উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে!
কবীর নয়ন
মেয়েটির বয়স ১৬ হল। চোখে হাজারো স্বপ্ন, বিশ্ব জয়ের, আকাশ ছোঁয়ার। মনে কৈশোরের চপলতা, অনাবিল আনন্দ। নিজের মতো করে দুনিয়াটাকে চিনে নিতে, সাজিয়ে নিতে চায় সে। নিজের পড়ালেখা, এগিয়ে চলা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। এমন সময়, "উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে"। একবার ভাবুন তো...
সরকার বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের (The Child Marriage Restraint Act, 1929) বদলে নতুন আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর বলা হলেও বাবা-মা বা আদালতের সম্মতি সাপেক্ষে তা ১৬ বছর করা হচ্ছে। নতুন আইনে ১৬ বছরের মেয়ের বিয়ের জন্য 'বিশেষ প্রয়োজন' বা 'যুক্তিসঙ্গত কারণ'-এর কথা উল্লেখ থাকলেও এর অপব্যবহারই যে বেশি হবে তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশে যেখানে অহরহ মা-বাবাই বাল্যবিয়ের আয়োজন করে, সেখানে তাঁদেরকে এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেয়া মানে অবিবেচনাপ্রসূতভাবে বাল্যবিয়ে আয়োজনকারীদের হাতে একটি মোক্ষম অস্ত্র তুলে দেয়া।
অন্যদিকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আদালত এবং আইন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মানসিকতার বিষয়টিও জড়িত। আদালতে এডভোকেট, পাবলিক প্রসিকিউটরসহ সবাই যে নারীর বিষয়ে সচেতন, তা নয়। সাধারণ ভাবে বিয়ের বয়স ১৮ রেখে আদালতকে ১৬ বছরে বিয়ের অনুমতি প্রদানের দায়িত্ব দেয়া মানে আদালতকেই আইনের ব্যত্যয় ঘটানোর দায়িত্ব দেয়া। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়; ধরা যাক ১৬ বছর বয়সের একটি মেয়ে 'পালিয়ে' আদালতে এসে বিয়ের অনুমতি চাইল, আদালত তখন কি করবেন? আইন রক্ষার্থে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে 'পালিয়ে যাওয়া'-কে 'বিশেষ প্রয়োজন' বা 'যুক্তিসংগত কারণ' হিসেবে বিবেচনা করে বিয়ের অনুমতি দেবেন?
আদালতে বিয়ের অনুমতি নিতে হলে নিশ্চয়ই একটি মামলা করতে হবে, কিন্তু প্রশ্ন হল সেই মামলার বাদী কে হবে? ১৮ বছর বয়স না হলে অর্থাৎ সাবালকত্ব না থাকলে কেউ সরাসরি মামলা করতে পারে না, আইনগত অভিভাবকের মাধ্যমে মামলা দায়ের করতে হয়। তার মানে হল, ঘুরেফিরে ক্ষমতাটি বাল্যবিয়ে আয়োজনকারীদের হাতেই থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ১৬ বছর বয়সী কয়জন মেয়ের সাহস হবে অভিভাবকদের হুকুমের বাইরে গিয়ে বিয়েতে আপত্তি জানানোর? আরেকটি গুরুতর সমস্যা হল, এই মামলার বিবাদী কাকে করা হবে? যে বাল্যবিয়েতে বাধা দিবে তাকে?
একটি আইন শতভাগ জনগণকে মানতে কখনোই বাধ্য করা যায় না, কিন্তু আইন সমাজে একটি মানদণ্ড তৈরি করে দেয়। প্রায় ১০০ বছর ধরে এদেশে মেয়েদের বিয়ের আইনানুগ বয়স ১৮ বছর। এখন এটি একটি মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমানো, মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্যের উন্নতি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, নারীশিক্ষাকে উৎসাহ প্রদান, নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার ও নারীর সমঅধিকার ইত্যাদি অনেক সামাজিক সূচকের প্রতি লক্ষ্য রেখে আইনে বিয়ের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছিল। একে সামনে রেখে সরকারী-বেসরকারী অগণিত উন্নয়নকর্মী, অধিকারকর্মী ও নারীআন্দোলনকর্মীর শতবছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে যখন দেশের সামাজিক সূচকগুলোতে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হচ্ছে, তখন মেয়েদের বিয়ের বয়সের প্রতিষ্ঠিত যৌক্তিক মানদণ্ড থেকে পিছু হটা সমাজে অবশ্যই একটি খারাপ ইংগিত দেবে।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ, বাংলাদেশের শিশু নীতি এবং শিশু আইন সহ অনেক আইনে ১৮ বছরের কম বয়স্ক প্রত্যেককে শিশু বলা হয়েছে। সাবালকত্ব অর্জনের জন্য ন্যুনতম বয়স ১৮ বছর করার প্রধান কারণ হল তার আগে কোনও ব্যক্তির সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্ণ সক্ষমতা ও পরিপক্বতা আসে না। বাংলাদেশে সাবালক না হলে কোন ব্যক্তি ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। সাবালক না হলে কোন ব্যক্তি চুক্তি করতে পারে না কারণ তা না হলে চুক্তিতে তার সম্মতির কোন মূল্য নেই। বিয়ে একধরণের সামাজিক চুক্তি এবং এতে স্বাধীন সম্মতি একটি অপরিহার্য উপাদান। এক্ষেত্রে পক্ষদ্বয়ের সাবালকত্বকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই কারন একজন নাবালকের সম্মতিকে আইনে কখনই স্বাধীন সম্মতি হিসেবে গণ্য করা হয় না।
বাবা-মায়ের কিংবা আদালতের সিদ্ধান্তে মেয়েদের ১৬ বছরে বিয়ের আইন করলে এই ইংগিতই দেয়া হয় যে, মেয়েদের নিজের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার অধিকারকে সরকার সমর্থন করে না। বিয়ের মতো জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত একজনের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়ার প্রথা যেখানে বিলোপ করা জরুরী, সেখানে এধরনের পশ্চাৎপদ আইন করে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বলপূর্বক বিয়ে দেয়ার মধ্যযুগীয় পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে উৎসাহিত করার কোনও মানে হয় না। এদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী এতে ভীষণভাবে উৎসাহিত হবে কারণ তাদের লক্ষ্যই হচ্ছে নারীদের পশ্চাৎপদ করে রেখে অধিকারবঞ্চিত করা। কমবয়সী এবং অপরিপক্ব মেয়েকে বিয়ে দিলে মানসিকভাবে গুড়িয়ে দিয়ে তাকে আজীবন শোষণ করা সহজ হয়। তাকে পরমুখাপেক্ষী, ভীতু, অক্ষম এবং অসম্পূর্ণ একটি মানুষে পরিণত করা সহজ হয়। তার শিক্ষা অর্জনের পথ রুদ্ধ করে সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠা সহসাই বন্ধ করা যায়। একটি নিরঙ্কুশ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করে দেশকে মধ্যযুগীয় অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়া সহজ হয়। তাই নারীবিদ্বেষী, নারীশিক্ষা বিরোধী, পুরুষতান্ত্রিক মৌলবাদী গোষ্ঠী বরাবর বাল্যবিয়ের পক্ষে অবস্থান নেয়।
__._,_.___