টানাপড়েনটা কি টের পাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী?
ফজলুল বারী॥
সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের সঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সাম্প্রতিক সমস্যাটি ফরিদপুরের একটি হিন্দু সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে। ফরিদপুরের ঝিলটুলির দক্ষিণ কালীবাড়িটি ছিল এলাকার সাবেক প্রতাপশালী জমিদার গুহ পরিবারের। ফরিদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে তাদের সাড়ে ৮ বিঘা জমিসহ বাড়ির বর্তমান বাজার মূল্য ২০ কোটি টাকার বেশি। সেই জমি-বাড়ির সম্পত্তি সম্প্রতি ২ কোটি ৪০ লাখ টাকায় অরুণ গুহ মজুমদারের কাছ থেকে কিনেছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন!
ফরিদপুর থেকে আমাকে বলা হয়েছে অরুণ গুহ মজুমদার ওই টাকায় বাড়িটি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এরপর দেশান্তরী হয়ে চলে গেছেন ভারতে। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে হিন্দু বেচারাকে এমনভাবে ভয় দেখানো হচ্ছিল যে বেচারা জান হাতে ভারতে পালিয়ে গেছে। বাবার সঙ্গে ভারতে চলে গেছে অরুণ গুহের মেয়ে তুলি গুহ মজুমদারও। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিল তুলি। এমন একজন মেধাবী ছাত্রীর এভাবে হঠাৎ দেশত্যাগের ঘটনায় স্তব্ধ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট লোকজন। তাকে ফেরানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু কী করে ফিরবেন তুলি? তার পরিবারের প্রায় সব সদস্যের বিরুদ্ধে তো এমন নানান মামলা আর হুমকি! মরার এমন দেশে হিন্দু হিসেবে তাদের জন্ম-যারা কোনওদিন দেশত্যাগ করে ভারতে চলে গেলে আর ফিরতে পারে না! প্রবীর সিকদার গ্রেফতার হওয়ার পর ফরিদপুরের এই বাড়ি কাহিনী লেখার পর আমাকে একজন জানিয়েছেন বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তি হওয়া থেকে রক্ষার জন্যেই স্বেচ্ছায় তা মন্ত্রীর কাছে বেচে দিয়ে দেশ ছেড়েছেন অরুণ গুহ মজুমদার!
যাক, এ বাড়ির ঘটনার আগে কিন্তু প্রবীর সিকদারকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে নিয়ে কখনও লিখতে দেখেছি মনে পড়ে না। প্রবীর রাজাকার মুসা বিন শমসেরকে নিয়ে লিখেছিলেন। এর জন্যে তিনি তার পা হারিয়েছেন। আর বিদেশে পাঠিয়ে তার একটি নকল পা সংযোজনের টাকার ব্যবস্থাও করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের একদিন আগে গণভবনে তিনি ওই চেক প্রবীরের হাতে তুলে দেন। সে কৃতজ্ঞতায় শেখ হাসিনাকে বোন ডাকতেন প্রবীর। 'শেখ হাসিনা আমার বোন' নামের একটি বইও তার আছে। ফেসবুকের লেখালেখিতে আওয়ামী লীগের একজন অন্ধ সমর্থক হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। লেখালেখির ব্যাপারে তার সতর্কতা থাকতো পাছে না আওয়ামী লীগের ক্ষতি হয়ে যায়! সে কারণে মুসা বিন শমসেরকে রাজাকার লিখলেও খন্দকার মোশাররফকে রাজাকারের সন্তান লিখেছেন, তার তেমন কোনও পোস্টের কথাও মনে পড়ে না!
অরুণ গুহ মজুমদারের বাড়ি-জমি জবরদস্তিমূলক দখল-ক্রয়ের বিরোধিতা করেছিলেন মোশাররফ হোসেনের সাবেক এপিএস সত্যজিৎ মুখার্জি। এর প্রতিক্রিয়া ঘটে দ্রুত। এজেন্সির লোকেরা পিছু নেয় সত্যজিতের। বেচারা পালিয়ে চলে যায় ভারতে। গ্রেফতার করা হয় সত্যজিতের মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে। চার মাস ধরে সে বেচারা জেলে। একজন মুক্তিযোদ্ধার এই গ্রেফতার নিয়ে ফেসবুকে ছবিসহ একটি পোস্ট দিয়েছিলেন প্রবীর। তার সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফের বিরোধের প্রকাশ তখন থেকেই। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সম্প্রতি এসব জমি দখল, জোরপূর্বক হিন্দুদের দেশত্যাগ করানোর প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন করেছে। ভয়ে অথবা সম্মান করে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের নাম উল্লেখ করেনি!
ফরিদপুর থেকে আমাকে বলা হয়েছে মোশাররফ মনে করতেন তার সাম্প্রতিক হিন্দু জমি সম্পত্তি ক্রয়ের বিরুদ্ধে সমস্যা সৃষ্টি করছে দু'জন ব্যক্তি। সত্যজিৎ আর প্রবীর সিকদার। সম্প্রতি তিনি তার ফরিদপুরের বাসায় একজন সাংবাদিককে বলেছেন, 'মালুর বাচ্চা মালু প্রবীর সিকদার, ওরে কী আদর করা যায় খুঁজতেছি'! এরপর থেকে এজেন্সির লোকজন প্রবীরকে ভয় দেখানো, অনুসরণ করা সব করছিল। এ নিয়ে নিরাপত্তা শঙ্কা নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন প্রবীর। অতঃপর 'নিরাপত্তা জিজ্ঞাসাবাদের' নামে তাকে তুলে যায়! এরপর তার নামে দেওয়া হয়েছে আইসিটি আইনে মামলা। সেই মামলায় হাতকড়া পরিয়ে ফরিদপুর নিয়ে যাওয়া হয় শারীরিক প্রতিবন্ধী সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সন্তান প্রবীর সিকদারকে। হাতকড়া পরানো তার সেই ছবি ফেসবুকে প্রকাশের পর থেকে দেশজুড়ে নতুন এক স্পর্শকাতর আলোড়নের নাম প্রবীর সিকদার।
আমার জনকণ্ঠের সহকর্মী প্রবীর। তাকে নিয়ে এখন লেখার পর অভূতপূর্ব নানা প্রতিক্রিয়া পাচ্ছি। এ নিয়ে ফেসবুকে প্রতিটি পোস্টের মুহূর্তের মধ্যে শতশত শেয়ার হচ্ছে! ফরিদপুরের হিন্দু বাড়িটির কাহিনী নিয়ে লেখা পোস্টটার শেয়ার এরমাঝে দেড় হাজার ছাড়িয়েছে! নানাজন নানান অসহায় মন্তব্য করছেন ইনবক্সে। এদের বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনার সমর্থক তরুণ ছেলেমেয়ে। অনেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের। নানাকারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। প্রবীরের ঘটনায় এমন অনেকে দেশত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করে আমার সাহায্য চেয়ে লিখেছেন! এ বিষয়টিই আমার কাছে বিশেষ বিব্রতকর বার্তা মনে হয়েছে। কারণ প্রবীর সিকদার একজন হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য, একজন শহীদের সন্তান এবং আওয়ামী লীগের চিহ্নিত সমর্থক। তার যদি এই অবস্থা, এই পরিণতি হয় তাহলে অন্যদের নিরাপত্তা কোথায়? প্রবীরের ঘটনায় ক্ষুব্ধ বিব্রত প্রতিক্রিয়া এসেছে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বক্তব্যেও। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ঘটনাটিকে দুঃখজনক উল্লেখ করেছেন। আর বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করার সাহস দেখাননি! কারণ প্রতিক্রিয়ার ওপাশের ব্যক্তিটি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। যিনি প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজের কোনও বাড়ি সম্পত্তি নেই। এ নিয়ে তার কোনও লোভের উদাহরণও নেই। কিন্তু বেয়াইয়ের বাড়ি সম্পত্তির লোভকে কেন্দ্র করে প্রবীরের মতো একজন সাংবাদিকের হয়রানির প্রতিক্রিয়ায় দেশের হিন্দু সম্প্রদায়, শহীদ পরিবারগুলো, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন, আওয়ামী লীগ সমর্থক লেখক-সাংবাদিক সব মহলের সঙ্গে সরকারের যে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়েছে তা কি টের পাচ্ছেন প্রিয় প্রধানমন্ত্রী?
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী সাংবাদিক
__._,_.___