বঙ্গবন্ধু থেকে নিলয় হত্যা একই সুত্রে গাথা
পনেরই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান-এর প্রতি আমার সশ্রদ্ধ শ্রধ্যার্ঘ। জাতীয় শোক দিবস এখন শক্তিতে পরিনত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হাতেগড়া দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। দেশ দ্রুতলয়ে অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। একদা কথিত 'তলাবিহীন ঝুড়ি' অর্থাৎ যারা এই উপাধিটি দিয়েছিলেন, তারাই এখন বলছেন, 'সম্বৃদ্ধির পথে' বাংলাদেশ। এখানেই বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার সরকার সফল।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়নি অনেকদিন। তখন সবাই বলতেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়েই দেশে হত্যার রাজনতি শুরু এবং এই হত্যার বিচার নাহলে হত্যার রাজনীতি বন্ধ হবেনা। কথাগুলো সর্বাংশে সত্য। জাতির জনকের হত্যার বিচার হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের হত্যার বিচার চলছে। তবু হত্যার রাজনীতি কিন্তু বন্ধ হয়নি এবং এর সর্বশেষ শিকার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়। আমার ধারনায়, হত্যার রাজনীতি তখনই বন্ধ হয় যখন প্রতিটি হত্যার বিচার হয় এবং আইনের শাসন চালু থাকে।
বাবার মুখে শুনেছি, বৃটিশ আমলে নাকি একগ্রামে একটি গুলি হলে চৌদ্দ গ্রাম উজাড় হতো, যতক্ষণ না বন্দুকটি খুঁজে পাওয়া যেতো। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের যেমনি প্রয়োজন ছিলো, তেমনি প্রতিটি হত্যার বিচারের প্রয়োজন আছে। একজন আস্তিকের যেমন বাঁচার অধিকার আছে, একজন নাস্তিকের বাঁচার অধিকারও কেউ কেঁড়ে নিতে পারেনা। আর নিহত আস্তিকই হোক বা নাস্তিকই হোক, একজন মানুষ নিহত হয়েছে, এর বিচার হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হচ্ছে কই? মিডিয়ায় এসেছে, 'উনত্রিশ মাসে ১০ ব্লগার হত্যা, কিনারা হয়নি একটিরও'। 'জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড'- প্রশ্ন হলো, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মত যেকোন হত্যার বিচারের জন্যেই কি আমাদের সিকি শতাব্দী অপেক্ষা করতে হবে? নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় বা শুধুই নীল্ খুন হলেন সাতই আগস্ট ২০১৫ নিজের বাসায়, প্রকাশ্য দিবালোকে। এই হত্যার জট খোলা বা ত্বরিত বিচার কি খুবই কঠিন? অন্যান্য ব্লগারদের হত্যার বিচার শ্লথ হয়ে যাওয়ার কারনটা কি? হয়তো এজন্যেই প্রফেসর অজয় রায় বলতে পেরেছেন, 'ব্লগার হত্যাকান্ডের পেছনে সরকারের প্রচ্ছন্য মদত আছে'।
অজয় স্যার নিজেও জানেন, সরকারের ইন্দন নাই, কিন্তু তিনি একথা বলছেন হতাশা থেকে, কারণ পুত্র হত্যার সঠিক-দ্রুত তদন্ত তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। নীলের পরিবারও ক'দিন বাদে একই কথা বলবেন না সেই গ্যারান্টি কোথায়? মিডিয়ায় সর্বত্র এখন নিহত ক'জন ব্লগার বা মুক্তবুদ্ধির মানুষের তালিকা পাওয়া যাচ্ছে, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০০৪ - হুমায়ুন আজাদ; ১৫ জানুয়ারী ২০১৩ - ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন; ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৩ - ব্লগার রাজীব হায়দার; ৯ এপ্রিল ২০১৩ - আরিফ রায়হান দীপ; ২৬ ফেব্রুয়ারী২০১৫ - ব্লগার অভিজিৎ রায়; ৩০ মার্চ ২০১৫ - ব্লগার ওয়াশিকুর বাবু; ১২ মে২০১৫ - ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ; ৭ আগস্ট, ২০১৫ - ব্লগার নিলয় চক্রবর্তী নীল । জাতি এদের হত্যার বিচার চায় এবং এই বিচারটি করার দায় সরকারের।
এরমধ্যে পুলিশ কমিশনার ব্লগারদের উপদেশ দিলেন সীমা লঙ্ঘন না করতে। উপদেশ না প্রচ্ছন্ন হুমকি ঠিক স্পস্ট নয়, তবে তিনি সীমা টেনে দিলে ভালো করতেন। তিনি ভুলে গেছেন, আকাশের যেমন সীমা নাই, মুক্তমনেরও কোন সীমা থাকেনা। পুলিশ কমিশনার বা আমরা যারা আস্তিক তারা সসীম হলেও মুক্তমনারা অসীম। পুলিশ কমিশনার অবশ্য উগ্রপন্থীদের কোন উপদেশ দেননি। বাংলায় একটি কথা আছে, 'যার কাজ তারে সাঁজে--'। পুলিশের কাজ অপরাধী ধরা, উপদেশ দেয়া নয়। নিউইয়র্কের সাংবাদিক সঞ্জীবন সরকার লিখেছেন, নিলয় থানায় জিডি করতে গিয়েছিল । পুলিশ তাকে পরামর্শ দিয়েছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছেড়ে চলে যেতে। এমন সুন্দর উপদেশ অন্য দেশের পুলিশ দিতে পারেনা। আমাদের দেশের পুলিশ আর 'ফুলিশ' নয়।
তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি চমত্কার কথা বলেছেন, তিনি বলেছেন, 'এরা কোন ইসলামকে রক্ষা করছে?' শেখ হাসিনা বলেছেন, যারা মুসলমান হয়ে মুসলমানদের হত্যা করে, কিংবা মানুষ হত্যা করে, ইসলাম ধর্মকে কলুষিত করে, তারা মুসলমান হতে পারে না। এরা কোন ধর্মে বিশ্বাস করে? এদের কোনো ধর্ম নেই। ধর্মকে ব্যবহার করে যারা অপকর্ম করছে, তাদের রেহাই দেয়া হবে না। ড: তুহিন মালিক বলেছেন, জনসংখ্যা বাড়ছে, কমছে মানুষ। সাংবাদিক হারুন হাবিব লিখেছেন, 'আরো একজন মুক্ত চিন্তার মানুষকে হত্যা করা হলো। এক বছরে চারজন ব্লগার নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হলো। প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে কি সমাজ ও রাষ্ট্র দখল করা সম্ভব? এসব বর্বরতা, নির্মমতার বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিপন্ন হবে। আর একজন লিখেছেন, নিলয় নীল হত্যা, সুষ্ট তদন্ত ও বিচায় চায় বিশ্ব মানবতা। বাংলাদেশের ফেসবুকে সিংহভাগ কমেন্ট এসেছে হত্যাকান্ডের সমর্থনে। বাংলাদেশের লোকজন কি মৌলবাদী?
কিছু লোক অবশ্য বলতে চেয়েছেন, ব্লগার হত্যার নামে হিন্দু নিধন চলছে। কারণ হিসাবে তারা বলছেন, এবছর নিহত চারজন ব্লগারের মধ্যে তিনজন হিন্দু এবং দুইজনের বউ মুসলমান! অভিজিত বা নিলয়ের নাম হিন্দু হলেও তারা হিন্দু কিনা সেই সংশয় অনেকের। কারণ এরা যে শুধু ইসলামের বিরুদ্ধে লিখেছেন তা নয়, তারা সমানে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধেও লিখেছেন। তারপরও কোন হিন্দু তাদের খুন করছে না। ভারতে জাকির নায়েক সমানে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে বলে চলেছেন, তিনি বহাল তবিয়তে আছেন। সাইদীর হিন্দুধর্ম বিদ্ধেষী ওয়াজ আমি শুনেছি, কিন্তু তাকে আমরা খুন করতে যাইনি। যারা ইসলাম রক্ষার নামে এসব খুন করছেন তারা কি আসলে ইসলাম রক্ষা করছেন? আইসিস বা বোকা হারেম কি ইসলামের মর্যাদা বাড়াচ্ছে? ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন, তাহলে আমাকে কেন খঞ্জর হাতে তুলে নিতে হবে তারই বান্দাকে হত্যা করতে? পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী। দু'চার জন ধর্মে বিশ্বাস না করলে কি আসে যায়? আর মেরে কেটে তো পৃথিবীর ছয়শ কোটি মানুষকে এক জায়গায় আনা সম্ভব নয়।
নীল্ ব্লগার হিসাবে পরিচিত। দেশে-বিদেশে সবাই জানলো বাংলাদেশে আর একজন ব্লগার খুন হয়েছে। খুনী অতি পরিচিত ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠী। এই হত্যাকান্ড পরিকল্পিত তা বলাবাহুল্য। এরফলে বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদের উত্থান ঘটছে তা বোঝানো সহজ হবে। বাস্তবে যে তা ঘটছে না তা কি কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবেন? তাইতো আওয়ামী ওলামা লীগসহ ১৩টি কট্টর মৌলবাদী সংগঠন এরই মধ্যে মানববন্ধন করেছেন এবং দাবি তুলেছেন, নাস্তিক ব্লগার ও মুরতাদদের দেশ থেকে বিতাড়ন, ইসলামের সমালোচনাকারী ব্লগারদের ফাঁসিসহ সকল ব্লগ ও ওয়েবসাইট অবিলম্বে বন্ধের। মিডিয়া বলছে, জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া এসব সংগঠন ১৭ দফা দাবি জানিয়েছে।
সমস্যাটা সেখানেই, ওলামালীগ যদি আওয়ামী লীগের বন্ধু হয়, তবে জামাতের আর প্রয়োজন কি? ক'দিন আগে সুলতানা কামাল নিউইয়র্কে এসেছিলেন, ঘরোয়া পরিবেশে তিনি বলেছেন, 'ক'দিন পর বাংলাদেশে শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ার মত মানুষও পাওয়া যাবেনা সরকার প্রধান হবার মতো, ধর্মান্ধরা সেটি দখলে নেবে। অথবা যেই সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন তাদের জামাত-ওলামা লীগের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করতে হবে। এপ্রসঙ্গে কানাডার ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেসের হাসাম মাহমুদ সম্ভবত: চরম একটি সত্যকথা বলে ফেলেছেন, তা হলো, "ভয়ংকর মেরুকরণের মধ্যে পড়ে গেছে দেশ। জনগণ একদিকে প্রচণ্ড শক্তিতে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আর অন্যদিকে ডুবে গেছে মূল্যবোধের মারাত্মক অবক্ষয়ে। দুর্নীতি, হিংস্রতার আর শেষ নেই-- জাতি আতঙ্কিত। সেই সুযোগে হুঙ্কারী ধর্মদস্যুরা প্রস্তাব করছে ইহকাল পরকালের স্বপ্নীল সমাধান, শারিয়া-ভিত্তিক "ইসলামী রাষ্ট্র" যা সবার অলক্ষ্যে ধীরে ধীরে গ্রামবাংলা সহ জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে"।
নিলয় হত্যাকান্ডের থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতেও একটি মহল কাজ করছেন। এরা যে শুধু যে ইসলামী মৌলবাদী তা নয়, জেনে-নাজেনে আরো অনেকে তাতে জড়িয়ে যাচ্ছেন। নীল্ বিবাহিত ছিলেন কিনা এনিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিবাহিত হোন বা গেট-টুগেদার করুন, তাতে তো খুনির অপরাধ কমে যায়না। আবার জামাতে ইসলামীর বিবৃতিতে নিহতকে 'নিলয় ইসলাম' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর একটি মহল বলেছে, দুইমাস আগে ভারতের একটি ইন্টারনেট কাগজ নিলয় হত্যার খবর ছেপেছে! আসলে ওই নিউজে কয়েকজন নিহতের নাম দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ কি পাকিস্তানের দিকে যাচ্ছে? ওই নামের মধ্যে নিলয় নামটি ছিলো। দুরে বসে ঘটনা না জেনে টেবিল রিপোর্টের এটি একটি ব্যাধি। সমস্যার মোড় অন্যদিকে ঘোড়ানোর চেষ্টা না করে সবার উচিত সাদামাটা হিসাব করা: একটি খুন হয়েছে, এর বিচার হতে হবে, ব্যাস। এপ্রসঙ্গে নিলয়ের ছোট কাকি শ্যামা দত্ত-র কথার প্রতিধ্বনি করা যায়, তিনি প্রিয়.কম-কে বলেছেন, 'আমাদের ছেলে ষড়যন্ত্রের শিকার। পরিকল্পিতভাবেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের ছেলেকে আমরা তো আর ফিরে পাবো না। সরকারের কাছে দাবি ন্যায় বিচারটুকু যেন আমরা পাই।'
বিশ্বব্যাপী এই হত্যাকান্ডের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়াই স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্র নিন্দা জনিয়েছে, বিচার চেয়েছে। জাতিসংঘ একই কথা বলেছে। অন্যান্য দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা বলবে বা বলছে। আসলে এতে দেশের ভাবমুর্ক্তি অবশ্যই ক্ষুন্ন হচ্ছে। কিছুদিন আগে মার্কিন কংগ্রেসে মানবাধিকার নিয়ে যে বিল এসেছে, তাতে এটি নুতন সংযোজন হবে। বাংলাদেশ আইসিস-এর স্বর্নদ্বার এমন কথাও শুনছি। সন্ত্রাস দমনে সরকারের ভূয়সী প্রশংসা বিশ্বব্যাপী আছে, একইসাথে মাঝেমধ্যে হেফাজত-জামাতের সাথে আপোষের কথাও ওঠে, জামাত নিষিদ্ধ করে এ কলংক মোচন সম্ভব। ইতোপূর্বে মৌলবাদীরা ৮৪জনের হিটলিস্ট প্রকাশ করেছে। গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা একেএকে প্রাণ হারাবে সেটা হতে পারেনা। দেশের ব্লগাররা ইতিমধ্যে দেশ ছাড়ছে, অন্যরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। নীল্ হত্যার পর ফেইসবুকে প্রশ্ন রেখেছিলাম, এরপর কার পালা? এপ্রশ্ন বোধকরি এখন অনেকের! বঙ্গবন্ধু থেকে নিলয় হত্যা একই সুত্রে গাথা, আততায়ীরা একই প্রজাতির, বিচারও হোক তেমনি গুরুত্ব সহকারে। খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালে সমাজে পতন ধরে বটে!
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক।
নিউইয়র্ক। ৯ আগস্ট ২০১৫।
SitangshuGuha 646-696-5569
SitangshuGuha 646-696-5569
__._,_.___