সরকারি হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সবমিলিয়ে জমির পরিমাণ ১ কোটি ৪৪ লাখ হেক্টর। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে বাড়ছে নগরায়নের প্রবণতা। ঘটছে শিল্পোন্নয়ন, নিত্য-নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং সেই সাথে বিস্তার ঘটছে শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানেরও। এসব কারণে কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে। কৃষিজমি রূপান্তরিত হচ্ছে আবাসিক, বাণিজ্যিক বা শিল্পপ্লটে। একটি বেসরকারি সংস্থার হিসেব অনুযায়ী- আবাসন, শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক খাতে ব্যবহারের কারণে বছরে গড়ে ২ লাখ একর কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। আবার পানির আধার তথা বিল-ঝিল ও হাওড়-বাঁওড় ভরাট করে থামিয়ে দেয়া হচ্ছে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক ধারা। ফলে ভূপ্রকৃতি যেমন দিনদিন বিরূপ হচ্ছে, তেমনি হুমকি দেখা দিচ্ছে ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তায়। ১৯৮৩-৮৪ সালের সরকারি হিসেব অনুযায়ী- দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ২০ লাখ একর। কিন্তু ১৯৯৭ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় যে, মাত্র এক যুগের ব্যবধানেই কৃষিজমির পরিমাণ কমে গিয়ে ১ কোটি ৭৫ লাখ একরে দাঁড়ায়। এমন বেপরোয়া গতিতে কৃষিজমির ধ্বংস হওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকার ২০০০ সালের গোড়ার দিকে জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি নামে একটি নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করে। পরের বছর ২০০১ সালের ২১ জুন আনুষ্ঠানিক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০০১ জারি করা হয়। তাতে বলা হয়েছিল যে, গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারির দিন থেকেই নীতিমালাটি কার্যকর হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। আর সেটা না হওয়ায় গত এক দশকে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অঞ্চলসহ সারাদেশেই আবাসন, শিল্পায়ন ও নগরায়নের জন্য ব্যাপকভাবে কৃষিজমি ধ্বংস করা হয়। অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) নামের একটি বেসরকারি সংস্থার হিসেব অনুযায়ী- আবাসন, শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে প্রতিদিন গড়ে ২২০ হেক্টর কৃষিজমি ধ্বংস করা হচ্ছে। সেই হিসেবে বছরে গড়ে ৮০ হাজার ২০০ হেক্টর (একরের হিসেবে যা ২ লাখ একর) কৃষিজমি হারিয়ে যাচ্ছে অপরিকল্পিত উন্নয়নের থাবায়। স্বাধীনতার পর গত ৪৪ বছরে কমবেশি ৫০ লাখ একর কৃষিজমি ধ্বংস হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের সন্নিহিত এলাকায় কৃষিজমি ধ্বংস করে অনেকগুলো বেসরকারি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলাচ্ছে। এসব প্রকল্পের উদ্যোক্তারা আদৌ রাজউক বা সরকারের অন্যকোনো দফতরের অনুমোদন নেয়নি। এছাড়া গাজীপুর, টঙ্গি, সাভার, ধামরাই, কেরানীগঞ্জ, সিঙ্গাইর, মুন্সীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন অংশে বিপুলসংখ্যক আবাসিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কৃষিজমির উপর। কেবল আবাসিক প্রকল্পই নয়; শিল্পায়ন এবং নগরায়নের জন্যও কৃষিজমি ও বনাঞ্চল ধ্বংস এবং পানির আধার ভরাট করা হচ্ছে যথেচ্ছা। কৃষি জমিতে গৃহ নির্মাণে নীতিমালার অভাবে যার যা ইচ্ছে মতো অট্টালিকা গড়ে তুলছে। এছাড়াও দরিদ্র পরিবারের লোকজন অভাবের তাড়নায় একদিকে কৃষি জমির উর্বর মাটি ইট ভাটায় বিক্রয় করছে, অন্যদিকে ইটভাটার মালিকরা দেদারসে আবাদি কৃষিজমির উপরের উর্বর মাটি কিনে ইট ভাটায় নিয়ে আসছে। এতে জমির উর্বরতা হারিয়ে কৃষি উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। কৃষি জমি রক্ষার জন্য এই মুহূর্তেই পরিকল্পনা মাফিক জনবসতির জন্য আবাসন প্রকল্প নির্মাণ নীতিমালা ও বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরী। এটা শুধু দেশের মধ্যে শহর কেন্দ্রীক হলেই চলবে না; বরং গ্রাম-অঞ্চলেও সুপরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প নির্মাণ নীতিমালা ও সহজ কিস্তিতে বণ্টনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য খোদ সরকারকেই যথাযথ প্রদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া বে-সরকারি আবাসন প্রকল্প নির্মাণাধীন কোম্পানীর মালিকগুলোকে গ্রামে-গঞ্জে পরিকল্পিত আবাসন নির্মাণের জন্য সরকারকে উৎসাহিত করতে হবে। সর্বোপরি উর্বর জমির উপর শিল্প-কারখানা নির্মাণ না করাসহ ভূ-গর্ভস্থ খনিজ সম্পদ পাথর, বালু ও কয়লা ইত্যাদি উন্মুক্তভাবে খনন ও উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। এছাড়া সরকারিভাবে কৃষি জমি রক্ষার্থে যথাযুক্ত নিয়মনীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে ভূমি সংক্রান্ত বিষয়ে বর্তমান সরকার উন্নত ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনগণকে ভূমি বিষয়ক সকল সেবা প্রদান এবং ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র বিমোচনে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। |
__._,_.___