সহজিয়া কড়চা
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অন্তর্বীক্ষণ
বাংলাদেশের স্বাধিকার সংগ্রামের অনেকগুলো পর্যায়। তার শেষ অধ্যায়টি মুক্তিযুদ্ধ। কোনো যুদ্ধ দুই পক্ষের মধ্যে হয়। এক পক্ষ বিজয়ী হয়, আরেক পক্ষ পরাজিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। জনগণের মধ্যে যারা যেভাবে পারছে, যার যা আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দুটি দিক, একদিকে বর্বরতা, অন্যদিকে বীরত্ব। নিরপরাধ ও নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার ও বর্বরতা; অন্যদিকে সেই বাহিনীকে প্রতিহত করতে বাঙালির অসীম সাহসিকতা। সম্মুখ যুদ্ধে দুই পক্ষই হতাহত হলে আন্তর্জাতিক আইনে তাকে অপরাধ বলে না। কিন্তু কোনো পক্ষ যখন নিরস্ত্র মানুষের ওপর অত্যাচার করে এবং হতাহত করে, তখন তা মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য। একাত্তরে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা যে চরম মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ করেছে, তা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
যে পক্ষ অন্য পক্ষের কাছে নতজানু হয়ে পরাজয় স্বীকার করে, তার মান-মর্যাদা সেখানেই শেষ হয়ে যায়। বিজয়ী পক্ষের গৌরব ও দায়িত্ব বিরাট। বিজয় একটা বিশেষ মুহূর্তে আসে বটে, কিন্তু বিজয়কে অর্থবহ বা সংহত করার জন্য অনেকটা সময়ের প্রয়োজন। যুদ্ধকালীন মানুষ যে নিষ্ঠা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়ে কাজ করে, বিজয়ের পরও ততটাই ত্যাগ ও নিষ্ঠা থাকা দরকার বিজয়ের সাফল্য থেকে সুফল পাওয়ার জন্য। যদি তা না হয় তাহলে বিজয় অপূর্ণ থাকে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পৃথিবীর ন্যায়সংগত স্বাধীনতাসংগ্রামগুলোর একটি। যে কারণে ঢাকার রেসকোর্সে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের পর তিন মাসের মধ্যে ৫৪টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। স্বীকৃতি বাংলাদেশের প্রাপ্য ছিল বলেই দেয়, দয়াপরবশ হয়ে নয়। বস্তুত, সারা বছরই বিশেষভাবে মার্চ মাস-ডিসেম্বর মাস এলেই স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর নিয়ে অগণিত প্রতিবেদন ও লেখা প্রকাশিত হয় পত্রপত্রিকায়। রেডিও-টেলিভিশনেও সম্প্রচারিত হয় সমপরিমাণ। সবই স্মৃতিচারণামূলক। বাংলাদেশে একটা রেওয়াজ একবার চালু হলে তা থেকে বেরিয়ে আসার সাহস কেউ দেখাতে পারেন না। না পারার কারণ অপদস্থ হওয়ার ভয়।
একাত্তরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটির মতো। তাদের মধ্যে যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন, তাঁদের প্রায় তিন কোটি মানুষের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। সেই তিন কোটির দুই কোটি ইতিমধ্যে মারা গেছেন। এখনো কোটি খানেক মানুষের সেই ভয়াবহ দিনের স্মৃতি রয়েছে। আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে তাঁরাও প্রায় কেউই থাকবেন না। অর্থাৎ এক যুগ পরে স্মৃতি রোমন্থন করার মতো লোক আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তখন মিডিয়া কী করবে?
মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষ। ২৫ মার্চ ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের কয়েক শ সদস্য। কিন্তু ওই রাতে ও পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় গ্রেপ্তার হলেন শুধু বঙ্গবন্ধু এবং নিহত হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলসহ বিভিন্ন হলের ছাত্র-শিক্ষকেরা এবং হাজারো সাধারণ মানুষ। ২৭ মার্চ সকালে আমি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের অবস্থা স্বচক্ষে দেখেছি। প্রফেসর গোবিন্দ চন্দ্র দেব নিহত হলেন, রাজনীতির নাম-গন্ধও যাঁর মধ্যে ছিল না। এখনকার ছেলেমেয়েদের ধারণা হওয়া স্বাভাবিক, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিলেও ১৫-১৬ জন দেশপ্রেমিকের অবদানই সর্বোচ্চ, তাঁদের কয়েকজন নিহত হয়েছেন আর কয়েকজন এখনো জীবিত আছেন, জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি আদৌ তেমন নয়। জাতির জীবনের সব শহীদের মর্যাদা সমান, সব বীরের অভিন্ন মর্যাদা প্রাপ্য। এ ক্ষেত্রে বৈষম্য ও পক্ষপাতিত্ব গ্রহণযোগ্য নয়।
কিছু কিছু বিষয় আছে, যা বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গোপন রাখতে হয়। অনন্তকাল কোনো সত্য গোপন করা আত্মপ্রবঞ্চনা। তাই ২৫-৩০ বছর পর বিভিন্ন দেশ তার সরকারি কাগজপত্র ডিক্ল্যাসিফাইড বা অবমুক্ত করে। আমাদের প্রবাসী সরকারের নয় মাসের কাগজপত্র কোথায় গেল, তা কেউ জানে না। ওই সরকারের সংস্থাপন বিভাগে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, দেশে ফিরে আসার সময় যাবতীয় কাগজপত্রের একটা সুরাহা করার কথা তাঁদের। মুক্তিযুদ্ধের নির্ভুল ইতিহাস রচনার বহু উপাদান হারিয়ে গেছে। তারপরও যা আছে তার সদ্ব্যবহার করার পথেও বিচিত্র বাধা।
কোনো রাষ্ট্রের ইতিহাসে ৪৪ বছর দীর্ঘ সময়। ১০ বছরেই একটা রাষ্ট্র থিতু হতে পারে। সত্য যত অপ্রীতিকরই হোক, তা সহজে গ্রহণ করাই ভালো। দেশের স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক হয়ে গেল। একটি বড় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই সময় তৈরি হয়েছে। কিন্তু এত দিনে ওই মধ্যবিত্ত বিদ্বান জনগোষ্ঠীর যে পরিপক্বতা অর্জন প্রত্যাশিত ছিল, তা হয়নি। বরং নিম্নমানের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন এক শিক্ষিত মধ্য শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যারা কোনো ন্যায়নিষ্ঠা ও যুক্তির ধার ধারে না। ৪৪ বছরে একটা আলোচিত মধ্য শ্রেণি বিকশিত হতে পারত, যারা প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সতর্কতার সঙ্গে কথা বলবে।
দেশপ্রেম, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আজ একটি ছাঁচের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেই ছাঁচের বাইরে আর যা কিছু, তার সবই অগ্রহণযোগ্য। একটি নিকৃষ্ট মুৎসুদ্দি শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যারা ওই ছাঁচটির রক্ষণাবেক্ষণকারী। অপ্রীতিকর বিষয় ও সত্য বেরিয়ে পড়তে পারে—এই আশঙ্কায় সত্যান্বেষণ থেকে বিরত থাকা অথবা সত্যান্বেষণে বাধা দেওয়া অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমরা সেই অবস্থাতেই আছি।
অব্যাহতভাবে স্মৃতিরোমন্থন, নিজের বীরত্বগাথা এবং ৪৪ বছর আগের শত্রুকে অব্যাহত সমালোচনায় যদি কোনো দেশের উন্নতি হতো, তাহলে এত দিনে বাংলাদেশ আমেরিকা ও চীনকে ছাড়িয়ে যেত। অতীতকে একচুলও নড়াচড়া করা যাবে না, কিন্তু ইচ্ছা করলে ভবিষ্যৎকে প্রত্যাশামতো তৈরি করা সম্ভব। সে জন্য জাতির অনুভূতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তাচেতনাকে বারবার পরীক্ষা বা ঝালাই করতে হয়। সেই অন্তর্বীক্ষণের কাজটি করেন দেশের চিন্তাশীল মানুষেরা। তা করার জন্য তাঁদের দিতে হয় পূর্ণ স্বাধীনতা ও সুযোগ। কোনো বিষয়কে ডায়ালেকটিক্যালি বা দ্বান্দ্বিকভাবে বিচার করতে গেলে সবাইকে কার্ল মার্ক্স বা হেগেলের মতো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী হওয়ার দরকার নেই। কোনো বস্তু বা বিষয়কে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিক থেকে বিচার করলে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব। একটি জনগোষ্ঠীর স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষমতাকে বিনষ্ট করে দেওয়া মানুষকে খোজা ও বন্ধ্যা করে দেওয়ার শামিল।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা নেতৃত্বের পর্যায়ে ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এখনো সক্রিয় রাজনীতিতে আছেন। নতুন প্রজন্মের নেতারাই এখন রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্রিয়। তাঁরা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের দেখেননি। একটি যুদ্ধের পর কীভাবে তাঁরা এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন এবং স্থিতিশীলতা আনেন, সে সম্পর্কে নবযুগের দেশহিতৈষী রাজনীতিকদের কোনো ধারণা নেই। তা যে নেই তা প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা আমরা দেখতে পাই। শুধু সন্ধ্যাবেলা নয়, দিনদুপুরে রাস্তাঘাটেও তার প্রমাণ পাই।
কয়েক দিন আগে যানজটে রাস্তায় আটকা পড়েছিলাম। গাড়িতে বসে শুনতে পেলাম মানববন্ধনের সমাবেশ থেকে এক অতি পণ্ডিত তাঁর শ্রোতাদের জ্ঞান দান করে বলছেন: পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করাই ভুল ছিল। শুধু এটুকুই নয়, তিনি তাঁর ভাষণে যোগ করেন: বন্ধুরাষ্ট্র ভারতকে অখুশি করে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক করার প্রয়োজন ছিল না।
বাংলাদেশে কোনো কোনো প্রসঙ্গে বাক্স্বাধীনতা সর্বোচ্চ, কোনো কোনো ব্যাপারে ভাব প্রকাশে কাটছাঁট চাই, কোনো কোনো প্রশ্নে মত প্রকাশে ঘোরতর আপত্তি। উল্লিখিত বক্তা যে বক্তব্য দিলেন তা দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অজ্ঞতাপ্রসূত। শুধু তা-ই নয়, বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনীতির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ। তিনি বৈদেশিক নীতিতে যথেষ্ট দূরদর্শিতা ও সতর্কতার পরিচয় দেন। ১৯৭৪-এর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক যখন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়, সেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে স্বাগত জানান। তিনি বলেছিলেন, আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে, এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সন্তোষের বিষয়। আমরা সব সময় অনুভব করেছি, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের এবং উপমহাদেশে শান্তি ও সহযোগিতার জন্য এটি একটি অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপ হবে।
শুধু মিসেস গান্ধী নন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীও স্বাগত জানিয়েছিলেন। এবং দুই দেশের সম্পর্ক স্থাপনের দিনই ইরান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তুরস্ক ঘোষণা করে তারাও স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখপাত্র বলেন, সমগ্র বিশ্বই ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক স্থাপনকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। এসব বঙ্গবন্ধু সরকারের চাট্টিখানি সাফল্য ছিল না। আমরা এসব কাছে থেকে দেখেছি বলে রাজপথে বক্তাদের ভাষণ কানে লাগে।
আজ একটি শ্রেণি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো এবং ডেকচিতে তেহারি রান্নার মাধ্যমে তঁার আদর্শ বাস্তবায়ন করতে চায়। ৭ মার্চ ছাড়াও জীবনে তিনি আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন। সেসবের কেউ চর্চা করছে না। ১৯৭২-এ ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি বলেছিলেন: 'বাংলাদেশে মানুষে মানুষে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদে বণ্টন-ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে।'
সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির এক-তৃতীয়াংশ ইংরেজিতে অনুবাদের দায়িত্ব বর্তেছিল আমার মতো অক্ষমের ওপর। তাই সেই দিনটি চোখে ভাসছে। সেদিন তিনি বলেছিলেন: 'পারিবারিক ও ব্যক্তিমালিকানার পরিধি কমিয়ে এনে পরিবারপিছু জমি ১০০ বিঘায় আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই উচ্চসীমা আরও কমিয়ে আনা যায় কি না সেটা বিবেচনা করে দেখা হবে।' তাঁর দলের নেতারাই কি তাঁর সেই নীতি-আদর্শ ধরে রাখতে পেরেছেন?
৪৪ বছর পার করেছি। এখন আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা ও অন্তর্বীক্ষণ প্রয়োজন। রাষ্ট্র যদি স্পিরিচুয়ালি—আত্মিক দিক থেকে অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে, ম্যাটেরিয়াল বা বৈষয়িক দিক থেকে তার যত চাকচিক্যই আসুক, তার মূল্য কম। সমাজ যদি আত্মিক দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে পড়ে, কোনো ভাবাবেগ দিয়েই সে শূন্যতা পূরণ হয় না।
যে পক্ষ অন্য পক্ষের কাছে নতজানু হয়ে পরাজয় স্বীকার করে, তার মান-মর্যাদা সেখানেই শেষ হয়ে যায়। বিজয়ী পক্ষের গৌরব ও দায়িত্ব বিরাট। বিজয় একটা বিশেষ মুহূর্তে আসে বটে, কিন্তু বিজয়কে অর্থবহ বা সংহত করার জন্য অনেকটা সময়ের প্রয়োজন। যুদ্ধকালীন মানুষ যে নিষ্ঠা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়ে কাজ করে, বিজয়ের পরও ততটাই ত্যাগ ও নিষ্ঠা থাকা দরকার বিজয়ের সাফল্য থেকে সুফল পাওয়ার জন্য। যদি তা না হয় তাহলে বিজয় অপূর্ণ থাকে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পৃথিবীর ন্যায়সংগত স্বাধীনতাসংগ্রামগুলোর একটি। যে কারণে ঢাকার রেসকোর্সে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের পর তিন মাসের মধ্যে ৫৪টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। স্বীকৃতি বাংলাদেশের প্রাপ্য ছিল বলেই দেয়, দয়াপরবশ হয়ে নয়। বস্তুত, সারা বছরই বিশেষভাবে মার্চ মাস-ডিসেম্বর মাস এলেই স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর নিয়ে অগণিত প্রতিবেদন ও লেখা প্রকাশিত হয় পত্রপত্রিকায়। রেডিও-টেলিভিশনেও সম্প্রচারিত হয় সমপরিমাণ। সবই স্মৃতিচারণামূলক। বাংলাদেশে একটা রেওয়াজ একবার চালু হলে তা থেকে বেরিয়ে আসার সাহস কেউ দেখাতে পারেন না। না পারার কারণ অপদস্থ হওয়ার ভয়।
একাত্তরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটির মতো। তাদের মধ্যে যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন, তাঁদের প্রায় তিন কোটি মানুষের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। সেই তিন কোটির দুই কোটি ইতিমধ্যে মারা গেছেন। এখনো কোটি খানেক মানুষের সেই ভয়াবহ দিনের স্মৃতি রয়েছে। আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে তাঁরাও প্রায় কেউই থাকবেন না। অর্থাৎ এক যুগ পরে স্মৃতি রোমন্থন করার মতো লোক আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তখন মিডিয়া কী করবে?
মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষ। ২৫ মার্চ ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের কয়েক শ সদস্য। কিন্তু ওই রাতে ও পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায় গ্রেপ্তার হলেন শুধু বঙ্গবন্ধু এবং নিহত হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলসহ বিভিন্ন হলের ছাত্র-শিক্ষকেরা এবং হাজারো সাধারণ মানুষ। ২৭ মার্চ সকালে আমি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের অবস্থা স্বচক্ষে দেখেছি। প্রফেসর গোবিন্দ চন্দ্র দেব নিহত হলেন, রাজনীতির নাম-গন্ধও যাঁর মধ্যে ছিল না। এখনকার ছেলেমেয়েদের ধারণা হওয়া স্বাভাবিক, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিলেও ১৫-১৬ জন দেশপ্রেমিকের অবদানই সর্বোচ্চ, তাঁদের কয়েকজন নিহত হয়েছেন আর কয়েকজন এখনো জীবিত আছেন, জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি আদৌ তেমন নয়। জাতির জীবনের সব শহীদের মর্যাদা সমান, সব বীরের অভিন্ন মর্যাদা প্রাপ্য। এ ক্ষেত্রে বৈষম্য ও পক্ষপাতিত্ব গ্রহণযোগ্য নয়।
কিছু কিছু বিষয় আছে, যা বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গোপন রাখতে হয়। অনন্তকাল কোনো সত্য গোপন করা আত্মপ্রবঞ্চনা। তাই ২৫-৩০ বছর পর বিভিন্ন দেশ তার সরকারি কাগজপত্র ডিক্ল্যাসিফাইড বা অবমুক্ত করে। আমাদের প্রবাসী সরকারের নয় মাসের কাগজপত্র কোথায় গেল, তা কেউ জানে না। ওই সরকারের সংস্থাপন বিভাগে যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, দেশে ফিরে আসার সময় যাবতীয় কাগজপত্রের একটা সুরাহা করার কথা তাঁদের। মুক্তিযুদ্ধের নির্ভুল ইতিহাস রচনার বহু উপাদান হারিয়ে গেছে। তারপরও যা আছে তার সদ্ব্যবহার করার পথেও বিচিত্র বাধা।
কোনো রাষ্ট্রের ইতিহাসে ৪৪ বছর দীর্ঘ সময়। ১০ বছরেই একটা রাষ্ট্র থিতু হতে পারে। সত্য যত অপ্রীতিকরই হোক, তা সহজে গ্রহণ করাই ভালো। দেশের স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক হয়ে গেল। একটি বড় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই সময় তৈরি হয়েছে। কিন্তু এত দিনে ওই মধ্যবিত্ত বিদ্বান জনগোষ্ঠীর যে পরিপক্বতা অর্জন প্রত্যাশিত ছিল, তা হয়নি। বরং নিম্নমানের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন এক শিক্ষিত মধ্য শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যারা কোনো ন্যায়নিষ্ঠা ও যুক্তির ধার ধারে না। ৪৪ বছরে একটা আলোচিত মধ্য শ্রেণি বিকশিত হতে পারত, যারা প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সতর্কতার সঙ্গে কথা বলবে।
দেশপ্রেম, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ আজ একটি ছাঁচের ভেতর ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেই ছাঁচের বাইরে আর যা কিছু, তার সবই অগ্রহণযোগ্য। একটি নিকৃষ্ট মুৎসুদ্দি শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যারা ওই ছাঁচটির রক্ষণাবেক্ষণকারী। অপ্রীতিকর বিষয় ও সত্য বেরিয়ে পড়তে পারে—এই আশঙ্কায় সত্যান্বেষণ থেকে বিরত থাকা অথবা সত্যান্বেষণে বাধা দেওয়া অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমরা সেই অবস্থাতেই আছি।
অব্যাহতভাবে স্মৃতিরোমন্থন, নিজের বীরত্বগাথা এবং ৪৪ বছর আগের শত্রুকে অব্যাহত সমালোচনায় যদি কোনো দেশের উন্নতি হতো, তাহলে এত দিনে বাংলাদেশ আমেরিকা ও চীনকে ছাড়িয়ে যেত। অতীতকে একচুলও নড়াচড়া করা যাবে না, কিন্তু ইচ্ছা করলে ভবিষ্যৎকে প্রত্যাশামতো তৈরি করা সম্ভব। সে জন্য জাতির অনুভূতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তাচেতনাকে বারবার পরীক্ষা বা ঝালাই করতে হয়। সেই অন্তর্বীক্ষণের কাজটি করেন দেশের চিন্তাশীল মানুষেরা। তা করার জন্য তাঁদের দিতে হয় পূর্ণ স্বাধীনতা ও সুযোগ। কোনো বিষয়কে ডায়ালেকটিক্যালি বা দ্বান্দ্বিকভাবে বিচার করতে গেলে সবাইকে কার্ল মার্ক্স বা হেগেলের মতো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী হওয়ার দরকার নেই। কোনো বস্তু বা বিষয়কে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিক থেকে বিচার করলে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব। একটি জনগোষ্ঠীর স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষমতাকে বিনষ্ট করে দেওয়া মানুষকে খোজা ও বন্ধ্যা করে দেওয়ার শামিল।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা নেতৃত্বের পর্যায়ে ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এখনো সক্রিয় রাজনীতিতে আছেন। নতুন প্রজন্মের নেতারাই এখন রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্রিয়। তাঁরা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের দেখেননি। একটি যুদ্ধের পর কীভাবে তাঁরা এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন এবং স্থিতিশীলতা আনেন, সে সম্পর্কে নবযুগের দেশহিতৈষী রাজনীতিকদের কোনো ধারণা নেই। তা যে নেই তা প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা আমরা দেখতে পাই। শুধু সন্ধ্যাবেলা নয়, দিনদুপুরে রাস্তাঘাটেও তার প্রমাণ পাই।
কয়েক দিন আগে যানজটে রাস্তায় আটকা পড়েছিলাম। গাড়িতে বসে শুনতে পেলাম মানববন্ধনের সমাবেশ থেকে এক অতি পণ্ডিত তাঁর শ্রোতাদের জ্ঞান দান করে বলছেন: পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করাই ভুল ছিল। শুধু এটুকুই নয়, তিনি তাঁর ভাষণে যোগ করেন: বন্ধুরাষ্ট্র ভারতকে অখুশি করে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক করার প্রয়োজন ছিল না।
বাংলাদেশে কোনো কোনো প্রসঙ্গে বাক্স্বাধীনতা সর্বোচ্চ, কোনো কোনো ব্যাপারে ভাব প্রকাশে কাটছাঁট চাই, কোনো কোনো প্রশ্নে মত প্রকাশে ঘোরতর আপত্তি। উল্লিখিত বক্তা যে বক্তব্য দিলেন তা দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অজ্ঞতাপ্রসূত। শুধু তা-ই নয়, বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনীতির প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ। তিনি বৈদেশিক নীতিতে যথেষ্ট দূরদর্শিতা ও সতর্কতার পরিচয় দেন। ১৯৭৪-এর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক যখন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়, সেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে স্বাগত জানান। তিনি বলেছিলেন, আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে, এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সন্তোষের বিষয়। আমরা সব সময় অনুভব করেছি, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের এবং উপমহাদেশে শান্তি ও সহযোগিতার জন্য এটি একটি অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপ হবে।
শুধু মিসেস গান্ধী নন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীও স্বাগত জানিয়েছিলেন। এবং দুই দেশের সম্পর্ক স্থাপনের দিনই ইরান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তুরস্ক ঘোষণা করে তারাও স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখপাত্র বলেন, সমগ্র বিশ্বই ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক স্থাপনকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। এসব বঙ্গবন্ধু সরকারের চাট্টিখানি সাফল্য ছিল না। আমরা এসব কাছে থেকে দেখেছি বলে রাজপথে বক্তাদের ভাষণ কানে লাগে।
আজ একটি শ্রেণি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো এবং ডেকচিতে তেহারি রান্নার মাধ্যমে তঁার আদর্শ বাস্তবায়ন করতে চায়। ৭ মার্চ ছাড়াও জীবনে তিনি আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন। সেসবের কেউ চর্চা করছে না। ১৯৭২-এ ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি বলেছিলেন: 'বাংলাদেশে মানুষে মানুষে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদে বণ্টন-ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে।'
সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির এক-তৃতীয়াংশ ইংরেজিতে অনুবাদের দায়িত্ব বর্তেছিল আমার মতো অক্ষমের ওপর। তাই সেই দিনটি চোখে ভাসছে। সেদিন তিনি বলেছিলেন: 'পারিবারিক ও ব্যক্তিমালিকানার পরিধি কমিয়ে এনে পরিবারপিছু জমি ১০০ বিঘায় আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই উচ্চসীমা আরও কমিয়ে আনা যায় কি না সেটা বিবেচনা করে দেখা হবে।' তাঁর দলের নেতারাই কি তাঁর সেই নীতি-আদর্শ ধরে রাখতে পেরেছেন?
৪৪ বছর পার করেছি। এখন আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা ও অন্তর্বীক্ষণ প্রয়োজন। রাষ্ট্র যদি স্পিরিচুয়ালি—আত্মিক দিক থেকে অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে, ম্যাটেরিয়াল বা বৈষয়িক দিক থেকে তার যত চাকচিক্যই আসুক, তার মূল্য কম। সমাজ যদি আত্মিক দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে পড়ে, কোনো ভাবাবেগ দিয়েই সে শূন্যতা পূরণ হয় না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷সৈয়দ আবুল মকসুদ | আপডেট: ০০:৩০, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫ | প্রিন্ট সংস্করণ
যুদ্ধাপরাধের বিচার
ভারতকে মুচলেকা দিয়েছিল পাকিস্তান!
মিজানুর রহমান খান | আপডেট: ০০:২৭, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৫ | প্রিন্ট সংস্করণ
__._,_.___