বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব ও 'জয় বাংলা'
শামসুজ্জামান খান
শামসুজ্জামান খান
'জয় বাংলা' স্লোগানটি বাংলাদেশের উদ্ভবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। গ্রামভিত্তিক, সমন্বয়বাদী ও লোকজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং আধুনিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনাঋদ্ধ সাংস্কৃতিক বোধের ভেতর থেকে এর শক্তি সমন্বয় করে প্রবলভাবে বেড়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল। বাংলাদেশ ভূখণ্ড ও ভারতীয় উপমহাদেশের সনাতন ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার কূটচক্রের আবহে এই স্লোগান বিগত বছরগুলোতে অপেক্ষাকৃত ছোট স্পেসে টিকে থেকেছে। বলা যেতে পারে, এর ঐতিহাসিক বিকাশ প্রক্রিয়ার মূলধারার চেয়ে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও আরোপিত রাজনৈতিক কূটকৌশল সামরিক, ছদ্মসামরিক এবং বাংলাদেশবিরোধী শক্তির অনুচরদের মদদে শক্তি অর্জন করে জনগণকে কিছু বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হওয়ায় এমনটি ঘটেছিল। মুক্তবুদ্ধি মননজীবী, স্বচ্ছ চিন্তার সংস্কৃতিকর্মী ও সাহিত্যিক-শিল্পীদের একটা বড় অংশ ও আলোকিত নতুন প্রজন্মের ছাত্র এবং তরুণদের একটা বিশাল বাহিনী স্বাভাবিকভাবেই প্রথম ধারা বা সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্য চিন্তার সেক্যুলার প্যাটার্নের সঙ্গে যুক্ত আছে। তাঁরা বিচ্ছিন্নভাবে মূল ধারার ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন। তবু তাঁদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান এত দিন নিচু মাত্রায় থাকায় 'প্রজন্ম ৭১' বা 'একাত্তরের যাত্রীরা' এত দিন সোচ্চারভাবে 'জয় বাংলার' ব্যবহার করেছে এটা চোখে পড়েনি। ছাত্ররাজনীতি ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ-চেতনার বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়াতেই মূলত এমনটা ঘটেছিল। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর এই ফেব্রুয়ারিতে সেই জায়গাটা নিয়ে ষাট-সত্তরের দশকের দ্রোহি ছাত্র আন্দোলনের মশাল হাতে তুলে নিয়ে ইতিহাসকে তার স্বাভাবিক প্রগতির ধারায় ফিরিয়ে এনেছে।
দুই.
ঐতিহাসিকভাবে দেখলে হিন্দু-মুসলিম বাঙালির ধর্মীয় আবদ্ধতা ও গোঁড়ামি এবং চিন্তা-চেতনার নিশ্চলতার মধ্যে প্রায় এককভাবেই জাগৃতির প্রবল বেগ ও ব্যাপকতা এনেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। গোটা বাঙালি জাতিকে তিনি জাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ওই চেতনার প্রোজ্বল শিখায়। তাঁর চিন্তার সহযোগী ছিলেন কমবেশি মাত্রার সক্রিয় জীবনমুখী ও আধুনিক বাঙালি জাতি গঠনের সাধনায় নিয়োজিত সাহিত্য সাধক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ক্ষিতিমোহন সেন, এস ওয়াজেদ আলী, হুমায়ুন কবীর, বিজ্ঞানী স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং রাজনীতি ক্ষেত্রে এ কে ফজলুল হক, সুভাষ চন্দ্র বসু, সি আর দাশ প্রমুখ। এই বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার জাতীয়তাবাদীরাই ১৯৩০ সালে নজরুলকে বাঙালি জাতির 'জাতীয় কবি' হিসেবে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। আর রক্ষণশীল, মূঢ় ও সামাজিক চেতনাহীন তথাকথিত মুসলমানরা তাঁকে 'কাফের' আখ্যা দিয়েও পূর্ণ পরিতৃপ্ত হয়নি। তাদেরই একজন নজরুলকে বলেছিলেন : 'লোকটা মুসলমান না শয়তান'। সাম্প্রদায়িক মুসলমান ও হিন্দুদের আক্রোশ নজরুলের চিন্তার স্বচ্ছতা, প্রগতিশীলতা ও সমন্বিত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের দীপ্রতাকে কিছুমাত্র ম্লান করতে পারেনি। তিনি অবৈজ্ঞানিক ও উদ্ভট দ্বিজাতিতত্ত্বের রাজনৈতিক প্রজনন পাকিস্তানকে 'ফাঁকিস্তান' নামেই আখ্যাত করে গেছেন। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রজীবনে পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় জিন্নাহর উর্দুর পক্ষে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী বক্তব্যের বিরোধিতা দিয়ে শুরু করে মুজিব ধীরে ধীরে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের অগ্রনায়কের ভূমিকায় চলে আসেন। প্রকৃতপক্ষে নজরুল এবং বঙ্গবন্ধুই বাংলার হাজার বছরের সমন্বয়বাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ জীবনচর্যার ভাববস্তুকে নবরূপে বিন্যস্ত করে বিপুল গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন।
তিন.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর সাহিত্যকে ভালোবাসতেন। বক্তৃতা-বিবৃতি ও আলাপচারিতায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে আবৃত্তি করতেন। এতে সাধারণ্যে এমন ধারণা চালু হয়ে যায় যে শেখ মুজিব রবীন্দ্র ভক্ত; এ ধারণায় বিন্দুমাত্র ভুল নেই। তবে মুজিবের উত্তরাধিকারের মধ্যে শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, নজরুলেরও অবস্থান ছিল বেশ দৃঢ়। তাই বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের চিন্তাধারার মৌলিক অন্তঃসারকে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি করতে চেয়েছিলেন তিনি। আমার এ অনুমানের উদাহরণ খুব স্পষ্টভাবেই চোখে পড়ে। প্রথম উদাহরণ তো এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। বিদ্রোহী কবিকে ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্য কারো পক্ষে এটা সম্ভব ছিল না। কবিকে এ দেশে আনার মধ্যে শেখ সাহেবের ভেতরের চিন্তা কী ছিল তা আমরা হুবহু বলতে পারব না। তবে অনুমান করতে পারি। আমাদের অনুমান অবশ্য নিছক অনুমান নয়। ওই অনুমানের পক্ষে কিছু তথ্য-প্রমাণ হাজির করব।
দ্বিতীয় ও মূল উদাহরণের কথাটিকে যদি এভাবে তুলি যে প্রাজ্ঞ চেতনা ও ইতিহাসবোধ শেখ সাহেবের চিন্তার পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল। আর সে জন্যই বাংলার দুই মহান কবির ভাবনা থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান দুটি মৌল স্তম্ভকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। এর একটা জাতীয় সংগীত। পূর্ব বাংলার বাউল সুরে রচিত রবীন্দ্রনাথের 'আমার সোনার বাংলা' গানকে তিনি খুব যথার্থভাবেই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করেছিলেন। অন্যটি সেক্যুলার বাংলাদেশের প্রতীক: 'জয় বাংলা'। নজরুলের বাংলাদেশ বন্দনা: 'নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মমঃ' বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টির বাইরে ছিল না। এর পরে তো তিনি নজরুলের কাছ থেকে আরো স্বচ্ছ এবং লাগসই পঙ্ক্তিই পেয়ে যান। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভেতর থেকে নজরুল চয়ন করেছিলেন : 'বাংলা বাঙালির হোক। বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক'- এ অবিনাশী পঙ্ক্তিমালা। এসব পঙ্ক্তি না থাকলে আকস্মিকভাবে বঙ্গবন্ধু 'জয় বাংলা' স্লোগান তুলতে পারতেন না। 'বাংলার জয় হোক' আর 'জয় বাংলার' মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে! অতএব, নজরুলের কাছে বঙ্গবন্ধু বিশেষভাবে ঋণী তাঁর 'জয় বাংলা' স্লোগানের জন্য। আমাদের উদ্ধৃত পঙ্ক্তিতে অর্থ ঠিক থাকলেও শব্দের কিছু ভিন্নতা আছে; ('বাংলার জয় হোক'; আর বঙ্গবন্ধু ব্যবহার করেছেন 'জয় বাংলা') কিন্তু কবি তাঁর 'ভাঙার গান' (১৯২২) কাব্যগ্রন্থে 'পূর্ণ অভিনন্দন' কবিতায় হুবহু 'জয় বাংলা' শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, ফরিদপুরের এক বিপ্লবী অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র দাস, যাঁকে কবি মাদারীপুরের 'মর্দ্দবীর' বলে উল্লেখ করেছেন, তাঁর কারামুক্তি উপলক্ষে ওই কবিতাটি রচিত। কবিরা দিব্যদৃষ্টির অধিকারী। নজরুলের ভাঙার গানের ওই কবিতা সে কথাকেই মনে করিয়ে দেয়।
কবি নজরুল ও তাঁর চিন্তার অনুসারী কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হোসেনদের ঢাকা থেকে বহিষ্কার করেছিলেন ঢাকায় রক্ষণশীল নবাব ও তাঁর অনুচররা। বঙ্গবন্ধু নজরুলকে যেন বিপরীত চেতনার প্রতীক প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। এ ঘটনার তাৎপর্য অনেক।
তো এখানেই একটা মৌলিক প্রশ্ন ওঠে, তা হলো : নজরুলকে যদি 'জাতীয় কবি' অর্থাৎ বাঙালির সমন্বিত জাতিসত্তার মূল ধারক হিসেবে গ্রহণ করে এই অভিধায় অখ্যাত করা হয় তাহলে তা করার অধিকার ছিল বঙ্গবন্ধুর এবং যাঁরা 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' ও 'জয় বাংলা'য় বিশ্বাস করেন তাঁদের। 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ' ও 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম'-ওয়ালাদের নজরুলকে 'জাতীয় কবি' বলার অধিকার তো সংগত কারণেই থাকে না। কারণ, 'লেবার স্বরাজ পার্টির' স্রষ্টা ও আধুনিক বাঙালিত্বের তাত্তি্বক ও সাধক কবি নজরুল অমন বিষয় রাজনীতি ক্ষেত্রে অনুমোদন করেননি। অতএব, তাঁরা নজরুলকে 'জাতীয় কবি' বললে তার পেছনের মতলবটা এক মৌলিক বিরোধ হয়ে দাঁড়ায়। নজরুলের মতো মহান কবিকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে 'জাতীয় কবি' বলা এও ইতিহাস ও সত্যের এক ধরনের বিকৃতি।
চার.
'জয় বাংলা'কে স্বীকার না করলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মৌলচারিত্র্যকে অস্বীকার করা হয়। যাঁরা এ স্লোগান বর্জন করেছেন, তাঁরা প্রকৃত বাঙালি নন, বাংলাদেশের মৌল জাতীয় সত্তায় বিশ্বাসী নন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামেও বিশ্বাসী নন এবং আমাদের হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তির তাঁরা শত্রুপক্ষ। বিখ্যাত পণ্ডিত ড. মুহাম্মদ এনামুল হক (তিনি আরবি ভাষা সাহিত্যে অনার্স এবং মুসলিম বাংলা সাহিত্য ও Sufism in Bengal গ্রন্থের লেখক) বলেছেন, 'জয় বাংলা' শুধু একটি রাজনৈতিক জিগির-স্লোগান নয়, এ হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র বা 'ইসমে আজম'। এ বীজমন্ত্রটি যিনি আবিষ্কার করেন তিনি হচ্ছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ সাহেবের অদ্ভুত পৌরুষব্যঞ্জক কণ্ঠে যেদিন এ 'ইসমে আজম' উচ্চারিত হলো, সেদিন তড়িৎ প্রবাহের মতো দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের লাখ লাখ নয়, কোটি কোটি কণ্ঠে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হলো সে অমোঘ মন্ত্র। তাদের অন্তরের সুপ্তচেতনা জেগে উঠল এবং লুপ্ত অনুভূতি পুনরুজ্জীবিত হলো। তারা ভাবল জাতিত্বে তারা হিন্দু নয়, তারা বৌদ্ধ নয়, তারা খ্রিস্টান নয়, তারা মুসলমান নয়, তারা বাংলাদেশের মানুষ, তারা বাঙালি। এ যে দেশপ্রেম, এ যে জাতীয়তাবোধ, 'জয় বাংলা' তারই বীজমন্ত্র, তারই 'ইসমে আজম'।
দেশের স্বল্পসংখ্যক মূঢ় লোক, দেশদ্রোহী স্বাধীনতাবিরোধী 'জয় বাংলার' বীজমন্ত্রে অনৈসলামিক ভাব ও প্রভাব বর্তমান, এ কাল্পনিক অজুহাতে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে এর প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছে (ড. মুহম্মদ এনামুল হক, বাঙালি বাংলাদেশ)।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও বলেছেন, 'আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।' তাহলে বাংলার সুলতানি আমলের সুলতানদের বাঙালিত্বের সাধনা থেকে শুরু হয়ে সপ্তদশ শতকের কবি আবদুল হাকিম ও লালন ফকির, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহাম্মদ এনামুল হক, মওলানা ভাসানী (তাঁরা সবাই 'বাঙালি' বলতেন) ও শত মনীষীর চিন্তাকে অমান্য ও অশ্রদ্ধা করে আমরা কী ইতিহাসের ধারা থেকে বিচ্যুত হইনি? বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতা এখানেই যে তিনি তাঁদের চিন্তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন।
পাঁচ.
বঙ্গবন্ধুকে গভীর চক্রান্তের মাধ্যমে হত্যা করে বাংলাদেশের মূল চারিত্র্য অর্থাৎ চার রাষ্ট্রনীতি বদলে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ খুব যথার্থভাবে বলেছেন : "বাংলাদেশের সংবিধানে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' লিপিবদ্ধ করার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করে যারাই ক্ষমতায় আসে তারা সংবিধানকে বিনষ্ট করে।" তিনি বলেন, 'পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় মূলনীতি ও প্রস্তাবনার পরিবর্তন করে এমন অবস্থায় দেশকে নিয়ে আসা হয়েছে, যাতে মনে হয় আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি, ধর্মযুদ্ধ করেছি। এই সংশোধনীর প্রস্তাবনায় রয়েছে ধর্ম নাকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল' (ভোরের কাগজ, ১৫ জুলাই ১৯৯৫)। এ অবস্থায় 'জয় বাংলাকে' উড়িয়ে দেওয়া হবে এটা অস্বাভাবিক নয়। তবে 'জয় বাংলা' তো ইতিহাসের অনেক আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে আমাদের জাতীয় আত্মপরিচয়ের ধারার সঙ্গে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও গণজাগরণ এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিপুল গণসমর্থনধন্য এ স্লোগানটি ড. মুহাম্মদ এনামুল হকসহ সব দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী অন্তরের সঙ্গে সমর্থন করেছিলেন। আর কবি নজরুল ইসলাম তো এ 'জয় বাংলার' মূল উদ্ভাবক। এমনকি মওলানা আকরম খাঁ তাঁর 'মোস্তফা চরিত' গ্রন্থে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নামের সঙ্গে 'জয় মোহাম্মদ' ব্যবহার করেছেন। অতএব আমাদের গোটা ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ইতিহাস সম্বন্ধে অনেক ভেবে-বুঝেই বঙ্গবন্ধুও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ মূল ভাবনার দায় তো মূল নেতার বা প্রধান চরিত্রের, দৌবারিকের নয়।
লেখক: মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমী [ঢাকা, শনিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, ৪ ফাল্গুন ১৪১৯, ৫ রবিউস সানি ১৪৩৪]http://www.kalerkantho.com/print_edition/index.php?view=details&type=gold&data=news&pub_no=1155&cat_id=2&menu_id=20&news_type_id=1&index=0&archiev=yes&arch_date=16-02-2013#.VWOQ1dJViko
'জয় বাংলা' স্লোগান বঙ্গবন্ধু নজরুলের একটি কবিতা থেকে নেন
- কাজী নজরুল ইসলাম---ভাঙ্গার গান
দুই.
ঐতিহাসিকভাবে দেখলে হিন্দু-মুসলিম বাঙালির ধর্মীয় আবদ্ধতা ও গোঁড়ামি এবং চিন্তা-চেতনার নিশ্চলতার মধ্যে প্রায় এককভাবেই জাগৃতির প্রবল বেগ ও ব্যাপকতা এনেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। গোটা বাঙালি জাতিকে তিনি জাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ওই চেতনার প্রোজ্বল শিখায়। তাঁর চিন্তার সহযোগী ছিলেন কমবেশি মাত্রার সক্রিয় জীবনমুখী ও আধুনিক বাঙালি জাতি গঠনের সাধনায় নিয়োজিত সাহিত্য সাধক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ক্ষিতিমোহন সেন, এস ওয়াজেদ আলী, হুমায়ুন কবীর, বিজ্ঞানী স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এবং রাজনীতি ক্ষেত্রে এ কে ফজলুল হক, সুভাষ চন্দ্র বসু, সি আর দাশ প্রমুখ। এই বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার জাতীয়তাবাদীরাই ১৯৩০ সালে নজরুলকে বাঙালি জাতির 'জাতীয় কবি' হিসেবে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। আর রক্ষণশীল, মূঢ় ও সামাজিক চেতনাহীন তথাকথিত মুসলমানরা তাঁকে 'কাফের' আখ্যা দিয়েও পূর্ণ পরিতৃপ্ত হয়নি। তাদেরই একজন নজরুলকে বলেছিলেন : 'লোকটা মুসলমান না শয়তান'। সাম্প্রদায়িক মুসলমান ও হিন্দুদের আক্রোশ নজরুলের চিন্তার স্বচ্ছতা, প্রগতিশীলতা ও সমন্বিত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের দীপ্রতাকে কিছুমাত্র ম্লান করতে পারেনি। তিনি অবৈজ্ঞানিক ও উদ্ভট দ্বিজাতিতত্ত্বের রাজনৈতিক প্রজনন পাকিস্তানকে 'ফাঁকিস্তান' নামেই আখ্যাত করে গেছেন। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রজীবনে পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় জিন্নাহর উর্দুর পক্ষে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী বক্তব্যের বিরোধিতা দিয়ে শুরু করে মুজিব ধীরে ধীরে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের অগ্রনায়কের ভূমিকায় চলে আসেন। প্রকৃতপক্ষে নজরুল এবং বঙ্গবন্ধুই বাংলার হাজার বছরের সমন্বয়বাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ জীবনচর্যার ভাববস্তুকে নবরূপে বিন্যস্ত করে বিপুল গণমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন।
তিন.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর সাহিত্যকে ভালোবাসতেন। বক্তৃতা-বিবৃতি ও আলাপচারিতায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে আবৃত্তি করতেন। এতে সাধারণ্যে এমন ধারণা চালু হয়ে যায় যে শেখ মুজিব রবীন্দ্র ভক্ত; এ ধারণায় বিন্দুমাত্র ভুল নেই। তবে মুজিবের উত্তরাধিকারের মধ্যে শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, নজরুলেরও অবস্থান ছিল বেশ দৃঢ়। তাই বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের চিন্তাধারার মৌলিক অন্তঃসারকে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি করতে চেয়েছিলেন তিনি। আমার এ অনুমানের উদাহরণ খুব স্পষ্টভাবেই চোখে পড়ে। প্রথম উদাহরণ তো এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। বিদ্রোহী কবিকে ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অন্য কারো পক্ষে এটা সম্ভব ছিল না। কবিকে এ দেশে আনার মধ্যে শেখ সাহেবের ভেতরের চিন্তা কী ছিল তা আমরা হুবহু বলতে পারব না। তবে অনুমান করতে পারি। আমাদের অনুমান অবশ্য নিছক অনুমান নয়। ওই অনুমানের পক্ষে কিছু তথ্য-প্রমাণ হাজির করব।
দ্বিতীয় ও মূল উদাহরণের কথাটিকে যদি এভাবে তুলি যে প্রাজ্ঞ চেতনা ও ইতিহাসবোধ শেখ সাহেবের চিন্তার পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল। আর সে জন্যই বাংলার দুই মহান কবির ভাবনা থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান দুটি মৌল স্তম্ভকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। এর একটা জাতীয় সংগীত। পূর্ব বাংলার বাউল সুরে রচিত রবীন্দ্রনাথের 'আমার সোনার বাংলা' গানকে তিনি খুব যথার্থভাবেই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করেছিলেন। অন্যটি সেক্যুলার বাংলাদেশের প্রতীক: 'জয় বাংলা'। নজরুলের বাংলাদেশ বন্দনা: 'নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মমঃ' বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টির বাইরে ছিল না। এর পরে তো তিনি নজরুলের কাছ থেকে আরো স্বচ্ছ এবং লাগসই পঙ্ক্তিই পেয়ে যান। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভেতর থেকে নজরুল চয়ন করেছিলেন : 'বাংলা বাঙালির হোক। বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক'- এ অবিনাশী পঙ্ক্তিমালা। এসব পঙ্ক্তি না থাকলে আকস্মিকভাবে বঙ্গবন্ধু 'জয় বাংলা' স্লোগান তুলতে পারতেন না। 'বাংলার জয় হোক' আর 'জয় বাংলার' মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে! অতএব, নজরুলের কাছে বঙ্গবন্ধু বিশেষভাবে ঋণী তাঁর 'জয় বাংলা' স্লোগানের জন্য। আমাদের উদ্ধৃত পঙ্ক্তিতে অর্থ ঠিক থাকলেও শব্দের কিছু ভিন্নতা আছে; ('বাংলার জয় হোক'; আর বঙ্গবন্ধু ব্যবহার করেছেন 'জয় বাংলা') কিন্তু কবি তাঁর 'ভাঙার গান' (১৯২২) কাব্যগ্রন্থে 'পূর্ণ অভিনন্দন' কবিতায় হুবহু 'জয় বাংলা' শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, ফরিদপুরের এক বিপ্লবী অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ্র দাস, যাঁকে কবি মাদারীপুরের 'মর্দ্দবীর' বলে উল্লেখ করেছেন, তাঁর কারামুক্তি উপলক্ষে ওই কবিতাটি রচিত। কবিরা দিব্যদৃষ্টির অধিকারী। নজরুলের ভাঙার গানের ওই কবিতা সে কথাকেই মনে করিয়ে দেয়।
কবি নজরুল ও তাঁর চিন্তার অনুসারী কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হোসেনদের ঢাকা থেকে বহিষ্কার করেছিলেন ঢাকায় রক্ষণশীল নবাব ও তাঁর অনুচররা। বঙ্গবন্ধু নজরুলকে যেন বিপরীত চেতনার প্রতীক প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। এ ঘটনার তাৎপর্য অনেক।
তো এখানেই একটা মৌলিক প্রশ্ন ওঠে, তা হলো : নজরুলকে যদি 'জাতীয় কবি' অর্থাৎ বাঙালির সমন্বিত জাতিসত্তার মূল ধারক হিসেবে গ্রহণ করে এই অভিধায় অখ্যাত করা হয় তাহলে তা করার অধিকার ছিল বঙ্গবন্ধুর এবং যাঁরা 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' ও 'জয় বাংলা'য় বিশ্বাস করেন তাঁদের। 'বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ' ও 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম'-ওয়ালাদের নজরুলকে 'জাতীয় কবি' বলার অধিকার তো সংগত কারণেই থাকে না। কারণ, 'লেবার স্বরাজ পার্টির' স্রষ্টা ও আধুনিক বাঙালিত্বের তাত্তি্বক ও সাধক কবি নজরুল অমন বিষয় রাজনীতি ক্ষেত্রে অনুমোদন করেননি। অতএব, তাঁরা নজরুলকে 'জাতীয় কবি' বললে তার পেছনের মতলবটা এক মৌলিক বিরোধ হয়ে দাঁড়ায়। নজরুলের মতো মহান কবিকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে 'জাতীয় কবি' বলা এও ইতিহাস ও সত্যের এক ধরনের বিকৃতি।
চার.
'জয় বাংলা'কে স্বীকার না করলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মৌলচারিত্র্যকে অস্বীকার করা হয়। যাঁরা এ স্লোগান বর্জন করেছেন, তাঁরা প্রকৃত বাঙালি নন, বাংলাদেশের মৌল জাতীয় সত্তায় বিশ্বাসী নন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামেও বিশ্বাসী নন এবং আমাদের হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তির তাঁরা শত্রুপক্ষ। বিখ্যাত পণ্ডিত ড. মুহাম্মদ এনামুল হক (তিনি আরবি ভাষা সাহিত্যে অনার্স এবং মুসলিম বাংলা সাহিত্য ও Sufism in Bengal গ্রন্থের লেখক) বলেছেন, 'জয় বাংলা' শুধু একটি রাজনৈতিক জিগির-স্লোগান নয়, এ হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র বা 'ইসমে আজম'। এ বীজমন্ত্রটি যিনি আবিষ্কার করেন তিনি হচ্ছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ সাহেবের অদ্ভুত পৌরুষব্যঞ্জক কণ্ঠে যেদিন এ 'ইসমে আজম' উচ্চারিত হলো, সেদিন তড়িৎ প্রবাহের মতো দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের লাখ লাখ নয়, কোটি কোটি কণ্ঠে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হলো সে অমোঘ মন্ত্র। তাদের অন্তরের সুপ্তচেতনা জেগে উঠল এবং লুপ্ত অনুভূতি পুনরুজ্জীবিত হলো। তারা ভাবল জাতিত্বে তারা হিন্দু নয়, তারা বৌদ্ধ নয়, তারা খ্রিস্টান নয়, তারা মুসলমান নয়, তারা বাংলাদেশের মানুষ, তারা বাঙালি। এ যে দেশপ্রেম, এ যে জাতীয়তাবোধ, 'জয় বাংলা' তারই বীজমন্ত্র, তারই 'ইসমে আজম'।
দেশের স্বল্পসংখ্যক মূঢ় লোক, দেশদ্রোহী স্বাধীনতাবিরোধী 'জয় বাংলার' বীজমন্ত্রে অনৈসলামিক ভাব ও প্রভাব বর্তমান, এ কাল্পনিক অজুহাতে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে এর প্রচণ্ড বিরোধিতা করেছে (ড. মুহম্মদ এনামুল হক, বাঙালি বাংলাদেশ)।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও বলেছেন, 'আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।' তাহলে বাংলার সুলতানি আমলের সুলতানদের বাঙালিত্বের সাধনা থেকে শুরু হয়ে সপ্তদশ শতকের কবি আবদুল হাকিম ও লালন ফকির, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহাম্মদ এনামুল হক, মওলানা ভাসানী (তাঁরা সবাই 'বাঙালি' বলতেন) ও শত মনীষীর চিন্তাকে অমান্য ও অশ্রদ্ধা করে আমরা কী ইতিহাসের ধারা থেকে বিচ্যুত হইনি? বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতা এখানেই যে তিনি তাঁদের চিন্তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন।
পাঁচ.
বঙ্গবন্ধুকে গভীর চক্রান্তের মাধ্যমে হত্যা করে বাংলাদেশের মূল চারিত্র্য অর্থাৎ চার রাষ্ট্রনীতি বদলে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ খুব যথার্থভাবে বলেছেন : "বাংলাদেশের সংবিধানে 'ধর্মনিরপেক্ষতা' লিপিবদ্ধ করার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করে যারাই ক্ষমতায় আসে তারা সংবিধানকে বিনষ্ট করে।" তিনি বলেন, 'পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে জাতীয় মূলনীতি ও প্রস্তাবনার পরিবর্তন করে এমন অবস্থায় দেশকে নিয়ে আসা হয়েছে, যাতে মনে হয় আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি, ধর্মযুদ্ধ করেছি। এই সংশোধনীর প্রস্তাবনায় রয়েছে ধর্ম নাকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল' (ভোরের কাগজ, ১৫ জুলাই ১৯৯৫)। এ অবস্থায় 'জয় বাংলাকে' উড়িয়ে দেওয়া হবে এটা অস্বাভাবিক নয়। তবে 'জয় বাংলা' তো ইতিহাসের অনেক আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে আমাদের জাতীয় আত্মপরিচয়ের ধারার সঙ্গে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও গণজাগরণ এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিপুল গণসমর্থনধন্য এ স্লোগানটি ড. মুহাম্মদ এনামুল হকসহ সব দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী অন্তরের সঙ্গে সমর্থন করেছিলেন। আর কবি নজরুল ইসলাম তো এ 'জয় বাংলার' মূল উদ্ভাবক। এমনকি মওলানা আকরম খাঁ তাঁর 'মোস্তফা চরিত' গ্রন্থে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নামের সঙ্গে 'জয় মোহাম্মদ' ব্যবহার করেছেন। অতএব আমাদের গোটা ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ইতিহাস সম্বন্ধে অনেক ভেবে-বুঝেই বঙ্গবন্ধুও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কারণ মূল ভাবনার দায় তো মূল নেতার বা প্রধান চরিত্রের, দৌবারিকের নয়।
লেখক: মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমী [ঢাকা, শনিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, ৪ ফাল্গুন ১৪১৯, ৫ রবিউস সানি ১৪৩৪]http://www.kalerkantho.com/print_edition/index.php?view=details&type=gold&data=news&pub_no=1155&cat_id=2&menu_id=20&news_type_id=1&index=0&archiev=yes&arch_date=16-02-2013#.VWOQ1dJViko
'জয় বাংলা' স্লোগান বঙ্গবন্ধু নজরুলের একটি কবিতা থেকে নেন
তারিখ: ২৬/০৫/২০১৫
- কুমিল্লায় নজরুলজয়ন্তী উদ্বোধনীতে প্রধানমন্ত্রী
পূর্ণ-অভিনন্দন
- কাজী নজরুল ইসলাম---ভাঙ্গার গান
এস অষ্টমী-পূর্ণচন্দ্র! এস পূর্ণিমা-পূর্ণচাঁদ!
ভেদ করি পুন বন্ধ কারার অন্ধকারের পাষাণ-ফাঁদ!
এস অনাগত নব-প্রলয়ের মহা সেনাপতি মহামহিম!
এস অক্ষত মোহান্ধ-ধৃতরাষ্ট্র-মুক্ত লৌহ-ভীম!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর! ......
.........................................
.................................
ওগো অতীতের আজো-ধূমায়িত আগ্নেয়গিরি ধূম্রশিখ!
না-আসা-দিনের অতিথি তরুণ তব পানে চেয়ে নিনিমিখ।
জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ!
জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
সর্বমানবিক কবি [কাজী নজরুল ইসলাম ] by মুহম্মদ নূরুল হুদা |
ব্যবধানে স্বাধীনতা লাভ করলো তারই স্বপ্নধৃত বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যেমে এমন একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার জন্যেই তিনি ডাক দিয়েছিলেন ১৯৪২ সালে : 'বাংলা বাঙালির হউক, বাংলার জয় হউক।' বাঙালিকে মুক্তিযোদ্ধা হতে হলে যুদ্ধান্ত্র হাতে নিতে হবে আর তাড়াতে হবে ভিনদেশি দখলকারদের, যাদেরকে তিনি 'রামা' বা 'গামা' বলেছেন। তাঁর উক্তি : "এই পবিত্র বাংলাদেশ/ বাঙালির– আমাদের।/ দিয়া প্রহারেণ ধনঞ্জয়,/ তাড়াব আমরা, করি না ভয়/ যত পরদেশী দস্যু ডাকাত / 'রামা'দের, 'গামা'দের।" আরো স্মরণ করা যেতে পারে, 'জয় বাংলা' শীর্ষক বাঙালির চিরকালের জয়ধ্বনিও প্রথম তার কণ্ঠেই উত্থিত। তাঁর 'ভাঙার গান' কাব্যগ্রন্থের 'পূর্ণ-অভিনন্দন' কবিতায় তিনি লিখেছেন, 'জয় বাংলা-র পূর্ণ চন্দ্র, জয় জয় আদি অন্তহীন'
নজরুল দর্শন: অসাম্প্রদায়িকতা ও জাতীয় চেতনা : দ্যুতিময় বুলবুল
প্রকাশ তারিখ: ২৫/০৫/২০১৪ ৩:৫০:৫৭ অপরাহ্ন
__._,_.___