বিচার পেয়েছেন।
অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান
বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমরা দেখেছি, বিপুল জনমতের প্রতি সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বহুল প্রত্যাশিত বিচার কাজ শুরু হয়েছিল। ওই বছর ২১ জুলাই কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত দল। একই বছর ২৯ জুলাই তাকে আটক করা হয়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়েছিল ২০১২ সালের ৪ জুন। ২০১৩ সালের ৯ মে হত্যা ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে গত বছরের ৬ জুন আপিল করেন কামারুজ্জামান। গত বছর ৫ জুন এ বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ রাখেন। এর এক মাস ১৬ দিনের মাথায় রায় হয়। এ বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে রিভিউর আবেদন করেন কামারুজ্জামান। গত সপ্তাহের ৬ এপ্রিল তার রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তার মানে, কামারুজ্জামানকে আটকের পর গত পাঁচ বছর ধরে বিচার প্রক্রিয়া চলেছে। ট্রাইব্যুনাল ছাড়াও সর্বোচ্চ আদালতে আপিলের ও রিভিউ আবেদনের সুযোগ পেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থায় যত রকম সুযোগ রয়েছে, তার সবই পেয়েছেন তিনি। কিন্তু তার অপরাধ এত ব্যাপক এবং এমন মাত্রায় প্রমাণিত যে, ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে বাঁচার কোনো উপায় তার ছিল না।
আমি নিজে মুক্তিযুদ্ধ করেছি ১১ নম্বর সেক্টরে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও রংপুরের কিছু অংশ নিয়ে ওই সেক্টর গঠিত হয়েছিল। কামারুজ্জামানের বর্বরতার সাক্ষীও ওই সেক্টর। সেক্টর হেডকোয়ার্টারে একজন স্টাফ অফিসার হিসেবে আগস্টের শেষ দিকে আমি জানতে পারি যে, কামারুজ্জামান শেরপুর এলাকায় কীভাবে হত্যা, অগি্নকাণ্ড, ধর্ষণ চালিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি জামালপুরের সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বদর বাহিনীর কমান্ডার এই কামারুজ্জামান মানবতাবিরোধী ধ্বংসযজ্ঞে পাকিস্তান বাহিনীর সহায়তাকারী ও ঘাতক হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের মতো সামরিক শাসকদের স্বাধীনতাবিরোধী পুনর্বাসনের সুযোগে দেশে কামারুজ্জামানের মতো ঘাতকদের রাজত্ব ফিরে আসে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে এলেও খালেদা জিয়া সরকারের ছত্রছায়ায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির প্রবল প্রতাপ এতটুকু কমেনি। বরং তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত হন। এমনকি খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় সরকারের সময় তারা মন্ত্রিপরিষদেও স্থান পান।
আমি মনে করি, কামারুজ্জামানের ফাঁসির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এতে আইনের প্রয়োগ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা গেছে। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের কাছে, বিশ্ববাসীর কাছে দৃশ্যমান করা সম্ভব হয়েছে যে, যত বড় অপরাধীই হোক, তার ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে আমি মনে করি। খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, এত আইনি সুযোগ দেওয়ার পরও জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো প্রতিষ্ঠান বিচারটি নিয়ে অভিযোগের সুরে কথা বলেছে। এমনকি তারা মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করার কথাও বলেছে! একাত্তরে কামারুজ্জামানের কীর্তিকলাপ বিবেচনা করলে, পুরো বিচার প্রক্রিয়া দেখলে; সজ্ঞানে কেউ এ নিয়ে অভিযোগ তোলার কথা নয়।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলতে হবে তা হচ্ছে, আরেক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি। প্রথমে ট্রাইব্যুনালের রায়ে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে দেখা দেয় অভূতপূর্ব 'গণজাগরণ'। সেটা যেন ছিল একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাধারণ মানুষের পুনর্জাগরণ। এর ফলশ্রুতিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আইনে সংশোধন আনা হয় এবং আপিল বিভাগে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। তখন দেশ-বিদেশে সমালোচনা হয়েছিল যে, এটা সরকারের একটা চমক। নির্বাচনের আগে তারা ভোটের জন্য এটা করেছে। আদতে জামায়াতের সঙ্গে সরকারের গোপন সমঝোতা হয়েছে, অন্যান্য ঘাতকের রায় তেমনভাবে কার্যকর হবে না। সেসব সমালোচনার মুখে ছাই দিয়ে জামায়াতের দিক থেকে কামারুজ্জামানের মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হলো।
কামারুজ্জামানের বিচারের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হলো যে, বঙ্গবন্ধুকন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে কোনো ছাড় দেবেন না। সাময়িক সুবিধার জন্য স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আপস করবেন না। প্রাণভিক্ষার আবেদনের জন্য চিন্তা-ভাবনার সময় নেওয়ার পেছনে কামারুজ্জামান ও তার দলের মতলব ছিল সময়ক্ষেপণ করা। আসলে পরে দেখা গেছে, একদিকে সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করতে চেয়েছে; অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সমঝোতার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে গেছে।
আমি মনে করি, এই বিচার ও শাস্তির তাৎপর্য অনেক। একটি দেশ সভ্যতার ক্ষেত্রে কোন অবস্থানে, তার একটি পরিমাপক হচ্ছে ন্যায়বিচার হচ্ছে কি-না, অপরাধের শাস্তি হচ্ছে কি-না, ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি রাষ্ট্র সহানুভূতিশীল কি-না, বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর হচ্ছে কি-না। বাংলাদেশ নানা দিক থেকে পিছিয়ে থাকতে পারে; কিন্তু বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ছিল, সেখান থেকে মুক্ত হচ্ছে। এটা শুরু হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচারের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ চলছে। জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারও হবে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারও হবে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের বিচারের মধ্য দিয়ে অন্ততপক্ষে সবার কাছে হাজার বছর ধরে প্রচলিত বাংলার সেই প্রাচীন প্রবাদ বাস্তবে পরিণত হচ্ছে যে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না।
আমি মনে করি, দেশ যে সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাচ্ছে, কামারুজ্জামানসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তার প্রমাণ। আমরা জানি, গণতন্ত্রের পথে বারবার আঘাত এসেছে। যুদ্ধাপরাধীরা অনির্বাচিত শাসকের সঙ্গে আঁতাত করে গণতন্ত্র হত্যা করেছে। কিন্তু বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাহাত্তরের সংবিধান অনেকাংশে ফিরিয়ে এনে সেখানে বিধান করেছে যে, সরকার ব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ করে, সেনাশাসন এনে আর আগের মতো পার পাওয়া যাবে না। অসাংবিধানিকভাবে সরকার হটানোর ষড়যন্ত্র করলে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট অপেক্ষা করবে। ফলে যুদ্ধাপরাধীরা আর আগের মতো সেই অসাংবিধানিক সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ার স্বপ্নও দেখতে পারবে না।
কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানের বিচারের মধ্য দিয়ে আরেকটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মোড়লরা, যারা কথায় কথায় আমাদের উপদেশ দেয়, সেগুলো অসার। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়, আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব চাপ উপেক্ষা করে এই বিচারের প্রশ্নে অনড় থেকেছেন। এই দৃঢ়চিত্ত তিনি পিতার কাছ থেকে পেয়েছেন। রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা আমাদের মুগ্ধ করেছে। গত ৫ জানুয়ারি থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট যে হরতাল-অবরোধ চালিয়ে আসছিল, তার নেপথ্য কারণও ছিল কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার ব্যাহত করা। কিন্তু আমরা দেখলাম, তাদের নেত্রী খালেদা জিয়া শেষ পর্যন্ত পোড়া মানুষের মৃতদেহের ওপর দিয়ে হেঁটে আদালতে গেলেন এবং সুবোধ বালিকার মতো গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। শেখ হাসিনার দৃঢ়তা, সততা, প্রজ্ঞার কারণে এখন বিদেশি মোড়লরাও সুর পাল্টেছেনে। বলছেন যে, রাজনৈতিক সংকট কেটে গেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রতি আমাদের অভিবাদন।
শেষ করতে চাই সোহাগপুরের বিধবাদের কথা দিয়ে। তারা তো বেশি কিছু চাননি। তারা শুধু স্বামী হত্যার বিচার চেয়েছেন। তাদের স্বামীকে যারা হত্যা করেছেন, তাদের সম্ভ্রমহানি যারা করেছেন, মৃত্যুর আগে তাদের শাস্তি দেখে যেতে চেয়েছেন। ৪৩ বছর পরে হলেও তারা ন্যায়বিচার পেয়েছেন।
অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান
বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
__._,_.___