ট্যাঁবুর সুচনা ও বর্তমানে আমরা
লেখক : গৌরব
সময়টা হল ১৭৭০ সন। বিখ্যাত নাবিক ও অভিযাত্রী কাপ্তান জেমস কুক তার নতুন পৃথিবী খুজে বের করার তৃতীয় অভিযাত্রায় বের হয়েছেন। এই বারের যাত্রা দক্ষিন সাগরে। ঘুরতে ঘুরতে তিনি তার জাহাজের বহর নিয়ে এসে পৌঁছালেন ফিজি দ্বীপপুঞ্জে। সেখানে তিনি জাহাজ থামালেন টোঙ্গা দ্বীপে। তো নতুন জায়গায় গেলে সেখানের লোকদের সাথে আগে খাতির করাই নিয়ম। কুক সাহেব দ্বীপের অদিবাসিদের সর্দারকে ডাকলেন খানাপিনার জন্য। সর্দার আসলো তার সাথে দেখা করতে। কিন্তু কুক সাহেবের সাথে তার ভোজ করার কোন ইচ্ছে দেখা গেল না। কুক মহাশয় যতই সর্দারকে খানা খাওয়াইতে নিতে চায় সর্দার ততই এক জায়গায় গ্যাঁট হয়ে দাড়িয়ে থাকে। তো অনেক পেড়াপিড়ির পর কুক হাল ছেড়ে দিয়ে সর্দারকে আলাপ করার জন্য বসতে বললেন। এইখানে ও সর্দার নারাজি। সে ঠায় দাড়িয়ে থাকলো কুকের সামনে। কুক আর তাকে বেশী ঘাঁটালেন না। সর্দারের সাথে দাড়িয়েই কথাবার্তা বলতে লাগলেন। কথাবার্তার ভিতর কুক শুনতে পেলেন একটি নতুন শব্দ, "টাফু"। সর্দার নতুন যা কিছু দেখে বলে উঠে টাফু। যেমন কুক তাকে কম্পাস দিতে গেলে তিনি এক লাফে দশ হাত পিছনে গিয়ে বলতে লাগলেন টাফু টাফু।
সাথে সাথে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে গেল মুহূর্তটি। আধুনিক সমাজের সংস্পর্শে এলো একটি নতুন শব্দ। সেটি হল ট্যাঁবু। টোঙ্গা দ্বীপের অধিবাসিদের মাঝে 'ব' এর উচ্চারণ ছিল না। তাই তারা বলতো টাফু। কুক তার খাতায় লিখে গিয়েছেন টাবু। সেই দ্বীপে যা কিছু ভীতিকর, নিষিদ্ধ ছিল তাকেই ট্যাঁবু বলা হত। সর্দার কুক এর সাথে খেতে বসেননি কারণ সেদিন তারা একটি মৃত ব্যক্তির সৎকার করেছিলেন। যারা সৎকার কাজের সাথে জড়িত থাকে তারা কয়েক সপ্তাহ না খেয়ে থাকতো। মৃত ব্যক্তির শান্তির জন্য তারা এটি করতো। আর বিদেশিদের সামনে কখনো বসতে নেই এই ছিল তাদের সামাজিক রীতি। উভয়ই ছিল ট্যাঁবু।
আপনার আমার মনের ভিতরে গেঁথে আছে কিছু ভীতি। সেই ভীতির কারনে আমরা পালন করছি কিছু রীতি অথবা দূরে থাকছি কিছু বিষয় থেকে। আপনি নিজেও জানেন না কি কারনে এই ভীতি সঞ্চিত হয়েছে আপনার মাঝে। বরং ধরে নেন এটাই স্বাভাবিক কারণ সেই ভীতিকর বিষয়গুলো নিয়ে আপনি শিক্ষা পাননি, পেয়েছেন কিছু বিধি-নিষেধ। জন্মের পর থেকে আপনার কৌতূহলকে ঘিরে ফেলা হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে। পরবর্তীতে সেই বেড়া ডিঙ্গানোর সাহস আর আপনি করতে পারেননি। জন্ম নিয়েছে চক্ষু লজ্জার, কে কি মনে করে! এই ভয়, লজ্জা, বিধি নিষেধ যা কিছু আপনার আমার মাঝে, জেনে রাখুন তা সবই ট্যাঁবু।
মৃতের আত্মার জন্য কয়েক সপ্তাহ না খেয়ে থাকা। হাসি আসছে নিশ্চয়ই। চিন্তা করছেন এই বোগাস চিন্তা কিভাবে মানুষের মাথায় আসে। জেনে রাখুন ওই সর্দার পরবর্তীতে কাপ্তান কুককে বলেছিলেন বোকা গর্দভ। কারণ আর কিছুই নয়। কুক তাকে খ্রিষ্টীয় পদ্ধতিতে সৎকার কিভাবে করা হয় বলেছিলেন। অন্যের ট্যাঁবু আপনার কাছে হাস্যকর, ঠিক তেমনি আপনারটি অন্যের কাছে। কারণ এখনো ট্যাঁবুর বিশ্বজনীন কোন রুপ পাওয়া যায়নি। যদিও প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ও লেখক ফ্রয়েদ বলেছেন শুধু মাত্র দুটো আচরণ বিশ্বজনীন ট্যাঁবু। একটি হল INCEST অর্থাৎ নিজ পরিবারের ভিতরে শারীরিক সম্পর্ক। আর একটি হল PATRICIDE অর্থাৎ নিজ পরিবারের কাওকে খুন করা মানে নিজের মা বাবা ভাই বোনকে। অবাক হচ্ছেন নাকি যে এই রকম ঘৃণ্য কাজ নিষিদ্ধ হওয়াই স্বাভাবিক, সেখানে ট্যাঁবু এর যোগসূত্র কোথায়। দয়া করে একটু চিন্তা করুন INCEST সম্পর্ক ছাড়া মানব প্রজাতির বংশবৃদ্ধি ছিল অসম্ভব। আর বর্তমানে একে দেখা হয় অস্বাভাবিক হিসেবে। নিজ পরিবারের মাঝে রক্তের সম্পর্ককে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখা হয়। সুতরাং খুনকে মানুষ স্বাভাবিক হিসেবে নিলেও নিজ পরিবারের সদস্যদের খুনকে দেখা হয় অস্বাভাবিক ভাবে। ধারনা করা হয় পারিবারিক মমতা ও ভালবাসাকে অতিক্রান্ত করে তাদের খুন করতে সক্ষম হওয়াটা স্বাভাবিক নয়। কিন্তু চিন্তা করলে দেখা যায় প্রতিটি খুন ও ধংসের সূচনা কিন্তু মানুষ তার রক্তের সম্পর্কের মানুষকে দিয়েই শুরু করেছে। কারণ আত্মহত্যার চেয়ে খুনের সূচনা আগে। প্রথম খুন যদি অস্বাভাবিক না হয় তাহলে বর্তমানে কেন এটি স্বাভাবিক হবে না ! এই জন্যই একে ধরে নেয়া হচ্ছে ট্যাঁবু হিসেবে।
আসুন আমাদের সমাজের দিকে চোখ দেয়া যাক। কি হচ্ছে আমাদের বর্তমান সমাজে ? সমাজ ভেদে ট্যাঁবু বদলায়। এই সমাজের ট্যাঁবু গুলো মূলত -
ধর্ম : "চিত্রা নদীর পারে" সিনেমাটি গড়ে উঠেছিল দেশভাগ পরবর্তী ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে। এর একটি দৃশ্য ছিল, নায়িকা চরিত্রে আফসানা মিমি ও পাঁশের মুসলমান বাড়ির এক ছোট বোন আলাপ করছে, " জানিস দিদি, আমরা ছোটবেলায় কি মনে করতাম? আমরা ভাবতাম লাল পিপড়াগুলো খারাপ কারণ ওরা কামড়ায়। তাই ওরা হিন্দু। আর কাল পিঁপড়াগুলো ভাল। তাই ওরা মুসলমান।" এই রকম কোন চিন্তা কি ছিল আপনাদের মনে ছোটবেলায় ? ভেবে দেখুন অনেকের থাকার কথা। আমরা ভাল, ওরা খারাপ; আমরা শ্রেষ্ঠ, ওরা নিকৃষ্ট; আমরাই সত্য, ওরা মিথ্যা। ছোটবেলা থেকেই আমাদের ধর্মীয় অনুভুতি জাগ্রত করা হয় এই রকমের চিন্তায়। আমরা ধার্মিক হয় জন্মসূত্রে। বুঝে ধর্ম মেনে নেয়ার সুযোগ আমাদের থাকে না। বোঝার ক্ষমতা জন্ম নেয়ার আগেই আমদের মাঝে জন্ম দিয়ে ফেলা হয় এই রকম ট্যাঁবু। নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব আমাদের অন্য ধর্মকে প্রশ্ন করতে মজা দেয় কিন্তু নিজ ধর্মকে প্রশ্ন করতে গিয়েও আমরা নিজের অনুভুতিকে অস্বীকার করি।
লিঙ্গ : এই ট্যাঁবু আবার দুই রকম। এক, নিজ লিঙ্গের শ্রেষ্ঠত্ব। দুই, অস্বাভাবিক লিঙ্গ। একটা সময় জানতাম লিঙ্গ দুই প্রকার। পুং লিঙ্গ আর স্ত্রী লিঙ্গ। তৃতীয় লিঙ্গ থাকতে পারে জানা ছিল না। কারণ কেও জানায়নি। তৃতীয় লিঙ্গের ওরা মানুষ নাকি মানুষ সাদৃশ্য কোন প্রাণী বুঝতে সময় লেগেছে। পুরুষ শ্রেষ্ঠ এই ভাবনা চলে আসছে আদিকাল থেকে। তবে বেশ বড় ধাক্কাও খেয়েছে এই চিন্তাধারা। কঠিন শারীরিক কাজ ছেলেদের। মেয়েদের স্থান নেই সেখানে। একটা সময় নারী পুরুষ শিকার করতো এক সাথে, চাষবাস করতো এক সাথে, ঘর বানাতো এক সাথে। কেন হুট করে পুরুষ শ্রেষ্ঠ মাতম উঠলো কে জানে ! আপনি চিন্তা করুন একজন মাটিকাটা শ্রমিককে। কি ভেসে উঠেছে আপনার সামনে ? একজন পুরুষ শ্রমিক। কেন একজন নারী শ্রমিক এর চেহারা ভেসে উঠলো না ! কারণ আমাদের মাঝে কাজ করছে পুরুষ শ্রেষ্ঠ ট্যাঁবু।
যেখানে দুই লিঙ্গের সমতা হচ্ছে না সেখানে তৃতীয় পক্ষ আর কি সুবিধা করতে পারবে। কেন হিজড়ারা ঘৃণার শিকার হবে ! হ্যাঁ, তারা জোর করে টাকা তুলে, রাস্তাঘাটে হয়রানি করে। ভেবেছেন কি আপনার পরিবারে একজন তৃতীয় লিঙ্গের কেও জন্মালে কি করতেন। তাকে লেখাপড়া করাতেন কি? সমাজে তার অবস্থান গড়তে সাহায্য করতেন কি? পরিবারে কি তাকে আশ্রয় দিতেন? নাকি সবায় যা করে তাই করতেন, অন্য হিজড়াদের কাছে দিয়ে দিতেন তাকে। সে জন্ম নিয়েছে মরতে নয়, বাঁচতে। হ্যাঁ তারা দোকানে চাঁদা তুলবে, ভাংচুর করবে। মানুষ হিসেবে বাঁচতে দিচ্ছে না। জানোয়ার হিসেবে বাঁচবে। এই সমাজের মানুষরূপী জানোয়ারের থেকে জানোয়াররুপী মানুষ ভাল।
বর্ণ : সাদা চামড়ার প্রতি আমাদের দুর্বলটা একটু বেশীই বলা যায়। ছোট ছোট বাচ্চাদের ও কে কত ফর্সা সেটা নিয়ে বেশ প্রতিযোগিতা করতে দেখা যায়। এই মানসিকতা তারা পাচ্ছে কার থেকে? বর্ণ শ্রেষ্ঠত্ব তাদের মাথায় ঢুকলো কিভাবে? জী, সকল শিক্ষার মত এই শিক্ষাও শুরু হয় পরিবার থেকে। পরিবারে বাবা মা নিজেরা বিচার করে কে ফর্সা, কে কাল। যে বেশী ফর্সা তাকেই আখ্যায়িত করে সুন্দর হিসেবে।
চামড়া সাদা হলেই আমাদের কাছে রীতিমতো পূজনীয় হয়ে যায়। প্রায় সময় বিদেশের কিছু ট্যাঁব্লয়েদ পত্রিকা বাংলাদেশের নানা ইস্যু নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আর আমাদের প্রধান দৈনিক গুলো সেই পত্রিকাগুলকেই আবার কোট করে খবর ছাপে। কেও কেও তুমুল আলোচনার ফাকে সেই পত্রিকাগুলর রেফারেন্স দেয়। বিদেশে ওই পত্রিকাগুলো কেও টয়লেট টিস্যু হিসেবেও ব্যাবহার করে না। হিসাব করলে তাদের মান আমাদের দেশের চটি পত্রিকাগুলর মতই। কিন্তু তারপর ও মাতামাতি। কারণ সাদা চামড়ার মানুষের পত্রিকা বলে কথা।
__._,_.___