৩৮৮ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারায় ব্যারিস্টার মওদুদ লিখেছেন, 'জাতি যেসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে, এটা ছিল তার মধ্যে একটি অন্যতম নজিরবিহীন ও অশোভনীয় ঘটনা। নিজের দলের লোকদের হুমকির মুখে নির্বাচিত একজন রাষ্ট্রপতির এহেন নিষ্ক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। গোটা ঘটনা সরকারের এবং সামগ্রিকভাবে শাসন প্রক্রিয়ার অনেক দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। নিজ সরকার এবং দলের অভ্যন্তরীণ সংকটের জের হিসেবে এটি ঘটেছে এবং বিরোধী দলের এতে কোনো ভূমিকাই ছিল না। গোটা জাতি ঘটনাক্রমে স্তম্ভিত ও আহত হয়েছে। বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে যেভাবে হেয় করা হয়েছে এবং পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে তা কেউই পছন্দ করেনি।' ব্যারিস্টার মওদুদের ভাষায়, 'যেহেতু যখনই খালেদা জিয়া ভাবলেন যে, তার স্বামীকে অবমাননা করা হয়েছে এবং বেগম জিয়ার ধারণা জন্মেছিল যে, বদরুদ্দোজা চৌধুরীর আচরণ ছিল অনানুগত্য ও বিশ্বাসঘাতকতার শামিল তখন দলের সকলেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নিষ্ক্রান্ত হওয়া ছিল অবধারিত। ব্যক্তিত্বের সংঘাত এড়াতে বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে অপসারণ করে আরও অনুগত, নমনীয় ও বিশ্বাসী কাউকে সেখানে বসানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।'
বইটির ৪১৯ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্যারায় ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, 'বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে জোর করে বের করে দেওয়ার পর তিনি সরকারবিরোধী হিসেবে রাজনীতিতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলে বিএনপি সরকার তা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি। গণতন্ত্রের বাহক দলীয় নেতারা তাকে রাশ টেনে ধরার প্রয়াস পান। ২০০৪ সালের ১৩ মার্চে বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিকল্প ধারা নামে মুক্তাঙ্গনে একটি নতুন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ঘোষণার আয়োজন করেন। অনুষ্ঠান হবার আগের দিন রাতেই বিএনপির ক্যাডাররা তার নির্মিত মঞ্চ ভেঙে দেয়। পরদিন সকালে 'বাস্তুহারা কল্যাণ পরিষদ' নামে পরিচয়বিহীন নামসর্বস্ব বাস্তুহারাদের একটি ভুয়া সংগঠনের গুণ্ডারা সেই জায়গা দখল করে রাখে। বিএনপি ক্যাডাররা তাদেরকে শক্তি ও সাহস জোগায়। পরিস্থিতি দমনে পুলিশ কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।' বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের এই সদস্য বলেন, 'একই দিন সকালে নবগঠিত দলের আরেকজন নেতা মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের অফিস স্থানীয় বিএনপির ক্যাডাররা লণ্ডভণ্ড করে দেয়। বদরুদ্দোজা চৌধুরী তার অনুগতদের সঙ্গে নিয়ে তার বারিধারার বাসা থেকে বের হয়ে আসার পর পুলিশ নানা ধরনের ছুঁতো ধরে একাধিক স্থানে তার গাড়ি গতিরোধ করে। প্রতিটি স্থানে এ কাজে বিএনপির ক্যাডাররা পুলিশকে সঙ্গ দেয়। বিশ্বরোড রেলক্রসিংয়ে গাড়িবহর পৌঁছার পর বাসের লগি দিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেট সৃষ্টি করা হলে তিনি গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। এয়ারপোর্টের দিকে হেঁটে সমবেত লোকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। তিনি মহাখালীর রেলক্রসিংয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে বিকাল সাড়ে ৫টা বেজে যায়। এ সময় বিএনপির ক্যাডাররা তাদের তাড়া করলে সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা তার সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে রেললাইনের ওপর দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। এ সময় পুলিশ সম্পূর্ণ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। মেজর মান্নানের মাথায় ইটের আঘাত এসে লাগে। তিনি গুরুতরভাবে আহত হন। প্রায় ৪০ জন সঙ্গী নিয়ে অদূরে রেললাইনের ওপর অসহায়ভাবে বসে থাকা বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে অবশেষে পুলিশ উদ্ধার করে তার বাসায় পৌঁছে দেয়।' বইতে ব্যারিস্টার মওদুদ লেখেন, 'এভাবে পথিমধ্যে আক্রান্ত, অপদস্থ ও নাজেহাল অবস্থায় বদরুদ্দোজা চৌধুরী জনসমাবেশে না গিয়ে এবং জনতার উদ্দেশে বক্তব্য না রেখেই মেজর আবদুল মান্নানকে মহাসচিব করে সংগঠনের ১২ সদস্যবিশিষ্ট এক কার্যনির্বাহী কমিটি তার বাসায় অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষণা করেন। সরকারকে ফ্যাসিস্ট আখ্যায়িত করে তিনি বলেন যে, পুলিশের সাহায্য নিয়ে সরকার সমর্থিত কর্মীরা ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টের দিকে তাকিয়ে বাধা দিয়ে সমাবেশে গিয়ে জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখা থেকে নিবৃত করেছে এবং জনসভাস্থলে যেতে দেয়নি।'
ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, 'সকল রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংগঠন সরকারের এ ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে। সরকার ও তার সমর্থকদের এই দানবীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে বদরুদ্দোজা চৌধুরী যতবার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সমাবেশের আয়োজন করেন, ততবারই তাকে একইরকম বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। এ সমস্ত কর্মকাণ্ডের পেছনে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রীর কোনো সম্মতি ছিল কিনা তা জানা যায় না। তবে এসব ঘটনার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো নিন্দা জানানো হয়নি কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনার প্রতিকারের জন্য কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়নি। রাজধানীর সম্মানজনক তেজগাঁও-রমনা এলাকা থেকে বিএনপির টিকিটে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত মেজর (অব.) আবদুল মান্নান ছিলেন ১৯৯১-১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের প্রতিমন্ত্রী। তিনিই ২০০৪ সালের ১০ মার্চ দল থেকে পদত্যাগ করে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে যোগ দিলে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তার অফিস তছনছ করে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন করা হয়। রাজশাহীতে ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থানের বিরুদ্ধে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে বক্তব্য দিলে বিএনপির আরেক সংসদ সদস্য আবু হেনার সঙ্গে একই ধরনের আচরণ করা হয়। সেই ইসলামী জঙ্গিরা স্থানীয় একজন মন্ত্রীর আস্থাভাজন ছিলেন। মন্ত্রীর গুণ্ডারা আবু হেনাকে হুমকি দিয়ে আতঙ্কিত করে তোলেন এবং ছয় মাস তিনি প্রবল নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে সময় কাটান। বিএনপির আরেকজন সংসদ সদস্য ও স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য কর্নেল (অব.) অলি আহমদ দল ছেড়ে নতুন দল গঠনের ঘোষণা দিলে দলের কয়েকজন নেতা তার সঙ্গে শরিক হওয়ার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তাদের প্রত্যেকের বাড়িঘরে বিএনপির ক্যাডাররা হামলা চালায়। এসব ঘটনাক্রমে উভয় বড় রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রহীনতার প্রতিচ্ছবিই প্রতিফলিত হয়েছে।'
একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী - উইকিপিডিয়া
__._,_.___